বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

চন্দ্রবিন্দু

চন্দ্রবিন্দু

দীপক বড়ুয়া, ০৩ ডিসেম্বর, এবিনিউজ : ঠিক দুপুরে বিন্দু বেরিয়ে পড়ে।

ছোট ছেলে আদিত্য তার ঘরে মোবাইলে গেম খেলছে। বউ গেছে বাবার বাড়ি।

বিন্দুর স্বামী প্রার্থনারুমে কবিতা লিখছে তখন। কাউকে না বলে বিন্দু চলে যায়। আদিত্য ভাবে। সত্যি ভালো হয়নি মার সাথে ওভাবে কথা বলে। একটি পরিবারে কতো কাজ। একটি প্রতিষ্ঠানের মতোই।

সকাল হতেই পরিবারের কাজ শুরু। কাঁচা বাজার, তরকারী, মাছ, চাল, ডাল, মসলা। কি আছে কি নেই, খোঁজ নেয়া। আবার পরিবারের নিজের আলাদা চাহিদা। তারও খোঁজ রাখা। কেউ এটা খায়, ওটা খায় না। ভিন্ন ব্যবস্থা, আয়োজন। সপ্তাহে বাজারের টাকা দেয় আদিত্য।

ঐ টাকায় সংসার সামাজিকতা নিজের চাওয়া পাওয়ার সব পূরণ করা। সত্যি অনেক কষ্টের। মাঝে মাঝে বাবাও চায়। দিয়ে হয়। কাজে অবসর। আদিত্য বাবাকে বলে, বাবা, আমি সত্যি অন্যায় করেছি।

– কি করেছ তুমি? বাবার ছোট্ট প্রশ্ন।

– আপনার নাতনিরা মামার বাড়ি থাকলে খুব সুস্থ থাকে।

– ওটা আবার কি কথা? এখানে কি অনাদরে থাকে ওরা? কাজের লোক আছে।

– বাবা তা নয়। এখানে আমি, আপনি, মা সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত থাকি। নাতনিরা খেলার সাথী পায় না। একা। ওখানে তো পাশের ফ্ল্যাটে যায়। সবার সাথে খেলে। ছাদে যেতে পারে। ছুটতে পারে।

– সেটা তুমি ঠিক বলেছ। শিশুরা খেলার সাথী চায়। খেলতে পছন্দ করে। যা হউক মাকে ফোন করো। রাগ করে গেছে, তাই।

– আপনি করেন।

– ঘটনাটা তোমার সাথে ঘটেছে। আমার ফোনে লাভ নেই।

ঠিক বিকেলে বিন্দুর স্বামী ফোন করে।

ঐ প্রান্তে ফোন ধরে বিন্দুর ছোট বোন।

– তোমার বড়দি আছে।

– হ্যাঁ আছে।

– ওকে ফোনটা দেবে?

– বড়দি কথা বলবেন না। রেগে আছে। আমাকে বলুন।

– আজ চলে আসবে?

বিন্দুর কণ্ঠ শোনা যায়,- ক’দিন থাকবো।

ফোন সুইচ অফ করে দেয়।

বিকেলে হৈ চৈ নেই। কাজের তাড়া নেই। প্রিয়া, শান্তা চুপচুপ। আদিত্য বেরিয়ে পড়ে। আদিত্যের বাবা তাঁর রুমে একা। বেরুয়নি।

পরিবারের রানি যদি ঘরে না থাকে। ঘর স্তব্ধ হয়ে যায়। সুখ শান্তি হাঁটাহাঁটি করে না। যাবার আগে বিন্দু পরিবারের প্রয়োজনীয় সবকিছু আনিয়ে রাখে। এতো বড়ো বাড়িটা এক্কেবারে ফাঁকা। ঘরের লক্ষ্মী না থাকলে এরকমই হয়।

বিন্দু থাকলে কতো কথা হয়। চা’র টেবিলে বসে তর্ক হয়। মিয়ানমারের কথা হয়। বর্মি সেনাদের ভয়াবহ অত্যাচারের কথা বলাবলি হয়। বিন্দুর জন্ম বার্মায়। বার্মায় অনেক মন্দির আছে। কিন্তু বেশ কিছুদিনের অত্যাচারে বার্মার উপরে রেগে আছে ভীষণ। ঘেন্যা করতে শুরু করেছে। চায়ের টেবিলে বসে বিন্দু বলে, শোনো, কি আশ্চর্য মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা নিপীড়নে নীরবতার জন্য সমালোচিত নেত্রী অংসান সু চি বলে কিনা। বিষয়টি নিয়ে তিনি মোটেও নীরব নন। সমস্ত সম্মাননা কেড়ে নেয়ার পরও হুস হয় না মেয়েটির। এই অত্যাচার কিছুতেই সইবে কি?

বিন্দুর স্বামী বলে, দেখো বিন্দু। ঐ মেয়েটি নিজেকে যত মহান মনে করে সত্যি তা নয়। কারণ সু চি জীবন এবং জগৎ সম্পর্কে মৌল প্রশ্ন এবং তার সমাধান, অর্থাৎ পৃথিবীর মানুষের আশা আকঙ্খা– বেঁচে থাকার সত্ত্বা বা পরম সত্য কি? এই ধরণের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নিয়ে এখনো চিন্তা করেননি। তাই মিয়ানমার এই পরিস্থিতি। মেয়েটা ভীষণ বোকা। মানুষকে ভালোবাসে না।

– তাহলে কি এভাবেই চলতে থাকবে। প্রতিদিন বার্মার থেকে লোক আসবে বাংলাদেশে। আমাদের দেশে কি হবে। ভাবছে ওরা। ওরা কি মানুষ? না অন্য কিছু।

– ওরা আজও। বুদ্ধের দর্শন জানে না। বুদ্ধ বলেছেন– পৃথিবীতে আমরা যা দেখছি, করছি, হচ্ছি সব কিছুই পরিবর্তনশীল ও ধ্বংসশীল। এক কথায় সর্বং অনিত্যম। অর্থাৎ সবকিছু অনিত্য। কোনকিছু চিরদিনের জন্য নয়।

– তার মানে?

– মানে বুঝার চেষ্টা করো বিন্দু– জগতের কোনো ঘটনাই স্বয়ং সংঘটিত নয়। প্রতিটি বস্তু বা ঘটনা কার্য– কারণ শৃঙ্খলাবদ্ধ। বৌদ্ধদর্শনে এই মতবাদকে বলা হয়– প্রতিত্যসমুৎপাদ।

– ওসব যুক্তি কথা আমি বুঝি না। আমি বুঝি, আমরা মানুষ। সবাই সুখ চাই, শান্তি চাই।

ঘর সুনসান স্তব্ধ।

বিন্দু নেই, কিছু নেই।

খবর পায় সবাই। কেউ বাসায় আসে না। খোঁজে না।

সত্যি কথা বলে বিন্দু।

মাঝে মাঝে স্বামীকে বলে। দেখো, আমি থাকবো না। এবাড়িতে কেউ আসবে না। আমার জন্যেই আসে। সামাজিকতা খুব সহজ নয়। জানো?

– সামাজিকতা করে লাভটা কী? সমাজ বিপদে কাউকে সাহার্য্য করে? স্বামীও উত্তর দেয়।

বিন্দুও থামে না। উচ্ছস্বরে বলে, মন আতমা জানো কি?

– হ্যাঁ, ভাবি অনুভব করি।

ঐ ভাবনাটাই অনুভূতি ও কর্মকে ধরে রাখে। সামাজিক না হলে মৃত্যুর পরে কেউ মৃতমুখ দর্শনেও আসবে না। তাতে জন্মের সার্থকতা নেই। বিন্দুর স্বামী কোনদিনও তর্কে পারেনি। আজও পারলো না।

সন্ধ্যায় আবারও ফোন করে বিন্দুর স্বামী।

ফোনের সুইচ অফ। তখনও খুব ক্ষেপে আছে বিন্দু।

ঐ একটি কারণে বিন্দুর স্বামী ঘর থেকে বের হয়নি।

বিন্দু ঘরে নেই। সবকিছু থির দাঁড়িয়ে।

অতিথি আসে। জিজ্ঞেস করে বিন্দু আছে?

না শুনে কে ঘরে ঢুকে না।

অদ্ভুত।

রাত বাড়ে।

আবারও ফোন করে বিন্দুর স্বামী। সুইচ অফ।

বিন্দুর স্বামী চন্দ্র। বড্ডো একা। বৌমা থাকলে থাকে বৌমার রুমে।

ছেলের অফিস ফেরে আলাদা রুমে। বিন্দু রান্নায়, না হয় বাইরে, ঘরের কাজে। যখন থাকে, পাশাপাশি বসে অনেক কথা হয়।

মানুষের কথা, ধর্মের কথা। স্বজনের ভালোমন্দের কথা।

একদিন চন্দ্র প্রশ্ন করে, বুদ্ধ নামটির তত্ত্বগত অর্থ কি জানো?

– না বিন্দু বলে।

– বুদ্ধের অর্থ হলো– আলোক প্রাপ্ত’। কি সম্পর্কে আলোকপ্রাপ্ত জানো?

– পরম সত্য সম্পর্কে। অর্থাৎ পরম সত্যের সন্ধান যিনি পেয়েছেন তিনিই বুদ্ধ। বুদ্ধ যে সত্য আবিষ্কার করেছেন, সে সত্য ইতিপূর্বে কেউ আবিষ্কার করেননি। তবে তিনি আরো বলেছেন, তাঁর আবিষ্কৃত সত্যই একমাত্র সত্য নয়। বুদ্ধ নিজেই বলেছেন, পৃথিবীতে রাশিরাশি সত্য আছে, তিনি দু’একটির সন্ধান পেয়েছেন মাত্র। তাঁর আবিষ্কৃত সত্য বিশ্বাসের মাধ্যমে বুঝা সম্ভব নয়। বুঝতে হতে যুক্তির মাধ্যমে। তাঁর আবিষ্কৃত সত্য হলো দু:খমুক্তি। মূলনীতি হলো মধ্য পথ। চারটি আর্যসত্য এবং অষ্টাদিক মার্গ।

– তোমার এই তাত্ত্বিক কথার কিছুই বুঝিনা আমি। রাখো।

রাত গভীর হয়।

আদিত্য, চন্দ্র খেতে বসে। বিন্দু থাকলে

খাওয়ার টেবিলে আলোচনায় ভর্তি থাকে। আজ বিন্দু নেই। চুপচাপ।

ভাত কেউ খেতে পারে না। শুধু মাত্র বসা।

খাওয়া শেষে আদিত্য আদিত্যের ঘরে, চন্দ্র তাঁর ঘরে চলে যায়।

টিভিও বন্ধ। ঘড়ির কাঁটা প্রতিদিনের মত বারটায় পা রাখে।

চন্দ্র শুয়ে পড়ে। পাশে বিন্দু নেই।

অনাদরে বিছানায় শোয়। ভাবে।

মনে পড়ে কাল সকালে বৌমারা আসবে। নাতনিরা আসবে। কি আনন্দ।

নির্জনতা পালিয়ে যাবে। জীবনের

সত্যি নির্জনতা পালাবে না। যতক্ষণ না বিন্দু আসে চন্দ্রের ঘরে।

বিন্দু আসবে। আজ, কাল, পরশু। একমাত্র

সেই প্রতীক্ষায় চন্দ্র আছে।

(সংগৃহীত)

এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত