শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২
logo
জেবা ইসলাম সেরাজ

সবুজের সারথি

সবুজের সারথি

ঢাকা, ০৪ ডিসেম্বর, এবিনিউজ : বাবা-মা দুজনই শিক্ষক। বাড়িতে পড়াশোনা, ছাত্রছাত্রীদের আনাগোনা, পাঠচক্র; মোটকথা পড়াশোনাকেন্দ্রিক পরিবেশ সবসময়ই ছিল। তাই সেই ছেলেবেলা থেকে বই পড়ার প্রতি অগাধ আগ্রহ জন্মে জেবা ইসলাম সেরাজের মধ্যে। এখনো বিজ্ঞানের নতুন নতুন বই পেলে মুখ ডুবিয়ে পড়তে বসে যান। মা, বাবার পেশা প্রবলভাবে আকর্ষণ করত তাকেও। তাই তো ছোটবেলায়ই ভেবে রেখেছিলেন নিজেকে কোন অবস্থানে দেখতে চান। সে যা-ই হোক না কেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। এখানেই থেমে যাননি। গ্লাসগো ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। পরবর্তী সময়ে লিভারপুল ইউনিভার্সিটি থেকে পোস্ট ডক্টরেট ডিগ্রিও লাভ করেন। জেবা ইসলাম সেরাজ গবেষণাকাজে যুক্ত রয়েছেন অনেক বছর ধরেই। তার গবেষণাধর্মী কাজের মধ্যে অন্যতম লবণ সহনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন। আইসিজিইবি, নয়াদিল্লির সঙ্গে যৌথ গবেষণায় মটরশুঁটির হেলিকেস জিন ধানের জিনোমে যুক্ত করে নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন করেছেন তিনি। নতুন এ জাতের ধানে লবণ সহনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তার এ উদ্ভাবন দেশের কৃষি খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। তিনি একটি দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তা হুবহু তুলে ধরা হলো-

আপনার ছেলেবেলা, বেড়ে ওঠা, শৈশবের গল্পগুলো শুনতে চাই...

আমার বাবা ড. আহমদ শামসুল ইসলাম ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। তার অপরাহ্নগুলো কাটত স্নাতকোত্তর ছাত্রদের নিয়ে। মাঝে মধ্যে তার গুণমুগ্ধ কিছু ছাত্র থেকে যেতেন এবং আমদের সঙ্গে রাতের খাবার খেতেন। ছাত্রদেরকে সময় দেয়ার পাশাপাশি তিনি বহিঃপরীক্ষক হিসেবে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। অন্যদিকে আমার মা হুমায়রা ইসলাম পেশায় একজন শিক্ষক হলেও আমাদের পড়শোনা এবং নিত্যনৈমিত্তিক প্রতিটি প্রয়োজনে খেয়াল রাখতেন। আমাদের বাসার পরিবেশ বই পড়ার উপযোগী ছিল, উপরন্তু বই পড়ার প্রতি ছিল আমার অগাধ ভালোবাসা। আমার মা কখনই আমার পছন্দের বইগুলো কেনার ব্যাপারে অনাগ্রহ দেখাতেন না। এছাড়া শৈশবে খেলাধুলা করতে পছন্দ করতাম। বাড়িতে যেমন সাতপাথর, এক্কা দোক্কা খেলতাম; তেমনি স্কুলের মাঠে বাস্কেটবল, নেটবল ও বেসবল খেলায় অংশ নিতাম। সে সময় বাড়ি অথবা স্কুলে পর্যাপ্ত খালি জায়গা থাকত। তাই আমরা খুব সহজে এবং স্বাচ্ছন্দ্যে খেলাধুলা করতে পারতাম। আজ আমি একজন সফল শিক্ষক ও গবেষক। এ সফলতার পেছনে আমার পরিবারের অবদান অপরিসীম ।

যাদের অনুপ্রেরণায় আজকের এ অবস্থানে...

আমার বাবা আমার আদর্শ। সবসময়ই আমার বাবার মতো হতে চেয়েছিলাম। আমার মা আমাকে আলোর সে পথ দেখিয়েছিলেন, যে পথে চললে বাবার আদর্শ ধারণ করে একজন বড় মাপের বিজ্ঞানী এবং শিক্ষক, সর্বোপরি ভালো মানুষ হওয়া যায়। শুধু তা-ই নয়, জীবনের প্রতিটি লক্ষ্য কীভাবে আনন্দের সঙ্গে অর্জন করা যায়, সেটি আমার মায়ের কাছ থেকেই শেখা। পরবর্তী জীবনে বিজ্ঞানের প্রতি আমার ভালোবাসা দেখে মা-বাবা দুজনই আমাকে বিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য অনুপ্রেরণা দেন। অবশ্য প্রতিনিয়ত এখনো আমি বিজ্ঞান দ্বারা উদ্বুদ্ধ হই। বিশেষ করে জীববিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানভিত্তিক ম্যাগাজিনগুলো পড়তে খুবই পছন্দ করি। কারণ সেখানে বিজ্ঞানের নতুন নতুন উদ্ভাবন সৃজনশীলভাবে চিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়। সৌভাগ্যবশত এমন একটি পরিবারে আমার বিয়ে হয়েছে, যেখানে আমার বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারাকে পুরোপুরি সম্মান ও সমর্থন করা হয়। তাদের সমর্থন এবং আমার স্বামীর সহযোগিতায় রাতে দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণাগারে কাজ করে সফলভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগার গড়ে তুলতে পেরেছি। এছাড়া প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞানের নিত্যনতুন অগ্রগতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের সমানভাবে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছি।

দেশের প্রথম সারির বিজ্ঞানীর খেতাব আপনার ঝুলিতে, এমন অর্জনের পেছনে মূলমন্ত্র কী ছিল?

আমি মনে করি, আমার সফলতার মূলমন্ত্র হলো কঠোর পরিশ্রম, কাজের প্রতি গভীর মনোযোগ এবং গবেষণালব্ধ কোনো ফলাফলকে সঠিক বলে দাবি করার আগে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সেটার পুনরাবৃত্তি। আমি সবসময় নতুন কিছু জানার ব্যাপারে আগ্রহী। এ বয়সেও আমার ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে নতুন অনেক কিছু শিখছি। আমি বিশ্বাস করি, আদান-প্রদানের মাধ্যমে জ্ঞানের গভীরতা বাড়ে। আমার সম্ভাবনাময় ছাত্রছাত্রীদের মেধার প্রতি সম্মানপূর্বক যত্নশীল আমি।

এ দেশের প্রেক্ষাপটে একজন নারী বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করছেন। এ কাজ কতটা চ্যালেঞ্জিং?

নারী হিসেবেই না, সবার জন্যই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পথটি চ্যালেঞ্জিং। আমার এ দীর্ঘ গবেষণা যাত্রা সহজ ছিল না। মাঝে মধ্যে মনে হতো গবেষণা করা আসলে প্রাচীরে মাথা ঠোকার সমান। তবু থেমে যাইনি। নিজের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস আর অধ্যবসায় সফলতার চাবিকাঠি বলেই মনে হয়।

উপকূলীয় অঞ্চলে যাতে লবণ সহনশীলতা ধান উত্পাদন করা যায়, এমন জাত উদ্ভাবন করেছেন। ধানচাষীরা কতটা উপকৃত হচ্ছেন বলে মনে হয়?

আমার পক্ষে প্রত্যক্ষভাবে কৃষকদের সঙ্গে কাজ করা সম্ভব নয়। তবে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং আরো কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায়। আমাদের দেশের কৃষকদের সমস্যা সবসময় অবগত থাকার চেষ্টা করি এবং সে অনুযায়ী গবেষণার লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করি।

নতুন কোনো উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করছেন কি?

আমাদের গবেষণাগারে ডিএনএ মার্কারগুলোর সহযোগিতায় ধানের একটি জাত উত্পাদন হয়েছে, যা ঝধষঃড়ষ লাইন নামে পরিচিত এবং এরই মধ্যে এটি বিআরআরআই এবং এসিআই উভয় গবেষণাগারেই পরীক্ষিত হয়েছে। ধানের এ নতুন জাতটি মাঠপর্যায়ে আনার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। এছাড়া আরো একটি লবণ সহনশীলতা ধানের জাত বিআরআরআই গবেষণাগারে পরীক্ষিত হচ্ছে। উপরন্তু আমরা আমাদের আরো কিছু লবণ ও খরাসহনশীলতার পাশাপাশি উচ্চফলনশীল ট্রান্সজেনিক ধানের জাত নিয়ে গবেষণা করছি, যাতে শিগগিরই এগুলোকে কৃষকের সামনে উন্মোচন করতে পারি।

নারীরা এগিয়ে চলেছে। বিভিন্ন গবেষণাধর্মী কাজেও তাদের সরব উপস্থিতি। আপনার চোখে নারীরা বর্তমানে কতটা সফল?

প্রতিটা ক্ষেত্রেই নারীর সফল পদচারণা লক্ষ করার মতো। বিভিন্ন ক্ষেত্রেই তাদের জয়জয়কার। আমার চারপাশ তাকিয়েও যদি বলি, তাহলেও বলব নারীরা অগ্রসর হচ্ছে পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়েই। এখন পর্যন্ত আমার পাঁচজন পিএইচডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত ছাত্রছাত্রী, এদের তিনজনই নারী এবং তারা স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে তাদের সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ বলতে গেলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. লাইসা আহমদ লিসা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের গবেষক ড. রোকেয়া বেগমের কথা বলতেই হয়। সম্প্রতি আমার আরো দুজন পিএইচডি গবেষক তাদের গবেষণাপত্র জমা দিয়েছেন।

অন্য যেসব কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন, সে বিষয়ে যদি বলেন...

আমার বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধে ৬০টির বেশি প্রকাশনা রয়েছে। প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সেন্টার ফর বায়োইনফরমেটিক্স লার্নিং অ্যান্ড সিস্টেমেটিক্স ট্রেইনিংয়ের (সিব্লাস্ট) প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবেও কাজ করছি। সিব্লাস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বায়োইনফরমেটিক্স শেখার একটি অনলাইন শিক্ষা পোর্টাল। এছাড়া বায়োসেফটি বিশেষজ্ঞ কমিটির একজন গুরুত্বপর্ণ সদস্য এবং বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধের মূল্যায়নকারী ও সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছি। অন্যদিকে ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, অস্টিন, আমেরিকায় একজন সম্মানিত গবেষক হিসেবেও কাজ করে যাচ্ছি। (বণিক বার্তা)

এবিএন/সাদিক/জসিম/এসএ

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত