
ঢাকা, ০৭ ডিসেম্বর, এবিনিউজ :
আওয়ামী লীগ একটানা ৯ বছর ক্ষমতায়। এর মধ্যে শেষ চারটি বছর রাজনৈতিক অঙ্গন বলা যায় স্থিতিশীল রয়েছে। আর্থসামাজিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য এমন পরিস্থিতি যে কোনো সরকারের জন্য কাঙ্ক্ষিত। এ সময়ের অর্জন নিয়ে বলুন...
আবদুর রাজ্জাক : ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ আওয়ামী লীগের পক্ষে, মহাজোটের পক্ষে বিপুলভাবে রায় দেয়। তার আগের দু'বছর দেশ পরিচালনা করেছে বিশেষ ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ সরকার এসেছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশব্যাপী পরিচালিত তীব্র গণআন্দোলনের মুখে। গত ৯ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার যে দেশটিকে স্বল্প আয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে পেরেছে, সেটি নিয়ে কোনো সংশয় দেশে বা বিদেশে নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন বিশ্বসমাজে নন্দিত নেতা। তার ভাবমূর্তি দেশের জন্যও সম্মান-গৌরব নিয়ে আসছে। আপনাদের জানা আছে, ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর থেকে পরের পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর জোট সরকার। তাদের দুঃশাসন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর নির্যাতন, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর একের পর এক হামলা, ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে নানা ধরনের দুরভিসন্ধি- এসব দেশবাসীর জানা আছে। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার মন্ত্রিসভাকে কেউ কেউ 'চমকের মন্ত্রিসভা' বলেছিলেন। কিন্তু নতুন সরকারের সামনে ছিল কঠিন সময়। বিদ্যুতের জন্য সর্বত্র হাহাকার ছিল। চালের অগ্নিমূল্য ছিল। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মানুষ বুঝতে পারে- আওয়ামী লীগের সরকার মানেই উন্নয়ন। শেখ হাসিনার সরকার মানেই বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো। আপনার মূল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আমি বিএনপির শাসনামল নিয়ে কয়েকটি কথা বলতে চাই।
২০০১ সালের পরের সময়ের কথা বলবেন?
রাজ্জাক : হ্যাঁ। ১ অক্টোবর নির্বাচনের আগেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ও পরে আওয়ামী লীগের অনেক কর্মী-সমর্থকের ঘরবাড়ি টার্গেট হয়। সংখ্যালঘুরা টার্গেট হয়। ভোলা, সিরাজগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় তো ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মতো বর্বরতা ঘটানো হয়েছে। চাঁদপুরের একটি গ্রামে এক শিশুর হাত ভেঙে দেওয়া হয়। বিএনপি কর্মীরা বলেছিল- বড় হয়ে যেন এ হাত দিয়ে নৌকায় সিল দিতে না পারে সে জন্যই এ শাস্তি। মায়ের কোল থেকে শিশুকে কেড়ে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর অত্যাচারের ঘটনা নিয়ে তখন প্রামাণ্য গ্রন্থ 'মানবতাবিরোধী অপরাধ' প্রকাশিত হয়েছিল। বিএনপির অপশাসন কেবল রাজনৈতিক নিপীড়নে সীমিত ছিল না। কৃষি, শিল্প সব ক্ষেত্রে তারা দেশকে পিছিয়ে দিচ্ছিল। নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিচ্ছিল। জাতীয় সংসদের ঢাকা-১০ আসনের নির্বাচনে মোসাদ্দেক আলী ফালুকে কারচুপি করে, জবরদস্তিমূলকভাবে জয়ী করানো হয়। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন কীভাবে হবে, সে বিষয়ে ধারণা করতে আমাদের সমস্যা হয়নি। তারা সংবিধান সংশোধন করে, যাতে সাবেক বিএনপি নেতা ও প্রধান বিচারপতি কে এম হাসান পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারেন। বিচারপতি এমএ আজিজকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে বসানো হয়। নির্বাচন কমিশন এমনভাবে পুনর্গঠন করা হয়, যাতে পাতানো নির্বাচন নির্বিঘ্ন হয়। তারা এক কোটি ২৩ লাখ ভুয়া নাম ভোটার তালিকায় তুলেছিল। ১৪ দলের ২৩ দফায় ভুয়া নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া, প্রার্থীদের সম্পত্তির হিসাব দাখিল, জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান- এসব দাবি তোলা হয়েছিল।
আপনারা তো লগি-বৈঠা আন্দোলনে গিয়েছিলেন...
রাজ্জাক : বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান করে নির্বাচন করতে যখন মরিয়া ছিল বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী জোট, তখন আমরা দুটি পদক্ষেপ নিই- একদিকে ১৪ দল ও মহাজোট গঠন, অন্যদিকে রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ। আপনাদের স্মরণ থাকার কথা, আন্দোলন দমনের জন্য দমননীতির পথ নিয়েছিল বিএনপি সরকার। শেষ পর্যন্ত কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের পদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান পদে অধিষ্ঠিত হন। তার সামনে সাংবিধানিক যেসব বিকল্প ছিল, সেগুলো তিনি অনুসরণ করেননি। তিনি ঘোষণা দিলেন, তার সরকার রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা এভাবে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো। তিনি ১০ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন, যার মধ্যে চারজন কয়েকদিনের মধ্যে পদত্যাগ করেন। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিলেন, এ সরকার অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে আগ্রহী নয়। মহাজোট নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেয়। কিন্তু বিএনপি জোট যে কোনো মূল্যে ২২ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠানে দৃঢ়সংকল্প ছিল। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ ওই জোটের অনেক নেতা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন, এমন ঘোষণাও দেওয়া হয়। প্রহসনের ওই নির্বাচন ঠেকাতে আন্দোলন জোরদারের বিকল্প ছিল না। লগি-বৈঠা ছিল প্রতীকী। মূল বিষয় ছিল আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা এবং সেটা ঘটেছিল। এমন প্রেক্ষাপটেই বিশেষ ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি, যা ওয়ান-ইলেভেন নামে পরিচিত। এ সরকার প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় থাকে।
এ সরকারের সময় শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া গ্রেফতার হন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অনেক নেতাও গ্রেফতার হন। তাদের নামে মামলা হয়, দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে-
রাজ্জাক : সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপে বিশেষ ধরনের সরকার গঠিত হয়। সৃষ্টি হয় নতুন পরিস্থিতি। কিন্তু জনগণ অসাংবিধানিক সরকার চাইছিল না। রাজনৈতিক দলের বাইরে তৃতীয় শক্তি চাইছিল না। তবে পীড়াদায়ক ঘটনা ছিল, পশ্চিমা বিশ্ব প্রথম দিকে সেনাসমর্থিত বিশেষ ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে খুব উৎসাহী ছিল। দেশের কিছু লোকও এই অগণতান্ত্রিক সরকারকে সমর্থন দিতে থাকে। রাজনীতির মাঠ থেকে দুটি প্রধান দলের দুই শীর্ষ নেত্রীকে সরিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টাও ছিল লক্ষণীয়। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনে তৎপর হন। কিন্তু দেশবাসী চেয়েছে সাংবিধানিক সরকার। ফলে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি হয় সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার। দুই নেত্রীকে মুক্তি দেওয়ার বিষয়টিও গুরুত্ব পায়। কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান পদে না রাখার আন্দোলন পরিচালনার সময়েই ১৪ দলীয় জোট সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ২৩ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। এতে নতুন ভোটার তালিকা প্রণয়ন, ভুয়া নামগুলো ভোটার তালিকায় না রাখা, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বাড়ানো- এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল।
২০০৯ সালের সরকার গঠনের পর অর্জনের কথায় আসি...
রাজ্জাক : নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ রূপকল্প-২০২১, দিনবদলের সনদ ঘোষণা করে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের কথা বলে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার করে। অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার- এসব বিষয়ও ছিল। ফলে মানুষের মধ্যে নতুন আশাবাদ সৃষ্টি হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো, খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো, শিল্পায়ন, শিক্ষা-স্বাস্থ্য- সব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আমাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল। এখন দেশবাসীই বিচার করুক, আওয়ামী লীগ তার কথা রাখতে পেরেছে কি-না। এমনকি প্রতিপক্ষও স্বীকার করছে- আওয়ামী লীগ উন্নয়নের দল। বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। বাংলাভাই, শায়খ আবদুর রহমানের মতো নৃশংস জঙ্গিদের কারণে দেশের সর্বত্র আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। তখন কৃষকরা সার পায়নি। পাঁচ বছরেও তারা বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে পারেনি, বরং আগের কিছু কেন্দ্রও বিকল হয়ে পড়ে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে বিদ্যুৎ নিয়ে আন্দোলনের কথা সবাই জানেন। রাজধানীতে ডেমরা এলাকায় বিদ্যুৎ ও পানির দাবিতে আন্দোলন চলাকালে সাধারণ মানুষের তাড়া খেয়ে বিএনপির এমপি সালাহউদ্দিন আহমদ পালিয়ে যান। যে কারণে তার নামই হয়ে যায় দৌড় সালাহউদ্দিন।
নির্বাচনে আপনারা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিলেন। এ রায়ের মধ্য দিয়ে যে প্রত্যাশা ব্যক্ত হয়েছে মানুষের, তার কতটা রক্ষা করতে পেরেছেন?
রাজ্জাক : আমি নতুন মন্ত্রিসভায় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাই। মনে আছে, প্রথম সভাতেই মন্ত্রিসভা সারের দাম বিপুলভাবে কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ৭০ টাকা কেজির টিএসপি ২২ টাকায় নামিয়ে আনা হয়। পটাশ সারের কেজি ৬০ টাকা থেকে ১৫ টাকা করা হয়। গত ৯ বছর এই একই দাম বজায় রয়েছে। কৃষিঋণ বরাদ্দ বেড়েছে। ফলে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে। বাংলাদেশ কেবল খাদ্যশস্য নয়, মাছ-সবজিতে অভূতপূর্ব সফলতা অর্জন করেছে। খাদ্যশস্যের বাজার বছরের পর বছর স্থিতিশীল। উত্তরাঞ্চলে এখন আর মঙ্গা শব্দটিই শোনা যায় না। অথচ বিএনপির আমলে প্রতি বছর সেখানে অভাবী মানুষের আর্তনাদ শোনা যেত। এটা আপনাআপনি হয়নি। আমরা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রহণ করেছি। অভাবী জনপদে বিনিয়োগ বাড়িয়েছি। মজুরি বেড়েছে। এক সময়ে বাম দলগুলো ক্ষেতমজুরদের জন্য সাড়ে তিন কেজি চালের দামের সমপরিমাণ অর্থ দিনে মজুরি দাবি করত। এখন কিছুটা চড়া মূল্যের বাজারেও দৈনিক মজুরি দিয়ে ১০ কেজির বেশি চাল কেনা যায়।
কিন্তু এ বছর হাওর এলাকায় মাত্র ৯-১০ লাখ টন বোরো চাল উৎপাদন কম হওয়ায় চালের দাম কেন বিপুলভাবে বেড়ে গেল? কেন বাজার নিয়ন্ত্রণ করা গেল না?
রাজ্জাক : হ্যাঁ, মূল্য বেড়েছে। কিন্তু আমরা দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছি। আমদানি বাড়ানো হয়েছে। হঠাৎ ফসলহানির কারণে আমদানি করতে হয়েছে। বিশ্ববাজার থেকে আমদানি করতে কিছু সময় লাগে। এ সুযোগ নিয়েছে একদল অসাধু ব্যবসায়ী। তবে অন্য একটি বিষয়ও মনে রাখতে হবে। গত কয়েক বছর কৃষকরা ধানের যথাযথ দাম পায়নি। বর্গাচাষি পাওয়া যাচ্ছিল না। ধান, গম, ভুট্টা, আলুর উৎপাদন বেড়েছে। খাদ্য আমদানিনির্ভর দেশটিতে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ থাকায় নেপালে ভূমিকম্পের সময় ২০ হাজার টন চাল সহায়তা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। মাছ ও ডিমের উৎপাদন বেড়েছে। সবজি মেলে বছরের সবসময়। চাল নিয়ে সাময়িক সমস্যা হয়েছে। এটা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব।
কৃষিতে শেখ হাসিনার সরকারের সাফল্য দৃশ্যমান। কিন্তু অর্থনীতির অন্যান্য খাতে?
রাজ্জাক : অর্থনীতির নিয়মই হচ্ছে জিডিপিতে কৃষির হিস্যা ক্রমেই কমবে, শিল্পের বাড়বে। এটা ঘটছে। অর্থনীতি গতিময় করতে চাই অবকাঠামো ও জ্বালানি খাতের উন্নয়ন। এসব মনোযোগ পাচ্ছে। পদ্মা সেতু গড়ে উঠছে নিজেদের অর্থে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন দৃশ্যমান। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন বাস্তব। বস্তিতে, গ্রামীণ জনপদে এর সুফল ছড়িয়ে পড়ছে। শিল্প উৎপাদন বাড়াতে হলে গ্রামে বাজার চাই। অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা বাড়ানোর জন্য চাই ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি। এ জন্য শিল্প খাতের প্রতি নজর দিচ্ছি আমরা। আমরা ৩২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নিয়ে ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু করি। ২০২১ সালের জন্য টার্গেট ২৪ হাজার মেগাওয়াট। এটা যে অর্জিত হবে, তা নিয়ে সংশয় নেই। শিক্ষা ক্ষেত্রে অর্জন সবাই দেখছে। পাঁচ কোটি ছাত্রছাত্রী বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যায়। নিরক্ষরতা কমছে। এখন চ্যালেঞ্জ মান বৃদ্ধি। স্বাস্থ্যসেবার জন্য হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিক, নতুন নতুন মেডিকেল কলেজ- কত আয়োজন। গড় আয়ু ৭০ বছর ছাড়িয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এ দেশের চেয়ে মাথাপিছু আয় বেশি; কিন্তু শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সূচকে আমরা এগিয়ে আছি। এখন বলতে পারি, উচ্চ প্রবৃদ্ধির পথ সুগম করতে পেরেছি। উন্নয়নের মহাসড়কে চলার গতি বাড়াতে চাই উন্নয়নের উপযোগী নেতৃত্ব। এ নেতৃত্ব কেবল জননেত্রী শেখ হাসিনাই দিতে পারেন- এটা তো মানুষই বলছে।
কিন্তু বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ যেভাবে দেশের উন্নয়ন ঘটাতে পারছে, দলের জনপ্রিয়তা সেভাবে বাড়ছে না। আপনি কী বলবেন?
রাজ্জাক : দল ক্ষমতায় থাকলে নেতাকর্মীদের প্রত্যাশা থাকে। ক্ষোভ-কোন্দল-দ্বন্দ্ব কমবেশি থাকে। শহর বা গ্রাম যেখানে যান মানুষ স্বীকার করবে, উন্নয়ন সহজে চোখে পড়ে। তারা সুবিধা পায়। ঢাকায় বিদ্যুৎ প্রায় যায়ই না। পানি পায় সবাই। তবে আরও ভালো কিছুর প্রত্যাশা থাকে। সুশাসন সবাই চায়। আমরা সবকিছু ভালো করেছি, বলব না। ভুলভ্রান্তি আছে। এসব দূর করার চেষ্টা করছি। টেন্ডারবাজির অভিযোগ আছে, সেটা জানি। কিন্তু এখন ই-গভর্ন্যান্স চালু হয়েছে। কেনাকাটায় পছন্দের কাউকে কাজ দেওয়া যায় না। একটা সিস্টেমে সবকিছু আনার চেষ্টা চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে অনিয়ম নেই। মন্ত্রী-এমপি-উপাচার্যরাও কাউকে ভর্তি করাতে পারেন না। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তিতে লটারি চালু হয়েছে। বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে নিয়োগের জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে নিবন্ধন করতে হয়। জোর দিয়ে বলতে পারি, সুশাসনের জন্য প্রয়োজনীয় বিধিবিধান প্রণয়ন করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের নজর এখন সামনের দিকে। আওয়ামী লীগ যেমন উন্নয়নের দল, তেমনি ভবিষ্যৎমুখী দল।
একটু ব্যাখ্যা করবেন?
রাজ্জাক : সমুদ্রসীমা এখন অনেক বিস্তৃত। এ কৃতিত্ব শেখ হাসিনার। তেল, গ্যাস, অন্যান্য সম্পদ ও পর্যটন- কত সম্ভাবনা বঙ্গোপসাগরে। গভীর সমুদ্রবন্দর হবে। কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল হচ্ছে। রাজধানীতে মেট্রোরেলের কাজ চলছে। তরুণ সমাজের মেধা-সৃজনশীলতা কাজে লাগানোর জন্য নতুন ভাবনা-চিন্তা রয়েছে। এ সবকিছুই থাকবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতার জন্য সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আঁতাত করছে- এ অভিযোগ বিভিন্ন মহল থেকে তোলা হচ্ছে...
রাজ্জাক : আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে। পাকিস্তানের সেই ঘোর অমানিশার যুগে আওয়ামী লীগ ১৯৫৫ সালে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দেয়, প্রকাশ্যে অসাম্প্রদায়িক আদর্শ গ্রহণ করে। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর প্ররোচনায় যে দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা হয়, সেটা রুখে দিতে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে 'পূর্ব বাংলা রুখিয়া দাঁড়াও' ধ্বনি নিয়ে বাঙালিরা পথে নামে। আপনি লক্ষ্য করবেন, ধর্মান্ধ রাজনৈতিক শক্তির তৎপরতা বিশ্বের সর্বত্র আছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রতি যে নির্মমতা, তার পেছনেও ধর্মান্ধ শক্তি। যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকান দল খ্রিষ্টধর্মকে কাজে লাগাচ্ছে। ধর্মভিত্তিক চ্যালেঞ্জ মানবতার জন্য হুমকি, সেটা বুঝতে হবে। তারা বাংলাদেশে মাদ্রাসায় কাজ করছে। শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে কাজ করছে। এদের মোকাবেলা করেই রাজনীতি করতে হয়। তাদের সঙ্গে আপসের সুযোগ নেই।
আগামী নির্বাচন নিয়ে আপনাদের কী পরিকল্পনা? ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে আপনার মত জানতে চাই।
রাজ্জাক : আমি বলব না যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সবকিছু ঠিক ছিল। কিন্তু সে সময়ের প্রেক্ষাপট মনে রাখতে হবে। বিএনপি-জামায়াত জোট পেট্রোল বোমার রাজনীতি শুরু করে। হেফাজতে ইসলাম দু'বার ঢাকার শাপলা চত্বরে সমাবেশ করে উগ্র ধর্মান্ধ রাজনীতির স্লোগান তোলে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার রুখতে মরিয়া চেষ্টা চলে। এ অবস্থাতেও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপিকে পছন্দের কয়েকটি মন্ত্রী পদ পর্যন্ত ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেন। কিন্তু বিএনপি সন্ত্রাসের পথেই থাকে। জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনে দেশবাসী তাদের সমর্থন দেয়নি। সমর্থন মিললে তারা সরকারের পতন ঘটাতে পারত। নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হতো না। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনও মানুষ বাতিল করতে বাধ্য করেছে। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচন তারা অনুষ্ঠান করতে পারেনি মানুষের সমর্থনের অভাবেই। জনগণই আওয়ামী লীগের শক্তি। এই শক্তির ওপর ভরসা রেখে, তাদের স্বার্থে কর্মকৌশল-কর্মপন্থা নিয়েই আমরা আগামী নির্বাচনে যাব। জনগণের সমর্থন যে মিলবে, সেটা নিশ্চিত।
খালেদা জিয়ার সমাবেশে অনেক মানুষ হচ্ছে। দলের কর্মী-সমর্থকরা উৎসাহিত। আপনারা কীভাবে দেখেন এ বিষয়টি?
রাজ্জাক : বিএনপি বড় দল। তবে বড় সমাবেশ দিয়ে সবকিছু বিচার করা যায় না। ১২ নভেম্বর বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে সমাবেশ করেছে, তার চেয়ে বড় সমাবেশ টাঙ্গাইলে আমার নির্বাচনী এলাকায় আমিই করতে পারব। ক্ষমতায় থাকুক আর না-ই থাকুক, আওয়ামী লীগ সবসময় জনগণের শক্তির ওপর নির্ভর করে।
আওয়ামী লীগে গণতন্ত্র নেই, এমন অভিযোগ সম্পর্কে কী বলবেন?
রাজ্জাক : আওয়ামী লীগের তৃণমূলেও কমিটি গঠনে ভোটাভুটি হয়। দলে ছোটখাটো সমস্যা থাকে, অনেকের প্রত্যাশা থাকে। আবার নির্বাচন এলে, নৌকা দেখলে বৃহত্তর স্বার্থে সবাই এক হয়ে যায়। এটাই এ দলের ঐতিহ্য। এ দলটি দেশের স্বাধীনতা এনেছে। এ দলের হয়ে কাজ করা গৌরবের, আনন্দের।
সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
রাজ্জাক : পাঠকদেরও শুভেচ্ছা।
সৌজন্যে: দৈনিক সমকাল