রঞ্জনা ব্যানার্জী, ০৮ ডিসেম্বর, এবিনিউজ : টিম আর সান্ড্রা কখন যে ঘরে ঢুকেছে আমি টেরই পাইনি। অশোকটার আর কাণ্ডজ্ঞান হলোনা। কতদিন বলেছি ঘরের বাইরে বেরোলে যেন দরজাটা টেনে দেয়! কীসের কী? দরজাটা আজও হাট করে খোলাই ছিল। কলবেলটা বাজলে আমিও নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার সময় পেতাম। আলগা পা’টা সোফার কিনারে অসহায় তাকিয়ে আছে, হুইলচেয়ারটা অবশ্য আমার পাশেই।
অক্টোবর যাই যাই করছে। গত দুইদিন তুমুল হাওয়ায় মেপল আর বার্চ গাছগুলো মাথা ঝাঁকিয়ে পাতা খসিয়েছে। অশোক আজ পাতা কুড়োচ্ছে। ওর ঠাণ্ডার ধাত। এতক্ষণ বাইরে থাকা ঠিক নয়। উলের শালটা বুনছিলাম মন লাগিয়ে, সময়ের তাল রাখিনি। ঘড়িতে এখন সাড়ে চারটা! আমি বাজারটা চাপি। অশোক আর আমার জরুরি যোগাযোগের মাধ্যম এখন এটা।
একসময় এইসব পাতা কুড়োনো, বাগান করা আমিই করতাম। হাঁটুর কাছটা চিনচিন করে ওঠে। এই এক ঝামেলা যখনই কোন পুরোনো কথা মনে হয় তখনই বামহাঁটুর কাছটায় অস্বস্তি লাগে।
টিমের হাতে চিঠি জাতীয় কিছু একটা। সান্ড্রা তড়বড় করে বলে, ‘অবিশ্বাস্য ঘটনা। অশোক আসুক, তারপর বলছি। ’আমি কৌতুহল চেপে রাখি। শালটা পরখ করেও। ‘সামান্তার জন্যে’, আমি জানাই। সামান্তা আমাদের বৌমা। বারোদিন পরেই আসছে ওরা। ঋষভ, সামান্থা আর আমাদের নাতনি অনুসূয়া। তার আগেই শেষ করবো। সান্ড্রা রায় দেয়, ‘সামান্তাকেমানাবে’। আমি জানি। সামান্তার নীল চোখের সাথেনীলহলুদ প্যাটার্ণটা দারুণ খুলবে।
কী আশ্চর্য অশোক এলো না! আমি হুইল চেয়ারটা কাছে টানি । সান্ড্রা উঠে দাঁড়ায়, ‘ব’স তো আমি দেখছি’আর অমনি অশোক ঘরে ঢোকে। ওকে আরো কালো দেখাচ্ছে। আমাদের নাতনিটিও হয়েছে দাদুর মত কৃষ্ণকালো। ঋষভ আর আমি সামান্তার মত ফকফকা শাদা না হলেও ময়লা নইতাও দাদুর রঙটাই জিতে গেল! সামান্তা অবশ্য বলে মিষ্টি রঙ।
অশোক কল ছেড়ে গরম জলে হাতের হিম তাড়ায়। টিম চোখ পাকিয়ে জানতে চায়, ‘বাজার টেপার সাথে সাথে ঢুকলে না কেন? এমার্জেন্সি কিছু যদি হতো?’ অশোক হাত মুছতে মুছতে বলে, ‘ তুমি আমাকে না দেখলেও আমি তোমার বিশাল বপু দেখেছি।এমার্জেন্সির ধরনটা বুঝেছি।’
আমি টিমের নজর কাড়ি। ‘অদ্ভুত ঘটনাটা বলো এবার!’ টিম হুঁশে আসে,‘ওহ্ অশোক কী সাংঘাতিক কাণ্ড!’ চিঠিটা হাওয়ায় দুলিয়ে বলে, ‘প্যান্ডোরাস বক্স!’
অশোক সোফায় বসতে বসতে জানতে চায়, ‘মিউনিসিপ্যালটির জলের মিটার লাগানোর নোটিস?’ দু’দিন আগে টিম কোথাও শুনে এসেছে জলের কলে কর্পোরেশন এবার মিটার বসাবে । টিম বলে,‘পড়েই দেখ’।
হঠাৎ সব সুনসান। কেবল টিমের ভারী নিঃশ্বাস লিভিং রুম জুড়ে ঘুরে বেড়ায়। অশোকের মুখ থমথম করছে, ‘চেকটা ফেরত দিয়ে দিও’।
‘কীসের চেক?’
অশোক চিঠিটা আমার হাতে দেয় ।
প্রেরকের নাম ‘এ্যান ব্রেটন’। কোন এক ইন্ডিয়ান দম্পতির খোঁজে টিমকে চিঠি লিখেছে। দশ বছর আগে এই দম্পতির সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছিল তার ছেলে। সেই অনভিপ্রেত ঘটনাটির পরপরই নাকি সেই দম্পতির গাড়ি এ্যাক্সিডেন্ট হয়। তাঁর ছেলের নাম ‘ব্রুস ব্রেটন’। দম্পতির কাছে তিনি তাঁর ছেলের হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। এই চেক যদি তারা গ্রহণ করেন তবে তার ছেলের আত্মার সদ্গতি হবে।
চোখের সামনে দৃশ্যটা দুলে ওঠে।
সান্ড্রা জিজ্ঞেস করে, ‘চেন তোমরা?’ আমি মাথা নাড়ি। অশোকও জানায় চেনে না এদের।
পুলিশের নথিতে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে লেখা আছে হঠাৎ লাফানো মুজের জন্যেই ব্রেইক ফেইল।
নর্থ আমেরিকায় হাইওয়েতে মুজ লাফিয়ে নামার ঘটনায় এমন এ্যাক্সিডেন্ট দুর্লভ নয়। কেবল আমি জানি অশোক অন্যমনস্ক না হলে হয়তো এমন ঘটতো না।
গাড়িটা আমার দিকেই দেবে উল্টেছিল। অশোকের কেবল হাল্কা চোট।
সান্ড্রার কথায় দশ বছর আগের সেই তিনদিন আবার জাগে।
আমাদের আসলে পাঁচদিন থাকার কথা ছিল। ২৪ থেকে ২৮ জুলাই। আমাদের পঁচিশতম বিয়েবার্ষিকীতে ঋষভের উপহার। কটেজটাটিমের বন্ধুর। ছোট স্কটিশ শহর। সাড়ে তিন ঘন্টার ড্রাইভ। আঠারো শতকের স্থাপত্যকলার নিদর্শনের জন্যে বিখ্যাত। ঋষভ তখন ইয়েলে ল পড়ছে। আমাদের অজান্তেই সে আমেরিকায় বসে টিমের মাধ্যমে সব আয়োজন সেরেছিল।
মঙ্গলবার ২০০৭ । ২৪ জুলাই। সকালে বেরিয়ে যাব ঠিক করলেও বেরোতে বেরোতে বেশ বেলা হয়েছিল। তবে হাইওয়ে ফাঁকা, সাড়ে তিন ঘন্টার মধ্যেই ঢুকে পড়েছিলাম শহরে। কী সুন্দর গোছানো শহর! দু’ধারে পাইন আর বার্চের সারি মাঝখানে সিঁথি কেটে সোজা পথ। তারপরেই বামে হেলে মেঠো রাস্তা। সমুদ্রের তীর ঘেঁষে ছয় সাতটা কটেজ। কটেজগুলোর ডান পাশে সারসার হাওয়াকলের আভাস। সূর্যের তেজ কমতেই সমুদ্রের ধারে কাটিয়েছিলাম সারা বিকেল।
পরদিন শহর দেখতে বেরিয়েছিলাম। রাস্তাঘাট ঝকঝকে। বড়বড় ভিক্টোরিয়ান দড়দালান ; এক্কেবারে ছবির মতন। দুপুরে লাঞ্চ করতে ঢুকেছিলাম একটা সীফুড রেস্তোরাঁয়। প্রায় ফাঁকাই কিন্তু আমরা ঢোকা মাত্র সবাই কেমন মাথা ঘুরিয়ে দেখলো!
শহরে ঢোকার সময়েই চার্চটা নজর কেড়েছিল। খুঁটিয়ে দেখবার মত স্থাপত্য। ভেতরটা আরও সুন্দর। উঁচু ডোমের নিচে স্টেইণ্ড গ্লাসের অপরূপ চিত্রকল্প। আমাদের যিনি ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন তাঁর নাম ‘এ্যান্ড্রু হল’। তিনি এই চার্চের মিনিস্টার। আসলে আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলাম উনি দেখতে পেয়ে ভেতরে ডাকলেন। জানালেন এই প্রিসবেটেরিয়ান চার্চটি আঠারো শতকের ঐতিহাসিক স্থাপনা।
সেই সন্ধ্যায় অশোকই দেখেছিল আগুনটা। কটেজের টালির ছাদের ওপারে লালের হোলি! রাতের খাওয়া সেরে জলের ধার ধরে হাঁটছিলাম দুজনে। একটু পরেই ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল । প্রায় ছুটে কটেজে ফিরেছিলাম। রান্না ঘরের জানালা দিয়ে দমকলের লাল আলোর ঘুর্ণির আভাস বোঝা যাচ্ছিলো।
পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের জন্যে ডিম কিনতে বেরিয়েছিল অশোক। ফিরে এসে জানালো চার্চটাতেই আগুন লেগেছে। চার্চে? এতো উঁচু পাথরের তৈরি চার্চে আগুন লাগলো কীভাবে? শর্ট সার্কিট? অশোক মাথা নাড়ে। ‘সম্ভবত আর্সন কেইস। পুলিশ ধারে কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না’। কজন ছোকরা গোছের ছেলেপেলে নাকি ওকে দেখছিল ঘুরে ঘুরে।সেতো প্রথম দিন থেকেই আদেখলার মত দেখছে যেন মঙ্গল গ্রহ থেকে নামলাম! ধুর! অশোককে বলি, ‘চল ফিরে যাই’!
চার্চের দিকটা বন্ধ, ঘুরপথে হাইওয়ের নিশানা পেতে সময় লাগে আধঘন্টা। গাড়িতে তেল নেয়ার জন্যে থামে অশোক। আমাদের ঠিক সামনে দাঁড়ায় ট্রাকটা। ড্রাইভার সিট থেকে নামে গাট্টাগোট্টা একজন। অল্পবয়েসি। তেল ভরা শেষে স্টোরের ক্যাশকাউন্টারের দিকে এগোয় অশোক। দেখি ছেলেটাও অশোকের পেছন পেছন যাচ্ছে। ট্রাকের পেছনের সিট থেকে নেমে অন্য একজন ড্রাইভার সিটে বসে। তারপরেই গাড়িটা টেনে স্টোরের পার্কিংএ থামায়। কী হচ্ছে? আমার বুক ঢিপঢিপ করতে থাকে। একটু পরে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। রাচ্চাটা পার হতে যাব দেখি ছেলেটা তেড়েফুঁড়ে যাচ্ছে অশোকের দিকে। লোক জমে গেছে। আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠি আমি। ছেলেটা চমকে তাকায় আমার দিকে। আমার কোমর থেকে পা জেলির মত টলটলে হয়ে গলে যাচ্ছে যেন । আমি রাস্তাতেই বসে পড়ি। ছেলেটা খিস্তি করতে করতে গাড়িতে ওঠে আর রাস্তায় চাকা ঘষে বিচ্ছিরী আওয়াজ তুলে গাড়িটা বেরিয়ে যায়। অশোক আমার দিকে তাকায় না। সোজা গাড়িতে ওঠে। কেউ একজন চেঁচিয়ে বলে, ‘ লেডি আর ইউ ওকে?’ গাড়িতে ফিরতে সারাদিন লেগে গেল যেন। পা দুটো ভয়ানক কাঁপছিল। আমার দু’পা কি জেনে গিয়েছিল এটাই ওদের একসাথে শেষ হাঁটা?
সারা রাস্তা অশোক গুম ধরে ছিল। কী হয়েছিল কিছুই বলেনি। এ্যাক্সিডেন্টের পরেও নয়। আমিও জানতে চাইনি। সান্ড্রার প্রশ্নের জবাবে আজই অশোক মুখ খুললো।এই প্রথম আমিও জানলাম আসলে কী হয়েছিল স্টোরে।
ক্যাশ কাউন্টারের লাইনে ছেলেটা এক্কেবারে ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল। ও–ই ‘ব্রুস ব্রেটন’। অশোক ফিরে তাকাতেই জানতে চাইলো, ‘কোন সমস্যা?’
টিপ্পনী কেটেছিল অশোক, ‘তোমার কী সমস্যা? চশমা হারিয়েছে?’ ছেলেটা সাপের মত হিসহিস করে আঙুল তুলে বলে, ‘তোমাকে আরও ছোট করে দাঁড়ানো শিখতে হবে’। অশোক বুঝলো এ ছেলে ঝামেলা পাকাতে চাইছে। কথা না বাড়িয়ে দাম দিয়ে দরজার দিকে এগোতেই ছেলেটা লাফ দিয়ে সামনে এলো, ‘এখানে থাকতে হলে আমাদের সমীহ করে চলতে হবে’। অশোক অবাক‘তুমি কে? ’ ছেলেটা থামে না, ‘তোমরা সব একই। কৌশলে আমাদের রক্তের ধারা পাল্টাচ্ছ’। আচ্ছা ঝামেলাবাজ তো!অশোক দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে যায়। ছেলেটা চেঁচায়, ‘নিজের দেশে যাও’। অশোক এবার আর মেজাজ ধরে রাখতে পারে না। ‘তোর বাপের দেশ এটা?’ ছেলেটা সাথে সাথে গায়ের ওপরে তেড়ে আসে। আশপাশের লোকজন না থামালে রক্তারক্তি হত।
এই ঘটনার কোন মাথামুন্ডু পায়নি অশোক।
টিমই প্রস্তাব দেয়, ‘চল যাই ইঙ্গলটাউন। চেকটারও তো একটা কূল করা দরকার’।
রাতে ঋষভ আদ্যোপান্ত শোনে। বলে টিমের কথাই ঠিক। ওরাও যাবে সঙ্গে।
ঠিক হয় ঋষভরা এলে একটা সেভেন সিটার ভাড়া করে সবাই একসাথেই যাব।
এ্যানের ফোন নম্বর জোগাড় করে ফেলে টিম। ফোনে ওকে জানিয়ে দেয় আমরা শনিবার এগারোই নভেম্বর আসছি ইঙ্গলটাউন। এ্যান আমাদের সেদিনই বিকেল চারটায় চায়ের নেমন্তন্নে ডাকে।
খুব ভোরে আমরা রওয়ানা দি।শহরটাতে ঢুকতেই সেই চার্চ। আমি ছাড়া সবাই গাড়ি থেকে নামে। আমি জানালা দিয়েই দেখি। চার্চের গায়ে খোদাই করা মূর্তিগুলি ঠান্ডা চোখে দেখে আমাকেও। বাইরে থেকেই কটা ছবি তুলে ফিরে আসে সবাই। কাল ফেরার পথে টিম ভেতরে যাবার ব্যবস্থা করবে। সামান্তা ওর সেলফোন স্ক্রল করে চার্চের গায়ের ক্লোজআপ শটগুলো দেখায়। ছবিতেও যেন বিষণ্নতা ছুঁয়ে আছে পাথরের গায়ে।
সেই কটেজটাতেই থাকবো। মেঠো পথটায় গাড়ি ঢুকতেই হাঁটুর চিনচিন অস্বস্তিটা বাড়ে।
ঠিক সময়েই পৌঁছেছিলাম এ্যান ব্রেটনের বাড়িতে। দরজায় হাত দিতে না দিতেই দরজা খুলে গেল। ষাটের ওপারে বয়েস। সম্ভ্রান্ত চেহারা। আমাদের সবাইকে সাদরে বসার ঘরে নিয়ে গেলেন। আমার নাতনি অনুসূয়া ওর কারসিট বাস্কেটে ঘুমিয়ে কাদা। প্রস্থেটিক পা’টা সয়ে গেছে, সাহায্য লাগে নাতাও সামান্তা হাত ধরে আমাকে সোফার কাছে নিয়ে যায়।
সামনের দেয়ালেই ঝুলছে ছবিটা। কালো গ্র্যাজুয়েশন গাউন পরা, নিচে লেখা, ‘ব্রুস ব্রেটন ১৯৮৮– ২০১৬’। ছবির চোখ জোড়া সরাসরি আমাকে দেখছে। আমি চোখ সরিয়ে নি। কফি টেবলের ওপরে বাদাম, চিজ, বাইট–সাইজ স্যান্ডুইচ। ট্রলিতে ফ্রুটপাঞ্চ আর গ্লাস সাজানো। ভদ্রমহিলা আমার পাশেই রিক্লাইনারটাতে বসেন। কেউ কোন কথা খুঁজে পাইনা। অবশেষে টিম গলা খাঁকারি দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে ব্রুসের জন্যে। এ্যানও আমার হাত ধরে সমবেদনা জানায়। এরপরেই ক্রমশ কথার পিঠে কথা বাড়ে আর আমরা অকল্পনীয় এক কাহিনীতে হোঁচট খেতে খেতে ঢুকি। অবাক হই জেনে যে ব্রুস আত্মহত্যা করেছিল। দীর্ঘদিন বিষন্নতায় ভুগছিল। চিকিৎসা চলছিল। মারা যাবার আগে সারাক্ষণ কেবল একজোড়া ভয়ার্ত চোখের ছবি আঁকতো। অবশেষে ওর সুইসাইড নোট থেকেই এ্যান জানে এটা সেই ইন্ডিয়ান লেডির চোখ। ব্রুস এই চোখের ভয় ভাঙাতে চেয়েছিল। আমি শুধরে দি, ‘আমি বাংলাদেশের’।
ঘটনার মূলে ‘এ্যান্ড্রু হল’ এবং তাঁর স্ত্রী ‘ইসাবেলা’।
সেই এ্যান্ড্রু হল, যিনি চার্চটা ঘুরে দেখিয়েছিলেন!
এ্যান্ড্রু এসেছিলেন আমেরিকার শিকাগো শহর থেকে। শিকাগোতে বড় হলেও এ্যান্ড্রুর জন্ম কানাডার সাস্কাচুয়ানে। মিনিস্টারের চাকরি নিয়ে ফিরে এসেছিলেন স্বদেশে, এই ছোট্ট শহরে। সাথে সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী ইসাবেলা। হাসিখুশি ইসাবেলা খুব সহজে সবার মন জয় করে নিয়েছিল। সানডে স্কুলে পড়াতো। মহিলাদের নিয়ে বুকক্লাবও করেছিল।
এখানের লোকেরা মুখে কিছু না বললেও অন্য সংস্কৃতির আঁচ এড়িয়ে চলে। ইসাবেলা আর এ্যান্ড্রু বন্ধুবৎসল। সুদূর আমেরিকা থেকেও ওদের পুরোনো বন্ধুরা আসতো। এদের মধ্যেই আফ্রিকান আমেরিকান একজন বন্ধু ছিল;নাম অলিভার। লেখক। বেশ কবার এসেছিল সে।
শহরে একটা সূক্ষ্ম পরিবর্তনের হাওয়া টের পাচ্ছিলো কট্টরপন্থিরা। এখানকার উঠতি মেয়েদের কাছে ইসাবেলা ক্রমশ আইকন হয়ে উঠছিল। ওদের তাড়াবার ফন্দিফিকির চলছিল ভেতরে ভেতরে কিন্তু এমন হবে কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি । ওদের শিশুকন্যার জন্মই কট্টরপন্থীদের দুরভিসন্ধিতে হাওয়া লাগায় । বাচ্চাটা হওয়ার পরে ইসাবেলা এ্যান্ড্রুর গুণমুগ্ধরাও চমকে উঠেছিল। এই বাচ্চা কিছুতেই এ্যান্ড্রুর নয়। গায়ের রঙ হাল্কা বাদামী। মাথা ভর্তি কোকড়া চুল। এ্যান্ড্রু ইসাবেলার সমুদ্র নীল চোখও নয়।
এটা প্রিসবেটেরিয়ান চার্চের শহর। উপাসনালয় সংক্রান্ত ইস্যুতে কোন ছাড় নেই এখানে। এ কান ওকান ঘুরে পুরো শহরের বাতাস ভারী হয়। সেই আফ্রিকান আমেরিকান লেখককে নিয়ে কল্পকাহিনী রান্না হতে থাকে। চার্চের পরিচালনা পর্ষদকে বিভিন্ন ভাবে চাপ দেয়া হয়।
এক রোববারে এ্যান্ড্রুর পরিচালনায় প্রার্থনা চলার সময় একদল বেরিয়ে যায়। শোনা যায় সেদিনই এ্যান্ড্রু পদত্যাগ করতে চেয়েছিল। কিন্তু ইসাবেলা বেঁকে বসে। শহরের সবার কাছে উড়োচিঠি পৌঁছায়; এ্যান্ড্রুকে শহর ছাড়তে হবে। ইসাবেলা ওর বুক ক্লাবে মিটিং ডাকে। মিটিঙে কেউ আসেনা এমনকি এ্যানও নয়। অবশেষে পরিস্থিতি সামলাতে শহরের কর্তা ব্যক্তিরা টাউনহলে ক্লোজড ডোর মিটিং ডাকে। সেদিন মিটিং চলাকালীন সময়েই চার্চে কেউ আগুন লাগায়।
এ্যান জানায় ট্যুরিস্টদের সাধারণত মান্য করা হয়, সে শাদাই হোক কি কালো। কিন্তু আমরা এসে পড়েছিলাম ভুল সময়ে।সেদিন এ্যান্ড্রুর সাথে অশোক আর আমাকে ব্রুস দেখেছিল। ব্রুস এবং তার বন্ধুরা চার্চের কট্টরপন্থী গ্রুপের। ওরা ভেবেছিল এ্যান্ড্রু আমাদের চেনা কেউ। পেট্রোল পাম্পে অশোকের সাথে দেখাটা কাকতালীয় নয় ওরা অশোকের পিছু নিয়েছিল। এ্যান বলে, ‘নিয়তি। তোমরা কিছুই জানতে না অথচ তোমাদেরই ক্ষতি হলো সবচে’ বেশি’। আমি অবাক হই। ‘বলি তোমারো তো অপূরণীয় ক্ষতি হলো’! এ্যান আমাকে অবাক করে বলে, ‘ব্রুসকে আমি জীবনকে ধারণ করার শিক্ষা দিতে পারিনি। জীবনধারণ আর জীবনকে ধারণ দুটো এক নয়’।
সান্ড্রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘কানাডায় এমন বর্ণবাদী শহর আছে, জানাই ছিল না’। টিম বলে, ‘কার্পেটের নিচে ময়লা জমানো আমাদের ইউরোপিয়ান রক্তের দান’।
আমি যুক্তি খুঁজি, ‘আমরাও কি কালো দম্পতির হঠাৎ নীল চোখের বাচ্চা দেখলে এমন ভাববো না?’
সামান্তা বলে, ‘কেন ভাববে? চার্চের খাতিরেই যদি বল তাও সমাধান ছিল; জীনপরীক্ষা। দশ বছর আগেও এটা ছিল এখন আরো সহজলভ্য হয়েছে। সেটাও অপমানজনক। তাছাড়া ইসাবেলা তো কথা বলতে চেয়েছিল। তৃতীয় বিশ্ব নিয়ে নাক সিটঁকাই অথচ আমরা নিজেরা যে কী কুসংস্কারাচ্ছন্ন!’
সামান্তার চোখে জল চিকচিক করে। অনুসূয়াকে কারসিটের বাকল খুলে কোলে তুলে নেয়। কী জানে কী চলছে ওর মনে? আমি মনে মনে বলি, সব কালেই মেয়েদেরই পরীক্ষা দিতে হয়। রামরাবণকে নয়।
‘কী হলো তারপরে?’ এতক্ষণে অশোক কথা বলে। চার্চের আগুনটা অতিউৎসাহী কেউ ঘটিয়েছে। এ্যান্ড্রুকে তাড়ানোটা উদ্দেশ্য ছিল। চার্চের ক্ষতি নয়।এটা ট্যুরিস্ট শহর। ট্যুরিস্ট সিজনে এমন ঘটনা বাইরে প্রকাশ পেলে শহরের অর্থনীতিতে বিকট প্রভাব পড়বে। তাই চার্চের সংস্কারেই ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল কমিউনিটি। তাছাড়া এ্যান্ড্রু ঘটনার কদিন পরেই পদত্যাগ করেছিল। বাচ্চাটার যখন ছয়মাস তখন ইসাবেলা টাউন হলে সবাইকে ডাকে। ও একটা তথ্যবহুল প্রেজেন্টেশন দেয়। খুব কম লোকই উপস্থিত ছিল। অনেকেই যেতে চেয়েছিল কিন্তু চার্চের আগুনের প্রচ্ছন্ন ইন্ধনদাতা হিসেবে ভেতরে ভেতরে অনেকে নিজেকে দায়ী করেছে। বিশেষ করে বুকক্লাবের সদস্যরা। এ্যান গিয়েছিল। ইসাবেলার এই প্রেজেন্টেশনের সিডি অনেকের মেইলবক্সে পৌঁছে যায় পরে। তথ্যবহুল এই ভিডিও পরবর্তিতে অনেকের চোখ খুলে দিয়েছিল। পরের মাসেই ওরা সাস্কাচুয়ানে এ্যান্ড্রুর নিজের জন্মস্থানেই ফিরে যায়। সারা শহর তখন ওদের রাখার জন্যে এক হয়েছিল। বিদায় দিনে ইসাবেলা বলেছিল, ‘জানালাটা খুলে দিয়ে গেলাম দিগন্ত দেখার দায়িত্ব তোমাদের’ ।
আমি শুধাই, ‘বাচ্চাটা নিয়ে কী ব্যাখ্যা দিয়েছিল ইসাবেলা?’
সামান্তা হাসে ‘মা ওর জিনোলজিতে কালো কেউ ঘুমিয়েছিল। আমাদের সকলের পূর্বপুরুষ আফ্রিকান ভুলে গেলে? তোমার নাতনিকে দেখ’।
এ্যান সম্মতি দেয়, ‘ইসাবেলার তিন পুরুষ আগে বংশলতিকায় সাউথ আফ্রিকান কালো আছেন; তিনি ইসাবেলার ঠাকুরমার দিদিমা’।
টিম এ্যানকে সেই কুড়ি হাজারের চেকটা ফেরত দিতে গেলে এ্যান হাহা করে ওঠে, ‘ওটা আমার ছেলের প্রায়শ্চিত্ত’। সামান্তাই সমাধান দেয়, ‘এই টাকা দিয়ে ইসাবেলার নামেই লাইব্রেরিতে কর্ণার কর’। আমি মনে মনে বুকে টেনে নিই আমার বৌমাটিকে।
কটেজে ফিরতি পথে আমরা একটা রেস্তোরাঁতে থামি। বেশ ভিড়। অর্ডার নিতে আসা ছেলেটা দশ বছর আগের মত কৌতূহলী চোখে আমাদের দেখে না। ঝটপট খাবার নিয়ে আসে।
পরদিন ফেরার পথে সামান্তা বলে, ‘মা আগামী বছর তোমাদের বিয়ে বার্ষিকীটা এখানেই করবো।’
আমি ওকে কাছে টেনে নি। হাঁটুটা আর জ্বালাচ্ছে না।
(সংগৃহীত)