
ঢাকা, ১০ ডিসেম্বর, এবিনিউজ : ডা. এইচ বি এম ইকবাল। দায়িত্ব পালন করছেন বেসরকারি দ্য প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান হিসেবে। ব্যবসার বাইরেও এ উদ্যোক্তার পরিচয় মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিক। শূন্য ঘোষিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র পদে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় এসেছে তার নাম। এসব নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন একটি দৈনিকের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার অংশটি হুবহু তুলে ধরো হলো-
উদ্যোক্তার বাইরেও আপনার অনেকগুলো পরিচয় আছে। এর মধ্যে কোন পরিচয়ে সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
আমি একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। দেশের স্বাধীনতার জন্য আমার রক্ত ঝরেছে— এটিই আমার বড় পরিচয়। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমি ভারতের দেরাদুনে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সে (বিএলএফ) গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে মুজিব বাহিনীতে যোগদান করি। মুক্তিযুদ্ধে নিজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি মনি (শেখ ফজলুল হক মনি) ভাইয়ের নেতৃত্বে। আমি মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলাম। যুদ্ধ শেষে পুনরায় মেডিকেল কলেজে ফিরে যাই। সেনাবাহিনী বা অন্য কোনো চাকরিতে যাইনি।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে যাওয়ার পর পুরোপুরি রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। টানা ১৬ বছর রাজনীতির মাঠে সক্রিয় ছিলাম। রাস্তায় থেকেই আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছি। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পেছনে অনেক মানুষ রক্ত দিয়েছে। তার মধ্যে আমিও একজন।
মেডিকেল কলেজের ছাত্র থেকে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্পটা বলুন...
মেডিকেল কলেজের ব্যয় বহন করার জন্য অনেক ছাত্রই টিউশনি করত। আমি সে পথে পা বাড়াইনি। জীবনের তাগিদেই মেডিকেল কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় মেডিসিন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হই। খুবই ছোট পরিসরে ছিল সে ব্যবসা। এরপর মতিঝিলে অফিস নিই। পরবর্তীতে আসি এয়ারলাইনস ব্যবসায়। সেখান থেকে ফিন্যান্সিয়াল সেক্টরে, তারপর ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টর। এভাবেই বিভিন্ন খাতে যুক্ত হয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছি।
দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কিছু করার প্রেরণা থেকেই আমি অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি। ৪০-৪৫ হাজার ছাত্রছাত্রীর জন্য আমি শিক্ষানগরী গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছি। আমার সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মুনাফার ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় দিয়ে দিচ্ছি। প্রিমিয়ার গ্রুপ ফাউন্ডেশন ও প্রিমিয়ার ব্যাংক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে এ অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে।
সমাজের উন্নয়নে কোন ধরনের কাজ আপনাকে বেশি টানে?
সব ধরনের কাজকেই আমি সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। তবে যে কাজটি করলে আমি শুধু একা উপকৃত হব না, বরং গণমানুষ উপকৃত হবে— সে ধরনের কাজ করতে আমি বেশি পছন্দ করি। সে কাজগুলো করে আমি আত্মতৃপ্তি পাই। কোনো কাজের ফল একা ভোগ করতে আমার ভালো লাগে না। সবাই মিলে ফল ভোগ করতেই আমি ভালোবাসি।
পকেটে পয়সা থাকলে বাজার থেকে ভালো আম কিনে খেতে পারি। এটির মাধ্যমে শুধু আমি নিজেই উপকৃত হব। কিন্তু পকেটের পয়সা দিয়ে যদি একটি আমের চারা কিনে লাগাই এবং সেটির যত্ন নিই, তাহলে সে গাছের ফল আমার পরিবার, পথচারী, সমাজ ও দেশের মানুষ খেতে পারবে। সবাইকে নিয়ে চলাই আমার বেশি পছন্দের।
ডিএনসিসির সম্ভাব্য মেয়রপ্রার্থী হিসেবে আপনার নাম আলোচনায় এসেছে। এ ব্যাপারে কিছু বলুন...
ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ তেজগাঁও-রমনা আসনে আমি সংসদ সদস্য ছিলাম। এ নির্বাচনী এলাকাটিকে আমি বলি ‘মিনি বাংলাদেশ’। কারণ ওই এলাকায় জাতীয় সংসদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবালয়, সর্বোচ্চ বিচারালয়, সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অবস্থান। একই সঙ্গে মধুবাগ, মণিপুরি পাড়া, নাখাল পাড়ার বড় বড় বস্তিও এ এলাকায়। শ্রমিকদের এলাকা হিসেবে পরিচিত তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলও এখানেই। অর্থাৎ সব ধরনের মানুষের বসবাস এ এলাকায়। এখানে কাজ করে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, সেটি অনন্য।
সংসদ সদস্য থাকার সময় সততার সঙ্গে পরিকল্পিতভাবে দেশের উন্নয়নে কাজ করেছি। আমার নির্বাচনী এলাকার প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে পরিকল্পিতভাবে কাজ করেছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, তেজগাঁও কলেজ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, উইলস লিটল ফ্লাওয়ারসহ প্রায় সব কয়টি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিকল্পিত উন্নয়ন হয়েছে।
এখনো নির্বাচনী এলাকার মানুষ আমাকে ভোলেনি। তারা আমাকে স্মরণে রেখেছে। সাধারণ মানুষ আমাকে কাছে পেয়েছে, কাছ থেকে দেখেছে। তাদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে গিয়েছিলাম। সাধারণ মানুষ আমাকে তাদেরই একজন মনে করে। রাজধানীকে সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলতে আমি সদা প্রস্তুত।
ঢাকাকে ঘিরে আপনার স্বপ্নের কথা বলুন?
‘ক্লিন ঢাকা, গ্রিন ঢাকা’— এ স্লোগান লিখে আমিই প্রথম ২০০৯ সালে ঢাকাকে ঘিরে আমার পরিকল্পনার কথাগুলো বই আকারে আপার (শেখ হাসিনা) হাতে দিয়েছিলাম। পরে আনিসুল হক মেয়র নির্বাচনে সেই স্লোগান ব্যবহার করেন। বইয়ে আমি ঢাকার যানজট নিরসন, অবকাঠামো নির্মাণ, পরিবেশসহ রাজধানীর সব সমস্যা সমাধানে করণীয় সম্পর্কে তুলে ধরেছিলাম।
সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় আমি প্রথমবারের মতো তেজগাঁও-রমনা এলাকায় ৩০০ ভ্যানগাড়ি দিয়েছিলাম। সেগুলো প্রতিদিন সকালে প্রতিটি বাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলত। এজন্য ৬০০ লোক নিয়োগ দিয়েছিলাম, যাদের বেতনের টাকা আমার ব্যক্তিগত পকেট থেকেই দেয়া হতো। পাঁচ বছর ধরেই আমি তাদের বেতন দিয়েছি। ক্লিন ঢাকা, গ্রিন ঢাকা বিনির্মাণে সেটি আমার প্রথম পদক্ষেপ ছিল।
পৃথিবীর সব বড় শহরে মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ রাস্তার জন্য বরাদ্দ থাকে। কিন্তু ঢাকায় মাত্র সাড়ে ৮ শতাংশ রাস্তা রয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই যানজট নিরসন সম্ভব নয়। এ জন্য আট বছর আগে আমি প্রধানমন্ত্রীকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম ঢাকার চার স্থানে স্যাটেলাইট টাউন করার।
শ্রীপুর, ধামরাই, রূপগঞ্জ ও সোনারগাঁ— এ চারটি এলাকাকে স্যাটেলাইট টাউন হিসেবে গড়ে তুলে ফ্লাইওভার ও মেট্রোরেল দিয়ে ঢাকার সঙ্গে সংযুক্ত করার প্রস্তাবনা দিয়েছিলাম। এগুলো বাস্তবায়ন হলে চারটি শহর থেকে মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিটে ঢাকার গুলিস্তানে আসা সম্ভব হতো। তখন ঢাকা খালি হয়ে যেত। স্যাটেলাইট শহরগুলোয় স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, শপিংমল, বাজার সবকিছুই পাওয়া যেত। ফলে মানুষ সব শহরে ছড়িয়ে পড়ত। ঢাকা নগরীকে বাঁচাতে হলে চারটি ঢাকা বানাতে হবে। এ নগরীকে ঢেলে সাজাতে ১০০ বছরের পরিকল্পনা নিতে হবে।
উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখা তরুণদের উদ্দেশে কী বলবেন?
স্বপ্নচারী তরুণদের ‘ওনারশিপ কনসেপ্টে’ কাজ করতে হবে। যে চেয়ারটিতে আমি বসে আছি, সেটি আমার চেয়ার। যে কলম দিয়ে আমি লিখছি, সেটি আমার কলম। যে টেবিলে বসে আমি খাচ্ছি, সেটি আমার টেবিল। এ ধরনের বিশ্বাস বুকে ধারণ করার সাহস উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখা তরুণদের মাঝে থাকতে হবে। ওনারশিপ কনসেপ্টে এগিয়ে যেতে পারলে যেকোনো উদ্যোক্তা সফল হবেই। যে যেটা করবে, সেটা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে করা উচিত। সফল হতে হলে সততা ও পরিশ্রমের বিকল্প নেই।
সমালোচকদের উদ্দেশে আপনার বক্তব্য কী?
সমালোচনাই হলো মানুষের সামনে এগিয়ে যাওয়ার বড় প্রেরণা। সমালোচনা যত তীক্ষ হবে, সামনে এগিয়ে যাওয়ার আগ্রহ তত বাড়বে। ব্যক্তি, সমাজ ও দেশের জন্য আমি কী করলাম, সেটিই বড় কথা। সমাজ ও দেশ আমাকে কী দিল, সেটি বড় নয়। (সৌজন্যে : বণিক বার্ত)
এবিএন/সাদিক/জসিম/এসএ