![সাহিত্যিকের দীনতা ও উন্মুক্ত পথ](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2017/12/13/sirazul-islam_115145.jpg)
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ১৩ ডিসেম্বর, এবিনিউজ : ‘ঘরে–বাইরে’র বিমলা নিজের মনের মধ্যে অমরাবতীর যে–ছবি সযত্নে রক্ষা করেছিল সে–ছবিতে বিমলার মা ছিলেন, যে মা “বাবার জন্যে বিশেষ করে ফলের খোসা ছাড়িয়ে সাদা পাথরের রেকাবিতে জলখাবার গুছিয়ে দিতেন, বাবার জন্যে পানগুলো বিশেষ করে কেওড়াজলের ছিটে দেওয়া কাপড়ের টুকরোয় আলাদা জড়িয়ে রাখতেন, তিনি খেতে বসলে তালপাতার পাখা দিয়ে আস্তে মাছি তাড়িয়ে দিতেন।” খোসা ছাড়িয়ে সাদা পাথরের রেকাবিতে কী কী ফল সাজিয়ে দিতেন বিমলার মা রবীন্দ্রনাথ তা উল্লেখ করেন নি, আর ওই যে পান–জড়ানোর ন্যাকড়া আর খাবারের সামনে মাছিদের নিরলস ব্যস্ততা এদেরকে স্বর্গের ছবিতে পরিণত করার জন্য কল্পনার যে–শক্তি ও মোহের যে–প্রসারতা প্রয়োজন তা অবশ্যি বিমলার ছিল; কিন্তু তা যদি কারো না–থাকে এবং সে যদি দেখে যে বিশেষ করে গুছিয়ে দিলেও বাংলাদেশের ফলগুলো নিতান্ত সাধারণ, পান–জড়ানোর কাপড়গুলো নিতান্তই নোংরা এবং খাবারের সামনের মাছিগুলো আমাদের আজন্ম রোগজীর্ণতার পরিচয়লিপি, তাহলে সে–দেখাকেও দোষ দেওয়া যাবে না। বস্তুত রাজবাড়িতে বিমলার যে জীবন তা অতিশয় সামান্য, যেমন কর্মহীন তেমনি প্রাণহীন। তার না আছে কাজ ঘরের ভেতর, না আছে সুযোগ বাইরের বড় জীবনে স্বাদ গ্রহণের।
কিন্তু বিমলা যদি সুযোগ পেত দেউড়ি পার হয়ে বাইরে যাবার, দরিদ্র প্রজাদের সঙ্গে মিশবার, তাহলে বিমলা কি খোঁজ পেত অসামান্য কিছুর? মোটেই নয়, বরং বিমলা দেখত রাজবাড়িতে তার জীবনের যে সামান্যতা তা সমগ্র দেশের জীবনের অভাব ও অনটন, দীনতা ও নির্জীবতারই একটি বর্ধিত, বলা যেতে পারে রাজকীয়, সংস্করণ। বাংলাদেশে জীবনের দীনতা বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছে সাহিত্যে খাদ্য নিয়ে অতিরিক্ত উৎসাহে। খাদ্যের কথা সব দেশের সাহিত্যেই আছে, কিন্তু মঙ্গলকাব্য থেকে শুরু করে বুদ্ধদেব বসু পর্যন্ত আহারের বিষয় নিয়ে যে–পরিমাণ ব্যস্ততা সাহিত্যের চরিত্ররা প্রকাশ করেছেন তা একান্তই বঙ্গদেশীয়। এর একটা কারণ বোধ হয় সাধারণভাবে খাদ্যের অপ্রাচুর্য এবং দ্বিতীয় কারণ সাহিত্যের চরিত্রসমূহের, বিশেষ করে মেয়েদের, করবার মতো কাজের অভাব।
খাদ্য নিয়ে এই ব্যবস্থার পেছনকার কারণটা অবশ্যই অর্থনৈতিক। বাঙালি–জীবনের অর্থনৈতিক দীনতার সত্যটিকে লেখকরা অনেক সময় স্বীকার করেন নি হয়তো, কিন্তু লেখকদের লেখা স্বীকার করেছে সব সময়েই। লেখার মধ্যকার চিন্তার দারিদ্র্য ও প্রাণের অসদ্ভাবের ভেতর দিয়ে জীবনের দীনতা অনেক সময়েই নিজেকে প্রকাশিত করেছে। লেখকরা মিথ্যা কথা বলতে পারেন, লেখা কখনো মিথ্যা বলে নাণ্ড এই মতের সত্যতা বাংলা সাহিত্যে প্রমাণিত হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রকৃতিও জীবনের প্রতি, জীবনের সচ্ছলতার প্রতি বিরূপ। এই প্রকৃতি বৃহৎকে সহ্য করে না। বৃহৎ কীর্তিকে নয়, বড় মানুষকেও নয়। যা কিছু বড় হয়ে উঠতে চায়, চায় উঁচু হয়ে থাকতে, তাকে সে আঘাত করে নিচে থেকে, দু’পাশ থেকে, উপর থেকে। ফলে আপস, সন্ধি, কোমলতা, এরা বড় গুণ হয়ে প্রকাশ পায় জীবনে ও সাহিত্যে।
বড় চিন্তা অন্য যে অবস্থাতেই সম্ভব হোক অন্তত শূন্য উদরে সম্ভব যে নয় এটা ঠিক। এ সত্যটা সত্যদর্শী এ্যাথেনীয়রা খুব স্পষ্ট করে বুঝেছিলেন, সেই জন্য সে দেশের দার্শনিকেরা মহৎ জটিল গভীর তত্ত্বসমূহের রহস্যোদ্ধার করতে বসার আগে আহার করে নিতেন, উদর যত পূর্ণ হতো আলোচনাও তত উদাত্ত হয়ে উঠত। আহার করতেন, কিন্তু আহারের চিন্তাতে আবদ্ধ থাকতেন না, অন্য বিষয়ে চিন্তা করতে সুযোগ পেতেন। অন্নচিন্তা ছিল না বলেই বুদ্ধদেব হওয়াটা সিদ্ধার্থের মতো রাজপুত্রের পক্ষেই সম্ভবপর, দরিদ্র ভিখারীর পক্ষে নয়। বাংলা সাহিত্যে ও বাঙালির জীবনের একবার যে একটা উদ্দীপনা এসেছিল, যাকে বাড়িয়ে বলা হয় রেনেসাঁন্স, সেই উদ্দীপনা সম্ভব হয়েছিল এই কারণে যে তার সঙ্গে জড়িত ছিলেন যাঁরা তাঁদের জীবনে সচ্ছলতা ছিল অর্থের। রামমোহন, মাইকেল, বঙ্কিমচন্দ্র, এঁরা কেউই দরিদ্র ছিলেন না। বিদ্যাসাগর কিছু কম অর্থ উপার্জন করেন নি। রবীন্দ্রনাথের কোনো অভাব ছিল না।
কিন্তু এই সঙ্গে আরো একটা সত্য আছে জড়িত। এঁদের গৃহে সচ্ছলতা ছিল, কিন্তু এঁরা কেউই সদগৃহী ছিলেন না, গৃহীর মানসিকতা ছিল না এঁদের। সেজন্যই এঁরা লেখক হয়েছিলেন, নইলে সচ্ছল ঘরের আর পাঁচজন সুসন্তানের মতো স্ত্রী–পুত্র পরিজনের বেষ্টনীর মধ্যেই অর্থহীন জীবনযাপন করে নিঃশেষিত হয়ে যেতেন। শরৎচন্দ্র ধনী ছিলেন না, চেষ্টা করলে তিনি উকিল হতে পারতেন, হয়তো বা ডেপুটি, বংশ রক্ষা করে শেষে দেহ রক্ষা করতেন। কিন্তু তা করেন নি, নিজের গৃহে আবদ্ধ ছিলেন না, সেই জন্য দশ জনের ঘরের খবর নিয়েছেন, দশ ঘরের দুঃখে দুঃখিত হয়েছেন। বংশ রক্ষা হয় নি বটে, কিন্তু অনেককে রক্ষা করেছেন, সাহিত্যে।
গৃহ ও গৃহী মানসিকতার দিক থেকে মুসলমান সমাজের অবস্থাটা ছিল হীনতর। বঙ্কিমচন্দ্র কৃষকের ভাগ্য দেখে পীড়িত হয়েছেন, বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস নেই দেখে ব্যথিত হয়েছেন। সেই সঙ্গে ইংরেজি শিক্ষার সুফল যেটুকু তাকেও নির্দ্বিধায় গ্রহণ করেছেন; সাহিত্যিক রূপকল্প এনেছেন বিদেশ থেকে, ডেসডিমনার সঙ্গে শকুন্তলার তুলনা করে দেখিয়েছেন যে, ডেসডিমনাই পূর্ণতর চরিত্র, কিশোরী বালিকার। অর্থাৎ কিনা নিজের ছোট গৃহে আটক থাকেন নি, বের হয়ে গেছেন সম্পদের খোঁজে, ইতিহাসের সঙ্গে কল্পনাকে মিশিয়ে, জাতীয়তাবাদী অনুপ্রেরণার সঙ্গে বৈদেশিক সম্পদ আহরণকে যুক্ত করে আয়োজন করেছেন বৃহতের। নবাব আবদুল লতিফ ও কবি কায়কোবাদের মধ্যে দুস্তর পার্থক্য। কায়কোবাদ উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পান নি, চাকরি করেছেন সামান্য, জীবনযাপন করেছেন গ্রামে; কিন্তু এই কুটীরবাসীর সঙ্গে বড় দালানবাসী আবদুল লতিফের আত্মীয়তা ছিল, মানসিকতার দিক থেকে উভয়েই ছিলেন বর্জনবাদী, ছিলেন চারপাশের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন। প্রতিভার কথা বাদ দিয়েও কায়কোবাদের পক্ষে বড় কবি হওয়ার পথে একটা বড় অন্তরায় ছিল। সে হলো যে–জীবনের মধ্যে তিনি বাস করতেন সেই জীবনকে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করতে তাঁর অসম্মতি। এই জীবনের দিকে তিনি অন্তরের দিক থেকে অগ্রসর হয়েছেন, কিন্তু বুদ্ধি এসে তাঁকে শাসন করেছে। শাসন করে প্রেরণ করেছে মোগলদের অতীত ইতিহাসের অবাস্তব জগতে। এই বুদ্ধি আর যা–ই হোক বাস্তববুদ্ধি নয়।
নজরুলকে যদি বিচার করতে হয় তবে এই পটভূমিতেই করতে হবে। নয়তো তাঁর পূর্ব পরিচয় স্পষ্ট হয়ে উঠবে না আমাদের কাছে, আমরা জানতে পারব না তাঁর অসামান্যতাটা ঠিক কোথায় ও কতটা।
নজরুল বড় প্রতিভাবান ছিলেন একথা বললে সবটা বলা হয় না তাঁর সম্পর্কে। সেই সঙ্গে তাঁর পক্ষে কবি কায়কোবাদ হওয়া যে সহজ ও স্বাভাবিক ছিল এই কথাটা যোগ করলে নজরুলের পরিচয়লিপিটি পূর্ণতর হয়। কায়কোবাদের তুলনায় দরিদ্র ছিলেন নজরুল। তিনি কোরাইশ বংশের নন, কাজী বংশের। তাঁর বাবা মারা যান যখন তাঁর বয়স মাত্র নয়, অসহায় মা চলে যান অন্যঘরে। তারপরে গৃহ বলতে কিছু ছিল না নজরুলের। সেই কারণেই মনের দিক থেকে অতিবড় গৃহী হবার কথা ছিল তাঁর। সম্ভাবনা ছিল তিনি কেরানী হবেন, আরো বড় হলে সাব–রেজিস্ট্রার, কথা ছিল অন্নচিন্তাতেই সময় কাটবে জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিস্থলের অতিপরিমিত পরিসরে। তাঁর পক্ষে সৈনিক হওয়া ছিল অস্বাভাবিক, কবি হওয়া তার চেয়েও বেশি।
কিন্তু তিনি শুধু কবি হলেন না, হয়ে উঠলেন অসামান্য এক লেখক। তার কারণ তাঁর প্রতিভা ছিল,এবং সেই প্রতিভার একটা প্রধান লক্ষণ ছিল এই যে, তিনি সদ্গৃহী ছিলেন না। সেই যে তিনি ঘর ছাড়লেন অতি অল্পবয়সে, তারপর ভাগ্যকে গড়লেন নিজ হাতে, কিন্তু আর কোনোদিন ফিরে গেলন না ঘরেণ্ড না চুরুলিয়াতে, না অন্যকোথাও। দারিদ্র্য তাঁর অজানা ছিল না। কায়কোবাদের মতো তিনিও দেখেছেন অনাহারক্লিস্ট শিশুকে তাঁর চারপাশে কাঁদতে। কিন্তু তাঁর মনের মধ্যে সেই হীনম্মন্যতা ছিল না যা আপন সন্তানকে ধিকৃত করতে শেখায় অপোগণ্ড শিশু বলে, শেখায় করুণা করতে নিজেকে। দারিদ্র্য তাঁকে দুর্বল করে নি, মহৎ করেছে, তাঁকে দিয়েছে খ্রিস্টের সম্মান। আত্মকরুণা যে নজরুলে নেই তা নয়, আত্মকরুণা আছে, আছে অভিমান, ফুল নেব না অশ্রু নেবণ্ড এই প্রশ্ন, অর্থাৎ নানা প্রকারের ভঙ্গিমা; কিন্তু সবকিছু নিজের মধ্যে ধারণ করে, সবকিছুকে ছাড়িয়ে ছাপিয়ে, জীবনের সামান্যতাকে নিচে রেখে দিয়ে অনেক বড় হয়ে উঠেছেন তিনি।
তিনি গৃহের কবি নন, কবি তিনি উন্মুক্ত পথের, যদিও গৃহ তাঁর লেখার মধ্যে আছে। আগামী দিনের মানুষ নজরুলকে কিভাবে নেবে সেটা তাদের বিবেচ্য, কিন্তু আমাদের পক্ষে নজরুলের এই পরিচয়টাই প্রধান যে কবি তিনি উন্মুক্ত পথের। একেক যুগ একেকভাবে নেয় একই প্রতিভাকে, আমাদের পক্ষে উন্মুক্ত পথে স্বচ্ছন্দপদচারী নজরুলই প্রধানতম নজরুল। এই পরিচয়টাই যে বড় করে চোখে পড়ে তার কারণ দু’টি। প্রথম কারণ আমাদের জীবনে পথের অভাব, অভাব পথচারীর। আমরা সকলেই গৃহী, গৃহের বাইরে ছোট ছোট গলি–ঘুঞ্জি আঁক–বাঁক আছে বটে কিন্তু উন্মুক্ত পথ নেই খুব বেশি। পথ যেখানে বা আছে, সেখানে অভাব আছে যাত্রীর। দ্বিতীয় কারণ এই যে, গৃহহীন নজরুলের পক্ষে গৃহী হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল, গৃহী না–হওয়ার মধ্যে তাঁর অসাধারণত্ব যেমনভাবে প্রকাশ পেয়েছে তেমন বোধ হয় অন্যকোথাও নয়। সকলেই জানেন যে, নজরুলের ওপর প্রভাব পড়েছিল ওয়াল্ট হুইটম্যানের। সেই প্রভাব একান্ত স্বাভাবিক, কেননা হুইটম্যানও কবি ছিলেন উন্মুক্ত পথেরই।
উন্মুক্ত পথের পথিক বলেই অতি–অনায়াসে সর্বত্রগামী হয়েছেন তিনি। হিন্দু–মুসলমানদের মিলন তাঁর লেখার মধ্যে যেমন ঘটেছে, জীবনে, রাজনীতিতে বা সাহিত্যে তেমনটি আর কোথাও ঘটে নি এ দেশে। খ্রিস্টানরাও বাদ পড়ে নি। সাধারণ মানুষের জীবনে তিনি যেমন ভাবে প্রবেশ করেছেন তাঁর আগে অন্যকোনো লেখক তেমন ভাবে প্রবেশ করতে পারেন নি। তাঁর অসামান্য গল্প ‘রা সী’তে তিনি শুধু বাগ্দী মেয়েকে আনেন নি, এনেছেন তার মুখের ভাষাকেও। বাগ্দী মেয়েকে ভদ্র সাজে আসতে হয় নি, সাহিত্যে সে এসেছে অকুণ্ঠ পদে, এসেছে নিজের ভাষায় কথা বলতে বলতে।
সন্দেহ নেই নজরুলের লেখা নাটকগুলোই তাঁর সাহিত্যের দুর্বলতম অংশ। সেখানে ভাবালুতা অধিক, কিন্তু সেই ভাবালুতার মধ্যেও নারী–শক্তির উদ্বোধন ভিন্ন যে মুক্তি নেই আমাদের, এই কঠিন সত্যটিকে উজ্জ্বল করে প্রকাশ করেছেন তিনি ‘ভূতের ভয়’ নাটকে। ‘ঝিলিমিলি’তে বি. এ. পাস না–করার যে প্রাণঘাতী বিতর্ক হত্যা করল ফিরোজাকে সে শুধু বিতর্ক নয় একটা, সেটি মুসলমান সমাজের গৃহাভ্যন্তরের যে–প্রাণহীনতা, যে–আনন্দহীনতা ঘরের সমস্ত দরজা–জানালা বন্ধ করে অন্যায় শাসনের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছিল তারই কাব্যময় প্রকাশ। চিরকালের মেয়ে ফিরোজা নজরুলের কালে এসে লাঞ্ছিত হয়েছে মুসলমানের গৃহে আটকা পড়ে। স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত তরুণদেরকে নজরুল যেমনভাবে বুঝেছেন তেমনভাবে এমনকি রবীন্দ্রনাথও বোঝেন নি। ‘চার অধ্যায়ে’র তুলনায় ‘কুহেলিকা’র সাহিত্যিক মূল্য সীমিত সন্দেহ নেই, কিন্তু ‘কুহেলিকা’য় যে সহানুভূতি আছে তরুণ সংগ্রামীদের প্রতি ‘চার অধ্যায়ে’ তা নেই। ‘কুহেলিকা’য় জাহাঙ্গীর সমসাময়িক মুসলিম সমাজে ছিল না, নজরুল নানাদিক থেকে এগিয়ে ছিলেন তাঁর সমাজের তুলনায়। ‘মৃত্যু ক্ষুধা’র আনসার যখন নতুন রাজনীতিকে গ্রহণ করেছে, কৃষক–শ্রমিকের রাজনীতিকে, তখন বোঝা যায় নজরুল এগিয়ে গেছেন সমসাময়িক লেখকদের অনেককে পেছনে ফেলে। আনসারকে তিনি সব্যসাচী করেন নি, তার বদলে কমিউনিস্ট করেছেন। কল্পনার আতিশয্যকে পরিহার করার মধ্যে যে বাস্তব বুদ্ধি এখানে প্রকাশিত হয়েছে তা সাধারণ নয়। গোরার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ যে একটি অতিশয় তেজস্বী, নিতান্ত অবাঙালি পুরুষ সৃষ্টি করেছিলেন, যার আত্মবিশ্বাস প্রচণ্ড, সমাজের প্রতি যার দায়িত্বজ্ঞান সর্বদাই অবিচলিত, সেই কল্পনার মানুষটি যেন বই থেকে বের হয়ে শরীর ধরে এসে দাঁড়িয়েছে নজরুলের লেখায়; সংস্কারে বিশ্বাসী গোরা নয়, সেই গোরা যে জেল খেটেছিল অন্যের কারণে, কিন্তু মাথা নোয়ায়নি কিছুতেই, বিশেষ করে সেই গোরা উপন্যাসের শেষে যাকে দেখি এসে দাঁড়িয়েছে সুচরিতা ও পরেশবাবুর কাছে, বলছে, তার আর ভয় নেই ব্রাত্য হবার। কেননা তার সমাজ নেই, সংস্কার নেই, সে সকল মানুষের, সে বৃহৎ ভারতবর্ষের।
কিন্তু গোরা তো কল্পনার সৃষ্টি। গোরার পিতামাতার খোঁজে রবীন্দ্রনাথকে যেতে হয়েছে আয়ারল্যান্ডে, সংগ্রহ করতে হয়েছে আনন্দময়ীর মতো স্নেহশীলা মাতাকে, কৃষ্ণদয়ালের মতো অবস্থাপন্ন গৃহস্বামীকে। নজরুল দরিদ্র বাঙালি পরিবারের ছেলে, এবং সেই কারণে আরো বেশি অসামান্য। অসামান্য বলেই সামান্য সমাজ তাঁকে গ্রহণ করতে পারে নি। মুসলমান সমাজের মুরব্বিরা প্রথমে বলেছে তিনি ধর্মদ্রোহী। পরে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হলে, চেষ্টা হয়েছে তাঁকে কেটেছেঁটে সামান্য করে নেবার। কিন্তু তিনি অসামান্যই আছেন। উন্মুক্ত পথে তো চলেছেনই; নজরুল আরো একটা কাজ করেছেন, ডাক দিয়েছেন দেশবাসীকে, পথটাকে আরো বড় দীর্ঘ ও প্রশস্ত করে নেবার। এই যাত্রী পথপ্রদর্শক, আবার তিনি পথনির্মাতাও।
(সংগৃহীত)