বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

মৎস্য বিলাস

মৎস্য বিলাস

নীলাঞ্জনা বিদ্যুৎ, ১৫ ডিসেম্বর, এবিনিউজ : ঘরে ছোট নাতনী রূপকথা–র অসুখ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। গত পরশু থেকে নাতনীর ঠাণ্ডা লাগাটা চিন্তায় রূপ নিয়েছে। ডাক্তার গম্ভীর মুখে বলেছেন, ‘নিউমোনিয়া।’ নিউমোনিয়া শব্দটি পরিবারে সমূহ আতঙ্ক নিয়ে উপস্থিত। শ্বাসের গতি বেড়েই চলেছে শিশুটির। শ্বাস প্রশ্বাসের সময় একধরনের ঘড় ঘড় শব্দ হতে থাকে। কাঁদতেও তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তার কি শ্বাসকষ্ট ? শিশুটি স্পষ্ট করে বলতে পারে না। বলতে পারে না বলেই যত বিপদ। ঘরে প্রতিটি অভিভাবকের মুখাবয়বে দুশ্চিন্তার মেঘরাশি। পুরো পরিবারটি শিশুটির আশঙ্কায় আচ্ছন্ন। প্রথমে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে চান নি ডাক্তার। তবে এখন না দিয়ে উপায় নেই। সঙ্গে আরো ৩/৪টি ওষুধ । টাকা থাক বা না থাক ওষুধ আনতে হবে। আনবে কে, আনবার দায়ভার কার ? উত্তরে বলতে হবে তিনি আবদুল হাই। এখুনি তাকে বেরুতে হবে ওষুধের জন্য । ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনটি আবদুল দ্রুত পকেটে নিয়েছে। সময় তাকে বন্দুকের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তার দায়ভার এড়ানোর সুযোগ নেই।

অফিসের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আবদুল হাই। চাকরিতে আছেন প্রায় বিশ বছরের কাছাকাছি। ‘হচ্ছে ,হবে’ বলে আজ অবধি চাকরিটা স্থায়ী হল না তার। ভাগ্যগুণে মাইনেটাও নিয়মিত হল না । তিন/চার মাস অন্তর একবার পায়। অফিসের বড় সাহেব, সেকেন্ড অফিসার , ক্যাশিয়ার, সেকশন অফিসার, কেরাণী এমনকি ড্রাইভারেরাও এমৌসুমে সময় পেলে অফিসে ইলিশের গল্প জুড়ে দেন। লাঞ্চের সময় অফিসের ডাইনিং রুমে ইলিশের গল্পে কম বেশি সবারই অংশগ্রহণ থাকে। কেবল আবদুল হাই ছাড়া। গল্পে অংশগ্রহণ করতে না পারাটাই আবদুলকে অসহায় করে তোলে।আবদুল গল্পগুলোর সমাপ্তি কামনা করে । প্রসঙ্গ পরিবর্তনের চেষ্টা করে কিন্তু সবসময় পারে না। ইউডিসিপাপিয়া আপা মাঝে মাঝে মনে লাগলে এক/আধ টুকরো ইলিশ আবদুলকে খেতে দেয়। বড় সাহেবের টিফিন ক্যারিয়ার আবদুল যখন বেসিনে ধুতে যায় তার নাকে লাগে এক অপূর্ব ঘ্রাণ, জিভে আসে জল। তা হবেই না কেনো? না হলে সেটি কি পদ্মার ইলিশ! এবছর এখনো ইলিশ কিনতে পারেনি আবদুল। বড় সাহেবের পিয়ন খলিল ইলিশের গল্পটা বেশি করে। যেন আবদুলই তার গল্পের উদ্দিষ্ট শ্রোতা। সাহেবের অনেক গোপন বিষয়–আশয়ের সাথে খলিল জড়িত। বাজার করবার সময় বিশেষ করে ইলিশ কেনার সময়ও সাহেব খলিলকে সঙ্গে রাখে। কোন ইলিশটার ডিম একদম হয়নি, কোনটার ডিম একবার ছাড়া হয়ে গেছে। কোনটির তেল বেশি। কোনটিকে পচিয়ে খেলে ভালো হবে ইত্যাদি বিষয়ে নাকি বড় সাহেব খলিলের সঙ্গে পরামর্শ করে থাকেন। খলিল আবার চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সমিতির নেতা। সাহেবের কাছের লোক কাজেই তার ইলিশের গল্প অফিসের অন্যরা শুনবে না তা কি করে হয়। বড় সাহেবের ছোট মেয়ের জন্মদিনে অফিসের সবাই আমন্ত্রিত হয়েছিল গত সপ্তাহে। অফিসের গাড়িতে পিয়ন, দারোয়ান সবাই একসঙ্গে গিয়েছিল সাহেবের বাসভবনে । সেদিনের অনুষ্ঠানে গুরুগম্ভীর হুকুমদার বড় সাহেবের হাসি–খুশি আচরণে মন ভরে গিয়েছিল আবদুল সহ অনেকের। সে ভোজসভায় সর্ষে মাখা ঝলমলে ইলিশের স্বাদ নিতে নিতে মনে বিজলীর মত আচমকা ঝিলিক দেয়, তার পরিজন ও তিন বছর বয়েসী নাতনী রূপকথা। তাদের নিরীহ মুখচ্ছবি ভেসে উঠে । তার এত আপনজন রেখে সে একাকী ইলিশের স্বাদ নিচ্ছে! তার কাছে বিষয়টি অপরাধ হিসেবে ঠেকে। কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে কোনো ভাবে সে খাওয়া শেষ করে। বাজারে ইলিশের যা দাম! মাস্টাররোলের কর্মচারী আবদুল এখনো ইলিশ কিনতে পারেনি। আদৌ কি কিনতে পারবে! অন্তত রূপকথার জন্য হলেও! আবদুল নিজের জন্য এক জোড়া স্যান্ডেল কিনেছে মাস খানেক আগে। বর্ষা অগ্রিম এসে যাওয়াতে কিনতে বাধ্য হয়েছে। আগের জোড়া ছিল সস্তা চামড়ার তদুপরি মুচির সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার সমাহার। কিন্তু এবার বরুণদেবতার রোষানলে শেষ রক্ষা হয়নি। স্যান্ডেল কেনার আগে কয়েকদিন ধরে একাধিক দোকানে দোকানে জুতোর খোঁজ খবর নিয়ে ফিরেছে আবদুল। অফিসে তো খালি পায়ে যাওয়া যায় না। বেতন পাওয়া মাত্রই সে জুতো জোড়া কিনে নিয়েছে। না নিয়ে উপায় ছিল না। যদিও ছোট মেয়ের জন্য চাহিদা সত্ত্বেও কিনে দিতে পারে নি। ইলিশ কেনার আগেই ক’দিন ধরে ইলিশের খোঁজ খবর বেশ করে নিয়েছে আবদুল । ইলিশ কিনে তাকে যেন ঠকতে না হয় । মাছ যথেষ্ট তাজা নয়, পেটভর্তি ডিম কিংবা তেমন তেল হয়নিণ্ড এমন কটুকথা গিন্নীর কাছে যেন শুনতে না হয়। একজোড়া সাধারণ স্যান্ডেল কেনার জন্য তাকে আট/দশদিন বাজার যাচাই করতে হয়। আবদুলের মত অসচ্ছল ক্রেতার পক্ষে বিলাসী হওয়া বড্ড ঝুঁকিপূর্ণ। ইলিশ কেনাও তার কাছে রীতিমত সতর্কতার বিষয় বৈকি। আবদুল তক্কে তক্কে থাকে। কখন সুযোগ আসবে কিনতে পারবে একটি ইলিশ। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে যায়নি বলে আবদুল বন্ধু–বান্ধব অনেকের তিরষ্কার–টিপ্পনী সহ্য করেছে। দাম যা ই হোক না কেনো এবছর ইলিশ কিনতে পারবে না; এমন প্রচ্ছন্ন পরাজয় আবদুল সহ্য করবে!

মনে পড়ে এপ্রিলের শেষ কিংবা মে–র প্রথম দিকে, একাত্তরে; পাশের গ্রামের মাহবুব, অরুণাংশু, মাহবুব, সিদ্দিক, মৃণালসহ কয়েকজন তাকে একদিন সন্ধ্যায় নদীর পাড়ে ডেকে নিয়ে যায়। চুপিসারে তাকে প্রস্তাব দেয়। আগামী পরশুর শেষ রাতের জোয়ারে তারা নৌকায় চাপবে। নৌকা চড়ে প্রথমে নোয়াখালি পরে কুমিল্লা হয়ে ত্রিপুরা। আবদুলের খুব ইচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার। শেখ মুজিবের প্রতি তার প্রগাঢ় ভালোবাসা। পাকিস্তানীদের প্রতি তার প্রবল ঘৃণা। কিন্তু তার সাহসে কুলায় নি। এক সময় আগরতলা ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে লোক মারফতে বন্ধু অরুণাংশুর চিঠি পায়। পরবর্তী দলের সঙ্গে যাওয়ার জন্য। কিন্তু বাড়িতে বিধবা ছোট বোন, বৃদ্ধ পিতা, অসুস্থ মায়ের কথা বিবেচনা করে তার যাওয়া হয়ে উঠেনি। আজও সেসব মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুদের কাছে নিজেকে একজন পরাজিত মানুষ বলে মনে হয় আবদুলের। হঠাৎ কখনো আবদুলের মনে হয় আবার যদি মুক্তিযুদ্ধের সুযোগ আসে সে নিশ্চয় প্রশিক্ষণ নিতে যাবে। ‘জয়বাংলা’ বলে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কোনো বাধাই তাকে ফেরাতে পারবে না। পরক্ষণেই ভাবে কালের পরিক্রমায় ১৯৭১ আর কখনোই ফিরে আসবে না। বঙ্গবন্ধুর ডাকে মানুষের বাঁধ ভাঙা জোয়ার আর আসবে না। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ সবার জীবনে আসে না । তার জীবনে একবারেই এসেছিল। সে হাতছাড়া করেছে এখানেই তার পরাজয়।পিয়ন হাকিম, হায়দার আলী, মুন্সী, কুদ্দুস,ক্লিনার রাখাল চন্দ্র সবারই চাকরি এক সময় স্থায়ী হয়ে যায়। বছর কয়েক আগে খলিল হেড অফিসের জন্য টাকা চেয়েছিল। টাকা দিতে না পারায় তার চাকরি স্থায়ী হয় না। এখানে তার দ্বিতীয় পরাজয় । কিন্তু এবার সামান্য ইলিশের ক্ষেত্রে সে অবশ্যই পরাজয় স্বীকার করবে না। পকেটের অবস্থা যা ই হোক না কেনো ।

প্রথম বয়সে যাত্রাপালায় দেখেছিলো রাজকন্যা স্বয়ংবর সভায় যাচাই বাছাই পূর্বক বর পছন্দ করে । তেমনি আজকের ১১৫০ গ্রামের ইলিশ অনেক ক্রেতার ভীড় ঠেলে ভাগ্যবিড়ম্বিত আবদুলকে পছন্দ করে নিয়েছে। যেমন দাম তেমন চেহারা। পদ্মার ইলিশ, শরীরটা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায় । স্বচ্ছ নীলাভ চোখ দিয়ে তাকিয়ে আছে আবদুলের দিকে। অবশেষে সমস্ত জল্পনা–কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আবদুল ইলিশ–যুদ্ধে জয়ী হতে চলেছে। এতদিন সে যে তাচ্ছিল্যের শিকার হয়েছে এবার তার প্রতিশোধ নেবার পালা। কালকে অফিসের ডাইনিং রুমে ইলিশের গল্পে সর্বাগ্রে অংশগ্রহণ করবে। পারলে তার প্রিয় নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্টাইলে এক জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে দেবে। হোক না সে এখনও মাস্টাররোলের কর্মচারী তা বলে সে ছোটখাটো মাছ কিনে নি। বড়দের মধ্যে বড়টাই কিনেছে। ভীড়ের মধ্যে এক ক্রেতা বলে উঠলো, ‘ভাই, মাছের মত মাছ, একদম খানদানি ইলিশ।’ শিক্ষিতগোছের একজন তোত্‌লাতে তোত্‌লাতে বললো, ‘ মা–মা –মাছের রা–রা–রাজ্যে এ–এ–একেবা–বারে মো–মো–মোগল স–স–সম্রাট। ‘অপরাপর প্রতিদ্বন্দ্বী ক্রেতারা বিজয়ীবীরের দিকে কিছুক্ষণ অসহায়ের মত তাকিয়ে থাকে। মাছ বিক্রেতা দীনেশও আবদুলকে খাতির করে মাছটি দিয়েছে। আজকের বাজারদর অপেক্ষাকৃত সুলভ বলে দীনেশই তাকে মোবাইল ফোনে ডেকে এনেছে। মাছ কেনার ক্ষেত্রে বড় সাহেব, সেকেন্ড অফিসার ও সে এখন একই কাতারভুক্ত, ভাবতে তার বুক ফুলে উঠে। গর্বিত মন নিয়ে এবার ঘরের দিকে তার যাত্রা। কেবল যাত্রা নয় বলা যায় জয়যাত্রা। সে এখন অর্ধেক পৃথিবী জয় করবার আনন্দে হাওয়ায় ভাসছে। তার চাকরিতে পদোন্নতি না হতে পারে তবে কিছুক্ষণের মধ্যে পরিবারে তার পদোন্নতি হবে নিশ্চয়। স্ত্রী মোসাম্মৎ আকিমুন্নেসার কাছে হবে সে একজন সত্যিকার রোজগেরে স্বামী। পিতৃভক্ত কিশোরী কন্যা লিপির মমতা আরো বাড়বে সংগ্রামী পিতার প্রতি। হবে সে পুত্রবধূর কাছে স্নেহশীল শ্বশুর, অকর্মণ্য পুত্রদ্বয়ের কাছে দায়িত্বশীল পিতা এবং নাতনী রূপকথার কাছে সফল দাদু। রূপকথা সকাল–সন্ধ্যে পড়তে বসে। কচিকণ্ঠে পড়তে থাকে ‘ইলিপ মাচ খেটে মজা, ইগল হল পাকির লাজা’ণ্ড বাইরে বেরোবার সময় হলে সে বলে বসে,‘ডাডু , টুমি ইলিপ মাচ আনটে পারো না?’ আজকে দাদুর হাতে সেই ‘ইলিপ মাচ।’

অন্যদিন বাজার থেকে হেঁটে হেঁটে বাসার দিকে যায়। রিক্সায় যাতায়াত তার মত আবদুলের কাছে বিলাসিতা তা বলাই বাহুল্য। আজকে ইলিশের সম্মান রক্ষায় ঝটপট রিক্সা নিয়ে নেয়। এত মর্যাদাশীল মাছ নিয়ে কি হেঁটে যাওয়া যায়! মাস্টাররোলের পিয়ন আবদুলের সম্মান না থাকতে পারে। কিন্তু ইলিশের তো সম্মান আছে! তাও সেটি রাজকীয় ইলিশ। আবদুল রিক্সাওয়ালা ছোকরাকে বারবার তাগাদা দেয় দ্রুত চালানোর জন্য।সে চায় ‘কইলজার ভিতর বান্ধি রাইক্যুম তোঁয়ারে..’ ছোকরা এমন একটা গানের টান দিক ! তার প্রাণ জুড়িয়ে যাক। অন্যেরা যখন রিক্সায় চড়ে রিক্সাওয়ালা কত সুন্দর গান গায়। এ–শালার বেটা একটা অপদার্থণ্ড এমন ভাবতে ভাবতে আবদুলবড় রাস্তা থেকে ছোট রাস্তা তারপর গলি। গলির মুখে দোকানদার, পাড়ার লোকজন দেখুক তাদের সম্মানিত প্রতিবেশী সরকারি চাকরিজীবী জনাব খন্দকার কাজী মো. আবদুল হাই মিঞা প্রকাশহীরা সাহেব আজ রিক্স্রা নিয়ে বাসায় ফিরছেন। রিক্সাকে বাসা অবধি নিয়ে যেতে পারত। নেয় নি কারণ হঠাৎ তার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল । গলির মোড়ে নেমে দোকান থেকে পলিব্যাগ কিনে কাপড়ের ব্যাগ থেকে দশাশই চেহারার মাছটি দৃশ্যমান করে । আয়েশী ভঙ্গীতে বাসার দিকে রওয়ানা দেয়। পরিচিত কেউ জিজ্ঞেস তো করবেই;ণ্ড দাম কত, ওজন কত , ডিম হয়েছে কি না। বাসায় জামাই এসেছে কি না । উত্তরগুলোও প্রস্তুত রেখেছে মনে মনে। দামের প্রশ্নে সে বলবে, ‘অত বেশি কোথায়, মাত্রবাইশশ’।’ জামাইয়ের প্রশ্নে বলবে, ‘জামাই আসলে তো জোড়া ইলিশই কিনতে হয়। কিন্তু বিধি বাম অপরিচিত কয়েকজন ছাড়া কারো সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়নি।যা ই হোক রাস্তায় সে প্রশংসা, কৃতিত্ব, সম্মান আশা করেছিল তার ছিটে ফোঁটাও মিলে নি। এবার নিজের ঘরে সম্বর্ধনা না হোক অন্তত আন্তরিক অভ্যর্থনা তো আশা করতে পারে। যা এতদিনে সে পারেনি আজকে তা পেরেছে। এপাড়ার অনেকে না পারলেও সে তাদের আগে বড় ইলিশ কিনতে সক্ষম হয়েছে। টিনের শেড সামনে নর্দমা নিয়ে কানাগলির শেষপ্রান্তে তার বাসা । ইলশে গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে সে দ্রুত ঘরে ঢুকে রূপকথা–কে ডাকবে । রূপকথাকে কোলে নিয়ে ছুটে আসবে লিপি। ঘরে পা রাখা মাত্রই হঠাৎ কি হল ? গত দুদিন টানা বৃষ্টির কারণে নর্দমার গন্ধটি বেশি লাগছে।না, ঠিক তার কারণে নয় । শ্রান্ত আবদুলের মাথাটা কেমন যেন ভারী ; বুকটা যেন ধড়ফড় করে উঠছে। পরিবারের সমস্ত শঙ্কিত মানুষের সামনে একজন অপরাধীর আত্মসমর্পণ ! আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো ভাষাই খুঁজে পাচ্ছে না আবদুল । ডাক্তার বলেছেন দ্রুত সেফ্রাডিন সিরাপের ব্যবস্থা করতে ।

শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে রূপকথা–কে হাসপাতালে নিতে হবে অক্সিজেন দেয়ার জন্য । কর্জের টাকায় ওষুধ না কিনে …!যাওয়ার সময় গলির মোড় পর্যন্ত আবদুলের চিন্তায় ছিল একমাত্র সেফ্রাডিন সিরাপ সঙ্গে প্রেশক্রিপশন ভর্তি ৪/৫টি দামী ওষুধ। এতসব ওষুধ পাওয়া যাবে বড় রাস্তার পাশে ফার্মেসীতে। বড় রাস্তায় পৌঁছা মাত্রই মাছের আড়তের দীনেশের ফোন মুহূর্তে সব উল্টে দিল। ততক্ষণে বুকের ব্যথা বাড়ে, শ্বাসের প্রবাহ প্রবল হয়। সবাই ধরাধরি করে বিছানায় শুইয়ে দেয় । লিপি শার্টের বোতাম খুলে দেয়। আকলিমা বেগম, ছেলেবৌ শরীর ম্যাসাজ করতে থাকে। জীবন–মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আবদুল আবছা আবছা দেখতে পায়, শেষ রাতের জোয়ারে নৌকা ছেড়ে দিচ্ছে। অরুণাংশু, মাহবুব, সিদ্দিক, মৃণাল সহ ২০/২২ জন রওয়ানা দিচ্ছে । ক্রমশ ঢেউ বাড়ছে আছড়ে পড়ছে তীরে সশব্দে । আলো আঁধারের লুকোচুরিতে দুলে দুলে উঠছে নৌকো। আবদুলই সর্বশেষ যাত্রী । তার জন্য অরুণাংশু এতক্ষণ নৌকো আটকে রেখেছে।‘এবার তোকে ফেলে যাবো না । তোকে না নিয়ে আমাদের সংগ্রাম নয় ’ণ্ড অরুণাংশুর দরাজ কণ্ঠ। হাঁফাতে হাঁফাতে আসে আবদুল । আসা মাত্রই নৌকার গুলইয়ে দাঁড়ানো দীর্ঘদেহী অরুণাংশু হ্যাঁচকা টানে তুলে ফেলে। এদিকে পরিবারের একমাত্র উপার্জন ক্ষম সদস্য আবদুল ঘরভর্তি মানুষের রুদ্ধশ্বাস–মুহূর্তকে উপভোগ করে তার এতক্ষণের সঙ্গী ইলিশের মত চির অপলক হয়ে যায়।

(সংগৃহীত)

এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত