বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

ফ্রয়েডের ‘ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিমস’: স্বপ্নে যেভাবে কথা বলে অবচেতন মন

ফ্রয়েডের ‘ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিমস’: স্বপ্নে যেভাবে কথা বলে অবচেতন মন

ঢাকা, ২৪ ডিসেম্বর, এবিনিউজ : ১৮৯৯ সাল। ভিয়েনায় প্রকাশিত হলো একটি বই, দ্য ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিমস। মানুষের মন আসলে কিভাবে কাজ করে, সেটা বোঝার ক্ষেত্রে এক বিপ্লব ঘটিয়ে দিল এই বই। সাইকো-অ্যানালিসিস বা মনোসমীক্ষণের জনক সিগমন্ড ফ্রয়েড বইটির লেখক।

১৯৩৮ সালে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন ফ্রয়েড। সেখানে তিনি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছিলেন তার এই তত্ত্বের বিস্তারিত। ততদিনে সিগমন্ড ফ্রয়েড মনোসমীক্ষণের জনক হিসেবে বিখ্যাত হয়ে গেছেন।

কিন্তু নিজের বইতে যখন প্রথম তিনি এই ধারণা প্রকাশ করেন, সেটি কিন্তু সে রকম সাড়া ফেলতে পারেনি।

বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কাজ শুরু করি একজন নিউরোলজিষ্ট হিসেবে। যারা নানা রকম স্নায়ুরোগে ভুগছে, তাদের চিকিৎসা করতাম আমি। মানুষের অবচেতন মন এবং সহজাত প্রবৃত্তি সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমি জানতে পারি। আমার জানা এসব নতুন তথ্য থেকে বিজ্ঞানের এক নতুন শাখা তৈরি হলো। এর নাম দেয়া হলো সাইকোএনালিসিস। মনোবিজ্ঞানের এক নতুন শাখা।’

সাইকো-এনালিসিস নিয়ে সিগমন্ড ফ্রয়েড তার কাজ শুরু করেন ১৮৯০ সালে। মানবদেহের ক্ষেত্রে চিকিৎসাবিজ্ঞান যে কাজটা করেছে, মানুষের মনোজগত বুঝতে অনেকটা সেরকম একটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি তিনি গড়ে তুলতে চাইছিলেন।

এ বিষয়ে তার প্রথম প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনার নাম ছিল, ট্রাম ড্রইটাং, বা দ্য ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিমস। অর্থাৎ মানুষ ঘুমের মধ্যে যে স্বপ্ন দেখে, তার ব্যাখ্যা। ১৮৯৯ সালের ৪ নভেম্বর ভিয়েনায় বইটি প্রকাশিত হলো।ফ্রয়েডের ‘ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিমস’: স্বপ্নে যেভাবে কথা বলে অবচেতন মন

লন্ডনের গোল্ডস্মিথ কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক এবং মনোবিশ্লেষক যশ কোহেনের মতে, ‘ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিমস’ বইটি সাইকোএনালিসিস বা মনোসমীক্ষণের ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে এখনো।

‘একজন মনোবিশ্লেষক হিসেবে এটাই ফ্রয়েডের লেখা প্রথম বই। সাইকোএনালিসিসের তত্ত্ব এবং এর ব্যবহারিক প্রয়োগের প্রাথমিক ধারণা তিনি এই বইতে তুলে ধরেছেন। তিনি এই বইতে বলছেন, স্বপ্ন হচ্ছে মানুষের অবচেতন মনের গভীরে যাওয়ার বড় রাস্তা। অবচেতন মনে কি ঘটছে, তার প্রতিফলন হচ্ছে স্বপ্ন।’

‘সিগমন্ড ফ্রয়েড খুব দীর্ঘ এবং নিদারুণ যন্ত্রণাময় একটা সময় পার করে এসেছেন তখন। কিভাবে মানুষের ‘কনশাসনেস’ বা ‘চেতনা’ কাজ করে, তার একটা নতুন তত্ত্ব দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি। আমাদের মনোজগতে নিত্যদিন যেসব ঘটে, যেমন ঘুমের মধ্যে আমরা যে স্বপ্ন দেখি, সেগুলো বিশ্লেষণ করছিলেন তিনি। তার মতে, স্বপ্নের মাধ্যমে আমাদের অবচেতন মনই আসলে কথা বলছে আমাদের সঙ্গে। ফ্রয়েডের ধারণা, আমাদের স্বাভাবিক জীবনে যেসব আকাঙ্খা, তাড়না, অনুভূতি, চিন্তা আমরা প্রকাশ করতে পারি না, ঘুমন্ত অবস্থায় স্বপ্নের মাধ্যমে সেসব প্রকাশ পায়।’

তার এই তত্ত্ব প্রমাণের লক্ষ্যে ফ্রয়েড মানুষের স্বপ্ন বিশ্লেষণ করা শুরু করলেন। কিন্তু তার রোগীদের কাছ থেকে যেসব স্বপ্নের বর্ণনা তিনি শুনতেন, সেসব তো ছিল মনোবৈকল্যে ভোগা মানুষের স্বপ্ন। কাজেই এসবকে তো আর গবেষণার উদাহারণ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। তখন তিনি তার বন্ধুদের শরণাপন্ন হলেন। কিন্তু তার বন্ধুরা নিজেদের স্বপ্নের বিশদ বর্ণনা দিতে রাজী হলো না। শেষ পর্যন্ত ফ্রয়েডকে নিজের স্বপ্ন বিশ্লেষণের ওপরই নির্ভর করতে হলো।

এ রকম একটি স্বপ্নের বর্ণনা তিনি তার সাক্ষাৎকারে দিয়েছিলেন।

‘আমার গায়ে ঠিকমত কাপড়চোপড় নেই। নীচতলার ফ্ল্যাট থেকে সিঁড়ি বেয়ে আমি ওপরের ফ্ল্যাটে যাচ্ছিলাম। উপরে উঠার সময় আমি একেকবারে তিনটে করে সিঁড়ির ধাপ টপকাচ্ছিলাম। এত দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পেরে আমি খুবই খুশি। হঠাৎ খেয়াল করলাম, একটা কাজের মেয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে নীচে নামছে, অর্থাৎ আমার দিকে। আমি খুব লজ্জা পেলাম, এবং তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু এরপরই আমার মনে হলো আমি যেন থমকে গেছি, আমি যে আঠার মতো আটকে আছি সিঁড়ির সঙ্গে, সেখান থেকে নড়ার শক্তি আমার নেই।’

যশ কোহেন বলছেন, ‘গল্পে বা বাস্তব জীবনে যখন আমরা স্বপ্নের বর্ণনা দেই, তখন কিন্তু আমরা তার মধ্যে এক ধরণের কৃত্রিম ধারাবাহিকতা তৈরির চেষ্টা করি। কিন্তু ফ্রয়েডের একটা বড় অর্জন হচ্ছে, যেভাবে তিনি এই স্বপ্নকে অবিকল বর্ণনা করেছেন। এটার মধ্যে যে কোন ধারাবাহিকতা নেই, স্বপ্ন যে অসংলগ্ন, এর মধ্যে যে অনেক অপ্রত্যাশিত ব্যাপার আছে, সেগুলো তিনি সততার সঙ্গে তুলে ধরেছেন।’

ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিমস প্রকাশের পর বইটি মোটেই বিক্রি হচ্ছিল না। প্রথম ছয়শো কপি বিক্রি হতে সময় লেগেছিল নয় বছর। ফ্রয়েড যেভাবে বইতে তার স্বপ্নে দেখা যৌনতা এবং সংঘাতকে অবচেতন মনের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখিয়েছেন, সেটা অনেক পাঠক মানতে পারেননি।

সিগমন্ড ফ্রয়েড নিজেও সেটা স্বীকার করেছেন।

‘মানুষ আমার এসব তথ্য বিশ্বাস করছিল না এবং আমার দেয়া তত্ত্ব তাদের কাছে খুবই অরুচিকর মনে হচ্ছিল। সবাই অব্যাহতভাবে এর তীব্র বিরোধিতা করছিল।’

ইভা রোজেনফেল্ড ছিলেন ফ্রয়েডের মেয়ে অ্যানার বন্ধু। পরে তিনি ফ্রয়েডের রোগীও ছিলেন। ১৯৬৯ সালে এভান রোজেনফেল্ড বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘আমার স্বামী যখন প্রথম আমাকে ‘ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিমস’ বইটা পড়তে দিলেন, আমি বইটা পড়তে পড়তে একটা জায়গায় এলাম, যেখানে খুব যৌন উত্তেজক একটা স্বপ্নের বর্ণনা আছে। আমি বইটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম সোফার নীচে। আমি বললাম, আমি কখনই এই বইটা পড়বো না।”

সিগমন্ড ফ্রয়েডকে কাছ থেকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখার বিরল সুযোগ যারা পেয়েছিলেন, ইভা রোজেনফেল্ড ছিলেন তাদের একজন। কেমন লোক ছিলেন ফ্রয়েড?ফ্রয়েডের ‘ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিমস’: স্বপ্নে যেভাবে কথা বলে অবচেতন মন

‘ফ্রয়েড ছিলেন খুব সহজ এবং বিনয়ী একজন মানুষ। কিন্তু যখন তার কাজের প্রসঙ্গ আসত, তখন কিন্তু আর তিনি বিনয়ী থাকতেন না। তার সঙ্গে সাধারণ কথাবার্তার কোন সুযোগ ছিল না। কেউ সাহস করতো না। অন্তত আমি কখনো সেই সাহস করিনি।’

সুইস মনোবিজ্ঞানী কার্ল ইয়াং ছিলেন ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিমসের আরেক পাঠক। তিনি পরবর্তীকালে ফ্রয়েডের ভাবশিষ্যে পরিণত হন। ১৯৫৯ সালে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘১৯০০ সালে আমি ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিমসের কিছু অংশ পড়েছিলাম। কিন্তু সেটা খুবই অল্প। তারপর ১৯০৭ সালে আমি ভিয়েনায় যাওয়ার পর তার সঙ্গে সামনাসামনি সাক্ষাৎ হয়। আমি দিন পনেরো ভিয়েনায় ছিলাম। তখন তার সঙ্গে এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। আমাদের এই আলোচনা বন্ধুত্বে গড়ায়। আমি তাকে পছন্দ করতাম। তবে তিনি জটিল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। আমি খুব শীঘ্রই বুঝতে পারলাম যে তিনি যদি কোন চিন্তায় উপনীত হতেন, সেটাই ছিল চূড়ান্ত, এ নিয়ে আর কোন তর্ক চলত না।’

ইন্টারপ্রিটেনশন অব ড্রিমস বইতে ফ্রয়েড যে তত্ত্বের সূচনা করলেন, তার ওপরই ভিত্তি করেই গড়ে উঠলো আধুনিক সাইকো-এনালিসিস বা মনোসমীক্ষণ। তাঁর এই তত্ত্বকে ঘিরে বিরাট আগ্রহ তৈরি হলো বিংশ শতাব্দীতে। এটি মানুষের মনোজগত অধ্যায়নের জন্য এটি হয়ে উঠলো মূলধারার এক শাস্ত্র।

হঠাৎ করে ফ্রয়েডের সাইকোএনালিসিস চলে এলো সব কিছুতে। সব বই, পত্রিকায়, সিনেমায়, সবকিছুতেই সাইকো-এনালিসিস। বিখ্যাত শিল্পীদের মতো ফ্রয়েড যেন হয়ে উঠলেন আধুনিক মানুষের গুরু।

এবিএন/সাদিক/জসিম/এসএ

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত