বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

ছায়াটি ছড়িয়ে যায় আকাশে

ছায়াটি ছড়িয়ে যায় আকাশে

ইলিয়াস বাবর, ২৪ ডিসেম্বর, এবিনিউজ : ছেলেটা মনে হয় মানুষ হবে না। সবাই ঘোরে ধান্ধার পিছনে আর ও খালি টোটো করে কি সব নিয়ে! একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে মোতালেব মিয়া আকাশের দিকে তাকায়। তিন ছেলে দুই মেয়ের সংসারে তার যত চিন্তা সোহেলকে নিয়ে। বড় দুই ভাই মোটামুটি লাইনে আছে। মেয়ে দুটো স্বামী–সংসার নিয়ে দিব্যি দিনাতিপাত করছে। এখন চিন্তা বলতে কেবল সোহেল। মা–বাবা বুড়িয়ে গেলে বেলাইনে থাকা সন্তান নিয়ে চিন্তা থাকাটাই স্বাভাবিক।

বুড়োবুড়ি যাকে নিয়ে দিনমান ভেবে চলে, যার জন্যেই কপালে স্থায়িত্ব হতে থাকে চিন্তারেখা সেই সোহেল এতসব ভাবাভাবির মধ্যে নাই। সকালে পান্তা কি ভাজি–রুটি মুখে দিয়ে বের হয়ে যায়। লোকে বলে সোহেল নাকি পার্টি করে। পার্টি করলে তো মিটিং–মিছিলে যেতে হয়! মিছিলের বুকে সোহেলকে কেউ দেখেনি কখনো। কখনো সে যায়নি চাঁদা কি মাসোহারা আদায় করতে। রাজনীতি করে অনেকেই টাকা কামায়, সুবিধে নেয়ণ্ড সোহেল কি এসব পেয়েছে কখনো? বয়স চলে যাচ্ছে সে দিকে হিসেব নেই, চাকরি করবে তো! অন্তত বড় কাউকে ধরে নিজের পেটের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার চেষ্টা করে দেখবে না? তা না। স্কুল–কলেজের ছাত্র–ছাত্রীদের বইপড়া, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে আছে সে। তার বয়সের কেউ, তার মতো রেজাল্টধারী কেউ বসে নেই। ও বেকার খাটে বোকা বলে, পাগল বলে। আরে ব্যাটা নিজে বাঁচলে বাপের নাম। পেটে খেলে পিঠে সয়। তিনপুরুষ হাতিয়ে দেখে মোতালেব মিয়া। না। তার বাপ–দাদা–দাদার বাপ কেউই এমন বাউণ্ডুলে ছিল না। সে নিজেও এমন ছিল না। বরং চালাকি করে সমবয়সী এমনকি অনেক সিনিয়র কলিগদের পাশ কাটিয়ে ঠিকই বাগিয়ে নিয়েছিল প্রমোশন। বেড়েছে বেতন। সেই বেতনের টাকায় খেয়ে–পরে বেঁচে থাকা ছেলে কি না এমন হয়! অগত্যা স্ত্রীকে দোষ দেয়। ছেলে তোমারণ্ড পেটে শুদ্ধভাবে ধরতে জানোনি বলেই এই দশা। বাপের গোষ্ঠীর কোন খাসলতই পায়নি সোহেল। সবটাই মায়ের দিকের। তোমার ভাই কাসেমকে দেখলেই তো হয়। মামার মতো উচ্ছন্নে গেল আমার আদরের ছেলেটা। কী যে করি! স্ত্রী জোবাইদা খাতুন ভালো করে চেয়ে নেয় একবার স্বামীর মুখটা। সংসার জীবনের দীর্ঘ তিন যুগেরও বেশি সময় কাটিয়েছে এই মানুষটার সাথে! বিয়ের সময় জোবাইদার বয়স ছিল সবে তের। কিশোরী মানুষটি মোতালেবের সংসারে এসে শিখেছে জীবন কি, জগৎ কি। তার স্পষ্ট মনে আছে, তখনো সে জানতো রান্নাবান্না, কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হবে তাও শিখেনি ঠিকঠাকণ্ড তার বর মোতালেবই শিখিয়ে দিত যাবতীয় সাংসারিক কলা। বেচারা চাকরি করতো শহরে, বউ থাকতো গ্রামে, মা–বাবার সাথে। একমাত্র ছেলের বউকে যদি কেউ শহরে নিয়ে রাখে সুখের লাগি তবে অবস্থাটা না বুঝুক, অনেকেই ব্যাঙ্গাবে। চুদুরবুদুর কথা বলবে। মাসশেষে, বেতনের টাকায় এটা–সেটা নিয়ে বর যখন শহর থেকে আসতো কে দেখে জোবাইদার খুশি! চাপা রাখতো উচ্ছ্বাসটা। রাতেণ্ড ঘুমানোর সময় ফিসিরফুসুর করে বলতো কিছুটা। তখন কি মোবাইল ছিল! গ্রামে কারো ঘরে টিভিই আসেনি তখনো। জীবনসঙ্গীর মুখ থেকে আজ এমন কথা শুনে হতবাক জোবাইদা খাতুন ওরফে হায়দারের মা। নাতি নাতনিতে ভরপুর, মাথার প্রায় সব চুল পাকা হবার পরেও এমন কথা কে শুনতে চায়। কবেই যে স্বামী–স্ত্রীর সম্পর্ক বন্ধু কিংবা ভাই–বোনের মতো হয়ে গেছে! সংসার ছেলেদের উপর এখন, বউমাদের সুখে রাখতে, তাদের দেয়া রুটিনে অভ্যস্ত দুু’জনেই পরস্পরের বোঝাপড়ায় চালিয়ে নিচ্ছে জীবন। পেটখারাপের দায়ে যখন স্বামী দ্বারা দোষী সাব্যস্ত হতে হয় কিছুটা অধৈর্য হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। এত দিনের চেনা চেহারাটায় কে যেন অজান্তেই লেপটে দিয়েছে বিশ্রী কোন রঙ। এমন পৌঢ়তায় কি ছেলেমী সাজে? জোবাইদা খাতুনও খানিকটা জ্বলে উঠেণ্ড এ্যা, আমার পেট খারাপ? আমি শুদ্ধভাবে জন্ম দিতে পারিনি? বলি তুমিই পারোনি সুন্দরভাবে গর্ভে আনতে। তোমার বাবা কী ছিল তা মানুষজন এতোকালেও কেন বলে জানো না? তার ছেলে কেমন আর হবে! আমার জীবনটাই নষ্ট করলাম একটা বাজে মানুষের সাথে। বয়সকালে মানুষ ছোট হয়ে যায় এমন ভাবনা মোতালেবের ভাবনায় আসতেই বুঝতে পারে নিজের ভুল। জিহ্বায় আলতো কামড় দিয়ে অনুশোচনার দৃষ্টিতে নিবিড়ভাবে বউয়ের দিকে তাকায়। বেচারির কী দোষ! সন্তান গর্ভধারণে মায়ের যে ত্যাগ, বড় করে তুলতে মায়ের অবদান বরং বাবার কাজের চেয়ে কঠিন ও দীর্ঘ। তবুও দোষ যদি দিতে হয় আগে নিজের ভাগেই পড়ে। জীবনের মূল্যবান সময়টা তো চাকরি–বাকরি করেই শেষণ্ড কখনো নিতে পারেনি ছেলেদের খবর। মোতালেবের ভেতর আচমকা জেগে উঠে চিন্তাপুঞ্জ, ভেসে উঠে জন্মদাতার মুখ। পূর্বপুরুষের পাপে সে পাপী না হলেও বড় ধরনের সুবিধাভোগী। তার বাবা লিয়াকত আলী বড় চালাক বান্দা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিদের পক্ষ নিয়ে যতসম্ভব হারামি করেছিল স্বজাতির সাথে। লোকে বলে, তার মরহুম পিতাই অজপাড়ায় পাক বাহিনীদের ডেকে এনেছিল। চিনিয়েছিল পথ ঘাট। শুরু করেছিল ধ্বংসযজ্ঞ। সময়ের সাথে সাথে বাড়তে থাকে পাকিদের সাথে তার সখ্যতা। আর ওদিকে বাঙালির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতায় যোগ হতে থাকে অমরাবতীর পালক। ক্রমশ যুথবদ্ধ প্রাণময়তার ভেতর মরতে থাকে পাকিরা। এক গণনায়কের ডাকে বাঙালি অলৌকিক শক্তিতে জেগে উঠে যেন। মোতালেব মিয়ার পিতা, এ দেশীয় কুলঙ্গারদের অনেকেই দৃষ্টির অদূরে দেখতে পায় তাদের নৈতিক পরাজয়। অখণ্ড পেয়ারা পাকিস্তানের মৃত্যুপরোয়ানা যেন নিজেরাই উপভোগ করতে থাকে।

আর কেউ না জানুক মোতালেব জানে তার বাবা লিয়াকত আলী রাজাকার ছিলেন। যুদ্ধের সময় মোতালেবের বয়স কম ছিলণ্ড একেবারেই কম, এই প্রাইমারি পড়ুয়া। বুদ্ধি আর স্মৃতির জোরে একটি দেশের সার্বভৌমত্ব প্রাপ্তির গৌরবতিলক ঝাপসা হলেও একেবারে বিস্মৃত নয়। অথচ যুদ্ধের পর কেমন একটা কায়দায় বাপ তার সেজে যায় মুক্তিযোদ্ধা! রীতিমতো সনদধারী দেশমাতৃকার গর্বিত সন্তান! মরহুম বাপকে সে অস্বীকার করে না, তার জন্মকেও নয়। এখনো বাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে ফাতেহা শরীফের আয়োজন চলে, মিলাদ হয়। সামাজিক মানুষ হিসেবে, রীতি হিসেবে মোতালেব মিয়াকেও মানতে হয় নানা নিয়ম। কিন্তু! বাবার জন্যে মনের কোণে যে ভালোবাসা তাও দেখাতে পারে না বেশি করে। ঘর থেকেই উঠবে প্রতিবাদ! কাকে বিশ্বাস করবে! বাবা যদি চালাকি করে সনদটা না নিতেন আজ ছেলেমেয়ে–সংসার নিয়ে ঠিকে থাকা কি তার হতো? নিশ্চয়ই না। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে সেই সময়েই বাগিয়ে নিয়েছে সরকারি চাকরি। আজ তার বড়ছেলে বন্দরের বড় কর্তাণ্ড তা কেমনে? সার্টিফিকেট হাজার শক্ত হোক, চাকরিটা কি হতো? জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানের পোষ্য হিসেবেই সে পেয়েছে লোভনীয় এ পদ। তার কল্যাণেই আজ তার পাকা বাড়ি, শান–শওকত। কই, কত পয়সায়লা আছে, কেউ কি মোতালেব মিয়ার মতো করে রমজানে যাকাতের শাড়ি–লুঙ্গি দিয়েছে গরীবদুখীদের। বর্তমানের সম্মান দেখলে বাবাকে তার হাজার বার সালাম দিতে ইচ্ছে করে, মসজিদের কবরে যারা মরহুম লিয়াকত আলীকে যারা দাফন করতে দেয়নি তাদের জন্যেও করুণা লাগে। ভিটের এক দিকে উঁচু যে কবরখানা বানানো হয়েছে পারিবারিকভাবে তা সাজিয়েছে মারবেল পাথর দিয়ে। আর কার কবরে এমনটা দিয়েছে দশ গ্রামে! শালারা চিনোস নাই বাপরে, তার পাওয়ার কত্ত। বাইরের লোকদের কী বলবে! তার শেষকালে জন্ম নেয়া ছেলেটাই যত নষ্টের মূল। পেট খারাপ হোক আর যাই হোক ছেলেটাই এখন তার বংশের বড়োদের উদ্বিগ্ন হবার একমাত্র কারণ। মাস্টার্স শেষ করছে ভালো বিষয়ে, কতোবার বলার পরেও তার এক কথাণ্ড না, এরকম রাজাকারের মুক্তিযোদ্ধা সনদ দিয়ে আমি চাকরি নেবো না। বাপের মুখের উপর মরহুম দাদা নিয়ে যখন এমন কথা বললে কে নিরব থাকতে পারে! মোতালেব মিয়া তাও আধুুনিক জমানার ছেলের চরিত্র ধরে নিয়ে সোহেলকে বোঝাতে চায়ণ্ড বাবা, যাই কর না কেন, চাকরি–বাকরি না থাকলে সমাজে কেউ–ই গুণবে না। ছেলের উল্টো জবাবণ্ড যে সমাজ একজন রাজাকারের ছেলেকে বীর মুক্তিযোদ্ধার দাম দেয় সে সমাজে একজন সোহেলের দরকার নাই। এটুক বললেই হতো, এই যে সারাদিন টোটো করে কী নিয়ে! উফ!

পাশের স্কুলণ্ড যেখান থেকে সোহেল এসএসসি পাশে করে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে, তার সময়ে স্কুলসেরা রেজাল্ট করেছিল, তার কিছু ছেলে, উপজেলা সদরের কলেজের ছেলেমেয়ে নিয়ে বের হয়ে যায় সকালে। দিনের প্রায় অর্ধেক সময় চষে বেড়ায় উপজেলার বিভিন্ন প্রান্তরে। ছেলেমেয়েদের বই পড়তে দেয়। পড়তে দেয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। রাজাকারের নৃশংসতা আর বীরদের সাহসের কথা বলে যায় পটাপট। নিজের দাদাকেই পরিচয় দেয় রাজাকার হিসেবে। বলে কিনাণ্ড রাজাকার দেখতেও মানুষের মতোন। মানুষের মতো খায়, ঘুমায় কিন্তু মনটা তার অন্ধকারে ভরা। যে নিজ দেশের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে, সে নিজের মায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে কতক্ষণ! স্কুল কলেজের ছাত্র–ছাত্রীরা তন্ময় হয়ে শোনে সোহেলের কথা। সে এত কথা জানে কীভাবে! সাথে থাকা সহযোদ্ধারা গর্ব করে তাকে নিয়ে। অনেক পড়ে সোহেল ভাই, না পড়লে কেমনে জানবে নিজেকে? এমন প্রশ্ন জুড়ে দেয় দলের কেউ কেউ। উপজেলার আনাচে–কানাচে ছড়িয়ে পড়ে সোহেলদের নাম। কেউ কেউ এসে মোতালেব মিয়াকে বলে এসব খবর। ছেলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শিখাচ্ছে নিজের ধান্ধা না করে এমন খবরে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে যেন। এ্যা, আজ আসুক, দেখাবো ইতিহাস শেখানোর মজা। এমন ভাদাইম্যাগিরি তারে কে দিছে শুনি? কেউ কি তার হাতে তুলে দিছে দুশো টাকার কড়কড়ে নোট। খায় তো আমারই!

বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, ভাষা দিবসে সোহেলদের ব্যস্ততা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। দলে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে উপজেলার বিভিন্ন স্কুলে। রচনা প্রতিযোগিতা, সংগীত–চিত্রকলা প্রতিযোগিতা, কবিতা–ছড়া লেখা প্রতিযোগিতার খাতাপত্র নিয়ে যখন বাসায় ফেরে সোহেল, মা দাঁড়িয়ে থাকে গেইটের পাশেণ্ড উজ্জ্বল চেহারায়। সোহেল জানে, পৃথিবীতে কেউ তাকে ভালো না বাসুক, তার কাজে সমালোচনা করুক, এমনকি উপজেলার বিভিন্ন প্রান্তে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শিখাতে গেছে ছেলেমেয়েদেরণ্ড চেনা মানুষদের কাছ থেকে দুর্ব্যবহার পেলেও মা তাকে সমর্থন দেয়। আঁচলে মুছে নেয় তার দিনান্তের ক্লান্ত ঘাম। মাকে সাথে নিয়ে টুপ করে সোহেল ঢুকে যায় কাচারি ঘরে। এমন সুন্দর দালানের সাথে কাচারি ঘর না মানালেও সোহেল আর স্ত্রীর প্রতিবাদে মোতালেব মিয়া কচুটিও কাটতে পারে না কাচারি ঘরের। জোবাইদা খাতুন ছেলেমেয়েদের পড়ার ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া, সোহেলের বর্তমান ডেরাটিকে গরীব সময়ের স্মৃতি হিসেবেই রাখতে চায় নাতি–নাতনিদের সাথে। মাটির ঘরের সাথে জীবনের সম্পর্ক না থাকলে মানুষ আর মাটির থাকে না, শহুরে হয়ে যায়ণ্ড এমন কথার সামনে মোতালেব মিয়া তেমন আর প্রতিরোধের ভাষা খুঁজে পায় না। কিন্তু বর্তমানে সোহেলের কাচারিকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডে পিতা হিসেবে তিনি বিরক্ত। রাত নেই, দিন নেইণ্ড ছেলেমেয়েরা আসে, মিটিং হয়। এখান থেকেই হয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শিক্ষার পরিকল্পনা।

সোহেল যতক্ষণ ঘরে থাকে, কাচারিতেই থাকে। ভাত–নাস্তা মা দিয়ে যায় এখানেই। তখন মা–পুত্রে কথা হয়। মা পুত্রের মুখের দিকে তাকায়, কিছু বলতে চেষ্টা করে। তবুও কেমন করে যেন থমকে যায় জোবাইদা খাতুন। হাজার হোক পেটে ধরা ছেলেকে তো সে চিনে। সোহেল মায়ের ভাব বুঝতে পেরে নিজ থেকেই বলেণ্ড মা, টেনশন করো না, চাকরি আমার হবে। আর কিছু দিন শুধু। উপজেলার প্রায় জায়গাই শেষ। একটা পর্বের ছেলেমেয়েদের যদি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটা শিখিয়ে দিতে পারি তারাই পরবর্তীদের শেখাবে। তখন আমার দায়িত্ব শেষ হবে, চাকরি করবো, তোমাদের সুখে রাখবো। জানি, বাবা আমার কাজে বিরক্ত তবুও করার কিছু নেই। বলো মা, যদি দেশের জন্মের ইতিহাসই একটা প্রজন্মকে শেখাতে না পারি তবে আমরা মানুষ হিসেবে ব্যর্থ না? কে মুক্তিযোদ্ধা, কে রাজাকার তা চেনানোর দায়িত্ব আমাদের। মা, দশজনের হয়ে যদি তোমার ছেলে বড়ো একটা দায়িত্ব কাঁধে নেয় তুমি খুশি না? জোবাইদা খাতুন কিছু বলে না। চোখ তার গর্বে ছলছল করে। অনেক কিছু বলতে গিয়েও মুখ দিয়ে আসে না কিছুই।

কিছু দিবস আসলেই বেড়ে যায় সোহেলদের ব্যস্ততা। কাচারি ঘরে চলে আড্ডা, চলে করণীয় ঠিক করার কাজ। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধের গল্প পাঠের প্রতিযোগিতার খাতাপত্র নিরীক্ষণে ব্যস্ত সবাই। মাঝেমাঝে উঁকি দেয় জোবাইদা খাতুন। চা–মুড়ি–চনাচুর–বিস্কুটে চলে নাস্তাপর্ব। প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। মোতালেব মিয়া হয়তো বাজার কি পাড়ার দোকানের দিকে যাবে। বড়ঘর পেরিয়ে কাচারি ঘরের কাছাকাছি আসতেই শুনতে পায় সোহেলদের কলকলানি।

বুঝছো, এবার কিন্তু ছেলেরা দারুন গল্প লিখেছে। সোহেলের স্বর।

আমাদের শ্রম বৃথা যায়নি দাদা। এক অপরিচিত ছেলের স্বর।

সেটা সম্ভব হয়েছে তোমাদের সবার কল্যাণে। সোহেলের উচ্ছ্বাস।

আমাদের প্রজন্ম কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে পড়ে, জানে, লেখে… মুক্তিযোদ্ধা কারা, রাজাকার কারা; কারা চেতনা ফেরী তাও জানে কিন্তু…

এ্যা, মোতালেবের ঘরে বসে তারই রক্তের ছেলে এমন কথা বলে! নিজের কানকেই অবিশ্বাস লাগে তার। কেমন ছেলে এ? নিজের দাদাকে রাজাকার বানাতে তার লজ্জা করে না? ইতিহাস শেখায়, আজ রাতেই খতম করবো তোর ইতিহাস… মনে মনে গজরাতে গজরাতে গেইট পার হয়ে যায় মোতালেব মিয়া।

মায়ের ফোনকল পেয়ে এক প্রকার অবাকই হয় সোহেল। ঘড়িতে সময় দেখে। বাজে রাতের এগারোটা। শীতের রাতে গ্রামের মানুষ তেমন জেগে নেই। চারদিকে নিরবতা। কুয়াশার চাদর ভেদ করে কেবলি জেগে আছে কিছু তরুণের উদ্যমী স্বর। তারা ব্যস্ত আগামীকালের প্রোগ্রাম সূচি নিয়ে। জনকের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস বলে কথা। সেভাবেই তৈরি করা আছে সব। রাজু ভাইয়ের বাসায় একটু শলাপরামর্শ এই যা। এমন সময়ে মায়ের ফোন। মা তো জানে, সোহেল ঘরে ফিরে ঘুমাবে, একটু রাত হবে। ততক্ষণে বড়ঘরে বিরাজ করবে কবরের নিস্তব্ধতা। মা যত্ন করে গরম–বাটিতে তার জন্যে কাছারিঘরে রেখে দেবে ভাত–তরকারি। কেন মায়ের ফোন? রিসিভড করতেইণ্ড

বাপ আমার কই? এখনই ঘরে আয়, তোর বাপ কাছারি ঘরে আগুন দিচে লোকজন নিয়ে…

সোহেল এসে দেখে দাউ দাউ করে জ্বলছে কাছারিঘর। এতক্ষণে পুড়ে ছাঁই হয়ে গেছে প্রতিযোগীতার খাতা, আগামীকালের পুরস্কার, ব্যানার, ফেস্টুন ইত্যাদি। এসব যাক, কিন্তু দেয়ালে টাঙানো জনকের বড় ছবিটা! ভাবতেই মন তার শিরশির করে ঘৃণায়। মোতালেব মিয়ার কিলকিল বিশ্রী হাসি ছড়িয়ে পড়ে আগুনের ধোঁয়ায়। সেখানে সোহেল স্পষ্ট দেখতে পায় পটুয়ার আঁকা বিখ্যাত সেই পোস্টারের মুখ!

আগুনের খেলা শেষ হলে সোহেল নিস্পৃহ হাঁটতে হাঁটতে যায় সামনের দিকে। গেইট পার করে এক দলা থুথু মনের অজান্তেই ছড়িয়ে দেয় গেইটের ভেতরে। সোহেলের ছায়াটি ক্রমশ নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে থাকে ঘরবাড়ি আর গেইটের কাছ থেকে…

(সংগৃহীত)

এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত