![মুক্তিযুদ্ধে কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2017/12/27/poet_117257.jpg)
রেজাউল করিম, ২৭ ডিসেম্বর, এবিনিউজ : বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে। মাতৃভূমি রক্ষায় লড়াই করা বিরাট গৌরবের ব্যাপার। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলার আপামর জনতার অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে সেই গৌরব অর্জনের সুবর্ণ সুযোগ হয়েছিল হাজার হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার। এই গৌরব অর্জনের এক বড় অংশীদার হচ্ছে বিদেশিরা। তাদের একান্ত সহযোগিতায় যুদ্ধ জয় ত্বরান্বিত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বাঙালিদের পাশাপাশি কিছু মানুষ ছিলেন যারা এই দেশের না হয়েও মানবতার টানে এই গৌরবময় জয়ে রেখে গেছেন অসামান্য অবদান। তাই স্বাধীনতা অর্জনে বিদেশিদের অবদান কোনোদিন ভোলার নয়। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিনই সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে তাদের কথা। বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা সংগ্রামে শুরু থেকেই বহির্বিশ্বের নাগরিকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণ ছিল। নিরস্ত্র বাংলাদেশিদের হত্যা, নির্যাতন এবং একপেশে যুদ্ধের খবর কেউ পৌঁছে দিয়েছিলেন কলম হাতে, কেউ ক্যামেরা হাতে। বিশ্ববাসীকে জানান দিয়েছিলেন নিজের কবিতায়, কেউবা গান গেয়ে। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশিদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছিলেন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ। অথচ তাঁর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ছিল ঠিক বিপরীতে। পণ্ডিত রবিশঙ্করের অনুরোধে জর্জ হ্যারিসন বাংলাদেশের পক্ষে উদ্যোগী ভূমিকা রাখেন, আয়োজন করেন কনসার্ট ফর বাংলাদেশের। এই আয়োজনটি হয় যুক্তরাষ্ট্রে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আলোড়ন তুলেছিল কবি ও কাব্য। সেই কবির নাম অ্যালেন গিন্সবার্গ। তিনি একজন মার্কিন কবি। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ওপর তিনি লিখেছিলেন একটি দীর্ঘ কবিতা। কবিতাটির নাম ছিল- ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। তার কবিতাটি ছুঁয়ে যায় হাজারও মানুষের হৃদয়। নিপীড়িত মানুষের হাহাকার মেশানো, যুদ্ধের বাস্তবচিত্র কবিতার অক্ষরে অক্ষরে জানান দিয়ে যায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্য। তার কবিতা শুনে ও পড়ে অশ্রুসজল হয়ে পড়েন হাজারও মানুষ। বাংলাদেশের পক্ষে একাত্ম হয়ে ওঠেন বিশ্বের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অগণিত সাহিত্যপ্রেমিক। তার কবিতাটির কয়েকটি লাইন এখনো অনেকের মুখে মুখে চলে আসে। ‘মিলিয়নস অব সোলস নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান, হোমলেস অন যশোর রোড আন্ডার গ্রে সান, আ মিলিয়ন আর ডেড, দ্য মিলিয়নস হু ক্যান, ওয়াক টুওয়ার্ড ক্যালকাটা ফ্রম ইস্ট পাকিস্তান’। কবিতার ইস্ট পাকিস্তান বা পূর্ব পাকিস্তানই হলো বর্তমান বাংলাদেশ। তার এ কবিতার সূত্র ধরেই বিখ্যাত বাঙালি গায়িকা মৌসুমী ভৌমিক কবিতাটির কিছু অংশ বাংলায় অনুবাদ করে তৈরি করেছেন তার ‘যশোর রোড’ গানটি।
‘শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত শত মানুষের দল/ যশোর রোডের দুধারে বসত বাঁশের ছাউনি কাদামাটি জল/ কাদামাটি মাখা মানুষের দল, গাদাগাদি করে আকাশটা দেখে/ আকাশে বসত মরা ঈশ্বর, নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে/ ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে, যুদ্ধে ছিন্ন ঘর বাড়ি দেশ/ মাথার ভিতরে বোমারু বিমান, এই কালোরাত কবে হবে শেষ/ শত শত মুখ হায় একাত্তর যশোর রোড যে কত কথা বলে/ এত মরা মুখ আধমরা পায়ে পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে/ সময় চলেছে রাজপথ ধরে যশোর রোডেতে মানুষ মিছিল/ সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর, গরু গাড়ি কাদা রাস্তা পিছিল/ লক্ষ মানুষ ভাত চেয়ে মরে, লক্ষ মানুষ শোকে ভেসে যায়/ ঘরহীন ভাসে শত শত লোক লক্ষ জননী পাগলের প্রায়/ রিফিউজি ঘরে খিদে পাওয়া শিশু, পেটগুলো সব ফুলে ফেঁপে ওঠে/ এইটুকু শিশু এতবড় চোখ দিশেহারা মা কারকাছে ছোটে/ সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর, এত এত শুধু মানুষের মুখ/ যুদ্ধ মৃত্যু তবুও স্বপ্ন ফসলের মাঠ ফেলে আসা সুখ/ কারকাছে বলি ভাতরুটি কথা, কাকে বলি করো, করো করো ত্রাণ/ কাকে বলি, ওগো মৃত্যু থামাও, মরে যাওয়া বুকে এনে দাও প্রাণ/ কাঁদো কাঁদো তুমি মানুষের দল তোমার শরীর ক্ষত দিয়ে ঢাকা/ জননীর কোলে আধপেটা শিশু একেমন বাঁচা, বেঁচে মরে থাকা/ ছোটো ছোটো তুমি মানুষের দল, তোমার ঘরেও মৃত্যুর ছায়া/ গুলিতে ছিন্ন দেহ মন মাটি, ঘর ছেড়ে ছোতো মাটি মিছে মায়া/ সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর, ঘর ভেঙে গেছে যুদ্ধের ঝড়ে/ যশোর রোডের দুধারে মানুষ এত এত লোক শুধু কেনো মরে/ শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত শত শিশু মরে গেল/ যশোর রোডের যুদ্ধ ক্ষেত্রে ছেঁড়া সংসার সব এলোমেলো কাদামাটি মাখা মানুষের দল, গাদাগাদি করে আকাশটা দেখে/ আকাশে বসত মরা ঈশ্বর, নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে/ ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে, যুদ্ধে ছিন্ন ঘর বাড়ি দেশ/ মাথার ভিতরে বোমারু বিমান, এই কালোরাত কবে হবে শেষ/ শত শত মুখ হায় একাত্তর যশোর রোড যে কত কথা বলে/ এত মরা মুখ আধমরা পায়ে পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে/ এত মরা মুখ আধমরা পায়ে পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে’। ( সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড)।
আরউইন অ্যালেন গিন্সবার্গের জন্ম ১৯২৬ সালের ৩ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সির নেওয়ার্কে। তিনি একাধারে কবি, লেখক, গীতিকার, যিনি ১৯৫০-এর দশকের বিট প্রজন্ম এবং বিপরীত সংস্কৃতি আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। তিনি সামরিকতন্ত্র, অর্থনৈতিক বস্তুবাদ এবং নিপীড়ন বিষয়ের তীব্র বিরোধিতা করেন। শুরুতে গিন্সবার্গ তার ‘হাউল’ (১৯৫৬) মহাকাব্যের জন্য সর্বাধিক পরিচিত হন, যেখানে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদের ধ্বংসাত্মক শক্তিকে নিন্দা করেন। এই কবিতাটি লিখেছিলেন তার বিট প্রজন্মের বন্ধুদের বরণ করে নিয়ে এবং বস্তুবাদের ধ্বংসাত্মক শক্তিকে আক্রমণ করে। গিন্সবার্গ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশী শরণার্থী শিবিরগুলোতে ঘুরে বেরিয়েছিলেন। এসময় যশোরের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি কবিতা লিখেন যার নাম সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড। যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে তার বন্ধু বব ডিলান ও অন্যদের সহায়তায় এই কবিতাটিকে তিনি গানে রূপ দিয়েছিলেন। কনসার্টে এই গান গেয়ে তারা বাংলাদেশী শরণার্থীদের সহায়তার জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন।
গিন্সবার্গ নিউ জার্সিও প্যাটারসন এলাকায় বেড়ে ওঠেন। ১৯৪৩ সালে তিনি ইস্টসাইড হাই স্কুল থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরবতীর্তে মন্টক্লেয়ার কলেজে কিছুদিন অধ্যয়নের পর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৪৫ সালে তিনি পড়ালেখার খরচ চালাতে চাকুরি করতে বাধ্য হন। তিনি সেসময় কলম্বিয়া থেকে প্রকাশিত জেস্টার হিউমার ম্যাগাজিনে কিছুদিন কাজ করেন এবং ফিলোলেক্সান সোসাইটির সভাপতি নির্বাচিত হন। অ্যালেন গিন্সবার্গের কিছু কর্মকাণ্ড বেশ বিতর্কিত। তবে তাঁর সৎসাহস বিশ্ববাসী প্রত্য করেছে।
অ্যালেন গিন্সবার্গ ভারতবর্ষে থাকাকালীন সর্বাধিক সময় কাটিয়েছিলেন কলকাতায়, ১৯৬২-১৯৬৩ সালে পশ্চিমবাংলার কবিদের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন । তাঁর সঙ্গে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও মলয় রায় চৌধুরীর হৃদ্যটা গড়ে ওঠে এবং তিনি আমেরিকায় ফিরে গিয়ে হাংরি আন্দোলনের কবিদের রচনা সেখানকার প্রখ্যাত পত্রিকাগুলিতে প্রকাশের ব্যবস্থা করেছিলেন । অ্যালেন গিন্সবার্গেও বিখ্যাত কবিতা ‘হাউল’ এবং ‘ক্যাডিশ’ বাংলায় অনুবাদ করেছেন মলয় রায় চৌধুরী। ১৯৭৪ সালে তিনি ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। ১৯৯৭ সালের ৫ এপ্রিল বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু নিউইয়র্কে পরলোক গমন করেন।
(সংগৃহীত)
এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি