![শয়তানের ছবি](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2017/12/27/shaitan_117315.jpg)
মিলন বণিক, ২৭ ডিসেম্বর, এবিনিউজ : তুলির কচি মনে অনেকগুলো ভাবনা।
সব এলোমেলো ঘুরপাক খাচ্ছে। কোনো সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। কী করবে? কোনটা করলে ভালো হবে? বুঝতে পারছে না। বাবাকে বলেছে। বাবা সোজা বলে দিয়েছে, আমার তুলি মা-মনি যা করবে সেটাই ফাইনাল। সেটাই ঠিক। তুমি তোমার মতো করে প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করবে। তোমার অংশগ্রহণটায় বড় কথা। পুরষ্কার বড় বিষয় নয়।
মাকে জিজ্ঞাসা করেছে। মা জানতে চাইলো-
– কোন কোন বিষয়ে প্রতিযোগিতা হবে?
– চিত্রাঙ্কন, নাচ, গান, আবৃতি, খেলাধুলা আরো কত কী! তবে একজন সর্বোচ্চ দুইটা বিষয়ে অংশগ্রহণ করতে পারবে।
– তাহলে তুমি নাচ আর চিত্রাঙ্কনে নাম দিতে পারো।
– তা তো বুঝলাম। ছবি আঁকাটা আমার প্রিয় সখ। কিন্তু কোন ছবিটা আঁকবো, তাই তো ভেবে পাচ্ছি না।
– যেহেতু স্কুলে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান, মুক্তিযুদ্ধের ছবি আঁকলে ভালো। মা পরামর্শ দিলো।
মায়ের কথাটা তুলির মনে ধরেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের কোন ছবিটা আঁকবে? তাই নিয়ে ভাবনার শেষ নেই। তুলির দাদু শরাফত আলী একজন মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে তিনি শহিদ হয়েছেন। তার একটা ছবি আছে। দিদার কাছে দাদুর অনেক গল্পও শুনেছে। কিন্তু আফসোস। এমন মুক্তিযোদ্ধা দাদুকে তুলি দেখলো না। তাই একেবারে চিন্তা ফাইনাল। ছবি যখন আঁকবে, দাদুর ছবিটাই আঁকবে।
নাচের ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি ভাবছে না। যে ক’টা নাচ প্র্যাকটিস করা আছে ওখান থেকে যে কোনো একটা পারফর্ম করা যাবে। সবচাইতে ভালো লাগে ‘পূর্ব দিগন্তে সুর্য উঠেছে, রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল। জোয়ার এসেছে গণসমুদ্রে রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল——-’। গানটির সাথে তুলি ভালোই নাচতে পারে। প্রাইমারি স্কুলে তুলি পুরস্কারও পেয়েছিলো। মাও তাই বলেছে। এই গানের সাথে তোর প্রেজেন্টেশনটা খুব মানায়। একেবারে মন-প্রাণ ঢেলে দিয়ে চেষ্টা করিস। ভালো হবে।
– আচ্ছা ঠিক আছে, বলে পড়ার ঘরে চলে গেলো তুলি।
পড়ায় মন বসছে না। আর মাত্র ক’দিন পর স্কুলের প্রোগ্রাম। দেশের খ্যাতনামা চিত্রকরেরা আসবেন বিচারক হয়ে। তাঁদের মধ্যে শিল্পী হাশেম খান থাকবেন প্রধান বিচারক। এ কী চাট্টিখানি কথা! বিকেলের অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন মাননীয় সংস্কৃতি মন্ত্রী। প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মধ্যে তিনি নিজ হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন।
তুলি এখনও সিদ্ধন্তি নিতে পারছে না কোন ছবিটা আঁকবে। আগে ভাগে প্রস্তুতি নিয়ে না রাখলে এতগুলো ুদে আঁকিয়েদের সামনে লজ্জা পেতে হবে। পড়া শেষ করে বাবার বুক সেলপ-এর দিকে গেলো তুলি। সেলপ জুড়ে বই আর বই। মুক্তিযুদ্ধের অনেকগুলো বই আলাদা তাকে সারি সারি করে রাখা। ছবিও আছে। বেশিরভাগ ছবিই পাকহানাদারদের নির্মম নির্যাতনের ছবি। লাশের পর লাশ। বেয়নেটের খোঁচায় রক্তাক্ত মৃতদেহ। এসব দেখতে দেখতে ভয়ে, শিহরণে তুলির চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে আসে। ঝাপসা হয়ে আসে ছবিগুলো। একসময় ছবিগুলোর মাঝে সে তার নিজের দাদুকে খুঁজে পায়।
বাবার কাছে শুনেছে, দাদুকে ঘর থেকে ১৪ ডিসেম্বর রাতে পাকহানাদারেরা চোখ বেঁধে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে দাদু আর ফিরে আসেনি। অসংখ্য ক্ষত বিক্ষত লাশের পাহাড় থেকে দাদুর লাশটাকে আলাদা করে চেনার কোনো উপায় ছিলো না। শুধু দাদুর গায়ের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন সবুজ ফতোয়া দেখে দাদি লাশ চিনতে পেরেছিলো। সেই সবুজ ফতোয়া আর লুঙ্গি পরা অবস্থায় দাদুকে ওরা ধরে নিয়ে গিয়েছিলো।
তুলির বুক ফেটে কান্না আসছে। দাদুর ও দেশের অগনিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। মানুষের জন্য। তুলির খুব কস্ট হচ্ছে। ভাবছে, যারা শহিদ হয়েছেন, তাদের নিশ্চয় তুলির মতো কারও মেয়ে, কারও নাতনি, কিংবা কারও বোন আছে। ওরাও তুলির মতো কস্ট পাচ্ছে। কাঁদছে। তুলির খুব ইচ্ছা করছে, দাদু বেঁচে থাকলে ঠিকই জেনে নিতে পারতো। দাদু তো মুক্তিযোদ্ধা। সবার চেয়ে ভালো বলতে পারতো। একবার ভাবলো, বন্দুক হাতে দাদুর ছবিটা প্রতিযোগিতায় আঁকলে কেমন হয়? দাদুর এরকম একটা বড় ছবিও ঘরের দেয়ালে টাঙানো আছে।
এদিকে মা ডাকছে খাবার টেবিলে। শীত শীত লাগছে। মা ভূনাখিচুড়ি রান্না করেছে। খিচুড়ির সুন্দর গন্ধ আসছে। তুলির খুব প্রিয় ভূনাখিচুড়ি। কিন্তু আজ খেতে ইচ্ছে করছে না। আর মাত্র দুটো দিন। এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। অনিচ্ছ্বা স্বত্বেও খাবার টেবিলে বসে ভাবছে কি করা যায়? মেয়ের মুখ দেখে বাবার কিছুই বুঝতে বাকি থাকলো না। জিজ্ঞাসা করলো,
– কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারলি?
তুলি চুপ। কোনো কথা বলছে না। শুধু মাথা নেড়ে না বোধক উত্তর দিলো। বাবা মাথায় হাত রেখে বললো,
– কিচ্ছু ভাবিস না। খিচুড়িটা ভালো হয়েছে। আগে খেয়ে নে। তারপর আমি দেখছি কী করা যায়। আমি জানি আমার মেয়ে যেটা আঁকবে, সেটাই ফার্স্ট হবে।
তুলি কিছু বলছে না। খুব কান্না পাচ্ছে। বার বার নির্মম নৃশংস নির্যাতনের ছবিগুলো তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ত্রিশ ল মানুষকে মারলো এভাবে। একজন দুইজন নয়। ত্রিশ লক্ষ! কোনো কোনো দেশে ত্রিশ লক্ষ মানুষও নেই। তুলি হিসাব মেলাতে পারছে না। মাত্র নয় মাসে একটি দেশের ত্রিশ লক্ষ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এরা কি মানুষ না হিংস্র জানোয়ার? রক্তখেকো জানোয়ারের চেয়েও হিংস্র ওরা। ভাত খাওয়ার পর ড্রইং রুমে বাবার পাশে বসে এই প্রশ্নটা করেছিলো তুলি।
বাবা উঠে গিয়ে বুক সেল্প থেকে একটি বই হাতে নিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের তথ্য ও দলিল। ছবি সংবলিত বইটি তুলির হাতে দিয়ে বললো,
– দেখতো এই বইটা। অনেকগুলো ছবি আছে। আইডিয়া নিয়ে তোর মতো করে আঁকলেই হবে।
বাবার সাহায্য পেয়ে তুলি খুশি হলো। বইটা উল্টেপাল্টে ছবিগুলো দেখছে। এখানেও সব ছবিগুলো নির্মমতার স্বাক্ষ্য দিচ্ছে। ঘর পালানোর ছবি, পোড়াবাড়ি, শুন্য ভিটেমাটির ছবি, শকুনে ছিড়ে খাওয়া মানুষের লাশের ছবি। বন্দুক হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি।
আবারো বইটা নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে গেলো তুলি। আবারো দেখছে। একটা চবির দিকে দিকে বার বার চোখ আটকে যাচ্ছে। মানুষ খেকো হিংস্র হায়েনার মতো ছবিটা। পটুয়া কামরুল হাসানের আঁকা ছবি। দু’পাশে হায়েনার মতো দু’টো দাঁত। দেখতে মানুষের মতো। কিন্তু মানুষ নয়। মানুষরূপী জানোয়ার। এই ছবিটা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের। তার নির্দেশেই ত্রিশ লক্ষ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তার হিংস্র দু’টো দাঁতের সাথে লাল রক্ত লেগে আছে। সেই রক্তের সাথে তুলির দাদুর রক্তও মিশে আছে।
তুলি সেই ছবিটাই সারারাত জেগে বার বার আঁকার চেষ্টা করেছে। যতবার চেষ্টা করেছে ততবার ঘৃণাভরে ছবিটার ওপর লাল কালি দিয়ে ক্রস চিহ্ন এঁকে দিয়েছে। ঘৃণায় একবার ছবিটার উপর থুথু ছিটিয়ে দিলো।
অনুষ্ঠানের দিন প্রধান অতিথির হাত থেকে প্রথম পুরস্কার নেওয়ার যখন ঘোষনা এলো, তুলি বিশ্বাস করতে পারছিলো না। তুলির বাবা মাও বিস্ময়ে হতবাক। তুলি খুব ঘৃণাভরে ছবিটা এঁকে তার নিচে ক্যাপশান দিলো ‘শয়তানের ছবি’।
বিখ্যাত চিত্রশিল্পী হাশেম খান শয়তানের ছবিটা সকলকে দেখিয়ে বললো, তুলির আঁকা এই শয়তানের ছবিটা সবাই চিনে রাখুন। এদের মা নেই।
(সংগৃহীত)
এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি