বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo
  • হোম
  • মুক্ত মতামত
  • বিজয়ের মাসের ভাবনা: বিএনপি কি পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রেতাত্মা?

বিজয়ের মাসের ভাবনা: বিএনপি কি পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রেতাত্মা?

বিজয়ের মাসের ভাবনা: বিএনপি কি পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রেতাত্মা?

ড. মইনুল ইসলাম, ২৮ ডিসেম্বর, এবিনিউজ : গত ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখ রাতে টেলিভিশনের খবরে দেখলাম, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবাইদুল কাদের বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উদ্দেশ্যে সাবধানবাণী উচ্চারণ করছেন, ‘বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানের ধারায় ফিরিয়ে নিতে চাইলে আপনার মনোবাঞ্ছা আর কখনোই পূরণ হবে না’। এ মন্তব্য দেশের রাজনৈতিক বিভাজনের মূল ইস্যুটিকে জনগণের স্মৃতিতে পুনর্জাগরুক করার উদ্দেশ্যেই নিবেদিত। কারণ, বাংলাদেশের রাজনীতির যে ট্র্যাজিক ডাইমেনশনটা পুরো জাতিকে বিভাজনের অন্ধগলিতে প্রবিষ্ট করেছে তাহলো সমরপ্রভু জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর অবৈধভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতাদখলের পর তাঁর পাঁচ বছর সাত মাস তেইশ দিন মেয়াদের অসাংবিধানিক শাসনামলে দেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত যাবতীয় চেতনা ও সাফল্যকে বিসর্জন দিয়ে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে দেশটাকে আবার পাকিস্তানে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে পরিচালিত তাঁর প্রাণপণ প্রয়াস। অথচ, তিনি ছিলেন ‘বীর উত্তম’ খেতাবপ্রাপ্ত দেশের একজন নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৭১ সালের ২৬মার্চ থেকে ২৮ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণাকারীদের অন্যতম ঘোষক, যিনি ২৬ মার্চ দুপুরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার প্রথমপাঠক এম এ হান্নানের পর ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেছিলেন। (২৬ মার্চ সন্ধ্যায় আবুল কাশেম সন্দ্বীপ বঙ্গবন্ধুর ঐ ঘোষণাআরো দু’বার পাঠ করেছিলেন। অতএব, জিয়া আসলে স্বাধীনতার তৃতীয় ঘোষক।) ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়ার মৃত্যুর পর সাড়ে ছত্রিশ বছর অতিক্রান্ত হলেও তাঁর সৃষ্ট রাজনৈতিক দল বিএনপি সোৎসাহে এখনো এই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী চিন্তাধারা এবং কর্মকান্ড অব্যাহত রাখার মাধ্যমে এটাই প্রমাণ করে চলেছে, জিয়াউর রহমান মনেপ্রাণে যে পাকিস্তানী ভাবধারার অনুসারী ছিলেন তা থেকে তাঁর স্ত্রী–পুত্র বিচ্যুত হতে রাজী নন। বরং, জিয়াউর রহমানের জীবদ্দশায় তিনি বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি আক্রমণ না করার যে নীতি অনুসরণ করে গেছেন এখন তাঁর স্ত্রী ও পুত্র ঐ ভব্যতা বজায় রাখারও কোন প্রয়োজন বোধ করছেন না। ফলে, বিএনপি’র অনেক নেতা এখন বেগম জিয়া এবং তারেক রহমানকে খুশী করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর অহেতুক চরিত্রহননের উদ্দেশ্যে বেলাগাম কথাবার্তার তুবড়ি ফোটাতে উৎসাহিত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে প্রায়ই।

এ–পর্যায়ে ইতিহাস পর্যালোচনা হিসেবে বলছি,১৭৫৭ সালে একবার, ১৯৪৭ সালে আরেকবার ঔপনিবেশিক দখলদারির জিঞ্জিরে আবদ্ধ হয়ে শোষণ, লুণ্ঠন, বঞ্চনা ও সর্বোপরি অমানবিক হত্যাযজ্ঞের লীলাক্ষেত্র হয়েছে এদেশ। আবার, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের পথ বেয়ে এবং দু’লাখ মা–বোনের ইজ্জতের মূল্য চুকিয়ে মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে এ–জাতি প্রতিষ্ঠা করেছে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্র। এই জাতির স্বাধীনতার সংগ্রামের সঠিক ইতিহাস ১৯৫২ এর ভাষা সংগ্রাম, ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী বিজয়, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফার সংগ্রাম, ১৯৬৯ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা–বিরোধী গণ–অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মার্চের অসহযোগ আন্দোলনকে ধারণ করতেই হবে। এই সংগ্রামগুলোর ধারাবাহিকতায় জাতিকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে জাতিকে বিজয়ের বন্দরে পৌঁছে দিয়েছিলেন জনাব তাজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন মুজিবনগর সরকারের জাতীয় নেতৃবৃন্দ এবং মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারবৃন্দ ও লাখো মুক্তিযোদ্ধা। অতএব, ভাষা সংগ্রাম, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামকে অবমূল্যায়ন করে মুক্তিযুদ্ধকে হঠাৎ শুরু হওয়া ‘স্বাধীনতাযুদ্ধ’ অভিহিত করা সম্পর্কিত বিএনপি’র বিকৃত ও মিথ্যা ইতিহাসের বেসাতিকে ’ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে’ নিক্ষিপ্ত করার প্রয়োজনে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধকে এই সঠিক পদ্ধতিতে বিবেচনা করতেই হবে। বিএনপি’র ভাষ্যমতে জিয়ার ঘোষণার মাধ্যমে নাকি ‘স্বাধীনতাযুদ্ধ’ শুরু হয়েছিল, ওটাই নাকি একমাত্র সত্য, ওরা ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দটি উচ্চারণই করতে নারাজ। বিএনপি দাবি করেই চলেছে, বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার আগে কোন স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যাননি। এর ফলে জনগণবিভ্রান্তির কবলে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল, যেখান থেকে জিয়ার ঘোষণা নাকি জাতিকে পথ দেখিয়েছিল। তাদের কাছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের কোন গুরুত্ব নেই, তারা ঐ ভাষণ ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত রেডিও–টেলিভিশনে বাজানো পর্যন্ত নিষিদ্ধ রেখেছিল। সম্প্রতি জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক ঐ ভাষণকে মানবজাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ঘোষণা তাদের এহেন ধৃষ্ঠতার প্রতি চরম চপেটাঘাত। আমরা জানি, আওয়ামী লীগের নেমেসিস হিসেবেই ১৯৭৮ সালে বিএনপি’র জন্ম দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। কিন্তু, বাংলাদেশে রাজনীতি করব অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামকে অস্বীকার করব কিংবা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করব, এই অধিকার তো বিএনপি’র থাকতেই পারে না। আমি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কর্ণধারদেরকে প্রশ্ন করতে চাই, পরাজিত পাকিস্তানের ভূত কাঁধে নিয়ে আর কতদিন বিএনপিকে বাংলাদেশে রাজনীতি করতে দেয়া হবে? বিএনপি যদি পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রেতাত্মা না হতো তাহলে তারা স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন–সংগ্রামের পথ বেয়ে ধাপে ধাপে জাতির স্বাধীনতার সংগ্রামে উত্তরণের ইতিহাসকে এভাবে অবমূল্যায়ন করতে পারতো না। বিএনপি ১৯৬৬ সালের ছয় দফার কথা উচ্চারণও করে না, ৭ জুনের ছয় দফা দিবসও পালন করে না। ১৯৬৯ সালের গণ–অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন, ১৯৭১ সালের মার্চের অসহযোগ আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণা—এগুলোর কোন ঐতিহাসিক গুরুত্ব নেই বিএনপি’র রাজনীতিবিদদের কাছে? তখন তো বিএনপি’র জন্মই হয়নি, কী যুক্তিতে তারা এই ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোকে অস্বীকার করছে? তাহলে তো এটা একটা স্বাধীন দেশেরমাটিতে সন্দেহাতীতভাবে স্বাধীনতা–বিরোধী রাজনীতি হয়ে গেলো! ‘পাকিস্তান মুসলিম লীগ মার্কা’ এই রাজনীতিকে বাংলাদেশে আইনত নিষিদ্ধ করা তো ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে, নয় কি?

আমরা জানি, রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখলকারী সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান নিজের ক্ষমতার ভিতকে মজবুত করার প্রয়োজনে বাংলাদেশের রাজনীতিকে সুপরিকল্পিতভাবে আবারো ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন পাকিস্তানি আদলের ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, ভারতবৈরিতা ও মার্কিন–প্রেমের পুরানো দুষ্টচক্রে। জিয়াউর রহমান পারিবারিকসূত্রে করাচীতে কৈশোর ও তরুণজীবন অতিবাহিত করে পড়াশোনা শেষ করে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থায়ও চাকুরি করেছেন তিনি। তিনি বাংলা পড়তে জানলেও লিখতে জানতেন না জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার বলা হয় সেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পাঁচ বছর সাত মাস তেইশ দিন দেশটাকে অবৈধভাবে দখল করে শাসন করা সত্ত্বেও বাংলা লিখতে শেখার কোন গরজ তাঁর মধ্যে সৃষ্টি হলো না, এটাই তো জিয়ার আমরণ পাকিস্তানী সত্তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ! অথচ ইতিহাসের চরম পরিহাস হলো, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ চট্টগ্রামের ষোলশহর থেকে একটি আর্মি কনভয় নিয়ে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্রবাহী জাহাজ ‘সোয়াত’ থেকে অস্ত্র খালাসে প্রতিরোধ সৃষ্টিকারী জনগণকে শায়েস্তা করার দায়িত্ব দিয়ে। ঢাকার গণহত্যার খবর পেয়ে ওখান থেকে তাঁর সহকর্মীরা তাঁকে ফিরিয়ে এনেছিলেন। অতএব, জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধা হননি, ২৫–২৭ মার্চের ঘটনাপ্রবাহ তাঁকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে বাধ্য করেছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের ঘটনাক্রমে ষোলশহর থেকে পশ্চাদপসারণকারী সামরিক কর্মকর্তা ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রে’ আনীত হলেন বেতার কেন্দ্রের নিরাপত্তা বিধানের জন্যে। বেতার কেন্দ্রের সংগঠকরা তাঁকে রাজি করালেন একজন ‘আর্মি মেজরের’ কণ্ঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতার একটি ঘোষণা প্রদানের জন্যে, যাতে ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে শুরু হয়ে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের সেনানীরা উদ্দীপ্ত ও ঐক্যবদ্ধ হয় এবং ২৬ মার্চ দুপুর থেকে দফায় দফায় ঐ বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি সমরাঙ্গনের রণতূর্যের উজ্জীবনী সুধায় আপ্লুত হয়ে জাতিকে অকুতোভয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অমোঘ পথ নির্দেশে রূপান্তরিত হয়। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র পাকিস্তানের বোমা হামলার শিকার হওয়ার পর ৩১ মার্চ সেটা বন্ধ হয়ে যায়। ওদিকে জিয়াউর রহমানও তাঁর রেজিমেন্ট নিয়ে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার এবং জেড ফোর্সের কমান্ডার ছিলেন তিনি। ইতিহাসের কী ট্র্যাজিক পরিহাস, ঘটনাচক্রে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অগ্রসেনানী হয়েও জিয়াউর রহমান যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অন্তরে ধারণ করতে পারেননি, তারই অজস্র প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে তার জবরদখলকৃত পুরো শাসনামলে! সুচিন্তিতভাবে তিনি এবং তার সৃষ্ট বিএনপিতে কেনাবেচার মাধ্যমে জড়ো হওয়া সুবিধে শিকারী রাজনৈতিক সাঙাতরা জনগণের মানসপট থেকে মুছে দিতে চাচ্ছেন ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ও দু’লাখ মা–বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিটি আদর্শ, অর্জন ও গৌরবগাথা। তাঁর মুখোশাবৃত এই পাকিস্তানি সত্তাটির নির্মোহ মূল্যায়ন করতেই হবে। কারণ, এটা অনস্বীকার্য যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন, ঐ ঐক্যবদ্ধ জাতিকে জিয়াউর রহমানই আবার বিভেদ ও বিভাজনের রাজনীতির কানাগলিতে প্রবিষ্ট করে গেছেন সুপরিকল্পিতভাবে। আর, দুঃখজনকভাবে এই পাকিস্তান–মার্কা বিভাজনের রাজনীতিকে এখনো আঁকড়ে ধরে আছেন বেগম জিয়া এবং তারেক রহমান।

নইলে বেগম জিয়া এবং তারেক রহমান কিভাবে অস্বীকার করেন, যখন বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির পিতা’ অভিহিত করা হয় তখন এই সত্যটিকেই স্বীকৃতি প্রদান করা হয় যে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতা ঘোষণার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকলেও বঙ্গবন্ধুর নামেই এদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল, এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী মুজিবনগর সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি? ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণাপত্রে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণাকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হিসাবে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তখন ২৫/২৬ মার্চের রাতের ঘটনা–ঘোষণা ইত্যাদি নিয়ে বিতর্ক কিংবা পাল্টাপাল্টি দাবির অস্তিত্ব ছিলনা। আর, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন মর্মে একটা সাইক্লোস্টাইল করা লিফলেট ২৬ মার্চ সকালে চট্টগ্রামের রাজপথে বিলি করা হয়েছে; আন্দরকিল্লাহর নজীর আহমদ চৌধুরী রোডে আমি নিজেই ঐ লিফলেট পেয়েছি। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত বঙ্গবন্ধু কর্র্তৃক ২৬ মার্চের এই স্বাধীনতা ঘোষণা এদেশের সংবিধানের মূল ভিত্তি। পন্ডিতপ্রবর তারেক রহমান এসবই ভালোভাবে জানেন, তাঁর জ্ঞানপাপী উপদেষ্টারাও জানেন। এতদ্‌সত্ত্বেও যদি ইচ্ছাকৃতভাবে তারেক রহমান উন্মাদের মত প্রলাপ বকে বঙ্গবন্ধুকে হেয় করতে উঠেপড়ে লেগে থাকেন, এবং বেগম জিয়া ‘গবেষণালব্ধ তথ্য’ বলে তাঁর পন্ডিত ছেলের ঔদ্ধত্যকে উৎসাহিত করেন, তাহলে বলতেই হবে বেগম জিয়া নিজেও একদল জ্ঞানপাপীর খপ্পরে পড়েছেন। এই অকাট্য সত্যকে কিভাবে অস্বীকার করা হচ্ছে যে বোয়ালখালীর অবস্থান থেকে ২৭ মার্চ মেজর জিয়াকে কিছু সৈন্যসহ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের নিরাপত্তা বিধানের অনুরোধ জানিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল এবং বেতার কেন্দ্রের সংঘটকদের অনুরোধে সাড়া দিয়ে ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় মেজর জিয়া তাঁর বিখ্যাত স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেছিলেন, ২৬ মার্চে নয়? ঐদিন রাত নয়টার দিকে তিনি বেতার কেন্দ্রে এসে আরেকটি ঘোষণায় নিজেকে প্রভিশনাল সরকারের প্রধান হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু, উভয় ঘোষণাই বঙ্গবন্ধুর পরিবর্তে নিজের নামে দেয়াতে যখন চারিদিক থেকে প্রবল আপত্তি ওঠে তখন ঘোষণাগুলো যথাযথভাবে পরিবর্তন করার জন্য উপস্থিত কয়েকজনকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে সুপ্রিম লীডার হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে পঠিত ঐ পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত ঘোষণাটিই ইতিহাস। এটাই সত্য।

জিয়ার ভক্তদেরকে বলছি, জিয়ার পাকিস্তানী সত্তার প্রমাণগুলো দেখুন:

১) জিয়া বাংলাদেশে স্বাধীনতা–বিরোধী জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামের মত দলগুলোকে বাংলাদেশে পুনর্বাসিত করে গেছেন। ২) ১৯৭৮ সালে মাকে দেখতে আসার নাম করে জিয়ার অনুমতি নিয়ে গোলাম আজম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে চলে এসেছিল। প্রায় তিন বছর অবস্থানের পরও জিয়া এ–ব্যাপারে কোন আইনগত ব্যবস্থা নেননি। ৩) জিয়া তাঁর শাসনামলে বিভিন্ন অভিযোগে কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছিলেন।

৪) জিয়া সকল কুখ্যাত স্বাধীনতা–বিরোধী ঘাতক–দালালকে বিএনপিতে যোগদান করার সুযোগ দিয়েছিলেন। ৫) জিয়া সকল চিন্তিত স্বাধীনতা–বিরোধী সরকারী আমলা–কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, প্রকৌশলী, ডাক্তার, পেশাজীবী ও সামরিক কর্মকর্তাকে চাকুরিতে পুনর্বাসিত করেছিলেন। ৬) জিয়া সকল প্রচার মাধ্যমে ‘পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর’ পরিবর্তে শুধুই ‘হানাদার বাহিনী’ বলার নির্দেশ জারি করেছিলেন।৭) জিয়া দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা বধ্যভূমি, অগ্নি–সংযোগ, শরনার্থী ক্যাম্প ও গণহত্যার চিত্র মিডিয়ায় প্রচার বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ৮) পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা আদায়ের ইস্যুকে জিয়া কখনোই কূটনৈতিক নীতিতে অগ্রাধিকার দেননি। ৯) বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারীদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য পাকিস্তানের ওপর জিয়া যথাযোগ্য চাপ সৃষ্টি করেননি। ১০) জিয়া দেশের সকল স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এমনকি, জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ এবং শহীদ মিনারের পুনর্নিমাণ কাজও জিয়ার আমলে পরিত্যক্ত হয়েছিল। ১১) জিয়া ঘাতক–দালালদের বিচার সংক্রান্ত সকল আইন বাতিল করে দেয়ায় জেলে আটক প্রায় এগার হাজার স্বাধীনতা–বিরোধীকে আর বিচারের সম্মুখীন করা যায়নি।

বেগম জিয়া, তারেক রহমান এবং বিএনপি’র নেতারা কি জিয়ার এহেন পাকিস্তানী সত্তার জন্য গর্ববোধ করেন? এই ীণথটডহ কি তাঁরা পরিত্যাগ করবেন না? এই ইতিহাস–বিকৃতি থেকে তাঁরা কি জনগণকে এবং দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মকে মুক্তি দেবেন না? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ‘না’ হলে আমাদেরকে বলতেই হবে, এদেশে রাজনীতি করার কোন অধিকার নেই তাঁদের। যেমনি অধিকার নেই জামায়াতে ইসলামীর বা পাকিস্তান মুসলিম লীগের। ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭

লেখক : অর্থনীতিবিদ; ইউজিসি প্রফেসর

অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

(সংগৃহীত)

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত