বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

ঝটিকায় দেখা এক ঝলকের স্বপ্ন দেশ

ঝটিকায় দেখা এক ঝলকের স্বপ্ন দেশ

অজয় দাশগুপ্ত, ২৯ ডিসেম্বর, এবিনিউজ : ঝটিকা সফর কাকে বলে ঠিক বোঝানো মুশকিল। বিশেষত তা যদি হয় মাতৃভূমিতে। জন্মস্থান বা জন্মভূমির টান শেকড়ের টান গভীরে প্রোথিত মানুষ কখনো তা ভুলতে পারে না। আমাদের দেশটি যে মায়ার তা বলে বোঝানোর প্রয়োজন পড়ে না। মায়া মমতার এই দেশে যত ঘটনা, দুর্ঘটনা আর কাহিনীর জন্ম হোক না কেন বাংলাদেশ তার আপন অস্তিত্ব ও ঔজ্জ্বল্যে চলমান।

মুশকিল বা সমস্যা দেশ নিয়ে না, সমাজই হচ্ছে বিপত্তির উৎস। এক সময় দেশে চোর, ডাকাত, খুনি, বাটপার কিংবা অসৎ মানুষেরা ছিলেন ভয়ে। গোপনে লুকিয়ে চুবিয়ে থাকাটা ছিল তাদের স্বভাব। আর সৎ ভদ্র বিনয়ী মেধাবী কিংবা সরল সাধারণ মানুষেরা ছিলেন পুরো ভাগে। এখন দেখলাম এই নিয়মটা উল্টে গেছে। যারা মেধা দিয়ে চলেন, যাদের কলম ধারালো, যাদের কথা সোজা সাপ্টা, যাদের মন উদার, চিন্তা মুক্ত তারাই থাকেন ভয়ে ভয়ে। তাদের জানমাল কোনটাই নিরাপদ না। নিরাপদ যে না সেটা তো দেশের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। সে ভয় দূর দেশে আমাদের মনে আরো প্রবলভাবে জেঁকে থাকে। দূর থেকে বোঝা যায় না কতটা নিরাপদ কিংবা অনিরাপদ পদ্মা পাড়।

এবারের ঝটিকা সফরের কারণও দুটি। একটি সময় স্বল্পতা অন্যটি ভয়ভীতি ও সংকোচ, বলতে দ্বিধা নেই এসে মনে হয়েছে সংকোচের কারণ ততটা সত্য নয়। মানুষ এখানে আনন্দে বসবাস করছে। তাদের সমস্যা বা দুর্ভাবনা প্রকট হলেও জীবন চলমান। একথা বলতে পারি পৃথিবীর বহু দেশে স্বচ্ছলতা বা নিশ্চয়তা থাকার পরও জীবন এতটা সুন্দর না। মানুষের পোশাক খাবার জীবনে প্রচুর পরিবর্তন এলেও তাদের সমস্যা যায় নি। সন্তান সন্ততি আর যুদ্ধ জীবনের বড় সমস্যা অনিরাপত্তা, মনে হয়েছে পুরো দু’ভাগে বিভক্ত সমাজ, মধ্যবিত্ত ধ্বংস হয়ে গেছে। আছে ধনী কিংবা টাকাওয়ালা আর গরিব। এই দুই শ্রেণিতে ভাগ হওয়া সমাজে স্বাভাবিকভাবেই চেতনা লুপ্ত হয়ে যাবে। দুনিয়ার যত বড় বড় কাজ সংগ্রাম বা আদর্শ তার ধারক হচ্ছে মধ্যবিত্ত। এরা আছে বলেই প্রতিবাদ হয়। এরা থাকে বলে বহুকিছু বদলায়। দেশে ‘বদলে যাও বদলে দাও’ োগান থাকলেও মধ্যবিত্ত নাই হয়ে যাবার কারণে বদলানো নাই। উচ্চবিত্ত বলতে যা বোঝায় সেটাও নাই। আছে টাকা–পয়সাওয়ালা কিছু মানুষ। যাদের গাড়ি আছে চালানোর রাস্তা নেই, বাড়ি আছে গ্যাস নেই, খাবার আছে খিদে নেই। আরেক দিকে আছে গরিব মানুষ যারা আছে, আছে আর উন্নয়ন শুনতে শুনতে ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে ভাবছে আমিও বড় লোক বটে। এই কারণে তার চলা থামছে না। এদিক থেকে ওদিক থেকে যোগাড় করতে করতেই তার জীবন শেষ।

দুটি টিভিতে কথা বলার সময় মনে হয়েছিল, পুঞ্জিভূত ক্ষোভ মানুষকে অধৈর্য্য করে তুলেছে। তারা বুঝতে পারছে না কোথায় শান্তি, কোথায় সমাধান। সকাল থেকে মধ্য রাত অবধি মানুষ খালি বলছে, টিভি কিংবা রেডিও কিংবা চলমান মিডিয়ায় বিনোদনের ধারাও গেছে পাল্টে। আগে গান বাজনা নাচ বা নাটক থিয়েটার ছিল মূল বিনোদন। এখন কথা, মানুষ চাক বা না চাক তাকে কথা ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস থেকে মেজবান খেতে গিয়ে নিহত মানুষ সর্বত্র কেবল কথা। অভিভাবক বা শিশু কিশোরেরা যতটা আতঙ্কিত তার চেয়ে বেশি বক্তারা। আহত নিহতদের পরিবারের মুখ কালো কান্নারত ছবি চাপা পড়ে যায় কথাবাজদের তোড়ে। এই যে কথা সর্বস্ব সমাজ সেটাই ভুলিয়ে রাখে সবকিছু। খুন, হত্যা বা যে কোন অপরাধ এক সময় ভুলে যাওয়ার সমাজে কেউ কিছু মনে রাখে না, একদিকে ভালো, তাতে তার আয়ু বাড়ে। অন্যদিকে প্রতিকার বা প্রতিরোধ আজ অচল।

মুক্তিযুদ্ধের মত বিপন্ন দ্বিতীয় কিছু দেখিনি। অতি প্রচার অতি কথন আর ক্রমাগত ব্যবহারে মুক্তিযুদ্ধ এখন পণ্য। মূলত তার বিস্তার বা প্রভাব বিলীন। কিছু দিন পর মিডিয়ার বাইরে খুঁজে পাওয়া যাবে না। শিক্ষা, সংস্কৃতি, মুক্ত বুদ্ধি কিংবা চেতনার পায়ে তালা মেরে হাঁটতে বললে সে কোথায় যাবে? সরকারি দলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত বাকিদের ইমেজ শূন্যের কোটায়। বঙ্গবন্ধু কন্যা একাই টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। একটা বিষয় বুঝতে পারি নি। টাকা কবে থেকে এমন সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে। মানুষ কিছুতেই বুঝতে মারছে না কত টাকা বা সম্পদ হলে তার জীবন সুখের হবে। রাজনীতিতে যে বিষয়টা প্রত্যক্ষ তার নাম আওয়ামী লীগ। আর অন্তর্গতভাবে প্রচ্ছন্নভাবে যেটা সবল তার নাম বিএনপি। এই দ্বৈততা সর্বত্র। মনে এক মুখে আরেক। অধিকাংশ মানুষের মনে ধর্ম অধর্মের দ্বন্দ্ব, বাইরে প্রগতিশীলতা, জাতি ও আন্তর্জাতিকতায় ঘোর আমেরিকা বা পশ্চিমা বিরোধী মানুষ কিন্তু রাতে ডিবি লটারি বা ঐ সব দেশে যাবার স্বপ্ন দেখে। তবে এটা মানতে হবে প্রবণতায় মানুষ স্বদেশমুখি হতে চায়। আগে যেমন কাপড় থেকে সূঁচ যা ইচ্ছে কেনার জন্য বিদেশের মুখাপেক্ষি হতে হতো এখন আর তা নাই। স্বাবলম্বী একটা জনগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। ক্ষুধা দারিদ্রতা অভাব প্রায় উধাও। টাকার কমতি নেই। কমতি সমন্বয় ও এগিয়ে যাবার নির্দেশনায়।

মনে হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থায় যে গলদ ও ফাঁস বা অব্যবস্থা তার পেছনে প্রাইভেট সিস্টেমের হাত আছে, তারা হয়তো চায় না জনগণ তান্ত্রিক শিক্ষা মাথা তুলুক। ব্যবসার ক্ষতি ও সিন্ডিকেটের মন্দা কাটাতেই মাঝে মাঝে এসব হচ্ছে কি না তা ভেবে দেখা দরকার।

মূলত ব্যক্তি পরিবার সমাজ ও জাতিতে অবিশ্বাস আর সন্দেহ বেড়েছে, বেড়েছে দ্বৈত মনোভাব। আচরণে ভারত বিরোধী অথচ বছরে দু’বার ভারতে যাওয়া মানুষেরা সংখ্যায় বেশি। মুুক্তিযুদ্ধের জন্য মায়া কান্না সাপোর্টে পাকিস্তানি দল, আওয়ামী শাসনে লাভবান ভোটের বাক্সে ধানের শীষ, এমন সব বৈপরীত্যের পরও দেশ তো দেশই।

যখন চট্টগ্রামে পা রাখি বুকের ছাতি দীর্ঘ হয়ে যায়। জনক জননী ঘুমিয়ে এখানে। অযুত বন্ধু আর স্বজনের মুখ দেখে মনে হয়, এরা আছে বলেই জীবন এত সুন্দর। যে প্রজন্ম বড় হয়ে উঠছে তাদের কাছেই জমা আছে আগামী দিনের বাংলাদেশ। তাদের বুকে মুক্তিযুদ্ধের আসল বীজ মনে উদারতা চিন্তায় অসাম্প্রদায়িকতা আর আচরণে উদারতা দিতে পারলে স্বদেশ এগুবেই।

যত কথাই বলি না কেন, দেশ এগিয়েছে, মানুষও। এখন চাই সমন্বয়। কথা কম কাজ বেশি আর ভালোবাসা ফিরিয়ে আনতে পারলে এমন সোনার দেশ দুনিয়া বিরল।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

(সংগৃহীত)

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত