বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

সাগর ও নীলগিরি

সাগর ও নীলগিরি

বিচিত্রা সেন, ৩০ ডিসেম্বর, এবিনিউজ : সামনের পাহাড়টার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন নিখিলেশবাবু।কি গম্ভীর,মৌন পাহাড়টি! তাঁর মনে পড়ে কেউ একজন তাঁকে পাহাড়ের সাথে তুলনা করতো। কথায় কথায় বলতো,” তুমি পাহাড়ের মতো অহংকারী। আর খুব বেশি গম্ভীর।”যে বলতো তাকে তিনি নাম দিয়েছিলেন ”সাগর”, আসল নাম সাগরিকা। সাগরের মতোই ছিল তার উচ্ছ্বলতা। কথায় কথায় ছিল হাসি, রাগ, আর অভিমান।খুব মাতিয়ে রাখতো তাঁকে।হঠাৎ একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস তার বুকের চিনচিনে ব্যথাটাকে তীব্র করে তোলে।

”বাবা”..ছেলের ডাকে সম্বিত ফিরে পান তিনি। পাশে এসে দাঁড়ায় তাঁর একমাত্র ছেলে রোহিত। পরম মমতায় ছেলে জিজ্ঞেস করে, ”এভাবে চুপচাপ বসে আছো কেন এখানে?” তিনি মৃদু হেসে বলেন,” প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখছি।” ছেলে বলে,”মা তোমাকে ডাকছে।” তিনি উঠে দাঁড়ান।স্ত্রী এবং ছেলেকে নিয়ে তিনি নীলগিরিতে এসেছেন।তাঁর স্ত্রীর অনেকদিনের সখ ছিল এখানে আসার। আসতে পারতেন তিনি অনেক আগেই। সামর্থ্য এবং ক্ষমতা দুটোই তাঁর আছে।অনেক ভ্রমণ করেছেন তিনি পরিবার নিয়ে। শুধু নীলগিরিতে আসতে বললেই তিনি এড়িয়ে যেতেন।কারণ তিনি একজনকে কথা দিয়েছিলেন তাঁকে নিয়ে তিনি নীলগিরিতে যাবেন। কিন্তু ”সাগর” যে তাঁকে এমন করে ফাঁকি দেবে তা তিনি ভাবতেও পারেননি কোনোদিনও। তীব্র অভিমানে বুকের ব্যথাটা আবার চিনচিন করে ওঠে।মনে মনে বলেন,” বড্ডো বেশি নিষ্ঠুর তুমি সাগর”।

স্ত্রী তাঁকে এক গ্লাস শরবত এনে দেন। একটু একটু করে চুমুক দেন তিনি। আবার ভাবনার অতলে হারিয়ে যান তিনি।এত চমকে দিতে পছন্দ করতো সাগর। সবকিছুতে তার চমক চায়। মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগলেও কিছু বলতেন না তিনি। সাগরের স্বভাবটাই ছিল কেমন পাগলাটে ধরনের। যখন তখন ফোন করা, ফোনে ব্যস্ত পেলে গাল ফুলানো, দুদিন কথা না বলে থাকা, এএসব ছিল সাগরের নিত্যনৈমিত্তিক কাণ্ড কারখানা। তবুও কি যে ভালো লাগতো সাগরকে। তবে দুদিনের বেশি সাগর রাগ করে থাকতে পারতো না। অভিমান ভুলে নিজেই আবার ফোন করতো। সাগরের ফোন পেলেই তিনিও সব ভুলে আবার হাসি আনন্দে মেতে উঠতেন।

তবে বেশ কিছুদিন ধরে নিখিলেশ খেয়াল করছিলেন, খুব অল্পেই সাগর রেগে যেতো। আর একটু এদিক সেদিক হলেই কান্নায় ভেঙে পড়তো। ঠিক ওই সময়টাতেই তাঁর অফিসের ব্যস্ততা বেড়ে গিয়েছিল মারাত্মকভাবে। তাই ব্যাপারটা খেয়াল করলেও অতটা গুরুত্ব দিতে পারেননি। বরং সাগরের যখন তখন ফোন করা, ফোনে না পেলে রাগারাগি করা তাঁকে অনেকটা বিরক্তির দিকেও ঠেলে দিচ্ছিল। অফিসের ব্যস্ততায় সাগরকে ঠিকমতো সময়ও দিতে পারছিলেন না। ওদিকে সাগর যে খুব রেগে যাচ্ছে, তা তিনি বুঝতে পারছিলেন। কারণ সাগর বেশ কয়েকদিন ধরে ফোন করা বন্ধ করে দিয়েছে। প্রতিদিনই তিনি একবার ভাবেন সাগরের খবর নিবেন, কিন্তু ব্যস্ততার কারণে তা আর হয়ে ওঠে না। এক দুপুরে লাঞ্চের শেষে কেমন যেন এক অস্থিরতা তাঁকে ব্যতিব্যস্ত করে তুললো। তাঁর খুব করে মনে পড়লো সাগরের উচ্ছ্বল হাসির কথা,মনে পড়লো সাগরের অভিমান মেশানো কান্নার কথা। ভাবতেই কেমন যেন অপরাধী মনে হলো নিজেকে। মনে হলো এ কয়দিন সাগরের প্রতি খুব অবহেলা হয়ে গেছে।তা ছাড়া শুভ কাজটা এবার সেরে ফেলতে হবে। সাগরকে আর তিনি কষ্ট দিতে চান না,সবসময় পাশেই রাখতে চান। বউ করে সাগরকে নিয়ে আসতে হবে তাঁর ঘরে। মা বাবা দুজনেরই পছন্দ হয়েছে সাগরের ছবি।এখন সাগরের পরিবারের সম্মতি পেলেই সাগরের মাস্টার্স পরীক্ষার পরেই বিয়েটা সেরে ফেলা যাবে। মনে মনে এসব ভাবতে ভাবতেই ফোন করেন তিনি সাগরকে। সাগর সবসময় তাঁকে চমকে দেন, আজ তিনি চমক দেবেন সাগরকে বিয়ের প্রস্তাবটা দিয়ে। কিন্তু নিখিলেশ তখনো জানতেন না তাঁর জন্য সাগরের দেওয়া কত বড় চমক অপেক্ষা করছে!

হঠাৎ করেই সাগর কথা বন্ধ করে দিয়েছিল। অভিমানী প্রিয়া এমন অনেকবার করেছে, তাই তিনি তেমন একটা গুরুত্ব দেননি। জানতেন, কয়দিন পর অস্থির সাগর নিজেই কথা বলা শুরু করবে। কিন্তু এবার নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও সাগরের দিক থেকে আর সাড়া না পেয়ে নিখিলেশই ফোন করেছিলেন। ওপাশ থেকে অপরিচিত কণ্ঠস্বর,”হ্যালো”। বিব্রত নিখিলেশের প্রশ্ন,” এটা সাগরিকার এর ফোন নাম্বার না।” অপরদিক থেকে উত্তর,”হ্যাঁ, ছিল,কিন্তু আপনি মনে হয় জানেন না, তিনি তো আর আমাদের মাঝে নেই।” কিছু বুঝতে পারেন না নিখিলেশ। কোনো শব্দ ঢোকে না তাঁর মাথায়। একটু সামলে নিয়ে বলে,”মানে? বুঝলাম না।” ওপাশের কণ্ঠস্বর জানায় সাগরিকা মারা গেছে। বুকে ব্যথা আর মাথায় তীব্র যন্ত্রণা বলতে বলতে সে নাকি জ্ঞান হারিয়েছিল। আইসিইউতে নেওয়া হয়েছিল, তবে তিনদিন যমে মানুষে টানাটানি করে শেষ পর্যন্ত যমই জয়ী হলো। একবারের জন্যও নাকি ওর জ্ঞান আর ফিরে আসেনি। নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না নিখিলেশ, মাথাটা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছিল। তারপর কয়েকদিন শুধুই ঘোর।

এখন বোঝেন ওই নিষ্ঠুর মেয়েটা তাঁর সাথে চরম অপরাধ করেছে। তাঁকে ভীষণভাবে ঠকিয়েছে। তাঁর সমস্ত ভালোবাসা কেড়ে নিয়ে তাঁকে নিঃস্ব করে চলে গেছে। চলেই যদি যাবে তাঁকে ছেড়ে তাহলে কেন এতটা ভালোবেসেছিল? কেন নিখিলেশের মতো এমন গম্ভীর নির্লিপ্ত যুবককেও ভালোবাসতে বাধ্য করেছিল? খুব নিষ্ঠুর সাগর, খুব বেদরদী! অনেক চেষ্টা করেন তিনি ওই পাগলাটে মেয়েটাকে ভুলতে। কিন্তু এতোটা বছরে এক মুহূর্তের জন্যও তিনি সাগরকে ভুলতে পারলেন না।

সাগরকে ভুলতে না পারলেও জীবনের নিয়মে মা বাবার পছন্দে তিনি একসময় বিয়েও করেন। তাঁদের একটা ছেলেও আছে।সব মিলিয়ে জীবন চলেও গেছে এতটা বছর। কিন্তু কয়েকমাস আগে একটা স্ট্রোক হয়ে যায় তাঁর। ডাক্তারদের প্রাণান্তকর চেষ্টায় সুস্থ হয়ে উঠলে তাঁর ছেলে আর স্ত্রীই তাঁকে নীলগিরিতে নিয়ে আসলেন। সাগরের সাথে ওয়াদা ছিল দুজনে হানিমুনে প্রথম নীলগিরিতে আসবেন, সেই ওয়াদা পূরণ হয়নি বলে তাঁর স্ত্রী অনেক বার বলা সত্ত্বেও তিনি নীলগিরিতে আসেননি আগে কখনো। এবার বলতে গেলে বাধ্য হয়েই আসা! কিন্তু এখানে আসা অবধি বুকের ব্যথাটা চিনচিন করে বেড়েই চলেছে। কারণ নীলগিরির সাথে যে তাঁর প্রথম ভালোবাসা সাগরের অনেক স্বপ্ন জড়ানো! কী করে তিনি সাগরকে ভুলবেন? আজ এতটা বছর পরে এসে স্ত্রী পুত্রের কাছেও বা তিনি কী করে এ সত্য প্রকাশ করবেন? বুকের চিনচিন ব্যথাটা ক্রমে বেড়েই চলে নিখিলেশ বাবুর। কানে বাজতে থাকে সাগরের উচ্ছ্বল হাসি, কপট রাগমিশ্রিত ঝাঁঝালো কণ্ঠ আর অবিরাম ঝর্ণার মতো বেয়ে পড়া রাজ্যের কথামালা।

(সংগৃহীত)

এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত