বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

স্মৃতিতে একাত্তর

স্মৃতিতে একাত্তর

স্থিতধী বড়ুয়া, ৩০ ডিসেম্বর, এবিনিউজ : ১৯৭১ এর মহান মুক্তিসংগ্রামে আমাদের মতো তরুণ যারা অংশগ্রহণ করেছিল তাদের অনেকেই ইতিমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে। গত ১৫/১২/২০১৭ইং তারিখ বর্ষীয়ান জননেতা, সাবেক সিটি মেয়র, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি চট্টলার মেহনতি মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু, মুক্তিযুদ্ধের মহান সংগঠক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে পরপারে চলে যান। আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশ আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা লীগ, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা এবং বোয়ালখালীর শাকপুরা বধ্যভূমির সাধারণ সম্পাদক অনুজ প্রতীম স্বদেশ বিশ্বাস গত ০৬/১২/২০১৭ইং তারিখ রাত ১১টা ৩৫ মিনিটের সময় দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করেন। এখন প্রায় প্রতিদিন প্রচার মাধ্যমে বাংলাদেশের যে কোন প্রান্ত হতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কারো না কারো মৃত্যুর সংবাদ শুনতে পাই। আমরা যারা বেঁচে আছি প্রাকৃতিক নিয়মে আগামী ১০–১২ বছরের মধ্যে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। আমরা চলে যাওয়ার পর ৭৫ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সরকারের আমলে আর্থিক এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা আদায়ের জন্য রাজনীতির ছত্রছায়ায় যারা মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে কেবল তাদেরই পাওয়া যাবে। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু কেহ তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা মুখ লুকিয়ে রাখা ছাড়া আর কোন বিকল্প পথ খুঁজে পাবে না। বলতে দ্বিধা নাই যে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে জনগণের কাছে যে সম্মান পাওয়া যেতো এখন যেন এতে যথেষ্ট ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। আসল আর নকল একাকার হয়ে যাওয়ায় জনগণ আসলকেও নকল মনে করে।

১৯৭১এর মার্চে বৃহত্তর চট্টগ্রামের মতো নদী নালা ছোট বড় পাহাড়, টিলা, চা বাগান সমৃদ্ধ ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া জয়ন্তিয়া পাহাড়ের পাদদেশে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি বৃহত্তর সিলেটে হাঁওর কন্যা সুনামগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) দিরাই থানায় আমি ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলাম। উল্লেখ্য যে তৎকালীন সুনামগঞ্জ মহকুমার হাঁওর অঞ্চলের ৪টি থানা দিরাই, শাল্লা, জামালগঞ্জ এবং ধর্মপাশা বৃটিশ আমল হতে বাম রাজনীতির সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত। ৭০এর ডিসেম্বরে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রয়াত প্রাক্তন মন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ দিরাই–শাল্লা নির্বাচনী এলাকা হতে বিজয়ী হন। প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের নৌকার প্রবল জনপ্রিয়তা এবং গণজোয়ারের বিপরীতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী পাকিস্তান সরকারের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অক্ষয় কুমার দাসকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে ওয়ালী ন্যাপ প্রার্থী প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত জয় লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করে জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে মন্ত্রীত্ব লাভ করেন।

৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ পরদিন ৮ মার্চ সরকার জনগণের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে ঢাকা রেডিও স্টেশন হতে প্রচার করতে বাধ্য হলে সারা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এবং সর্বস্তরের প্রশাসন যন্ত্র অধীর আগ্রহে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে পান। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার পর রাজনীতি সচেতন দিরাইর স্থানীয় জনতা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে সবুজের উপর লাল সূর্যের মাঝখানে পূর্ব পাকিস্তানের ভৌগোলিক মানচিত্র খচিত পতাকা হাতে নিয়ে “জয় বাংলা” “পুলিশ জনতা ভাই ভাই, ইয়াহিয়ার ফাঁসি চাই” ইত্যাদি নানা োগান দিতে দিতে থানায় এসে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা তুলতে আমাকে অনুরোধ জানান। বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ঐ ভাষণে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা না থাকলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ হতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন এটা বুঝতে কারো অসুবিধা হয়নি। আমি স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে পাকিস্তানি পতাকার পাশে থানার মাঠে বাংলাদেশের পতাকা তুলতে অনুমতি প্রদান করি। ঐ দিন দিরাই বাজারসহ সর্বত্র স্বতস্ফূর্তভাবে বাংলাদেশের পতাকা তুলতে দেখা যায়। পরে জানা যায় সিলেটের অনেক স্থানে বাংলাদেশের পতাকা তোলা হয়। উল্লেখ্য যে, ১৯৪০ সালে ২৩ মার্চ সর্বভারতীয় মুসলিমলীগ নেতৃবৃন্দ লাহোর অধিবেশনে ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান গঠনের প্রস্তাব পেশ করেন। ঐ প্রস্তাবকে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব হিসেবে অভিহিত করা হয়। লাহোর প্রস্তাবের তারিখের সাথে মিল রেখে ১৯৫৬ সালে ২৩ মার্চ পাকিস্তানকে ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান ঘোষণা করা হয়, যা– সংক্ষেপে ‘পাকিস্তান ডে’ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে তখন হতে সাড়ম্বরে পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু ১৯৭১এর ২৩ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে একমাত্র সামরিক ছাউনী ছাড়া অফিস আদালত সহ কোথাও বাঙালিরা ‘পাকিস্তান ডে’ উদ্‌যাপন করে নাই।

২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ঢাকার বুকে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ আরম্ভের পর ঐ রাতেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সামরিক জান্তা গ্রেফতার করেন। তিনি গ্রেফতারের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। স্বাধীনতা ঘোষণার ঐ রাতেই রাজারবাগ পুলিশ ওয়ারলেচ হতে সর্বত্র প্রচার করা হয়। ২৬ তারিখ সকালে স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রের অনুলিপি আমাকে এবং ন্যাপ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সহ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের হাতে দিরাইয়ের বেতার অফিসের ইনচার্জ আবদুল হামিদ লোক মারফত পৌঁছে দেন। স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র আসার পর এম.এন.এ জনাব আবদুস সামাদ আজাদের অনুপস্থিতিতে এমপি বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের রাজনৈতিক নেতৃত্বে ছাত্র জনতার সমন্বয়ে দিরাইতে প্রতিরোধ বাহিনী গঠন করা হয়। থানার মাঠে সবাইকে থানার রাইফেল দিয়ে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং চারিদিকে সম্ভাব্য হানাদার বাহিনীর আক্রমণ মোকাবেলায় প্রতিরোধ ব্যুহ তৈরি করা হয়। ছাত্র–জনতার আগ্রহের সাথে ট্রেনিং এবং প্রতিরোধ ব্যুহ তৈরিতে অংশগ্রহণ করে। সুনামগঞ্জ সহ দিরাই শাল্লা অনেকদিন মুক্তাঞ্চল ছিল। পাকিস্তানিরা মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে নদী–নালা হাঁওর বেষ্টিত এই অঞ্চলে কোন অপারেশনে আসতে সাহস পায় নাই। মে মাসের শেষের দিকে সুনামগঞ্জের মাহকুমা পুলিশ অফিসার জনাব আলাউদ্দিন এবং হবিগঞ্জের শিক্ষানবীশ এস.আই আল্লা বক্স (পরবর্তীতে পুলিশ সুপার হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত) আমাকে বার্তা বাহকের মাধ্যমে জানান যে পাক সামরিক জান্তার হিট লিস্টে আমার নাম আছে। তারা আমাকে অতিসত্ত্বর দিরাই ত্যাগের পরামর্শ দেন। এই সংবাদ পাওয়ার পর জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বালাত গিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করি। ওখানে আমাকে ৫নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর মীর শওকত আলীর অধীনে মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুটমেন্ট এবং কলকাতায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কাছে বিএসএফ এর ওয়ারলেচ এর মাধ্যমে বালাত সাব সেক্টরের আওতাধীন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের পাক সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অপারেশনের খবরাখবর দেওয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়। মেজর মীর শওকত আলীর অধীনে দায়িত্বে থাকলেও সার্বিক তত্ত্বাবধানে সুনামগঞ্জের আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন। মাসে ২ বার প্রতি ব্যাচে ৬০ জন ট্রেনিংয়ে পাঠানো হতো। গ্রামের কৃষক, দিন মজুর, ছাত্র, শ্রমিক সবাই দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য কে কার আগে ট্রেনিং এ যাবে এ জন্য নির্ধারিত তারিখ ভোর হতে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতো। ৬০ জনের কোটা পূরণ হলে বাকীদের পরবর্তী ব্যাচে অগ্রাধিকার দেওয়া হতো।

বালাতে রিক্রুটমেন্টর দায়িত্বে থাকাকালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল বকসী, মেজর ডি সুজা এবং অপর এক শিখ মেজর এর সাথে আমার সখ্যতা গড়ে উঠে। মুক্তিযোদ্ধারা কোথাও অপারেশন করলে ফলাফল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে লিখিতভাবে জানানো ছাড়াও তাদেরকে মৌখিকভাবে জানাতে হতো।

আমার যতদূর মনে পড়ে, আগস্ট মাসের ২য় সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধারা দোয়ারা বাজারের কাছে সুরমা নদীতে পাক আর্মির টহলরত একটি লঞ্চে গুলি করলে একজন পাক সেনা নিহত হয়। শিখ মেজরকে ইংরেজিতে ‘ওয়ান পাঞ্জাবি হেজ বিন কিল্ড ইন দ্যা অপারেশন’ এই সংবাদ জানালে তিনি খুশি হওয়ার পরিবর্তে রাগান্বিত হয়ে আমার সাথে ইংরেজিতে দুর্ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে হিন্দিতে বলেন, ‘পাঞ্জাবি মাত বলো, পাকিস্তানি বলো’। তখন বুঝতে পারলাম পাঞ্জাবি বলাতে তার আঁতে লেগেছে। দ্বি–জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বৃটিশদের ভারতীয় উপমহাদেশ ভাগের সবচেয়ে বড় অভিশাপ পাঞ্জাব এবং বাংলাকে দ্বি–খন্ডিত করা, যার ফলশ্রুতিতে উভয় প্রদেশে দেশভাগের আগে ও পরে লক্ষ লক্ষ নিরীহ লোককে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রাণ দিতে হয়েছে। এর পরও উভয় দেশের পাঞ্জাবিদের পাঞ্জাবিপ্রীতি এবং বাঙালিদের বাঙালি প্রীতি এখনো রয়ে গেছে।

বালাতে মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুটমেন্টের দায়িত্বে থাকাকালে ভারতীয় সেনা বাহিনীর কর্ণেল বকসির সাথে প্রায় প্রতিদিন আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে আমার সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে। একদিন কথা বার্তার এক পর্যায়ে তিনি বলেন পাকিস্তানে দীর্ঘদিন সামরিক শাসনের কারণে সামরিক বাহিনীর অফিসাররা গণতান্ত্রিক হওয়ার পরিবর্তে উচ্চাবিলাসী এবং অগণতান্ত্রিক। কর্ণেল সাহেবের কথার মর্মার্থ তখন বুঝতে পারিনি। ৭৫এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে পাকিস্তানে কমিশনপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের হাতে নিহত হওয়ার পর এর মর্মার্থ বুঝতে অসুবিধা হয়নি।

৩০ লক্ষ শহীদ এবং ২ লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে যদি স্বাধীনতার পর হতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ছেঁদ না পড়তো তাহলে বাঙালি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হতে আজ এতদূরে সরে আসতো না।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা।

(সংগৃহীত)

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত