![হাবীব সাখাওয়াতের কাব্যগ্রন্থ: হৃদয়ে পূর্ণিমা চাঁদ](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/01/03/habib-1_118452.jpg)
শাকিল আহমদ, ০৩ জানুয়ারি, এবিনিউজ :তিনদশক ধরে কবিতার চাষাবাদে ব্যাপরীত আছে হাবীব সাখাওয়াতের হৃদয়–মন ও মগজ। তবে তাঁর কবিতার চাষবাস ক্ষীপ্রগতিতে নয়, অনেকটাই লোকাল ট্রেনের মতো হেলে দুলে, থেমে–থেমে। জীবন থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে সময়, সমাজ ও প্রকৃতিকে ভর করে, আশা–আকাঙক্ষা, হতাশা, ব্যস্ততা, নৈরাজ্য, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ ও সম্ভাবনার পথ ধরে কবিতার গলিপথে তিনি হেঁটে চলেছেন। কবি হৃদয়ের অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে অবলোকন করেছেন বদলে যাওয়া পৃথিবীকে।
“বাতাসের ঠোঁটে আর একটি ঠোঁট
মিশে আছে একাকার
বাতাস তার মৌনতা মাখা চুম্বনে
বারংবার জাগায় প্রকৃতির শরীর
এই অনিন্দসুন্দর যৌনতায়
আমি কতবার দেখেছি
এই পৃথিবী বদলে যেতে।
……………………….
………………………
একজন কবি কোনকিছু দেখে
একেবারে তার গভীরে ঢুকে
আর মনে রাখাটা হয়
তার চেয়েও অধিক।”
(দেখেছি পৃথিবী বদলে যেতে)
হাবীব সাখাওয়াতের কবিতায়ও অপরাপর কবিদের মতো অনায়াসে এসে যায় জীবনের প্রেম, ভালোবাসা ক্ষুধা ও রিরংসা। তবে তাঁর কবিতার মৌনতায় পল্লবিত হয় শৈল্পিক প্রণোদনা। তাতে পাঠক খুঁজে পায়না কোন অশ্লীলতা। কবিতার প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা থেকে বেরিয়ে আসে কবির পঙ্ক্তিমালা
১) “আমার সব ভালোবাসা
আমার কবিতার জন্যে
আমার সব বীর্য
আমার প্রেমময়ী স্ত্রীর জন্যে।”
………………………….
…………………………..
যেদিন আমার ভালোবাসা
কবিতাবিহীন হবে
সেদিন যেন আমার মৃত্যু হয়।”
(সব ভালোবাসা)
২) “কবিতার মাথা থেকে ঘোমটা
টেনে বসিয়ে দিই বাসরে
যেখানে কবিতার শরীর
তার যৌবন নিয়ে
মিশে যাবে আর একটি শরীরে।”
(যৌবন আছে, সংসার আছে)
জাতিসত্তা তথা অস্তিত্বের শেকড় সন্ধানে কবি হাবীব সাখাওয়াতের কবিতায় আছে সাফল্যের উচ্চতা। ভাষার পদাবলী, স্বাধীনতার স্মৃতিকাতরতা ও সোনালী স্বপ্নকে হারানোর শঙ্কা কবিকে করে তোলে বিচলিত। উৎসে ফিরে যাওয়ার আকুলতায় কবিমন বিচলিত হলেই শব্দে ও ছন্দে হয়ে উঠে মাতোয়ারা।
১) “একুশ তুমি আসবে তাই–
আমি, আমার অস্তিত্বের
পুরো আঙিনা
সাজিয়ে নিয়েছি এক
বিস্ময়কর আলপনায়।”
(একুশের পঙ্ক্তিমালা)
২) “ডিসেম্বর এলেই
পূর্বাকাশে নতুন একটি সূর্য
উদিত হতে দেখি
সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া একজন
নবজাতকের নির্মল হাসিতে ভরপুর
সোনালি আভা নিয়ে।”
(ডিসেম্বর এলেই)
৩) “হাতের মুঠো থেকে তেজেদীপ্ত
আলো গলতে–গলতে
পড়েছে
টেকনাফ থেকে তেতুলিয়ায়
আমার মা–মাটির
জমিনে।”
(মার্চ ২০১৬)
এক স্বতন্ত্র কবিমন ও কাব্যভাষা নিয়ে তিনি যেমন পাঠক হৃদয়কে হরণ করার চেষ্টা করেছেন, তেমনি কবিতাকে আমৃত্যু ধারণ করতে চেয়েছেন সত্য ও বিশ্বাসের আশ্বাসে। যাপিত জীবনের নানামুখী সংঘাত, যন্ত্রণা ও সংকট থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে নিতে চেয়েছেন কবিতায় ভালোবাসার মধ্য দিয়ে। স্নিগ্ধ সকালের কোমল রোদকে হৃদয়ে ধারণ করে যে কবি কলম ধরেছেন– সময়ের বাঁক বদলে প্রেম–বিরহ, দ্বন্দ্ব–সংঘাত, সংশয়ের প্রাপ্তি–অপ্রাপ্তির চোরাবালিতে জীবন যখন আটকে যায়, তখনও কবি জীবনের সুখ খুঁজে ফিরে কবিতার গহীন ভূবনে। তাইতো কবি ছোট্ট কবিতার অবয়বে প্রকাশ করেন–
“ধ্বংস করোনা আর পৃথিবী
সব মানুষের ভালোবাসা
এক জায়গায় করো আজ।”
(সবশেষ অনুরোধ)
সর্বোপরি হাবীব সাখাওয়াতের কবিতায় ফুটে উঠেছে নিষ্ঠুর সমাজ বাস্তবতার ভেতর দিয়ে পাঠকের মনকে জাগিয়ে তোলার এক অনুপম শক্তি। নিজস্ব এক গন্তব্যপথের সন্ধানে তিনি ক্রমাগত হেঁটে চলেছেন।
কোমল শব্দের গাঁথুনিতে, বিচিত্র উপমা, রূপক ও উৎপ্রেক্ষার সুষম প্রয়োগে, প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যকে ধারণ করে, জীবনের দ্বন্দ্ব–সংঘাত ও জিজ্ঞাসাকে কবি হাবীব সাখাওয়াত কাব্যময় করে তুলেছেন তাঁর ‘হৃদয়ে পূর্ণিমা চাঁদ’ কাব্যগ্রন্থে (প্রকাশকাল ২০১৭)। ৪২টি কবিতার সমন্বয়ে গঠিত কাব্যগ্রন্থটিতে জীবন–জগৎ ও প্রকৃতির বিচিত্র অনুষঙ্গ শৈল্পিক রূপায়ণে ধরা দিয়েছে পাঠক সমীপে। ‘হৃদয়ে পূর্ণিমা চাঁদ’ কবির যেমন প্রথম কবিতার গ্রন্থ নয় তেমনি আশাকরি শেষ কবিতাগ্রন্থও হবে না। তাঁর অপরাপর কাব্যগ্রন্থ ‘জ্যোৎস্না প্লাবন (২০১৩)’ এবং ‘স্বপ্ন দুয়ার (২০১৫)’ পাঠক হৃদয়কে আলোড়িত করেছে। ‘হৃদয়ে পূর্ণিমা চাঁদ’ যেভাবে অনুপম শিল্প হিসেবে পাঠকের পরানের গহীনে স্থান করে নিয়েছে, আগামী শিল্পকর্মও পাঠক হৃদয়কে আলোড়িত করবে এ প্রত্যাশাই থাকলো কবি সাখাওয়াতের প্রতি।
এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি