![জেরুজালেম: দাম্ভিকের শক্তি প্রদর্শন](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/01/04/jerujalem_118645.jpg)
শঙ্কর প্রসাদ দে, ০৪ জানুয়ারি, এবিনিউজ : ২১ ডিসেম্বর? ২০১৭। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত জেরুজালেম ইসরাইলের রাজধানী করার প্রস্তাব বাতিল সংক্রান্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে নেতা নিয়াহুর ভাষণটি ইউ টিউবে শুনে স্তম্ভিত হলাম। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি স্পষ্ট করে বললেন এই পরিষদ যত প্রস্তাবই গ্রহণ করুক, ইসরাইল তার জাতীয় স্বার্থে যা করার তা করবেই। ৬ ডিসেম্বর ট্রাম্প ইসরাইলের হবু রাজধানী জেরুজালেমে তার দেশের দূতাবাস স্থানান্তরের নির্দেশ দেন। সৌদি আরব, মিশর, কাতার ট্রাম্পের এই ঘোষণাকে স্বাগত জানানোর ফলে ফিলিস্তিনকে ঘিরে মধ্যপ্রাচ্যে সংকট নতুন মোড় নিল। ১৯৯৫ সালে অসলো চুক্তিখ্যাত শান্তি চুক্তি সম্পাদন হয়েছিল। অতঃপর ২০০০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের মধ্যস্থতায় পিএলও প্রধান ইয়াসির আরাফাত এবং ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী আইনজ্যাক রবিনের মধ্যে ওয়াশিংটন ডিসিতে স্বাক্ষরিত ঐ চুক্তিতেও জেরুজালেমকে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে আগের মতই রেখে দেয়া হয়।
এর আগের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বলে খৃষ্টপূর্ব ১২ শতকে নবী মোসেহ ইহুদী ধর্মের প্রবর্তন করেন এই জেরুজালেম শহরকে ঘিরে। পশ্চিম ওয়াল খ্যাত অংশটুকু নবী মোসেহ এর স্মৃতি বিজড়িত পুণ্যভূমিটুকু ইহুদীদের নিকট গুরুত্বপূর্ণ। ৭০ খৃষ্টাব্দে রোমানদের হাতে ইহুদী প্রধান তীর্থ ক্ষেত্র মাউন্ট টেম্বল দ্বিতীয় বারের মতো ধ্বংস হলেও সীমানা প্রাচীর হিসেবে যে দেয়ালটি আজো টিকে আছে সেটিই পশ্চিম ওয়াল নামে খ্যাত। অভিযোগ আছে জেরুজালেমের গলগাথায় বা এই এলাকাটিতে ইহুদীরা যীশুখৃষ্টকে ক্রুশবিদ্ধ করার কাজে সহায়তা করেছিল এবং যে বিচার সভায় যীশুকে ক্রুশবিদ্ধের আদেশ দেয়া হয়েছিল তার প্রধান ছিলেন ইহুদি।। ইতিহাসের নির্মম পরিহাস হলো খৃষ্টানরাই আজ ইহুদীদের সবচে ঘনিষ্ঠ মিত্র। অতঃপর ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) পুণ্য স্মৃতি বিজড়িত আল–আকসা মসজিদটি ঠিক পশ্চিম ওয়াল সংলগ্ন। মুসলমানদের অনুভূতি হলো আধুনিক টাইম ট্রাভেল খ্যাত আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের জন্য হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এই মসজিদ থেকে যাত্রা করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবে ইহুদী, খৃষ্টান ও মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসের এক গুরুত্বপূর্ণ শহর হলো জেরুজালেম এবং মজার ব্যাপার হলো তিনটি অনুভূতির কেন্দ্র বিন্দু হলো মাত্র ৩৫ একর ভূমি যা পূর্ব জেরুজালেমে পড়েছে।
ইহুদীদের অভিযোগ হলো, ইসলামের আবির্ভাবের পর থেকে তাদের বিড়ম্বনার সূত্রপাত। হযরত ওমর জেরুজালেম দখল করে নেয়ার পর থেকে ইহুদীদের দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। ধর্মীয় মতবাদের দিক থেকে ইহুদী ধর্মের প্রধান গ্রন্থ তোরাহ ও এর প্রবর্তক মোসেহকে ইসলাম ধর্মে নবী হিসেবে স্বীকার করা হলেও পথ বিচ্যুত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আবার ইহুদীরাও ইসলাম ধর্মের আদর্শিক অবস্থানের বিরুদ্ধে। এই বৈরীতার ফলাফল হলো কালক্রমে ইহুদীরা মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে প্রথমে ইউরোপের দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমেরিকার সমাজ জীবনে শক্ত অবস্থান নিয়ে নেয়। আমেরিকার কোন নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত ইহুদীদের বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। ডোনাল ট্রাম্পের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত এই বাস্তবতার বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
জেরুজালেম দুভাগে ভাগ হয়েছিল রক্তাক্ত যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। ঊনবিংশ শতকে ইউরোপের শিল্প, সাহিত্য ও বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে যে বিপ্লব সংগঠিত হয় তার নেতৃত্ব দিয়েছিল ইহুদীরা। আজো প্রতিবছর চিকিৎসা ও বিজ্ঞানের কোন না কোন শাখায় নোবেল পুরস্কার অর্জন করে ইহুদীরাই। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনষ্টাইনও ছিলেন একজন ইহুদী। নিজেদের অগ্রগতির সাথে সাথে তারা নিজেদের যাযাবর জীবনের পরিসমাপ্তি টানার উদ্যোগ নেয়। তারা নিজেদের একটি মাতৃভূমির দাবিতে বিশ্বব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলে এবং জেরুজালেমকে ঘিরে জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরে একটি ইহুদী রাষ্ট্রের পরিকল্পনা হাজির করে। এই আন্দোলন জায়নবাদী মুভমেন্ট হিসেবে খ্যাত। জায়নিষ্ট মুভমেন্টের নেতা আর্থার রত চাইল্ডের বরাবরে ০২/১১/১৯১৭ সালে ক্যাবিনেটের অনুমোদন নিয়ে বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফোর চিঠি লিখে জানান যে, প্যালেস্টাইনে ইহুদীদের একটি স্বতন্ত্র আবাস ভূমি গড়ে তোলা উচিত। দাবীটি বৃটিশ সরকার সমর্থন করে। এই চিঠিটিই বিখ্যাত বেলফোর ডিক্লারেশন হিসেবে খ্যাত এবং আজকের ইসরাইল রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক আইনী দলিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার ৬০ লক্ষ ইহুদীকে হত্যা করলে ইহুদীরা নিজেদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সশস্ত্র পথে অগ্রসর হয়। যে, যে দেশে পেরেছে, সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়া মাত্রই নিজেদের সামরিক শাখাকে সংগঠিত করে ১৯৪৮ সালে জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর দিয়ে হামলা শুরু করে। বসবাসকারী ফিলিস্তিনীদের উচ্ছেদ করে দখল করতে থাকে পশ্চিম তীর, গাজা, লেবাননের অংশ বিশেষ এবং জেরুজালেম। মিশর, সিরিয়া এবং জর্ডান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। জেরুজালেমের পূর্বাংশ জর্ডানের দখলে থেকে যায়। এই পূর্বাংশেই কিন্তু ৩৫ একরের পটভূমি। টেম্বল মাউন্টের পশ্চিম দেয়াল আল আকসা মসজিদ অংশটি অবস্থিত। পশ্চিম জেরুজালেম অধিকার করা মাত্রই ইসরাইল শহরটিকে তাদের রাজধানী ঘোষণা করলে দুনিয়াব্যাপী বিতর্কের ঝড় উঠে। যেহেতু পৃথিবীর প্রভাবশালী ৫টি ধর্মের মধ্যে হিন্দু ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্ম ছাড়া বাকী তিনটি ধর্মের অনুভূতি জড়িত সেহেতু এককভাবে জেরুজালেম ইহুদীদের অধিকারে যেতে পারে না। জাতিসংঘের ১১৮ (২) নং প্রস্তাবটি গৃহীত হয় ১৯৪৮ সালে এবং এই প্রস্তাবে প্যালেস্টাইনে ইসরাইল এবং প্যালেস্টাইন নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। উভয় পক্ষ যৌথ সম্মতিতে না আসা পর্যন্ত জেরুজালেমকে আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে রাখার কথা বলা হয়েছিল। ১১৮ (২) নং প্রস্তাবটি পিএলও সহ মুসলিম বিশ্ব প্রত্যাখ্যান করে। ফলে একটি দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষ হয়ে উঠেছে মধ্য প্রাচ্যের ললাট লিখন।
ঘটনা প্রবাহ ইঙ্গিত দিচ্ছে জেরুজালেম ইসরাইলী রাজধানী স্থিতি পাওয়ার সাথে সাথে আন্তর্জাতিক ভূমিকার অবসান ঘটবে। বৃহদাংশ ইহুদীরা মনে করে পশ্চিম ওয়াল সংলগ্ন স্থানটিতেই টেম্পল মাউন্ট অবস্থিত। দুবার টেম্পলটি ধ্বংস করা হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে আল আকসা মসজিদের অদূরে তৃতীয় টেম্পল মাউন্ট নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হবে। মুসলিম বিশ্বসহ আন্তর্জাতিক দুনিয়ার আপত্তি সেখানে নয়। আপত্তিটাই হলো নৈতিক। যে শহরটি তিনটি ধর্মের আবেগ অনুভূতির অংশ সে শহরটি তিন সম্প্রদায়ের জন্য উন্মুক্ত রাখাই শ্রেয়। দীর্ঘদিন ধরে পূর্ব–জেরুজালেমকে রাজধানী করে প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দীর্ঘকালের জন্য চাপা পড়ে যাবে। একই সাথে পিছিয়ে যাবে ফিলিস্তিনীদের স্বাধীন প্যালেষ্টাইন গঠনের স্বপ্নও। নেতানিয়াহু বলছেন, হযরত ওমরের আগ পর্যন্ত এ অঞ্চলটি ছিল ইহুদীদের মাতৃভূমি। সেটা যেমন সত্যি তেমনি এটাও সত্যি যে, ফিলিস্তিনীদের মাতৃভূমি হলো এই এলাকাটি। সুতরাং স্বতন্ত্র প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রই ফিলিস্তিনীদের সংকটের শেষ সমাধান। এক্ষেত্রে ৩৫ একরের আল–আকসা ও মাউন্ট টেম্পল অংশটি পবিত্র স্থান হিসেবে আন্তর্জাতিক তদারকিতে ছেড়ে দিলে সভ্যতা ও শান্তির জন্য এক ধাপ অগ্রগতি হতো। আজ হোক বা কাল হোক প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবেই। হয়তো সেদিন জেরুজালেমের একাংশ ইসরাইলকে ছাড়তে হতে পারে। জাতিসংঘে জেরুজালেম রাজধানী করার বিপক্ষে ভোট দিয়েছে ১২৮। ট্রাম্পের পক্ষে পড়েছে মাত্র ৯ ভোট। যে ৩৫টি দেশ ভোট দানে বিরত ছিল তারাও যে ট্রাম্পের বিপক্ষে তা বলাই বাহুল্য। এরপরও নেতানিয়াহু আর ট্রাম্পের হুমকি আসলে দাম্ভিকের শক্তি প্রদর্শনের নামান্তর মাত্র। হাবভাবে মনে হচ্ছে একবিংশ শতকের শান্তির পথে জেরুজালেম সংকট এক সর্বগ্রাসী আঘাত।
লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট
(সংগৃহীত)