
আফসান চৌধুরী, ০৪ জানুয়ারি, এবিনিউজ : আসামে অবৈধ বাংলাদেশী মুসলিমদের শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া চলছে। লক্ষ্য হলো তাদেরকে ভারত থেকে বহিষ্কার করা। এই মুহূর্তে একই ধরনের হিন্দুরা তুলনামূলক নিরাপদ মনে করলেও পরিণতিতে নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর বিপুল উত্তাপের সৃষ্টি হতে পারে। এর সুবাদে বাংলাদেশে ইসলামি চরমপন্থীদের চাপ বাড়তে পারে এবং তাদের প্রতি জনসমর্থনও দেখা যেতে পারে। আবার আসাম থেকে বের করে দেওয়া লোকজনের দায়িত্ব গ্রহণ করা হলে সেজন্য অনেক কিছুর প্রয়োজন পড়বে, কারণ সীমিত সম্পদ দিয়ে রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবিলা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারকে।
বাংলাদেশের জন্য সমস্যা ইতিহাস ও প্রতিবেশ উভয়ই। বর্তমান আঙ্গিকে এই অঞ্চলের রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে অভিবাসন প্রবাহে বিধিনিষেধ ছিল না। জীবিকার সন্ধানে, বিশেষ করে গরিবরা শ্রমিক স্বল্পতা, জমি প্রাপ্তি এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের সুযোগ থাকা আশপাশের অর্থনৈতিক এলাকায় পাড়ি জমাত। গত দুই শ’ বছর ধরে এই এলাকার লোকজন উত্তর-পূর্ব প্রান্তগুলোতে পাড়ি দিয়েছে। আরাকানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
কিন্তু বর্তমানে যে নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সীমানা রয়েছে, তাতে অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃআঞ্চলিক উভয় ধরনের প্রতিযোগিতাই রয়েছে। অভিবাসন এলাকায় এসব শ্রম অভিবাসীকে রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে গ্রহণ করার কারণেই মিয়ানমার ও ভারত উভয় স্থানে বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
একটি ঐতিহাসিক সমস্যা সমাধানে এটিই সর্বোত্তম পন্থা হোক বা না হোক, আসাম থেকে বের দেওয়া মানে এ নিয়ে অপ্রস্তুতিতে থাকা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সমস্যা সৃষ্টি করা। রোহিঙ্গা সঙ্কটে দেখা গেছে, বাংলাদেশের সক্ষমতার অভাব আছে এবং বেশ অপ্রস্তুতও।
প্রভাব পড়বে কোথায়?
আসাম যদি মুসলিমদের বের করে দেওয়ার কাজ শুরু করে, তবে প্রকটভাবে যে হুমকির সৃষ্টি হবে তা হলো:
ক. বাংলাদেশের ভারতবিরোধী লবিটি বিপুলভাবে শক্তিশালী হবে। রোহিঙ্গা সঙ্কটের সময় মিয়ানমারের পক্ষ নিয়ে বৈরী অনুভূতিবিষয়ক বোনাস পয়েন্ট অর্জন করেছিল ভারত। এবার তার আরো বেশি পয়েন্ট যোগ হবে। এর অর্থ হলো বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ ঐতিহ্যবাহী ভারতবিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা বাড়বে। ঐতিহ্যবাহী ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগের জন্য তা মাথাব্যথার কারণ হবে। ফলে আশা করা যায়, বহিষ্কার হলেও তা হবে নির্বাচনের পর। কারণ নির্বাচনের আগে হলে নির্বাচনী ফলাফলে প্রভাব বিস্তার করবে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ত্রাণকর্তার ইমেজ সৃষ্টি হলেও আসামের ঘটনা ওই ইমেজকে চুপসে দেবে। আওয়ামী লীগ সরকারের উত্তর-পূর্বের বিদ্রোহীদের আশ্রয় প্রদান প্রত্যাখ্যান করা অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
খ. সহিংস চরমপন্থা ব্যাপকভাবে বাড়তে পারে। আসাম থেকে বের করে দেওয়া লোকদেরকে রোহিঙ্গা-মিয়ানমার ইস্যুর মতো অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে দেখা হবে না। আসাম ইস্যুটিকে ভারতের সাথে জাতীয়/ভূখণ্ড গত সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হবে। ফলে প্রতিরোধ হবে অনেক বেশি জনপ্রিয় এবং নতুন সঙ্কটে নতুন নতুন গ্রুপের অভ্যুদয় ঘটবে, পুরনোগুলো উদ্দীপ্ত হবে। এর মানে হলো জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের চলমান সাফল্য অব্যাহত রাখতে হবে, তবে তা আরো বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে তথ্য আদান-প্রদান এবং সমন্বিত কার্যক্রম এখনকার মতো সহজ হোক বা না হোক, তা একটি ইস্যুতে পরিণত হবে। বাংলাদেশে ভারতবিরোধী জঙ্গিদের সাধারণভাবে বর্তমান জঙ্গিদের তুলনায় কোন দৃষ্টিতে দেখে, তা হবে একটি ইস্যু।
গ. নতুন বন্ধুরা ও পুরনো শত্রুরা কৌশল নতুন করে পর্যালোচনা করবে। কারণ তাদের ওপর চাপ কিছুটা কমে ভারতের দিকে বাড়ায় চীন খুশি হবে। এর ফলে বাংলাদেশের মধ্যে পাকিস্তান অনেক বেশি সহানুভূতি পাবে। অন্যদিকে এর দীর্ঘ দিনের শত্রু ভারতকে বাংলাদেশের মাটিতে নতুন করে পুরনো যুদ্ধে নিয়োজিত হতে হবে।
ঘ. বিশ্ব মিয়ানমারকে চেনে সামরিক-শাসিত দেশ হিসেবে। কিন্তু ভারত গণতান্ত্রিক দেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তার বৈশ্বিক মর্যাদা আছে। ফলে আসামের মুসলিমদের বের করে দেওয়া হলে এর একটি আন্তর্জাতিক প্রভাব থাকবে। ওই পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক শক্তিগুলোকে একটি অবস্থান গ্রহণ করতে হতে পারে। অভিবাসনবিরোধী দেশ হিসেবে ট্রাম্পের পক্ষে সহজেই সমর্থন দেওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু তাতে করে বৈশ্বিক জিহাদি প্রশ্নে একটি প্রভাব সৃষ্টি হবে। কারণ আসাম ইস্যুটি তখন হয়তো জিহাদি ও যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী পরিচিতি সৃষ্টি করবে।
রোহিঙ্গা বনাম আসামি মুসলিম?
ঙ. বাংলাদেশের সামর্থ্য ও সম্পদের ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বহিষ্কার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সহায়তা কম পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে। কারণ অন্তত একটি বিতর্কিত ভূখণ্ড গত পরিচিতি থাকা রোহিঙ্গাদের তুলনায় তাদেরকে অনেক বেশি বাংলাদেশী মনে হয়। এর মানে হলো, বহিষ্কৃত লোকজনকে তাদের নিজেদের মতো করে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। তা কেবল আর্থ-সামাজিক সমস্যাই সৃষ্টি করবে না, সরকারি সম্পদেও টানাপোড়নের সৃষ্টি করবে, রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দ করা সম্পদ নিয়েও বিরোধের জন্ম দেবে।
চ. বাংলাদেশে কর্মরত ভারতীয়দের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়বে এবং উত্তেজনাও সৃষ্টি হতে পারে। তৈরি পোশাকসহ যেসব খাতে ভারতীয়রা কাজ করছে, তাদের ওপর কী প্রভাব পড়বে তা নিশ্চিত নয়। কিন্তু আসাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর বৈধ ও প্রায় অবৈধভাবে বাংলাদেশে কর্মরত ভারতীয়দের তাড়িয়ে দেওয়ার দাবি জোরদার হবে।
এই প্রেক্ষাপটে আসাম থেকে গণহারে বহিষ্কার করা হলে প্রধানত মানবিক মাত্রায় থাকা রোহিঙ্গা সঙ্কটের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব সৃষ্টি হতে পারে। আসাম থেকে বহিষ্কারের ঘটনা বাংলাদেশের জন্য অভ্যন্তরীণ সমস্যার পাশাপাশি আঞ্চলিক সঙ্কটও সৃষ্টি করতে পারে।
লেখক: কলাম লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক।