বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

দেশলাইয়ের কাঠি

দেশলাইয়ের কাঠি

অলক দাশ, ০৫ জানুয়ারি, এবিনিউজ :

‘কারা ওখানে?’

এবার চরা গলায় শব্দের উৎসের দিকে প্রশ্নটি ছুঁড়ে দিলেন প্রধান শিক্ষক মহসিন রেজা। সামনের খোলা বারান্দায় তার অফিস সংলগ্ন অংশে কারা যেন ফিসফিস আর খুব সাবধানে পায়চারি করছে। তাতে একমনে কাজ করতে পারছেন না তিনি, মনসংযোগ ছুটে ছুটে যাচ্ছে।

কোন সাড়া এলনা। শব্দও উধাও। তবে তা কয়েক মুহূর্তের জন্য। পুনরায় শব্দ কানে এসে লাগতেই ধমক দিয়ে উঠলেন মহসিন রেজা,‘জবাব নেই কেন?’

এভাবে আর থাকা যায়না, নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করে একমত ওরা। দু’বার স্যারের নজরে পড়েছে। আর চেয়ারে বসে থেকে জানতে চইবেন না স্যার। দেখতে চলে আসবেন। তাকে এতক্ষণ বিরক্ত করার শাস্তিও দিতে পারেন। এখন দু’টি পথের একটিই বেছে নিতে হবে। শাস্তি এড়াতে পালানো, না হয় স্যারের সামনা–সামনি হওয়া।

কিন্তু পালানোর কথা ভাবতেই পারছেনা ওরা। স্যারকে খবরটি দিতেই হবে। এতক্ষণ ভয় আর সংকোচে স্যারর কাছে যেতে পারছিলনা, এবার পরিস্থিতিই স্যারের দিকে ঠেলে দিল ওদের। তবে দরজার সামনে গিয়েই দাঁড়িয়ে পড়ল। ওখানে দাঁড়িয়ে একজন আরেকজনকে চিমটি কাটে, জামা ধরে টানে। ইশারায় বলে, আগে তুই যা।

ঝুঁকে খাতায় লিখছিলেন মহসিন রেজা। ওদের উপস্থিতি টের পেয়ে মাথা না তুলেই প্রশ্ন করলেন, ‘কী চাই?’

পরিস্থিতি এবারো এগিয়ে দিল ওদের। স্যারকে সালাম দিয়ে আসার কারণ বলতে যায়। কিন্তু সবাই একসাথে বলতে যাওয়ায় কারো কথাই স্পষ্ঠ বুঝা যায় না।

‘থাম,’ একটু বিরক্ত মহসিন রেজা। ‘ভেতরে এস, তবে যা বলার একজনেই বলবে।’

রুমে ঢুকে বিনীতভাবে দাঁড়ায় ওরা। এই প্রথম স্যারকে তার অফিসে সরাসরি কিছু বলতে এসেছে। ভয় আর সংকোচ পিছু ছাড়ছে না। নিজেদের মধ্যে ঠিক করে নিল কে কথা বলবে। সে ভেঙে ভেঙে বলে,‘স্যার নার্গিস আমাদের ক্লাসে পড়ে। লেখা–পড়ায় খুব ভাল। ওর রোল নং তিন। ওকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। স্কুলেও আসতে দিচ্ছে না।

এবার মাথা তুলে ওদের ভাল করে দেখেন মহসিন রেজা। বয়স বার–চৌদ্দ বছরের মধ্যে। ওদের আসার কারণও বুঝতে পারছেন। বান্ধবীর এ বিয়ে বন্ধে স্যারের হস্তক্ষেপ চায়।

মহসিন রেজার এতদিন বাল্যবিয়ে নিয়ে একটুও ভাবাভাবির মধ্যে ছিলেন না। কিন্তু পরিস্থিতি এখন দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে। না করে দিতে বিবেকে বিঁধছে। নার্গিস তারই স্কুলের মেয়ে। খবরটি তাকে জানানোও হয়েছে। অসহায়বোধ করেন মহসিন রেজা। এতো আর শিক্ষার্থীকে শাসন মত ব্যাপার নয়। জানতে চাইলেন মহসিন রেজা, ‘বিয়ে কখন?’

মেয়েগুলো সবাই প্রায় একই সঙ্গে বলে ওঠে, ‘এমাসের ২৫ তারিখে স্যার।’

তারিখটি সামনের ডেস্ক ক্যালেন্ডারে কলম দিয়ে গোলমার্ক করলেন মহসিন রেজা। দেখে খুশি মেয়েগুলো, স্যার নিশ্চয় কিছু করবেন। নার্গিসের বাড়ির ঠিকানা জেনে নিয়ে মেয়েগুলোকে বিদায় দিলেন মহসিন রেজা।

স্কুল ছুটির পর রওনা হলেন নার্গিসদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। তবে কোন পরিকল্পনা নেয়া ছাড়াই। তবু নার্গিসদের বাড়ি যাচ্ছেন, যদি বলে রাজী করানো যায় নার্গিসের অভিভাবকদের। ঘাঁটার মুখে সাইকেল থেকে নেমে হ্যান্ডেলে হাত রেখে নার্গিসদের বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলেন মহসিন রেজা। লম্বা প্রশস্ত ঘাঁটা। যত ভেতরের দিকে যাচ্ছেন তত অবাক হচ্ছেন। নার্গিসদের পরিবার হত দরিদ্রই হবে মনে করেছিলেন। তাই মেয়ের বিয়ে দিয়ে খরচের ভার কমাতে চায় অভিভাবকরা!

ঘাঁটা শেষ প্রশস্ত উঠানে মিশে। সেমিপাকা বাড়ি। হঠাৎ একটি মেয়ে ছুটে এসে টুপ করে তার পা ছুঁয়ে সালাম করল। নার্গিস,নাম জিজ্ঞাসা করে জানলেন মহসিন রেজা। ভেতরে আরো একটি উঠান, এটি বাড়ির সম্মুখ ভাগ। উঠানের এক প্রান্তে টিনের চালের নিচে ডিপটিউবওয়েল, কিছুটা দূরে পাকা বাথরুম।

স্যারকে বসার ঘরে বসিয়ে দিয়েই উধাও নার্গিস। মনে মনে হাসেন মহসিন রেজা। এ বয়সী মেয়েরা এরকমই হয়, স্যারদের প্রতি সংকোচ আর অকারণ ভয় থাকে তাদের। একা বসে মহসিন রেজা। তার মনের অবস্থা পরীক্ষার পূর্বরাতের পরিক্ষার্থীর মত। পরীক্ষার বিষয় জানা, কিন্তু কি প্রশ্ন আসতে পারে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায়। পরিস্থিতি কিভাবে সামলাবেন ভাবছিলেন মহসিন রেজা, তাতে ছেদ পড়ল চা নাস্তার ট্রে হাতে একজনের আগমনে। লোকটি ট্রে থেকে চা–নাস্তার প্লেট টেবিলে নামিয়ে রেখে বলে, ‘নেন স্যার। ভাইজানকে মোবাইল করে দিছি।

কিন্তু কতক্ষণে আসবেন! মহসিন রেজার মনের এ প্রশ্নের উত্তর লোকটি নিজ থেকেই দেয়, ‘ভাইজান মোটরসাইকেলে চলাফেরা করেন। আসতে আধা ঘন্টাও লাগবে না।’ কথা শেষ করেই ভীষণ তাড়া থাকার মত দ্রুত পায়ে অদৃশ্য হয়ে গেল লোকটি।

মহসিন রেজা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে এক একটি চুমুক দিচ্ছেন মাঝখানে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে। এটি তার একাকীত্ব কাটাতে ব্যস্ত থাকার কৌশল। কিন্তু তাতেও কেউ আসার আগেই চা শেষ।

একসময় ঘাঁটা দিয়ে মোটরসাইকেল ঢুকার শব্দ ভেসে এল। নিজেকে ঠিক করে নিলেন মহসিন রেজা। নিজের অজান্তেই যেন শরীর পেছনে হেলে পড়েছিল। ঘরে ঢুকেই লোকটি সৌজন্যের হাত এগিয়ে দিয়ে নিজের পরিচয় দেয়, ‘আমি নার্গিসের বাবা হাজী সোলাইমান।’

হাত মেলান মহসিন রেজা। হাজি সোলাইমান মুখোমুখি সোফাটিতে বসেন। মৃদু হাঁফাচ্ছেন। হাসি হাসি মুখে আলোচনার কৌশলী সূত্রপাত ঘটালেন মোহসিন রেজা, ‘খুব সুন্দর বাড়ি করেছেন।’

এরকম বাড়ি করতে পেরে নিজেও তৃপ্ত হাজী সোলইমান। প্রশংসায় ভিজে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেন, ‘মিডলিষ্টে চাকরির টাকায় এ বাড়িটা নতুন করছি। আগে থাকতাম পূবে নয়াহাটের ওদিকে।’

নাম শুনলেও নয়াহাটের অবস্থান জানেন না মহসিন রেজা। এখনো জানার ইচ্ছা নেই। কিন্তু হাজী সোলাইমানের মনে ঢুকতে জানার কৃত্রিম আগ্রহ দেখালেন, ‘নয়াহাটের ওদিকে —-!’

‘আসতে যে মোড়টা ঘুরেছেন, না ঘুরে সোজা অল্প কিছু গেলেই নয়াহাট।’ হাজী সোলাইমান কথাগুলো বলেন ডান হাত তুলে অদৃশ্য নয়াহাটের দিকে ইংগিত করে। তবে এ আলোচনায় সেখানেই থামলেন। সেই দিনগুলো মনে রাখতে চান না। দিনে এনে দিনে খাওয়া গাদাগাদি পরিবারের একটি পাড়া। বাড়িগুলো যেন মুরগীর খাঁচা। শুষ্ক মৌসুমে যা একটু টেকা যায়। বর্ষাকালে ঘরের বাইরে পা দিলেই থকথকে কাদা–পানি। তারসাথে পোষা পশুর মলমূত্র মিশে বাতাসে উৎকট গন্ধ। প্রসঙ্গ পাল্টালেন হাজী সোলাইমান, ‘বিয়ে হয়ে যাচ্ছে শুনে ছাত্রীকে দেখতে এলেন বুঝি।’

মহসিন রেজা নিশ্চুপ হাসলেন।

‘আমি যাব স্কুলের মাষ্টারদের দাওয়াত দিতে,’ বলেন হাজী সোলাইমান।

মহসিন রেজা খুশি। তিনি যে বিষয়ে বলতে এসেছেন তার দ্বার হাজী সোলাইমানই একটু ফাঁক করে দিয়েছেন। ‘ মেয়ে খুবই মেধাবী’, অভিযান শুরু করলেন মহসিন রেজা।

হাজী সোলাইমান প্রতিক্রিহীন। ইচ্ছা করেই চুপ তিনি। মেয়ের লেখাপড়ায় আগ্রহ নেই তার। নার্গিস এপর্যন্ত উঠে এসেছে নিজের আর মায়ের আগ্রহে। পুরানো বাড়ীতে থাকলে হয়ত তা সম্ভব হতোনা। ওখানকার তার সতীর্থরা সবাই প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা দেয়ার আগেই ঝড়ে পড়েছে। কিন্তু নতুন বাড়ী এলাকার পরিবেশটাই লেখাপড়াময়। পড়ুয়া বয়সী সবাই লেখাপড়া করে।

নার্গিস খুব সাইন করবে , ‘বলেন মহসিন রেজা।’

এবার মুখ খুলেন হাজী সোলাইমান। অতিথির সামনে গৃহস্থ চুপ করে থাকলে ভাল দেখায়না তাই। বলেন, ‘নার্গিস মা অনেক সময় আমার দোকানের হিসাবপাতিও ঠিক করে দেয়। ’

মেয়ের লেখাপড়ার প্রশংসা! মনে জোর পেলেন মহসিন রেজা। বলেন,‘নার্গিস তার ক্লাসের অনেককে পড়া বুঝিয়ে দেয়।’ একথা বলে মনে মনে অনুতপ্ত মহসিন রেজা। মেয়ের লেখাপড়ার প্রতি বাবাকে আরো আগ্রহী করে তুলতে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি জানেন না নার্গিস আদৌ তা করে কিনা। তবে সান্ত্বনা পাচ্ছেন এই ভেবে, এ মিথ্যা একজনের ভাল করতেই বলেছেন।

এ ফিরিস্তি শুনতে কাজ ফেলে ছুটে আসেননি। মন পড়ে আছে দোকানে। তাড়া আছে বুঝাতে বলেন হাজী সোলাইমান, ‘দোকানে পিচ্চিটা একা এখন। সামলাতে পারবেনা।’

হাজী সোলাইমানের মনোভাব আঁচ করতে পেরে মহসিন রেজাও উদ্যোগী হলেন দ্রুত কাজ সারতে। বললেন, ‘নার্গিস লেখাপড়া চালিয়ে গেলে আপনার, এ গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করবে।’

‘উৎকট ঝামেলা!’ পারলে তড়াক করে উঠে চলেই যেতেন হাজী সোলাইমান। খুব কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে জবাব দিলেন, ‘ওর শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা চাইলে আমি না করব না।’

কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে ভেবে নিয়ে বললেন মহসিন রেজা, ‘মেয়েকে নিজের কাছে রেখেইতো লেখাপড়া করাতে পারেন।’

‘কি!’ হাজী সোলাইমান না বুঝার ভান করেন। ‘মেয়েকে ঘরে রাখতে হলে জামাইকেও রাখতে হয়। ঘরজামাই! শিক্ষিত লোক হয়ে এ কথা বলছেন!’ শেষের কথাটি বলার সময় অস্পৃশ্য কিছু ছুঁয়ে ফেলার মত ভাব করেন হাজী সোলাইমান।

মহসিন রেজার মনে হয়, আর চেপে রাখাটা অনর্থক। সরাসরিই বললেন,‘আপনি কি জানেন না বাল্যবিয়ে দেয়া সরকারের আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ!’

‘অসহ্য!’ তবে মনোভাব চেপে গিয়ে হাজী সোলাইমান উত্তর দিলেন শান্তভাবে হেসে হেসে, ‘বিয়ের বয়স হিসাব করেই তার বিয়ে ঠিক করছি। সে দেখতেই এরকম। আসল বয়স বুঝা যায়না।’

অবিশ্বাস্য! কেউ দেখতে যতই খাট হোক, তার শরীরি গঠন কখনোই বামুনের মত হয় না। নার্গিস বামুন নয়। কিন্তু এ নিয়ে এখন তর্ক করা অনর্থক মনে করে চুপ থাকলেন মহসিন রেজা।

নীরবতা ভাঙলেন হাজী সোলাইমান,‘মাস্টার আপনি বসেন। না জানি পিচ্চি এতক্ষণে দোকানে কী ঝামেলা পাকাইছে!’ বলতে বলতে উঠে পড়লেন হাজী সোলাইমান। মহসিন রেজাও হাঁফ ছেঁড়ে বাঁচলেন। ঘর থেকে বেরিয়ে ঘাঁটা পর্যন্ত এসে দু’জন যে যার পথ ধরলেন।

নার্গিসের বয়স নিয়ে ধাঁধায় পড়ে গেছেন মহসিন রেজা। তবে আজ আবার কিছুটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন। হাজী সোলাইমান লোক মারফৎ তাকে বিকালে দেখা করার অনুরোধ পাঠিয়েছেন। হাজী সোলাইমানের মধ্যে হয়ত বোধোদয় ঘটেছে! স্কুল ছুটির পর হাজী সোলাইমানের বাড়ী ছুটলেন মহসিন রেজা। সেখানে আরো কয়েকজন উপস্থিত। ভেতরের উঠানে চেয়ার পেতে বসানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে তাদের। পারস্পরিক সৌজন্যতা বিনিময়ের মধ্যে মহসিন রেজা একটি চেয়ারে গিয়ে বসতেই তার জন্য চা–নাস্তা চলে এল। বাকিরা এ পর্বটি আগেই সেরেছেন।

‘বুঝলে মাস্টার আপনের একটি ভুল ভাঙ্গাইতে সোলাইমান আমাদের এখানে ডাকচে।’ উপস্থিত লোকদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্কজন বলেন। ষাটের মত বয়স তার। দাড়ি লাল মেহেদি রাঙা। চুলও একই রঙে রাঙা বুঝা যায় মাথার টুপি গলে বেরিয়ে পড়া চুল দেখে।

শুরুতে এমন কথায় ধাক্কা খেলেন মহসিন রেজা। লোকটির কথা শেষ হয়নি বুঝতে পেরে চায়ের কাপ হাতে লোকটির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। লোকটি বলতে থাকেন, ‘এ স্কুলে আসছেন বছর দুই মত। আপনে বাইরের লোক, স্কুল নিয়েই থাকেন। এলাকার ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামিয়েন না। বলাতো যায়না কখন কে কি করে বসে।’ উপস্থিত লোকগুলো কেউ মুখে, কেউ মাথা নেড়ে কথায় সায় দিল।

মহসিন রেজার বাড়ী অন্য গ্রামে। তাহলে শাসাতেই এ আয়োজন! আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে ইচ্ছা করেনা মহসিন রেজার। কিন্তু অন্যরা না উঠলে বসে না থেকে উপায়ও নেই তার।

‘সোলাইমান কাগজডা দেখাও মাস্টাররে।’লোকটির মুখ থেকে কখন এ ডাক শুনবেন যেন সেই অপে াতেই ছিলেন হাজী সোলাইমান। তার একজনের পরে মহসিন রেজার চেয়ার। মাঝখানের লোকটিকে দিয়ে কাগজটি মহসিন রেজার দিকে দ্রুত এগিয়ে দিলেন হাজী সোলাইমান।

অনিচ্ছার মধ্যেই কাগজটিতে চোখ বুলিয়ে নিলেন হতাশ মহসিন রেজা। এটি নার্গিসের জন্মসনদ।

হাজী সোলাইমানের শারীরিক ভাষায় বিজয়ীর দম্ভ। বাকিদের মুখেও মিটি মিটি হাসি। একসময় সভা শেষ হল, মহসিন রেজাও বাঁচলেন সেই দমবন্ধ অবস্থা থেকে।

জন্মসনদ নিয়ে মহসিন রেজার মনের এ সন্দেহ আরো দৃঢ় হয় আলাপে প্রায় সবাই একই মত প্রকাশ করায়। এমন মিথ্যাচার মানতে পারছিলেন না। কিন্তু কি করবেন! আচমকাই আশার বিন্দু হয়ে দেখা দেয় ইসলামধর্ম শিক্ষকের পরো প্রস্তাবটি। তার সাথে বিষয়টি আলোচনা করতে গেলে বলেছিলেন ইসলামধর্ম শিক্ষক, ‘বাল্যবিয়ে কত মেধাকেই না অঙ্কুরে ধ্বংস করে দিচ্ছে! আমার কোন সহযোগিতার দরকার হলে বলবেন।’ সত্য উদঘাটনে নামতে আর দ্বিতীয়বার ভাবেননি মহসিন রেজা। তবে শুরু মহসিন রেজা একা করলেও ক্রমে তা রূপ নিয়েছে সাংগাঠনিক কাজে। স্কুলের ক্ষুদ্র একটি অংশ বাদে বাকিরা একজোট। সবাই মিলে ঠিক করেছেন সেই দিনের কর্মসূচি। নার্গিস উপলক্ষ টিকে দিয়ে এলাাকায় বাল্যবিয়ে বিরোধী সচেতনতা সৃষ্টির বীজ বপন করতে চান তারা।

এগিয়ে চলেছে প্রস্তুতি। কিন্তু ইসলাম ধর্ম শিক্ষকের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ বিরোধী পক্ষের লোকজন। তাকে দেখলেই মুখ লুকিয়ে কিংবা সরাসরি বিদ্রুপ ছুঁড়ে দেয় ওরা, ‘ভন্ড!’

বিদ্রুপ নীরবে হজম করে যাচ্ছেন ইসলাম ধর্ম শিক্ষক। আত্মবিশ্লেষণে এ বিদ্রুপ প্রাপ্যই মনে করেন। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন নবম শ্রেণিতে থাকতে। সেই তিনি এখন বাল্যবিয়ে বিরোধী ভূমিকায়! দু’চার কথা কেউ শুনিয়ে দিতেই পারে।

আত্মোপরাধবোধই বাল্যবিয়ে বিরোধী এ কাজে ঠেলে দিয়েছে ইসলামধর্ম শিক্ষককে। বিয়ে–পরবর্তী প্রথম দিকের মেয়ের মুখটি মনে হলেই বুকের ভেতরটা মোচড়ে মোচড়ে ওঠে তার। প্রাণোচ্ছ্বল মেয়েটি প্রচণ্ড ঝড়ে নেতিয়ে পড়া গুল্মের মত হয়ে গিয়েছিল। বাড়ি এলে দরজায় ভেতর থেকে খিল দিয়ে নিজেকে ঘরের মধ্যে আটকে রাখত। যে মেয়ে মায়ের পিছু ঘুর ঘুর করত, মায়ের হাত থেকে কাজ কেড়ে নিয়ে নিজে করতে চাইত বলে মায়ের বকুনি খেত, সেই মেয়েকে মা সাধাসাধি করেও ঘর থেকে বের করতে পারত না। শ্বশুরবাড়ির অনুকূল পরিবেশ পেয়ে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে মেয়ে। কিন্তু তারপরও মেয়ের মধ্যে এই সত্যটি আবিস্কার করেছেন তিনি, একজন মানুষের বেড়ে ওঠার ধাপগুলোর মধ্যে একটিও যদি স্বাভাবিক গতি পথে বাধাগ্রস্ত হয় সেই জেরে তার জীবন ছন্দ হারায়। মেয়েটি তাই সব সময় এমন মনমরা হয়ে থাকে ।

কি হবে! এমন কৌতুহলী প্রশ্নের মধ্যে এসে গেল সেই দিনটি। সকাল দশটার দিকে স্কুল চত্বর থেকে বের হয় ছাত্রী–শিক্ষক–অফিসষ্টাফদের সম্মিলিত তিন সারির র‌্যালি। পাড়ার ভেতরের রাস্তা ধ ধরে র‌্যালি যাচ্ছে। বেশি লোকদের কাছে বাল্যবিয়ে বিরোধী বার্তা পৌঁছে দিতেই এ কৌশল। তবে মহিলাদের কথা ভেবেই এ সিদ্ধান্ত। পাড়ার ভেতর দিয়ে গেলে র‌্যালির প্রতি বাড়ির মহিলাদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। একদম সামনে টানটান করে কোমড় উচ্চতায় টেনে ধরা ব্যানারটিতে বড় বড় করে লেখা– ‘বাল্যবিয়েকে সবাই না বলুন, ঘৃণা করুন।’ ছাত্রীদের হাতে হাতে প্ল্যাকার্ডে লিখা-‘আগে মানুষ পরে বিয়ে, বিতর্ক কেন এ নিয়ে!’,‘বাল্যবিয়ে বন্ধ কর করতে হবে’, ‘মেয়েরা কী বেশি খায়! বাল্যবিয়েতে করছ জবাই’, ‘বলছি তোমরা সবাই শোন,মেয়েরা নয় বোঝা কোন’…ইত্যাদি শ্লোগান।

র‌্যালি যত এগুচ্ছে দৈর্ঘ্যও বড় হচ্ছে। এলাকার প্রগতিশীল সংগঠনের এবং সাধারণ লোকেরা এসে যোগ দিচ্ছেন র‌্যালিতে। ইউনিয়ন পরিষদের খোলা মাঠে গিয়ে থামে র‌্যালি। সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে চেয়ারম্যানের হাতে তুলে দেয়া হয় নার্গিসের জন্মসনদপত্রের তদন্ত করার এবং বাল্যবিয়ে বিরোধী গণসচেতনতা তৈরির নিয়মিত কর্মসূচি পালনের দাবি সংবলিত স্মারকলিপি।

পরদিন। অফিসে বসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে গতকাল পালিত কর্মসূচির স্মৃতিচারণ করছেন মহসিন রেজা। এতটা হতে পারে ভাবেননি। তাদের কর্মসূচিতে ছিল শুধু স্কুলেরই অনুষ্ঠান হবে এটি। কিন্তু রূপ নিয়েছিল সার্বজনীনে। বিনা আমন্ত্রণেও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে এলাকার প্রগতিশীল মনের লোকেরা যোগ দিয়েছেন। স্থানীয় পত্রিকাগুলো যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে খবরটি ছেপেছে। দু’টি চ্যানেল তাদের আঞ্চলিক সংবাদেও দেখিয়েছে।

‘স্না–মালেকুম স্যার,’ এসে দরজায় দাঁড়িয়ে পর্দা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে বলে মেয়েগুলো। এতক্ষণ মনে মনে ওদেরই অপেক্ষায় ছিলেন মহসিন রেজা। মিষ্টিমুখ করাবেন। না এলে ডেকে পাঠাতেন ওদের। মেয়েগুলো এখন মহসিন রেজার চোখে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘দে’শলাই কাঠি’ কবিতায় বর্ণিত একটা ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠির মুখে উসখুস করা বারুদ আর বুকে জ্বলে উঠবার দুরন্ত উচ্ছ্বাস! অকপট আত্মস্বীকারুক্তি মহসিন রেজার, এ মেয়েগুলো এগিয়ে না এলে বাল্যবিয়ে বিরোধী এ কর্মসূচি তাদের মাথাতেই আসত না। মহসিন রেজার চোখের সামনে ভাসে ‘দে’শলাই কাঠি’ কবিতার সেই লাইনগুলো–

“আমরা বন্দী থাকবো না তোমাদের পকেটে পকেটে, আমরা বেরিয়ে পড়ব, আমরা ছড়িয়ে পড়ব শহরে, গঞ্জে, গ্রামে দিগন্ত থেকে দিগন্তে।”

কবিতা একটু আনমনাই করে তুলেছিল মহসিন রেজাকে। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েগুলো উসখুস নড়াচড়ায় তা কেটে গেল। ওদের সাদর অভ্যর্থনা জানানোর মত ভেতরে ডেকে নিলেন। এ কয়েকদিন একসাথে কাজ করায় স্যারদের সামনে এখন অনেকটা জড়তামুক্ত মেয়েগুলো। তবে তা শ্রদ্ধা অক্ষুন্ন রেখে। ‘স্যার’। ঊচ্ছ্বসিত কণ্ঠে একইসঙ্গে বলে উঠে ওরা।

মহসিন রেজা এবার আর ওদের থামায় না। বরং স্নেহ প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে মিটি মিটি হাসি মুখে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। মেয়েগুলোর একসঙ্গে কথা বলাটা এখন মহসিন রেজার কাছে বিরক্তিকর নয়, বরং ভোরের এক ঝাঁক পাখির মিষ্টি কিচিরমিচির মতই লাগছে।

বলে চলে ওরা, ‘স্যার নার্গিসের বিয়ে হচ্ছে না। থানা , ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নার্গিসের বাবাকে চিঠি দিয়েছে বিয়ে বন্ধ রাখতে।’

এ খবর আগেই পেয়েছেন মহসিন রেজা। প্রশাসন বিষয়টি তদন্ত করে তারপরই নার্গিসের বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানাবে। তবু জানা সংবাদটি মুগ্ধ শ্রোতার মত শুনছেন মহসিন রেজা, মেয়েগুলো খবরটি তাকে জানিয়ে যে আনন্দ পাচ্ছে তা থেকে তাদের বঞ্চিত করতে চাননা তিনি। ওদের কথা শেষ হলে দেয়াল ঘেঁষে শেলফের ওপর তাকে রাখা মিষ্টির প্যাকেটের দিকে ইংগিত করে বলেন মহসিন রেজা, ওটা নিয়ে এসো।

একজন গিয়ে প্যাকেট নিয়ে এসে স্যারের টেবিলে রাখে। মহসিন রেজা প্যাকেট খুলে ওদের দিকে এগিয়ে ধরে বলেন, ‘নাও।’

স্যার নিজে প্যাকেট খুলে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন! ওরা অবাক। ইতস্তার মধ্যে প্রত্যেকে একটি করে মিষ্টি নিয়ে খেতে থাকে। হঠাৎ একজনের খেয়াল হল, স্যারকেও দেয়া দরকার। এদিক ওদিক খুঁজে দেখতে না পেয়ে বলে সে, ‘স্যার প্লেইট আছে? ’

‘প্লেইট লাগবে না,’ বলে একটি মিষ্টি তুলে নিলেন মহসিন রেজা। মিষ্টিতে কামড় দিতে দিতে ভাবেন, কথাটি এখনই ওদের বলা ঠিক হবে কি হবে না। ওদের সাবধান করা তো দরকার। হাজী সোলাইমানের লোকেরা কর্মসূচি পালনের আগেও গ্রামের মানুষদের এই বলে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালিয়েছে, মেয়েগুলোই গ্রামের মানসম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। ওরাই বাইরের লোক মহসিন রেজাকে উসকে দিয়েছে। আর মহসিন রেজাও সায় দিয়েছেন নার্গিসের উপর কুনজর পড়ায়। মহসিন রেজা জানেন, হাজী সোলাইমানরা চুপ করে থাকবেন না। নিজেকে নিয়ে ভয় পাচ্ছেন না মহসিন রেজা। তার ভয় মেয়েগুলোর জন্য। প্রতিহিংসা থেকে যদি হাজী সোলাইমানের লোকেরা মেয়েগুলোর কোন ক্ষতি করে বসে!

মনের দুশ্চিন্তা মহসিন রেজার মুখের উপরও কাল ছায়া ফেলে। স্যারের হঠাৎ এ পরিবর্তনে মেয়েগুলোও ঘাবড়ে গিয়ে মূর্তির–মত হয়ে যায়। সেটি খেয়াল হতেই মেয়েগুলোর আনন্দ মাটি করে দেয়ার অপরাধবোধ চিন চিন করে ওঠে মহসিন রেজার বুকে। সে মুহূর্তে বিবেকের পরামর্শও পেয়ে গেলেন তিনি, হাজী সোলাইমানদের প্রসঙ্গ আজ নয়। এবার পরিবেশ স্বাভাবিক করতে প্রাণোচ্ছ্বল হাসিতে মনের কথাটিই ব্যক্ত করলেন মহসিন রেজা, ‘তোমাদের কাছ থেকে বড়দেরও শেখার আছে।’

এ কী বলছেন স্যার! লজ্জা পেল মেয়েগুলো। লজ্জারাঙামুখে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ একজন আরেক জনের দিকে তাকায় ওরা। তারপর স্যারকে সালাম দিয়ে হাতের কাচের চুরির মত রিনিঝিনি হাসি ছড়িয়ে দিয়ে পালিয়ে বাঁচল।

‘তোমাদের মুখের এ হাসি যেন কখনো মুছে না যায়।’ ওদের পথের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করেন মহসিন রেজা।

(সংগৃহীত)

এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত