বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বাংলাদেশ

অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বাংলাদেশ

ড. নারায়ন বৈদ্য, ০৬ জানুয়ারি, এবিনিউজ : অর্থনীতি বিষয়ের ছাত্র–ছাত্রীদের ‘অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারা’ (ফাইভ কান্ট্রিজ) বলে একটি পত্র পড়াশুনা করতে হয়। উক্ত পত্রে পাঁচটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কে বিস্তারিত পড়াশুনা করতে হয়। এ পাঁচটি দেশ হয়ণ্ড বৃটেন, আমেরিকা, রাশিয়া, চীন ও জাপান। প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিভাবে সংগঠিত হয়েছিল, উন্নয়নের কোন স্তরে এ দেশগুলো বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিলণ্ডএসব বিষয় সম্পর্কে প্রত্যেক ছাত্রকে বিস্তারিত জানতে হয়। এসব দেশের মধ্যে চীন এবং রাশিয়া (পূর্বে) ছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আর অপর তিনটি দেশ ছিল পুঁজিবাদী দেশ। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছেণ্ড সমাজতান্ত্রিক দুইটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা বা গতিপ্রকৃতি কখনো একরকম ছিল না। রাশিয়ার রুশ বিপ্লবের পরে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য লেলিনের গৃহীত পদক্ষেপ আর চীনের মাও সেতুং এর গৃহীত পদক্ষেপ কখনো একরকম ছিল না। দুইটি সমাজতান্ত্রিক দেশের মৌলিক বিষয়গুলো মিল থাকলে প্রায়োগিক দিক ছিল ভিন্ন। অর্থাৎ দুই দেশের গতিপ্রকৃতি ভিন্ন থাকার কারণে দুই দেশকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়। অনুরূপভাবে জাপান, আমেরিকা, বৃটেন– পুঁজিবাদী দেশ হওয়া সত্বেও এসব দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য গৃহীত পদক্ষেপ একই ধরণের ছিল না। জাপান ও বৃটেন ছিল রাজা শাসিত। আবার দুই দেশে রাজার ক্ষমতা নিয়মতান্ত্রিক হয়ে দাঁড়ায়। আমেরিকার শাসন ব্যবস্থায় কখনো রাজা ছিল না। বিশেষ করে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। বর্তমান সময়ে এ পাঁচটি দেশের প্রত্যেকটি হয় উন্নত দেশ।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারায় দেখা যায়, প্রত্যেকটি উন্নত দেশকে উন্নয়নের চারটি স্তর পার করে বর্তমান অবস্থায় আসতে হয়েছে। এ চারটি স্তর হয়ণ্ড অনুন্নত, স্বল্পোন্নত, উন্নয়নশীল ও উন্নত। এ চারটি স্তরের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন স্তরে তা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। ছোটকাল থেকে যতবার রচনা লিখেছি প্রত্যেকবার প্রথমে লিখেছি ‘বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ’। আসলে কি বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ। প্রিয় পাঠক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরীক্ষার উত্তরপত্র পরীক্ষণ করতে গিয়ে প্রায় উত্তরপত্রে ছাত্র–ছাত্রী লিখে যেত ‘বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ’। তাহলে উন্নয়নের চারটি স্তরের মধ্যে বাংলাদেশ কি তিনটি স্তর অতিক্রম করেছে? না। তা করতে পারেনি। একটি দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ধারায় কি কি স্তর অতিক্রম করলো তা হিসাব করার দায়িত্ব হল জাতিসংঘের। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (ইউএনসিডিপি) প্রতি তিন বছর পর পর একটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা (ট্রাইনিয়াল রিভিউ) সভা করে থাকে। একই সংগে বাংলাদেশে বর্তমান অবস্থায় স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে যেতে হলে তিনটি শর্ত রয়েছে। জাতিসংঘের এ তিনটি শর্ত হচ্ছে ১. কোন দেশ স্বল্পোন্নত (লেস ডেভেলাপ কান্ট্রি– এলডিসি) দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে হলে পর পর তিন বছর মাথাপিছু জাতীয় আয় (জিএনআই) এক হাজার ২৪২ ডলারের উপরে হতে হবে, ২. মানব সম্পদ উন্নয়ন সূচকে ১০০ এর মধ্যে ৬৬ বা তার বেশি অর্জন করতে হবে, ৩. অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে ৩২ বা তার নীচে থাকতে হবে।

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে যাওয়ার জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক আরোপিত তিনটি শর্তের প্রত্যেকটি বাংলাদেশ অর্জন করেছে। জাতিসংঘের তিনটি শর্তের মধ্যে দেখা যায় বাংলাদেশের বর্তমান মাথাপিছু জাতীয় আয় ১৬১০ ডলার। অথচ জাতিসংঘের শর্ত হচ্ছে পর পর তিন বছর মাথাপিছু জাতীয় আয় হতে হবে এক হাজার ২৪২ ডলার। এ শর্তটি বাংলাদেশ পালন করছে আজ তিন বছর। জাতিসংঘের ২য় শর্ত হচ্ছে যে, মানব সম্পদ উন্নয়ন সূচকে ১০০ এর মধ্যে ৬৬ বা তার বেশি অর্জন করতে হবে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের অবস্থান ৭০–এ। সুতরাং ২য় শর্তটিও অর্জিত হয়েছে। তৃতীয় শর্ত হচ্ছে যে, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার সূচক ৩২ বা তার নীচে থাকতে হবে। অথচ বর্তমানে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার সূচক ২৫.০৩ এ। এলডিসি থেকে কোন কোন দেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবে সে সিদ্ধান্ত হবে ইউএনসিপিডির ২০১৮ সালের মার্চের বৈঠকে। শর্ত পূরণ করা স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উন্নীত করার বিষয়টি বিবেচনা করবে সংস্থাটি। চলতি বছরে তিনটি শর্ত পূরণ করা বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পথে থাকা দেশগুলোর সঙ্গে থাকবে। জাতিসংঘের এ সংস্থাটির পরবর্তী বৈঠক হবে ২০২১ সালে। এ তিন বছরে তিনটি সূচক পিছিয়ে না পড়লে ২০২৪ সালে জাতিসংঘের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পাবে বাংলাদেশ। তবে এলডিসি হিসেবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বিদ্যমান সুবিধা ২০২৭ সাল পর্যন্ত ভোগ করতে পারবে বাংলাদেশ।

বর্তমানে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশে স্থানান্তরের সাথে সাথে এসব সুযোগ সুবিধা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়াসহ এশিয়া–আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বিনা শুল্কে রপ্তানি সুবিধা পাচ্ছে। বাংলাদেশের ৩৪ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের ২৭ বিলিয়ন ডলারই আসে এসব দেশ থেকে। এছাড়া স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা থেকে কম সুদে বা বিনা সুদে ঋণ সহায়তা পেয়ে থাকে। উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে চড়া সুদে ঋণ নিতে হবে। ২০২৭ সালের পর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুবিধা কমে যাবে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর পরই ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, কানাডাসহ বর্তমানে যে সব দেশ বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা দিচ্ছে, সে সব দেশ এ সুবিধা বহাল রাখবে বলে আশা করা যায়। ৪০ বছর ধরে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় রয়েছে। এখান থেকে বের হয়ে আসা জরুরি। ইহাকে এক ধরনের প্রমোশন বা মর্যাদা বলা যায়। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে নেয়া ঋণের সুদ বেড়ে যাবে।

২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের বিবেচনায় বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের খ্যাতি অর্জন করার পরপরই অনেক দেশ ও সংস্থা তাদের ঋণের সুদ বাড়িয়ে দিয়েছে। এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, ২০২৭ সালের পর বাংলাদেশ আর এলডিসি–এর সুবিধা পাবে না। তবে এ সময়ে যাতে আরো ভাল সুবিধা পাওয়া যায় সেজন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে আরো চেষ্টা চালাতে হবে। ঐকান্তিক চেষ্টা চালালে এ সুবিধাগুলো বন্ধ হলেও আরো ১০টি সুবিধার দুয়ার খুলে যাবে।

২০২৪ সালে যদি বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয় তবে ২০২৭ সাল পর্যন্ত এলডিসি হিসেবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বিদ্যমান সুবিধা ভোগ করতে পারবে বাংলাদেশ। এ ২০১৭ সাল থেকে অর্থাৎ বর্তমান সময় থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত প্রায় এক দশকে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে থাকবে না। অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাবে। এ দেশের রপ্তানিকারকেরা এ সময়ে রপ্তানি প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা অর্জন করবে। তাছাড়া উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পরও যাতে এখনকার মতোই জিএসপি সুবিধা পাওয়া যায় সেজন্য বাংলাদেশ সরকারকে চেষ্টা চালাতে হবে। তাই রপ্তানি সুবিধা নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছুই নেই। তবে একটি অসুবিধাও আছে। বাংলাদেশ তার উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ পেতে বেশি সুদ গুণতে হবে। তবে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর হলে সুনামের পাশাপাশি বিনিয়োগ, বাণিজ্যে নতুন কিছু সুবিধাও পাওয়া যাবে। বিনিয়োগে বিদেশীদের আস্থা বাড়াবে। তাই যতই তাড়াতাড়ি বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবে ততই উন্নত দেশে আশা নিয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে বাংলাদেশের জনগণ পরিশ্রম করতে পারবে।

লেখক : প্রাক্তন অধ্যক্ষ, গাছবাড়ীয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম

(সংগৃহীত)

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত