বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

সংকটে শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষক

সংকটে শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষক

বাসুদেব খাস্তগীর, ০৯ জানুয়ারি, এবিনিউজ : বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজমান। দেশের প্রাথমিক থেকে শুরু করে সরকারী বেসরকারী শিক্ষা ব্যবস্থায় নানা ধরনের অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ছে। পত্র-পত্রিকায়, মিডিয়ায় এ নিয়ে প্রতিনিয়ত খবর শিরোনাম হয়ে আসছে। কিছুদিন আগে সহকারী প্রাথমিক শিক্ষকরা আন্দোলনে গেলেন, নন এমপিও শিক্ষকরা আন্দোলনে ছিলেন। তাঁদের শিক্ষাদানে ছাত্রছাত্রীরা সার্টিফিকেট পায়, কিন্তু তাঁরা বেতন পান না। এমনপিওভুক্ত লক্ষ শিক্ষক পাহাড়সম অনেক সমস্যায় জর্জরিত। তারাও অচিরে হয়তো আন্দোলনে সামিল হবে।

চলছে ক্যাডার নন ক্যাডার দ্বন্দ্ব । প্রশ্ন ফাঁস এখন বিষফোঁড়া হয়ে ওঠছে। এক্ষেত্রে শুধু শিক্ষকদের টেনে আনা হচ্ছে। এগুলোর গভীরে যেতে না পারলে সর্বনাশ ঘটতেই থাকবে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এখন প্রচ- সংকটের মুখোমুখি। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকরা যেনো অতি অপাঙক্তেয়। আর শিক্ষা ক্যাডারের লোক দ্বারা বেসরকারী শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় বেসরকারীদের সুযোগ সুবিধা, অবস্থান, প্রাপ্তি কোনটাই এরা তেমন গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেন বলে মনে হয় না।

বেসরকারী শিক্ষকরা যুগের পর যুগ নিপীড়নের শিকার। সরকারের ভেতরের একটি মহল হয়তো মনে করছে সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরকে খুশি রাখলেই হলো। শিক্ষককে তার ন্যায্য পাওনা দিয়ে খুশি রাখলেই কী আবার না রাখলেই কী। তারা সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে কোন নিয়ামক শক্তি নয়। একটি পক্ষ শিক্ষককে সরকারের প্রতিপক্ষ করে তুলছে। এটি সরকারের জন্য অবশ্যই একটি অশনিসংকেত। বাংলাদেশের শিক্ষা সেক্টরের অধিকাংশ শিক্ষকই মান মর্যাদা ও জীবন জীবিকার প্রশ্নে কঠিন সময়ের মুখোমুখি। বাংলাদেশে সব পেশাজীবী শ্রেণী থেকে বেসরকারী শিক্ষকসহ নানা স্তরের শিক্ষক নানা ধরনের সমস্যায় নিপতিত আছেন। এই বাংলাদেশে হাজার হাজার টাকা দিয়ে সরকারী স্কুলে লিফট বা চলন্ত সিঁড়ির চিন্তা হয়। আর বেতন না পেয়ে লাখো শিক্ষক মানবেতর জীবনযাপন করে। চলন্ত সিঁড়ির বাণিজ্যে কেউ কেউ হয়তো লাভবান হতে পারেন, শিক্ষকদের বেতন দিয়ে দিলে কারো কোন হয়তো লাভ বা বাণিজ্যের সুযোগ থাকে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়, শিক্ষকদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হয় না। অবকাঠামোর সাথে সাথে শিক্ষকদেরও সমান উন্নয়ন দরকার।

সেদিন টিভিতে কোন একটা চ্যানেলে শিক্ষকদের নিয়ে একটা টকশো দেখছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের এক শিক্ষককে মাছরাঙা টিভির একজন সাংবাদিক বুঝাতে চাচ্ছেন শিক্ষকরাই সব নষ্টের মূল। কোচিং, প্রাইভেট, ক্লাসে না পড়ানো ইত্যাদি ইত্যাদি নানা অভিযোগ। শিক্ষক মহোদয় বুঝাতে চাইছেন একজন শিক্ষককে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় আর্থিকভাবে নিরাপত্তা দিতে না পারলে তাঁরা জীবনের সাথে তাল মেলাতে বিভিন্ন পন্থা খুঁজতেই পারেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ভাতা নিয়েও কথা উঠেছে। সাংবাদিক মহোদয় বলছেন, বিশ্ববিদালয়ের শিক্ষকরা পর্যাপ্তই বেতন পান। শিক্ষক মহোদয় বিভিন্ন দেশের উদাহরণ নিয়ে বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা এমনকি পাকিস্তানের তুলনায়ও বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের বেতন ভাতা অনেক কম। এখানে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা কত বেতন পান সে কথাও আলোচনা এসেছে। কিন্তু তার গভীরে যাওয়া হয়ণি। সবার সোজা সাপটা কথা বেতন ভাতা ডবল হয়েছে। সেই ডবলের শুভংকরী ফাঁকি বোঝাতে বেসরকারী শিক্ষকদের কোন প্রতিনিধি টেলিভিশনের টকশোতে নাই।

আরো একটি চ্যানেলে দেখলাম ‘শিক্ষকদের বেতনভাতা ডবল হয়েছে’ টকশোতে আলোচনাকারী সকলের এমন একটি ধারণা সবার মধ্যে বদ্ধমূল। এবার আসি সেই আলোচিত ডবলের কথায়। বাংলাদেশের মাধ্যমিক স্তর থেকে ডিগ্রি লেবেল পর্যন্ত পঁচানব্বই ভাগের বেশি শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত হয় বেসরকারী শিক্ষা ব্যবস্থায়। সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর উপজেলা হেডকোয়াটার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীরা সরকার প্রদত্ত মূল বেতন ছাড়া তেমন কোন আর্থিক সুবিধাই পান না। কিছু কিছু ব্যতিক্রম হয়তো আছে। সে ক্ষেত্রে উপজেলার বাইরে অধিকাংশ শিক্ষক সরকার প্রদত্ত মূল বেতনের প্রারম্ভিক অংশ ছাড়া অন্য যা পান তা নিতান্তই অপ্রতুল। কিন্তু এরাই শিক্ষক সমাজের সিংহভাগ।

অনেকে শুধু স্কেলের প্রারম্ভিক অংশ নিয়েই চাকরী করছেন দীর্ঘদিন। আর প্রতিষ্ঠানভেদে আছে নানা বৈষম্য। প্রতিষ্ঠানপ্রদত্ত আয় থাকলেও সে আয় কমিটির মাধ্যমে ঐ চলন্ত সিঁড়ির মত নানা অজুহাতে নানা প্রজেক্টে চলে যায়। এখানে সাধারণ শিক্ষকদের করার কিছুই থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান প্রধানও এক্ষেত্রে অসহায়। এ হচ্ছে শিক্ষকদের ডবল বেতন পাবার নমুনা। সরকারী চাকুরেদের সাথে শিক্ষকদের বেতন ভাতার ইতিমধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে পাহাড়সম বৈষম্য। বেসরকারী শিক্ষকরা এখনো ৫% ইনক্রিমেন্টটিও পান নি।

মাছরাঙা টিভির ঐ সাংবাদিক শিক্ষকদের নীতি-নৈতিকতা নিয়ে কথা বলছেন। নীতি নৈতিকতা আছে বলেই শিক্ষকরা চুরি-চামারি করতে পারেন না। কিছু সংখ্যক কোচিংবাজ শিক্ষকদের জন্য সকলকে দায়ী করা যায় না। গুটিকয়েক ছাড়া অধিকাংশ শিক্ষকই আজ সংকটে। ভাবতে হবে তাঁরা এই সমাজেরই মানুষ। তাদের ন্যায্য প্রাপ্তি দিয়েই তাঁদের তদারকি করেন, মনিটরিং করেন। তাঁদের আন্দোলনের মুখে ঠেলে দেয়া কারো জন্য সুখকর নয়।

সাংবাদিক মহোদয় বলছেন, ‘বেতন ভাতা বাড়ালেই হলেই কী কোচিং দুর্নীতি বন্ধ হবে’?

একটি পরিবেশের মধ্যে নিয়ে আসলে সব কিছু সম্ভব। পরীক্ষায় নকলের উৎসবের এদেশে নকল এখন স্বপ্ন। প্রশ্ন করতে পারি, সরকারী সব সুযোগ-সুবিধা ডবল হয়েও পুলিশ, কোট কাচারী, ভূমি, শিক্ষা প্রশাসনে দুর্নীতি, ঘুষ কি কমেছে? ডাক্তারের প্রাইভেট প্র্যাকটিস নিয়েও কথা হয় না তা তো নয়। ফলটা কি? এখন বুঝা যায়, পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষার নেওয়ার পিছনে যতটা না ছাত্রকে জ্ঞানমুখী করার প্রচেষ্টা ছিলো তার চেয়ে বেশি ছিলো একশ্রেণীর মানুষের গাইড বই ও কোচিং করার বাণিজ্য। কচি কচি ছেলেমেয়েরা কেন বারো-চৌদ্দটি বইয়ের ঘানি টানেন?

উত্তর সোজা। কি কোন বাণিজ্য নাই?

একটি মহল দীর্ঘদিন ধরে সরকারের সঙ্গে শিক্ষকদের দূরত্ব সৃষ্টি করে চলেছে। তা হতে হতে এখন আশঙ্কাজনক রূপ নিচ্ছে। অতি সম্প্রতি শিক্ষকদের আন্দোলন তারই প্রমাণ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে অবশ্য তারা আপাতত ফিরে গেছে। মধ্যম আয়ের দেশ বলে পরিচিত এই দেশে শিক্ষকদের বেতন ভাতার জন্য নিরন্তর আন্দোলন অনভিপ্রেত। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে বেসরকারী শিক্ষকদের মত বঞ্চিত পেশাজীবী বোধ হয় আর নাই। অনেক দিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভে অনেক সময় অনেক কথাই চলে আসে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অডিটের নামে যা হয় তা শিক্ষকদের উপর মড়ার উপর খাঁড়ার গা’র সামিল। শিক্ষাকে যদি রাষ্ট্র ও সমাজ পরিবর্তনের নিয়ামক শক্তি ভাবতে না পারেন তাহলে সমস্যা সমস্যাই থেকে যাবে। গুণগত শিক্ষার জন্য গুণগত শিক্ষক দরকার, উপযুক্ত বেতনভাতা, সুযোগ সুবিধা দরকার। সবার মাঝে সুন্দর শুভবুদ্ধির বিকাশ ঘটা প্রয়োজন। শুধু পাসের হার বাড়লে, বছরের প্রথম দিন ছাত্রছাত্রীদের হাতে বই তুলে দিলে শিক্ষার উন্নয়ন হয় না। শিক্ষার উন্নয়নের সাথে একটি জাতির সামগ্রিক উন্নয়ন জড়িত।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বিএমসি কলেজ, চট্টগ্রাম।

(সংগৃহীত)

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত