![বাংলাদেশ–ভারত সীমান্তে হত্যাকাণ্ড: বাংলাদেশের প্রতি ভারতের অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের বহিঃপ্রকাশ](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/01/11/dr.-mainul_120017.jpg)
ড. মইনুল ইসলাম, ১১ জানুয়ারি, এবিনিউজ : ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি তারিখে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী এলাকার অনন্তপুরের বাংলাদেশ–ভারত সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে পিতার সাথে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের জনৈক সিপাহী অমিয় ভট্টচার্যের সরাসরি গুলিতে বাংলাদেশের কিশোরী ফেলানী নিহত হয়েছিল। নিহত হওয়ার পর ফেলানীর মৃতদেহ শিকারীর গুলিতে নিহত পাখীর মত চারঘণ্টা কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে ছিল। এরপর অত্যন্ত অমানবিকভাবে একটি বাঁশে ফেলানীর মৃতদেহ বেঁধে কাঁধে ঝুলিয়ে সেটা বাংলাদেশ সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী বিজিবি’র কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। হত্যাকাণ্ডের পর ঝুলে থাকা ফেলানীর মৃতদেহের ছবি এবং ঐ অমানবিকভাবে মৃতদেহ হস্তান্তরের ছবি সারা বিশ্বের টেলিভিশনে ‘লাইভ’ প্রদর্শনের কারণে ফেলানী হত্যাকাণ্ড এরপর থেকে সীমান্তরক্ষার নামে বাংলাদেশ–ভারত সীমান্ত জুড়ে ভারতের নিষ্ঠুর নরহত্যার দলিল হিসেবে বিশ্বের মানুষের বিবেকে গেঁথে রয়েছে। এক্ষেত্রে যেটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ তাহলো, যেহেতু ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় ফেলানীকে সরাসরি গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে তাই ভারতের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি দেখা দেয়াতে গুলি করা হয়েছিল বলার কোন যুক্তি নেই। যেন মনের সুখে ‘টার্গেট প্র্যাকটিস’ করার জন্যেই ঐ নিষ্ঠুর নরহত্যা, যেটাকে ঠাণ্ডা মাথায় খুনের অপরাধ আখ্যা দেয়াই যৌক্তিক! বিশেষত, যেহেতু ভারত এবং বাংলাদেশের বর্তমান সরকার দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ককে ‘সবচেয়ে বন্ধুসুলভ’ বলে আখ্যায়িত করে থাকে তাই এই দু’দেশের সীমান্তে কোন উস্কানি ছাড়া কেন সরাসরি গুলি চালিয়ে মানুষ মারা হবে তার কোন সদুত্তর ভারতীয় পক্ষ থেকে গত সাত বছরে কখনোই পাওয়া যায়নি। ঐ হত্যাকাণ্ডের সাত বছর অতিবাহিত হওয়ার পর আজও ফেলানী হত্যার কোন সুবিচার মেলেনি। বরং, বিএসএফ সংক্রান্ত ভারতের নিম্ন–আদালতের বিচারে হত্যাকাণ্ডের আসামি অমিয় ভট্টচার্যকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে। এই রায়ের বিরুদ্ধে ভারতের একটি উচ্চতর আদালতে আপিল করা হয়েছে এবং আপিল মামলার শুনানী কয়েক দফা পিছানোর পর আগামী ১৭ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে আবার নাকি শুনানীর তারিখ পড়েছে। পুনরায় যে তারিখ পেছাবেনা তারও কোন নিশ্চয়তা নেই, কারণ ভারতের কাছে নতজানু বাংলাদেশের সরকার বোধগম্য কারণেই বিষয়টি নিয়ে তেমন কোন উৎসাহ দেখায়নি এই সাত বছরে। একজন মানবাধিকার আন্দোলনকারী এডভোকেট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই দীর্ঘ আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি মনে করি, এভাবে সীমান্তে ভারত কর্তৃক অব্যাহতভাবে বাংলাদেশী নাগরিক হত্যার গুরুত্বকে দু’দেশের সরকার যেভাবে পরিকল্পিতভাবে লঘুকরণের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে তাকে কোনভাবেই সমমর্যাদা–সম্পন্ন দুটো বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশের যৌক্তিক সুসম্পর্ক–উদ্ভূত আচরণ বিবেচনা করা যাবে না। বরং, এর মাধ্যমে আধিপত্যবাদী আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারতের ক্ষুদ্রতর প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতি তাচ্ছিল্যকর দৃষ্টিভঙ্গিই ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশ যেখানে কোন ভারতীয় নাগরিক হত্যার ঘটনা ঘটাচ্ছে না, সেখানে ভারত কর্তৃক দু’দেশের সীমান্তে একতরফাভাবে প্রায়ই বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা চালানো নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের অবজ্ঞাপূর্ণ ও হেয়কর আচরণ বলাই সমীচীন মনে করি।
আমরা অনেকেই হয়তো এদ্দিনে ভুলে গেছি যে ফেলানী হত্যার কিছুদিন পর ২০১২ সালে ভারতীয় সীমান্তে একজন বাংলাদেশী নাগরিককে সম্পূর্ণ ন্যাংটো করে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে বিএসএফ এর সিপাহীরা প্রচণ্ড মারধোর করার চিত্রও সারা বিশ্বের মিডিয়ায় প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। অতএব, ভারতীয় সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকদের প্রতি বিএসএফ সিপাহীদের এহেন অবমাননাকর আচরণ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ওয়াকিবহাল মহলের জানা রয়েছে যে এ–ধরনের ঘটনাগুলো নিয়মিত ঘটেই চলেছে প্রধানত ভারত থেকে বাংলাদেশে গরশু চোরাচালানিদের ক্ষেত্রে। অথচ, বাংলাদেশ–ভারতের সীমান্তপথে শুধু গরু পাচারের ক্ষেত্রে নয় আরো অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে এহেন চোরাচালান উভয় দেশের চোরাচালানি, বিএসএফ ও বিজিবি, শুল্ক কর্তৃপক্ষ , পুলিশ এবং মাস্তানদের জন্যে অত্যন্ত লোভনীয় বাণিজ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। এই অবৈধ বাণিজ্য কোন গোপনীয় তৎপরতা নয়, এটা আসলে উপরে উল্লিখিত পক্ষগুলোর মধ্যে সুনির্দিষ্ট লেনদেনের মাধ্যমে পরিচালিত ‘ফেইল্যুর–প্রুফ’, প্রচণ্ড মুনাফাদায়ক বাণিজ্য। এ–পর্যায়ে পাঠকদেরকে বলছি, চোরাচালান সম্পর্কে আমি যেহেতু ১৯৯০ সাল থেকে গত ২৭ বছর ধরে গবেষণা করে চলেছি তাই আমি এই বিষয়ে যে মন্তব্যগুলো করব সেগুলোকে যথাযথ গুরুত্বের সাথে অনুধাবনের প্রয়াস নিলে বাধিত হব। ১৯৯০ ও ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা বিআইডিএস থেকে ‘বাংলাদেশের অবৈধ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য‘ শিরোনামের যে গবেষণা প্রকল্পটি সম্পন্ন করে সুবিশাল গবেষণা প্রতিবেদনটি দুই কিস্তিতে প্রকাশিত হয়েছিল আমি তার অন্যতম প্রণেতা। ডঃ গফুর এবং ডঃ নওশাদ ফয়েজ ছিলেন ঐ প্রতিবেদনের অন্য দুই প্রণেতা। আমাদের এই প্রায় সাড়ে তিনশ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি এই বিষয়ে বাংলাদেশের পাইওনিয়ার রিসার্চ প্রজেক্টের প্রতিবেদন হিসেবে দেশে–বিদেশে স্বীকৃত। এরপরও আমি ঐ বিষয়ে মাঠ–পর্যায়ে গবেষণা অব্যাহত রেখেছি গত ২৭ বছর যাবত, যার ভিত্তিতে আমার অনেকগুলো রিসার্চ পেপার দেশে–বিদেশে প্রকাশিত হয়েছে।
আমার সুনির্দিষ্ট অভিমত হলো, অধিকাংশ পণ্যের চোরাচালান বা অবৈধ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অর্থনৈতিক তত্ত্বের বিচারে প্রকৃত প্রস্তাবে কোন ‘ল এন্ড অর্ডার সমস্যা’ নয়, এটা ভুল অর্থনৈতিক নীতির কারণে উদ্ভূত একটি গুরুতর অর্থনৈতিক সমস্যা। অতএব, এই সমস্যার সমাধানও খুঁজতে হবে সঠিক অর্থনৈতিক নীতি পরিবর্তনের মধ্যে। যদি আমরা মনে রাখি যে চোরাচালান দমনে নিয়োজিত সকল সরকারি এজেন্সীর বেশিরভাগ কর্মকর্তা–কর্মচারী প্রকৃতপক্ষে চোরাচালানিদের সাথে আর্থিক লেনদেনের বিনিময়ে নির্বিঘ্নে চোরাচালানের পণ্য চলাচলের সুযোগ করে দিয়ে নিজেদের দুর্নীতিজাত খাজনা আহরণে ব্যাপৃত রয়েছে তাই আইনপ্রয়োগকারী বাহিনীর মাধ্যমে কঠোরভাবে চোরাচালান দমনের নিষ্ফল গলাবাজি করা থেকে বিরত থাকাই আমাদের পক্ষে সমীচীন হবে। মাঠ–পর্যায়ে গবেষণায় বারবার যে সত্যটা উঠে এসেছে তাহলো, চোরাচালানের যৌক্তিকতা সৃষ্টি হয় বৈধ বাণিজ্যের মত দুই প্রতিবেশী দেশের পণ্যের দামের পার্থক্য বণিকদের মুনাফা আহরণের জন্যে যথেষ্ট সুযোগ সৃষ্টি করার মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রযোজ্য শুল্ক ও কর কাঠামো এবং পরিমাণগত বাধানিষেধ আমাদের দেশে চোরাচালানের অব্যাহত প্রবাহকে শক্তি যুগিয়ে চলেছে গত ৪৭ বছর ধরেই। তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রমাণিত সত্য হলো, ফেইল্যুর–প্রুফ লেনদেন ব্যবস্থা চোরাচালানের ঝুঁকি নিরসনের জন্যে কার্যকর বিবেচিত হলে সীমান্তের দু’পারের বণিকরা চোরাচালানের মাধ্যমে পণ্যের ক্রয়–বিক্রয়কে বেশি মুনাফাদায়ক করে তুলতে সক্ষম হয় সরকারের শুল্ক ফাঁকি দিতে পারার কারণে এবং অন্যান্য পরিমাণগত বাধানিষেধ উপেক্ষা করে বাণিজ্যের খরচ কমানোর সুযোগ পেয়ে যাওয়ার কারণে। (অবৈধ অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য চোরাচালান, নারী পাচার, শিশু পাচার, জঙ্গি সন্ত্রাসীদের চলাচল, বিপজ্জনক অপরাধীদের গোপন চলাচল, সোনা পাচার, সীমান্তবর্তী অঞ্চলের বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর তৎপরতা—এগুলোও বাংলাদেশ–ভারত সীমান্তের অন্যতম জটিল সমস্যা, যার সাথে দু’দেশের জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যু ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই আন্ত–আঞ্চলিক ইস্যুগুলো সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ যথাযথ কঠোর ব্যবস্থা নিতেই হবে। তাই, ওগুলো অন্যান্য পণ্যের চোরাচালানের তত্ত্বের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করলে ভুল হবে।) এ–সম্পর্কে বিস্তৃত তাত্ত্বিক আলোচনা আমাদের গবেষণা প্রতিবেদনে উপস্থাপিত হয়েছে। বক্ষ্যমাণ কলামে তাই এই বিষয়ে বেশি ব্যাখ্যার প্রয়োজন দেখছি না। শুধু এটুকুই জানাচ্ছি, উপরে উল্লিখিত বিপজ্জনক ডাইমেনশানসমূহ বাদ দিয়ে সাধারণ চোরাচালানিদের চোরাচালানের মাধ্যমে ভারত থেকে যত পণ্য বাংলাদেশে যায় তার প্রাক্কলিত মূল্য বাংলাদেশ থেকে ভারতে চোরাচালান হওয়া পণ্যের মূল্যের চাইতে দশগুণেরও বেশি হবে বলে এ–সম্পর্কিত গবেষকদের মধ্যে একটা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মানে, বাংলাদেশ–ভারতের বৈধ বাণিজ্যের মত চোরাচালানেরও প্রধান ফায়দাভোগী ভারতীয় চোরাচালানি এবং আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের লোকজন। বাংলাদেশেও চোরাচালানকে ঘিরে শক্ত একটা প্রাতিষ্ঠানিক চোরাচালান–চক্র গড়ে উঠেছে সারা দেশের অর্থনীতিতে। আর, চোরাচালান যে বাংলাদেশে শত শত পণ্যের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রধান ধারায় পরিণত হয়েছে তা–ও গবেষণায় বারবার উঠে এসেছে। এই বিষয়ের গভীরে যাওয়ার সুযোগ পাওয়ায় অর্থনীতির গবেষক হিসেবে আমি জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। আমাদের অর্থনীতি ও রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নে চোরাচালান বিশাল ভূমিকা পালন করে চলেছে, এটা আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি। বাংলাদেশের দুর্নীতির অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ডাইমেনশান চোরাচালান, এটাই আমি প্রতিষ্ঠা করেছি আমার গবেষণার মাধ্যমে।
এখানে আমি শুধু এটুকুই বলতে চাচ্ছি,মাঠ–পর্যায়ের গবেষণা থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে চোরাচালানের লেনদেনের চুক্তির কোন একতরফা বরখেলাপ হলেই সাধারণত: চোরাচালানের মাঠ–পর্যায়ের অপারেটররা বিএসএফ এর গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনার শিকার হয়। গরু–মহিষ চোরাচালানিরাই যে বাংলাদেশ–ভারত সীমান্তে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় প্রাণ হারিয়ে থাকে এটা সরকার এবং ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নয়। আর, গরু চোরাচালানের ব্যাপারটা এই দু’দেশের বিশেষ সামাজিক ও ধর্মীয় বাস্তবতায় ১৯৪৭ সাল থেকেই চোরাচালানের দুই পক্ষেরই স্বাথরক্ষা করছে বললে অত্যুক্তি হবে না। যেসব গরু ভারত থেকে বাংলাদেশে পাচার হয় তার ৯০–৯৫ শতাংশই বয়সের কারণে বা ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে ভারতীয়দের কাছে অর্থনৈতিক গুরুত্ব হারিয়ে পরিহার্য–পণ্যে (dispensable commodity) পরিণত হয়। মানে, ওগুলোকে বিক্রয় করতে না পারলে ওগুলোর মৃত্যু পর্যন্ত ভরণপোষণের ব্যয় ওগুলো থেকে প্রাপ্ত সেবার তুলনায় অনেক বেশি পড়ে যায়। অন্যদিকে, ধর্মীয় কারণে গো–হত্যা সাধারণ হিন্দুদের কাছে মহাপাপ বিবেচিত হয়। আরো মজার তথ্য হলো, গরু চোরাচালানের সাথে উল্টোদিকে চামড়া চোরাচালানেরও একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পাওয়া যায়। অতএব, গরু চোরাচালানকে ক্রেতা–বিক্রেতা উভয় পক্ষের জন্যে একটা win-win solution বলা যেতে পারে। হয়তো এজন্যেই ১৯৪৭ সালের ভারত–বিভাগের পর ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান ও ভারতের বৈরী সম্পর্ক সত্ত্বেও সীমান্তপথে গরু–মহিষ চোরাচালানকে দু’দেশের সরকার তেমন একটা কঠোরভাবে দমনের প্রচেষ্টা চালায়নি এহেন বিবেচনা থেকে। গরুর বৈধ–বাণিজ্য চালাতে দিলে ভারতের সরকারের জন্যে সেটা কট্টর–হিন্দুত্বের অনুসারী মহল থেকে রাজনৈতিক সমালোচনা ডেকে আনবে বিধায় অর্থনৈতিক যুক্তি থাকা সত্ত্বেও দুদেশের বৈধ বাণিজ্যের পণ্যের তালিকায় কখনো গরু স্থান পায়নি, আবার গরু চোরাচালান হচ্ছে জেনেও না জানার ভান করতে তাদের আপত্তি ছিল না। ১৯৬৫ সালের পাক–ভারত যুদ্ধের পর দুদেশের সম্পর্ক চরম শত্রুতায় পর্যবসিত হওয়ার পরও গরু–চোরাচালান একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও প্রায় নির্বিঘ্নে চালু ছিল গরুর চোরাচালান। এমনকি ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তান–প্রেমী মহলের শাসন চালু হওয়া সত্ত্বেও গরুর চোরাচালানে ভারত কর্তৃক কড়াকড়ি আরোপের কোন নজির সৃষ্টি হয়নি। সম্প্রতি ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ভারতের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের মত কট্টর হিন্দুত্ববাদী কিছু কিছু বিজেপি নেতা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে ‘বাংলাদেশীদেরকে গরুর মাংস খাওয়া ভুলিয়ে দেওয়ার’ মত হাস্যকর গলাবাজি চালালেও উপরে বর্ণিত অর্থনৈতিক যুক্তি তাঁরা খন্ডাতে পারবেন মনে হয় না! মনে রাখতে হবে যে বাংলাদেশে উৎপাদিত গরুর সংখ্যা যদ্দিন অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা মেটানোর জন্যে অপ্রতুল বিবেচিত হবে তদ্দিন বাংলাদেশে গরুর গোশতের উচ্চ বাজার দাম ভারতের গরু চোরাচালানকে মুনাফাদায়ক বিবেচনা করায় উৎসাহ যোগাবে। অতএব, বৈধভাবে ভারত থেকে বাংলাদেশে গরুর মাংস রফতানির ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে গরু চোরাচালানকে বিএসএফ দিয়ে বন্ধ করা যাবে না। এমনকি, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েও যে এই চোরাচালান বন্ধ করা যাবে তা–ও মনে করি না। তবে, কিছুদিন পরপর সীমান্তে গুলি করে মানুষ হত্যা অব্যাহত রেখে বিএসএফ এর সীমান্তরক্ষীরা ভারতীয় সরকারকে মনে করিয়ে দিতে থাকবে যে তারা এ–ব্যাপারে কড়া নজরদারি জোরদার রেখেছে। এটা নেহাতই ‘ভাবের ঘরে চুরি’ ছাড়া আর কিছুই নয়। বেশিরভাগ বিএসএফ কর্মকর্তা–কর্মচারী যে চোরাচালানের ফায়দাভোগী হয়ে মালদার বনে যাচ্ছে সে খবর ভারত সরকারেরও জানা আছে নিশ্চয়ই!
সেজন্যেই বলছি, ভারত কর্তৃক সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা বন্ধ করার সদিচ্ছা ভারত সরকারকেই দেখাতে হবে। ভারত সরকারের কঠোর আদেশ জারি এ–ব্যাপারে প্রথম অবশ্য করণীয় কর্তব্য। সুনির্দিষ্টভাবে ভারত সরকারকে আইনী নিষেধাজ্ঞা জারির মাধ্যমে এহেন হত্যাকান্ডকে কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। প্রাণঘাতী গুলি বর্ষণের আগে রাবার বুলেট বা নিম্নাঙ্গে গুলি বর্ষণের মাধ্যমে অবৈধ সীমান্ত–পারাপারাকারীকে আহত করে গ্রেফতারকরার আদেশ জারি করে হত্যাকান্ডকে ‘জিরো টলারেন্স ক্রাইম’ ঘোষণা করা হলে হত্যাকান্ড ক্রমেই শূন্যে নেমে আসবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বাংলাদেশের প্রতি ভারতের বড়ভ্রাতাসুলভ দৃষ্টিভঙ্গির আশু পরিবর্তন। একটা সভ্য গণতান্ত্রিক দেশের সীমান্তে বন্ধুপ্রতিম দেশের নাগরিক হত্যাকে ভারত যেভাবে ‘মাইনর অফেন্স’ বা ‘নো অফেন্স’ হিসেবে বিবেচনা করে চলেছে তা কোনমতেই গ্রহণযোগ্য আচরণ বিবেচিত হতে পারে না। কিছুদিন আগে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ মুখে বলে গেলেন,‘সাবচে’ পহেলে বাংলাদেশ’। ভারত সরকারকে বলব, `Please put your money where your mouth is’ কাজে প্রমাণ করুন, বাংলাদেশকে আপনারা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ এবং সমমর্যাদাসম্পন্ন ভ্রাতৃপ্রতিম প্রতিবেশী হিসেবে বিবেচনা করেন। ১০ জানুয়ারি ২০১৮
লেখক : অর্থনীতিবিদ; ইউজিসি প্রফেসর
অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
(সংগৃহীত)