![কেমন মুদ্রানীতি চাই?](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/01/14/atiur_120471.jpg)
ড. আতিউর রহমান, ১৪ জানুয়ারি, এবিনিউজ : এ মাসেই বর্তমান অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতির ভঙ্গিটি প্রকাশিত হবে। এরই মধ্যে ‘কেমন মুদ্রানীতি চাই’ বিষয়টি নিয়ে অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, উদ্যোক্তা, অর্থনৈতিক সাংবাদিক ও সাবেক গভর্নরদের মতামত সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। জেনে ভালো লাগছে যে সংশ্লিষ্ট সবার মতামত নিয়ে মুদ্রানীতি প্রণয়নের যে ধারাটি ৯ বছর আগে চালু করেছিলাম, তা আমার উত্তরসূরি চালু রেখেছেন। শুধু চালু রেখেছেন বললে পুরোটা বলা হলো না। বলা যায়, আরো গভীরতর করেছেন। দিন দিন অংশগ্রহণমূলক মুদ্রানীতি প্রণয়নের ধারা আরো জোরালো হোক, সেই কামনা করছি। অনেকের ধারণা, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে দেওয়া এবারের মুদ্রানীতি মূলত মূল্যস্ফীতি মোকাবেলার কৌশলের কথা বলবে। একই সঙ্গে তারা এও আশা করছে যে আর্থিক খাতের সমকালীন বাস্তবতার নানা দিকও এতে স্থান পাবে। এবারের মুদ্রানীতির ধরনটা ঠিক কেমন হবে, তা এখনই বলা মুশকিল। তবে সমসাময়িক আর্থিক সূচকের আলোকে নিশ্চয়ই কিছু আঁচ-অনুমান করা সম্ভব। অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে প্রতিটি মুদ্রানীতির মূলে থাকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি। কেননা এই মূল্যস্ফীতিই গরিব মানুষের বেশি বেশি পকেট কাটে। এবারের মুদ্রানীতিতে তাই বিষয়টি হয়তো বেশি করে গুরুত্ব পাবে। চলমান খাদ্য মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার (ডিসেম্বর ২০১৭-তে যা ছিল ৭.১৩ শতাংশ) কারণে এমনটি হতে পারে। এপ্রিল-মে মাসে হাওরে আচমকা বন্যা, পরবর্তী সময়ে উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বন্যা, কোনো কোনো এলাকায় উৎপাদিত ধানে চিটা ধরা বা ব্লাস্টের আক্রমণের কারণে গেল বছর চালের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে কম হয়। এরই মধ্যে খবর আসে, সরকারি গুদামে চালের মজুদও কম। ঠিকমতো মনিটরিং হলে হয়তো এমনটি ঘটত না। তা ছাড়া চালের ওপর তখনো শুল্ক আরোপিত ছিল ২৮ শতাংশ। কেউ কেউ মনে করে যে এ হার কমাতে একটু দ্বিধার কারণে ব্যবসায়ীরা এর পূর্ণ সুযোগ নিয়েছে। চালের দাম হঠাৎ করেই তাই বেড়ে যায়। শুল্ক কমানো, ব্যক্তি ও সরকারি খাতে আমদানি বাড়ানো সত্ত্বেও চালের দাম এখনো পুরনো অবস্থানে আর ফিরে আসেনি। তবে বর্তমানে তা আগের চেয়ে অনেকটাই স্থিতিশীল রয়েছে। তা সত্ত্বেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি বছর শেষে অস্বস্তিকরই থেকে গেছে। পেঁয়াজ ও সবজির দাম বেশি থাকায় খাদ্য মূল্যস্ফীতির এমন দশা। এর প্রভাব খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির ওপরও পড়ার কথা। তাই গড় মূল্যস্ফীতি খানিকটা বাড়ার কথা। সেপ্টেম্বরে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৫.৫৫ শতাংশ। অক্টোবরে তা একটু বেড়ে হয়েছে ৫.৫৯ শতাংশ। তবে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি নভেম্বর ২০১৭-তে ছিল ৫.৯১ শতাংশ। ডিসেম্বরে তা কমে ৫.৮৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তার মানে পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, মূল্যস্ফীতি বছর শেষে কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে শুধু পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যের ওপর নির্ভর করে মূল্যস্ফীতির সূচকের গতি-প্রকৃতি নিয়ে আলাপ করা বেশ কষ্টকরই হবে বলে মনে হয়। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে মুদ্রার সরবরাহ সঠিকভাবে স্থির করতে এই সংখ্যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিসংখ্যানটি তাই নির্ভরযোগ্য হওয়া খুবই জরুরি। সে কারণে ‘ইনফ্লেশন এক্সপেকটেশন’ বা ‘মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা’ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব জরিপ থাকা খুবই বাঞ্ছনীয়। যদ্দুর মনে পড়ছে, এমন একটি জরিপ বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মিত করার উদ্যোগ নিয়েছিল। জানি না, এখনো তা চালু আছে কি না। না থাকলে তা ফের চালু করার প্রয়োজন রয়েছে। আগামী বছর মূল্যস্ফীতির ধরন কেমন হবে, সেটা অনুমান করার জন্য এই জরিপের গুরুত্ব অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। ওই জরিপের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক জনসমক্ষে প্রকাশ না করলেও মুদ্রানীতি প্রণয়নে তা যে যথেষ্ট উপকারে আসবে, সে কথা কোনো ম্যাক্রো-অর্থনীতিবিদই অস্বীকার করবেন না।
এটি নির্বাচনী বছর। তাই এ বছর সরকারি ও বেসরকারি খরচ বাড়বে। অন্যদিকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও রয়েছে অনিশ্চয়তা। সে ক্ষেত্রে বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। তখন ব্যাংক থেকে সরকারি ঋণের পরিমাণ বাড়তে পারে। এ কারণে মূল্যস্ফীতিও বাড়তে পারে। আগামী দিনগুলোতে মূল্যস্ফীতি বাড়ার ঝুঁকি মাথায় রেখে এবং চলমান জিডিপি প্রবৃদ্ধির বাড়ন্ত ধারা হিসেবে নিয়ে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করলে নিশ্চয়ই তা ‘সংযত’ বা কিছুটা ‘সংকোচন’ধর্মী হবে বলে বিশেষজ্ঞ মহল অনুমান করছে। মূল পলিসি হার (রেপো বা রিভার্স রেপো রেট) না বদলালেও ম্যাক্রো-প্রুডেনশিয়াল নীতিমালা হেরফের করে নিশ্চয়ই ‘সতর্ক’ বা ‘সংযমী’ মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা সম্ভব। মনে রাখা চাই, মূল্যস্ফীতি শেষ পর্যন্ত বাজারে বাড়তি টাকা সরবরাহের বিষয়। তাই বাজারে বিপুল পরিমাণে টাকা দৌড়াদৌড়ি করলে মূল্যস্ফীতির ওপর তার কোনো প্রভাব পড়বে না, সে আশায় গুড়ে বালি। সে কারণেই ব্যক্তি খাতে ঋণের পরিমাণ যে হারে এখনো বাড়ছে, তার লাগাম টেনে ধরার প্রয়োজন রয়েছে। ঋণ-আমানত সমানুপাত কমিয়ে তা নিশ্চয়ই করা সম্ভব। বাংলাদেশ ব্যাংক এই সমানুপাতকে এডিআর বলে। সাধারণ বাণিজ্যিক ব্যাংকের বেলায় এ হার ৮৫ শতাংশ। আর শরিয়ানির্ভর ব্যাংকের জন্য তা ৯০ শতাংশ। উভয় ধরনের বেশ কয়েকটি ব্যাংক এই সমানুপাত এরই মধ্যে টপকে গেছে। আমানতের হার কমা সত্ত্বেও কোনো কোনো ব্যাংক তার ঋণ দেওয়ার ধারায় পরিবর্তন আনেনি বলে এই বিপত্তি দেখা দিয়েছে। তাই উভয় ধারার ব্যাংকের জন্য এডিআর কমিয়ে আরেকটু নিচে নির্ধারণ করাই এ মুহূর্তে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আমার ধারণা, বাংলাদেশ ব্যাংক ওই পথেই হাঁটবে। আশার কথা, এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর স্বল্পকালীন তহবিল ব্যবস্থাপনা বিষয়ে তার নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশনা জারি করেছে। একই সঙ্গে ব্যাংক থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া আমানতকে ঋণ হিসেবে গণ্য করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তহবিল ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা বেশ খানিকটা ফিরবে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানে একই গ্রুপের ব্যাংক থেকে বিপুল আমানত জমা থাকতে পারে। সর্বশেষ এই নির্দেশনা এই ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে। তবে এ জন্য নির্দেশনা পরিপালনের সংস্কৃতি জোরদার করতে হবে।
আমাদের বর্তমান জিডিপি প্রবৃদ্ধির ধারা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য ব্যক্তি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি বড়জোর ১৫-১৬ শতাংশের বেশি হওয়ার কথা নয়। গত মুদ্রানীতিতে তেমন লক্ষ্যমাত্রাই ঠিক করা হয়েছিল। অথচ এই হার এরই মধ্যে ১৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। গেল অক্টোবরেও তা ষোলোর ঘরেই ছিল। বাড়তি এই ঋণ কোথায় যাচ্ছে, তা-ও খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। সে কারণে ব্যাংকগুলো থেকে তাদের স্বল্পকালীন তহবিল ব্যবস্থাপনার ওপর নিয়মিত প্রতিবেদন সংগ্রহের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের মাঠপর্যায়ের তত্ত্বাবধান আরো জোরদার করার প্রয়োজন রয়েছে। উল্লেখ্য, ভারতে ২০১৭ অর্থবছরে মাত্র ৫.১ শতাংশ হারে ঋণের প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। তবু তারা ৬ শতাংশের বেশি হারেই জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করেছে। তাই শুধু ঋণের হার বাড়ালেই প্রবৃদ্ধি বাড়বে—এমন প্রত্যাশা সঠিক নয়। খুব বেশি হারে ঋণ বাড়লে বিশেষ বিশেষ খাতে বুদ্বুদ সৃষ্টি হওয়া ছাড়াও বিদেশি মুদ্রার ওপরও চাপ বাড়ে। একই হারে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স না বাড়লে চলতি হিসাবে ঘাটতি বাড়ে। কমে যায় মাসের হিসাবে আমদানি সক্ষমতার সূচক। সব শেষে কমে মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ। আকুর হিসাব মেটানোর পর আমাদের রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে। আমদানির হার যেভাবে বাড়ছে, তাতে রিজার্ভের ওপর চাপ শিগগিরই কমবে বলে মনে হয় না। তার মানে ওপরে উল্লিখিত প্রবণতাগুলোর সঙ্গে বাস্তবতা অনেকটাই মিলে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন উদ্বৃত্ত থাকার পর চলতি হিসাবে ঘাটতির পরিমাণও হালে বেড়েছে। শুধু কি তাই, টাকার সঙ্গে বিদেশি মুদ্রা, বিশেষ করে মার্কিন ডলারের বিনিময় হারও আর স্থির থাকতে পারছে না। ডলারের দাম বাড়ছে। টাকার দাম কমছে। এতে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের ওপর খানিকটা ইতিবাচক প্রভাব পড়লেও আমদানি করা পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। এর চাপ আবার মূল্যস্ফীতির ওপর পড়ছে। একে বলে ‘কস্ট পুশ’ মূল্যস্ফীতি। অস্বীকার করার উপায় নেই যে এখনো আমরা মেশিনপত্র, কাঁচামালসহ অনেক ভোগ্যপণ্য আমদানি করে থাকি। এসবের দাম বাড়লে উৎপাদন খরচ বাড়বেই। তাহলে মূল্যস্ফীতি স্থির থাকবে কী করে? আমাদের দেশে নিঃসন্দেহে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে। বিদেশি মুদ্রা বিনিময় হারের কারণে বিনিয়োগের পরিমাণ টাকার অঙ্কে বেশি করে বাড়ছে। সে কারণে ব্যাংকের ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। সে জন্য ভবিষ্যতে মন্দ ঋণের পরিমাণ আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে এই ঋণ যদি বেপথু হয়, তাহলে মন্দ ঋণ বাড়বেই। তাই শুধু ঋণ বৃদ্ধির হার কমানোর ওপর জোর না দিয়ে যে উদ্দেশ্যে ঋণ নেওয়া হচ্ছে সেখানে তা যাচ্ছে কি না, সে বিষয়টি যাচাইয়ের কোনো বিকল্প নেই। ঋণদাতা ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ নিপুণভাবে এই ঋণের গুণমান যাচাই-বাছাই করার মতো তত্ত্বাবধানপ্রক্রিয়া চালু না রাখলে মন্দ ঋণের বোঝা যে বাড়বে, তা আর ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের তরুণ কর্মীদের পেশাদারি ও তত্ত্বাবধান সক্ষমতার ওপর আমার পূর্ণ ভরসা রয়েছে। উপযুক্ত পরামর্শ, সাহস ও পরিচালনা নির্দেশনা দিলে তারা ঠিকই মাঠপর্যায়ে এই যাচাই-বাছাই ভালোভাবে করতে সক্ষম। তাই অনুরাগ বা বিরাগের বিষয়টি ভুলে গিয়ে গ্রুপ-নির্বিশেষে সব গ্রাহকের ওপর সমানভাবে পেশাদারি তত্ত্বাবধান চালু রাখলে গুণমানের বিনিয়োগ নিশ্চিত করা অবশ্যই সম্ভব। আসন্ন মুদ্রানীতিতে গুণমানের ঋণ ব্যবস্থাপনা নিয়ে নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থাকবে। বিশেষ করে বিদেশি মুদ্রায় দেওয়া ঋণগুলো কোথায় যাচ্ছে, কী কাজে লাগানো হচ্ছে, সে বিষয়ে মনিটরিংয়ের ওপর নিশ্চয়ই জোর দেবে এই মুদ্রানীতি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সভাপতিত্বে যে কমিটি বিদেশি মুদ্রার ঋণ অনুমোদন করে তার ব্যবহার যেন সংশ্লিষ্ট ব্যাংক নিশ্চিত করে, সে তাগিদ বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট তত্ত্বাবধান বিভাগকেই দিতে হবে। কয়েকটি ব্যাংকের ‘অফশোর ইউনিটে’র অপকর্মের কথা এরই মধ্যে আমরা গণমাধ্যমের বদৌলতে জানতে পেরেছি। তাই প্রতিটি বিদেশি মুদ্রার ঋণের ব্যবহার যথার্থ হচ্ছে কি না তার নিরীক্ষণ নিরন্তর চালু রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে কার্পেটের নিচ থেকে ময়লা কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধায়করাই বের করে এনেছেন।
বিগত অর্থবছরে ভারতের ব্যাংকিং খাতে আমানত বেড়েছে ১১.৮ শতাংশ হারে। আর আগেই বলেছি, ঋণ বেড়েছে ৫.১ শতাংশ হারে। তাই তারল্য ব্যবস্থাপনাই তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। আমাদের বেলায় অর্থবছর শেষে আমানত বেড়েছিল ১০.৬৫ শতাংশের মতো। ডিসেম্বরে হয়তো এর চেয়ে একটু বেশি হবে এই হার। কিন্তু ব্যক্তি খাতে ঋণ বেড়েছে ১৯ শতাংশেরও বেশি হারে। সরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণ বৃদ্ধির হার এর চেয়ে ঢের কম হলেও তাদের আমানত বৃদ্ধির হার বেশি। তাই তাদের কাছে তারল্যও বেশি। তবু তারা বেশি হারে ঋণ দিতে পারে না। কারণ তাদের খেলাপি ঋণের হার বেশি। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের বেশি হারে ঋণ দেওয়ার বিপক্ষে। তবে উৎপাদনশীল এসএমই ও কৃষির মতো উৎপাদনশীল খাতে বেশি পরিমাণে ঋণ দিতে তাদের বাধা নেই। তারা বরং ব্যক্তি খাতের ব্যাংকগুলোকে স্বল্পমেয়াদি ধার দিয়ে তাদের টিকিয়ে রেখেছে। এই ‘মিসম্যাচ’ই এই মুহূর্তে ব্যাংকিং খাতে বাড়তি টেনশন তৈরি করছে। আমানতের সুদের হার কমে যাওয়ায় আমানতের পরিমাণ কমেছে। একইভাবে কিন্তু ঋণের সুদহার কমছে না। কোনো কোনো ব্যাংকের স্প্রেড তাই ৫ শতাংশের বেশিই রয়ে গেছে। অন্যদিকে জাতীয় সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বাজারে চলমান আমানতের হারের চেয়ে বেশি হওয়ার কারণে টাকা ওই দিকে ঝুঁকেছে। আর হালে একটি নতুন ব্যাংকের আমানত জমা রেখে তা যথাসময়ে ফেরত পেতে অসুবিধা হওয়ার কারণে বেশ কিছু ব্যাংকে আমানত জমার হার কমে গেছে। একদিকে ওই ব্যাংকের কারণে বেশ কিছু ব্যাংকের আমানত নিয়ে গ্রাহকদের বাড়তি উৎকণ্ঠা দূর করা, অন্যদিকে জাতীয় সঞ্চয়পত্রের হার অন্যান্য আমানতহারের সঙ্গে সমন্বিত করাই এই মুহূর্তের আমানত বিষয়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। পেনশনভোগী ও সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য সামাজিক সংরক্ষণের বিষয়টি গভীর বিবেচনায় নিয়েও জাতীয় সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংকের আমানতের হার কী করে সমন্বয় করা যায়, সে বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হওয়া বাঞ্ছনীয়। মুদ্রা ও রাজস্ব নীতি সমন্বয় পরিষদের সভায় এ বিষয়ে আলাপ হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সভাপতিত্বে আর্থিক খাতের রেগুলেটরদের যে সমন্বয়সভা হয়, তাতেও ‘শ্যাডো ব্যাংকিং’ বিষয়ের ওপর আলাপ অব্যাহত রাখতে হবে। মনে রাখা চাই, ব্যাংকে আমানত বাবদ সুদের হার কমে গেলে ব্যাংক নয় অথচ ব্যাংকের মতো আচরণ করে, এমন প্রতিষ্ঠানের তৎপরতা বেড়ে যায়।
আগের মুদ্রানীতির ধারাবাহিকতায় আসন্ন মুদ্রানীতিও নিশ্চয়ই উৎপাদনশীল খাত, বিশেষ করে উৎপাদনশীল কৃষক, খুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের পক্ষে কথা বলবে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবসা সম্পর্কিত এসএমই খাতের চেয়ে ম্যানুফ্যাকচারিং এসএমইর দিকে ব্যাংকগুলোকে মনোযোগী হতে বলেছে। এই ধারা আসন্ন মুদ্রানীতিতেও নিশ্চয়ই বজায় রাখা হবে। একই সঙ্গে এসএমই খাতের মাঠে কী ঘটছে, তা-ও যাচাই করার অঙ্গীকার নিশ্চয়ই এবারের এমপিএসেও উল্লেখ করা হবে। এরই মধ্যে এসএমই খাতের সাধারণ প্রভিশনিং কমিয়ে ০.২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। নারী উদ্যোক্তা ও সবুজ অর্থায়নের যে সুবিধা এসএমই খাত পেয়ে আসছিল, তা বাংলাদেশ ব্যাংক বজায় রেখেছে। তাই আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অংশ হিসেবে এ দুটি বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে বাড়তি সমর্থন রয়েছে, সে কথা জোর দিয়ে মুদ্রানীতির একাংশে বলার প্রয়োজন রয়েছে। মাঠ থেকে অনেকেই বলতে চেষ্টা করছে যে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও সবুজ অর্থায়নের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সক্রিয়তা খানিকটা হলেও কমে গেছে। উদাহরণ হিসেবে তারা গার্মেন্ট ও চামড়া শিল্পের জন্য ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সবুজ রূপান্তর তহবিলের অর্থ এখনো ছাড় না হওয়ার প্রসঙ্গ তোলে। আশা করছি, এবারের মুদ্রানীতিতে সবুজ অর্থায়নের প্রশ্নে বাংলাদেশ ব্যাংকের জোরালো সমর্থনের কথা আবারও উচ্চকিত হবে। আমার বিশ্বাস, দ্রুতই এই সবুজ তহবিলের অর্থ বিতরণের ব্যবস্থা করা হবে বলে উদ্যোক্তাদের আশ্বস্ত করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বেশ কিছুদিন হলো, ভোক্তা ঋণের লাগাম বেশ হালকা করে দেওয়া হয়েছে। কথা ছিল, ভোক্তা ঋণের বৃদ্ধির হার যেন গড় ঋণ বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি না হয়। কিন্তু বাস্তবে তা গড় ঋণ বৃদ্ধির হারের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি হয়ে গেছে। এর প্রভাবও ব্যক্তি খাতের কয়েকটি ব্যাংকের ‘এডিআর’ সীমারেখা লঙ্ঘনের ওপর হয়তো পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রুডেনশিয়াল নীতি উপেক্ষা করায় কয়েকটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। তাই আসন্ন মুদ্রানীতিতে ভোক্তা ঋণ বৃদ্ধির হারের লাগাম টেনে ধরার কথা নিশ্চয়ই বলা হবে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো ছাড়ও দিতে হবে। শুধু জোর দিয়ে বলতে হবে যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সব ঋণনীতিই বিচক্ষণতার সঙ্গে নেওয়া হয়।
বিচক্ষণতার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রচলিত রিকন্ডিশন্ড গাড়ির চেয়ে হাইব্রিড বা বিদ্যুত্চালিত পরিবেশবান্ধব গাড়ি আমদানির জন্য স্বল্প সুদের সবুজ অর্থায়নের কথাও বলতে পারে। ব্যাংকিং ঋণ ও গ্রাহকের নিজস্ব তহবিলের সমানুপাত হেরফের করাও সম্ভব।
সব শেষে ব্যাংকিং খাতের ওপর সামগ্রিক আস্থা বৃদ্ধির অংশ হিসেবে এ খাতের সুশাসন নিয়ে দু-একটি কথা নিশ্চয়ই মুদ্রানীতিতে বলা যেতে পারে। বিশেষ করে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সুরক্ষা, সুদক্ষ ‘স্বাধীন পর্ষদ সদস্য’ (ইনডিপেনডেন্ট ডিরেক্টর) নিয়োগের মাধ্যমে পর্ষদের সক্ষমতা ও স্বাতন্ত্র্য বৃদ্ধি, বড় বড় ঋণ ডিজিটালি চিহ্নিত করে বিশেষ বিশেষ গ্রুপের মোট ঋণের হিসাব কষা ও সেসবের হালহকিকত জানার উদ্যোগ অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংক নিতে পারে। সম্প্রতি ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিটি বড় ঋণের জন্য ২০ ডিজিটের লিগ্যাল এনটিটি আইডেনটিফাইয়ার (এলইআই) চালু করার রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। এর ফলে বড় ঋণ ঘিরে যে রহস্য রয়েছে, তা অনেকটাই খোলাসা হবে। আমরা চাইলেই অনুরূপ ডিজিটাল উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি। এর ফলে বড় ঋণ মনিটরিং অনেকটাই সহজতর হবে। এ ছাড়া গণমাধ্যমে বহুল আলোচিত বিচার-বিশ্লেষণের বিপরীতে আর্থিক খাতের রেগুলেটরে অবস্থান কী, তা তুলে ধরার মতো সুযোগ মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় তার কাছে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই চলে আসে। নিশ্চুপ না থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক যেন এই সুযোগের উপযুক্ত সদ্ব্যবহার করে, সেই প্রত্যাশাই করছি। কেউ কেউ হয়তো প্রশ্ন তুলতে পারেন, মুদ্রানীতি প্রকাশের সময় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়গুলোর বাইরে গিয়ে এত কথা বলার কী-ই বা প্রয়োজন? তাঁদের সঙ্গে দ্বিমত না করেও এ কথা বলা যেতে পারে যে আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষাও বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। সে জন্যই ম্যাক্রো-প্রুডেনশিয়াল বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন রয়েছে। পাশাপাশি উন্নয়নধর্মী কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুনাম রয়েছে। এই সুনাম ধরে রাখার জন্যই গ্রাহকস্বার্থের দিকে নজর তীক্ষভাবেই রাখতে হবে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির কথাও জোর দিয়ে বলতে হবে। কিছুদিন আগে দুটি ব্যক্তি খাতের ব্যাংকের পর্ষদ ও প্রধান নির্বাহীদের অস্বাভাবিকভাবে পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলেও হালে অন্য দুটি ব্যাংকের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দৃঢ় অবস্থান প্রশংসিতও হয়েছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, এখনো বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি জনগণের গভীর আস্থা রয়েছে। আশা করছি, আসন্ন মুদ্রানীতি ঘোষণার মাধ্যমে জনমনে সেই আস্থা আরো অটুট হোক। মজবুত হোক।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর
বাংলাদেশ ব্যাংক