![গণতন্ত্র, উন্নয়ন, শেখ হাসিনা এবং নির্বাচন প্রসঙ্গ](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/01/17/mustofa_121053.jpg)
মোস্তফা কামাল, ১৭ জানুয়ারি, এবিনিউজ : ভালো কাজের মূল্যায়ন সব দেশেই হয়। দেশের উন্নয়নে কাজ করলে অবশ্যই জনসমর্থন পাওয়া যায়। যদিও আমাদের দেশে একটি কথা প্রচলিত আছে, দেশের মানুষ এক মেয়াদের বেশি কোনো দলকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ক্ষেত্রে তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতাসীন হয়। পাঁচ বছর পর ১৯৯৬ সালে বিএনপিকে পরাজিত করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার আসনে বসে। আবার ২০০১ সালে বিএনপি এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়।
ফলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কোনো সরকারই খুব বেশি অগ্রসর হতে পারেনি। কোনো সরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করলেও পরের সরকার তা বাতিল করে দিয়েছে। এ রকম অনেক উদাহরণ আমাদের কাছে আছে। সংগত কারণেই বিগত সরকারগুলোর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হালে পানি পায়নি। যদিও শুধু শেখ হাসিনাই ১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতাসীন হয়ে দীর্ঘমেয়াদি সব প্রকল্প বাতিল করে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার ঝুলে ছিল দীর্ঘ পাঁচ বছর।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে দীর্ঘমেয়াদি অনেক প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি ছিল। সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তারা বঙ্গবন্ধু এবং জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যাকারী এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ অনেক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে। এতে শেখ হাসিনার প্রতি দেশের আপামর মানুষের আস্থা বেড়ে যায়। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রেও আসে ব্যাপক সাফল্য। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও বাংলাদেশের উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
স্বল্পোন্নত একটি দেশকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরের নেপথ্য কারিগর শেখ হাসিনা। এই মুহূর্তে তাঁর ওপরই বেশি মানুষের আস্থা। ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচন নিয়ে নানা সমালোচনা থাকলেও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করেছেন। সংকট মোকাবেলায় প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। যেকোনো বিপদে অবিচল থেকেছেন। তাঁর সাহসী পদক্ষেপে (কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুঃসাহসী) অনেক সংকট উত্তরণ সহজতর হয়েছে। তাঁর মতো বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এ দেশের মানুষকে অনেক বেশি আশাবাদী করে তুলেছে।
চলতি বছরের শেষে নির্বাচন। যেনতেন একটি নির্বাচন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দেখতে চান না। তিনিও চান, সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। বিগত ৯ বছরে শেখ হাসিনার সরকার দেশের যে উন্নয়ন করেছে তা যদি মানুষ মনে রাখে, তাহলে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসবে—এমন প্রত্যাশা আওয়ামী লীগের।
বিএনপি অনেক দিন ধরেই বলে আসছে, নির্বাচনের জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করতে হবে। বিকল্প সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। এ জন্য সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে দলটি। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল মনে করে, নির্বাচনকালীন সরকার কী হবে, তা নিয়ে সংলাপের কোনো প্রয়োজন নেই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তেমনটাই বলেছেন। গত ১২ জানুয়ারি বেতার ও টিভিতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচন নিয়ে যে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে তিনি বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী চলতি বছরের শেষ দিকে নির্বাচন হবে। নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে সেই নির্বাচন পরিচালনা করবে। নির্বাচনকালীন সরকার তাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেবে।
প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দল সেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক ধারা সুসংহত করবে।
১২ জানুয়ারি ছিল সরকারের চার বছর পূর্তি এবং ধারাবাহিকভাবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ৯ বছর পেরিয়ে দশে পদার্পণের দিন। দিনটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বিগত ৯ বছর সরকার দেশের উন্নয়নে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং এতে সাফল্যও পেয়েছে। গ্রাম থেকে শহর—সর্বত্রই উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। শুধু অবকাঠামো খাতেই যে উন্নয়ন হয়েছে তা নয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক গতি ঊর্ধ্বমুখী। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
শেখ হাসিনার একটি মহৎ গুণ হচ্ছে তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েও অতি সাধারণ। সবার সঙ্গে মেশেন। মানুষের কথা শোনেন। দেশ ও দেশের মানুষকে বঙ্গবন্ধুর মতোই গভীরভাবে ভালোবাসেন। জনগণের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। নিজের স্বার্থের কথা ভাবেন না। পরিবারের স্বার্থ কিংবা দলীয় স্বার্থকে বড় করে দেখেন না। তিনি দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করেন। তারই প্রতিফলন দেখি আমরা তাঁর উন্নয়নকাজে।
পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্প একসময় ছিল স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে শেখ হাসিনা দৃঢ়সংকল্প। তিনি সাহায্যের হাত বাড়ালেন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগীরা সাহায্য করতে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের ষড়যন্ত্রে সব কিছু ভণ্ডুল হয়ে গেল। বিশ্বব্যাংক তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলল, তাঁর দুর্নীতির ‘ইনটেনশন’ ছিল। সেই অজুহাতে বিশ্বব্যাংক অর্থ দিতে অপারগতা প্রকাশ করল। অথচ সেই দুর্নীতি পরে আর প্রমাণ করতে পারল না (যদিও তখন যোগাযোগমন্ত্রীকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। যোগাযোগসচিবকেও শাস্তি পেতে হয়েছিল)।
শেখ হাসিনা গোড়া থেকেই বলে আসছিলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে কোনো ধরনের দুর্নীতি হয়নি। তার পরও কেন বিশ্বব্যাংক গোঁ ধরে বসে ছিল? বিশ্বব্যাংকের অন্য কোনো উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, সরকারকে বিপদে ফেলতেই বিশ্বব্যাংক তখন আদাজল খেয়ে নেমেছিল। যা-ই হোক, বিশ্বব্যাংকের পাতা ফাঁদে পা দেয়নি সরকার। শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নিলেন, নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু করবেন। সেই সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন তিনি। শুরু হলো পদ্মা সেতুর কাজ। সেই সেতু এখন দৃশ্যমান।
আগামী বছরের মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হওয়ার কথা। কোনো কারণে শেষ না হলেও নিশ্চয়ই ২০১৯ সালের মধ্যে শেষ হবে। দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করবে। এর ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দেড় শতাংশ বাড়বে। এ কথা সবাই স্বীকার করবে, সরকারপ্রধানের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা না থাকলে পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিত না। তা ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় কমপক্ষে এক শ ইপিজেড নির্মাণের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে দেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
আমরা কথায় কথায় মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের উদাহরণ টানি। কিন্তু ওই দুই দেশ কিভাবে উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে তা খতিয়ে দেখি না। মালয়েশিয়ার উন্নতির নেপথ্যের নায়ক সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ। তিনি একক প্রচেষ্টায় মালয়েশিয়াকে গর্তের ভেতর থেকে টেনে তুলেছেন। তিনি বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ কিংবা উন্নয়ন সহযোগীদের প্রেসক্রিপশনে দেশ পরিচালনা করেননি। তিনি একজন ভিশনারি নেতা এবং দেশকে ভালোবাসেন। দেশের স্বার্থে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়ে দেশ পরিচালনা করেছেন। কিভাবে দেশের উন্নয়ন হবে, সে চিন্তা সব সময় করেছেন। তিনি ১৯৮১ সালে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ২০০৩ সালে তিনি স্বেচ্ছায় প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেন। টানা ২৩ বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে মালয়েশিয়াকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে তুলে আনেন।
ড. মাহাথিরের শাসনামলে মালয়েশিয়ায় গণতন্ত্র ছিল। হয়তো তাতে ত্রুটি ছিল; কিন্তু উন্নয়নের খাতিরে সে দেশের মানুষ সেটা মেনে নিয়েছিল। সে দেশের মানুষ মেনে নিতে পারলে আমরা কেন ‘গণতন্ত্র নেই! গণতন্ত্র নেই!’ বলে চিৎকার-চেঁচামেচি করব? আগে তো মানুষের মুখে আহার দিতে হবে, তারপর অন্য মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে হবে। পেটে ভাত না থাকলে গণতন্ত্র দিয়ে কী হবে? এমন বক্তব্য অবশ্য অনেকে দিয়ে থাকেন। অনেক গবেষকও বলেন, উন্নয়ন ও গণতন্ত্র সমান তালে চলতে পারে না। অবাধ গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে হলে উন্নয়নকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিতে হবে।
ড. মাহাথির কেন এখনো মালয়েশিয়ায় তুমুল জনপ্রিয় নেতা? তিনি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়েও উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। এ কারণেই তিনি মালয়েশিয়াকে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করতে পেরেছেন। তিনি এখনো সারা বিশ্বে আলোচিত চরিত্র। সিঙ্গাপুরকে একটি ছোট শহর থেকে অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেছেন প্রয়াত নেতা লি কুন ইয়াও। মালয়েশিয়া থেকে আলাদা হওয়ার পর সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি মেধা আর শ্রম দিয়ে দেশটি গড়ে তোলেন। তখনো সেখানে গণতন্ত্র নিয়ে অনেক প্রশ্ন ছিল।
যেকোনো দেশের উন্নয়নের জন্য এ রকম দেশপ্রেমিক ও নির্মোহ নেতা প্রয়োজন, যিনি তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে এগিয়ে নেবেন। সেই নেতৃত্বই দিচ্ছেন শেখ হাসিনা। তিনি দেশপ্রেমিক। তিনি নিজের চেয়ে দেশকে বেশি ভালোবাসেন। তিনি টানা ৯ বছর দেশকে উন্নয়নের পথে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে এসেছেন।
চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্প সমাপ্তির দিকে যাবে। আরো অনেক বড় প্রকল্প আলোর মুখ দেখবে। আগামী নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এই নির্বাচনেই নির্ধারিত হবে এ দেশের ভবিষ্যৎ। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে, না পিছিয়ে পড়বে, তা নির্ধারণ করবে আগামী নির্বাচন। দেশের মানুষ যদি ভুল না করে তাহলে দেশ সঠিক পথেই এগোবে।
আমরা ২০২১ সালের আগেই মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের কাতারে উঠে আসতে চাই। আমাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেবে আগামী দিনের নেতৃত্ব। সেই নেতা কে হবেন, তা দেশের মানুষ ঠিক করবে। এখন আমাদের আকাঙ্ক্ষা একটাই—সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। নিশ্চয়ই এই চাওয়া অন্যায্য নয়! (কালের কণ্ঠ)
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক