বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

কলকাতায় সূর্যসেনের অজ্ঞাতবাস

কলকাতায় সূর্যসেনের অজ্ঞাতবাস

পত্রলেখা নাথ, ১৯ জানুয়ারি, এবিনিউজ : চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের নেতা মাস্টার দা সূর্যসেনকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে সেদিন উল্লাসের হাসি হেসেছিল ব্রিটিশ সৈন্য। দেহটাকে দাহ করার কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। মাস্টার দা সূর্যসেনকে নিয়ে এত ভয় ছিল ব্রিটিশ শক্তির, মৃত্যু হয়েছে নিশ্চিত জেনেও দেহটাকে একটা লোহার সেলের ভেতর ভরে বঙ্গোপসাগরের জলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। শোভাবাজার স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে এক ঝটকায় মনের মধ্যে পুরো ঘটনাটা উঠে এল। বিপ্লবী নায়ক মাস্টার দা সূর্যসেনের নাম হয়তো সবাই জানেন। কিন্তু শোভাবাজারের ওপর গঙ্গার ধার ঘেঁষে যে বাড়িটি আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে অগ্নি বিপ্লবের কাহিনির দিনগুলির স্মৃতি নিয়ে মাস্টার দা সূর্যসেনের মূল্যবান মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে আজও যে বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে, তা ক’জনই বা চেনেন!

কারাগারে আলো আঁধারিতে ইদানীং চোখ সয়ে গেছে। হাতে আর সময় নেই। শরীরটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে জ্ঞান হারিয়ে যাচ্ছে, এ অনন্তরাত শেষ হবার নয়। দেওয়ালে পিঠ দিয়ে ঘষে কোনো মতে উঠে বসেন মানুষটি। কারাগারে সম্বল বলতে সাদা পাতা আর একটা কলম। হাত কাঁপছে তবু আজ কয়েকটা কথা বড় বলতে ইচ্ছে করছে।

‘ফাঁসির রজ্জু আমার মাথার উপর ঝুলছে। মৃত্যু আমার দরজায় করাঘাত করছে। মন আমার অসীমের পানে ছুটে চলেছে। এই তো আমার মৃত্যুকে বন্ধুর মত আলিঙ্গন করার সময়। হারানো দিনগুলোকে নতুন করে স্মরণ করার সময়। আমার আসন্ন মৃত্যুর শীতল স্পর্শ যদি তোমাদের মনকে এতটুকু স্পর্শ করে, তবে আমার এই সাধনাকে তোমরা তোমাদের অনুগামীদের মধ্য ছড়িয়ে দাও–যেমন আমি ছড়িয়ে দিয়েছিলাম তোমাদের মধ্যে। ..দাসত্বের দিন চলে যাচ্ছে স্বাধীনতার লগ্ন আগত…. ১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিলের চট্টগ্রাম বিদ্রোহের কথা কোনো দিন ভুলো না। জালালাবাদ, জুলধা, চন্দননগর ও ধলঘাটের সংগ্রামের কথা সব সময় মনে রেখো। যে সব বীর সৈনিক স্বাধীনতা সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের নাম মনের গভীরে রক্তাক্ষরে লিখে রেখো।

আমার একান্ত অনুরোধ, এই সংগঠনকে তোমরা কোনো দিন ভেঙে দিও না। জেলের বাইরে ও ভিতরে সবার জন্যে আমার আশীর্বাদ ও ভালবাসা রইল।

বিদায়!

বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক! বন্দে মাতরম্‌!

১১ জানুয়ারি ১৯৩৪

চিঠিটা লিখে মাস্টারদা শেষবারের মতো বলে উঠলেন বন্দেমাতরম্‌। শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে গত কয়েকদিনে ব্রিটিশ পুলিশের অত্যাচার যেন চরমে উঠেছিল। সারা শরীরে ক্ষত। হাত পায়ের হাড় ভেঙে দিয়েও ক্ষান্ত হয়নি অত্যাচারীরা। হাতুড়ির আঘাতে দাঁত ভেঙে দিয়েছে, উপড়ে নিয়েছে হাত পায়ের নখ।

শেষে নির্মম অত্যাচার করে অচৈতন্য দেহটাকে ঝুলিয়ে দিয়েছিল ফাঁসিকাঠে। দিনটা ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের নেতা মাস্টারদা সূর্যসেনকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে সেদিন উল্লাসের হাসি হেসেছিল ব্রিটিশ সৈন্য। দেহটাকে দাহ করার কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। মাস্টারদা সূর্যসেনকে নিয়ে এত ভয় ছিল ব্রিটিশ শক্তির, মৃত্যু হয়েছে নিশ্চিত জেনেও দেহটাকে একটা লোহার সেলের ভেতর ভরে বঙ্গোপসাগরের জলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।

শোভাবাজার স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে এক ঝটকায় মনের মধ্যে পুরো ঘটনাটা উঠে এল। বিপ্লবী নায়ক মাস্টারদা সূর্যসেনের নাম হয়তো সবাই জানেন। কিন্তু শোভাবাজারের ওপর গঙ্গার ধার ঘেঁষে যে বাড়িটি আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে অগ্নি বিপ্লবের কাহিনির দিনগুলির স্মৃতি নিয়ে, মাস্টারদা সূর্যসেনের মূল্যবান মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে আজও যে বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে, তা ক’জনই বা চেনেন!

সেন্ট্রাল এভিনিউ থেকে যে রাস্তাটা শোভাবাজার স্ট্রিট হয়ে গঙ্গা পর্যন্ত পৌঁছেছে। সেই রাস্তার ওপর গঙ্গার ধারেই ৪নং শোভাবাজার স্ট্রিটের বাড়িটির দোতলার একটি ঘরে আত্মগোপন করেছিলেন মাস্টারদা সূর্যসেন।

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক। সশস্ত্র বিপ্লবের পথে পা বাড়াবার পর বাংলার বিপ্লবীদের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল বোমা তৈরি করার ফরমুলা ও বোমা তৈরির কারখানা। শ্রী অরবিন্দ ঘোষের হাত ধরে বিপ্লবের যে আগুন প্রজ্বলিত হয়েছিল, যার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকি, বসন্ত বিশ্বাস, বাঘা যতীন সে বিপ্লব থেমে থাকতে পারে না। এই বিপ্লবের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে সারা বাংলার কবিপ্লবীরা একত্রিত হতে শুরু করেছিলেন। সন্তোষ মিত্রের একটি দল, জুলু সেন ও সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের একটি দল, বরানগর, হাওড়া, হুগলি, চন্দননগর, কৃষ্ণনগর ইত্যাদি জায়গায় বিপ্লবীরা একে একে যুক্ত হতে লাগলেন। তৈরি হল চট্টগ্রাম থেকে মিরাট ও লাহোর পর্যন্ত এক সুতোয় গাঁথা দল। দলের নাম দেওয়া হল রেড বেঙ্গল পার্টি।

বিপ্লবীরা বোমা তৈরি ফরমুলা শিখতে শুরু করলেন। এতে সাহায্য করলেন হরিনারায়ণ চন্দ্র, চন্দনগরের তিনকড়ি মুখার্জী, প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়নের অধ্যাপক সুরেশবাবু, মগরার দিগসুই নিবাসী ডাঃ দীনবন্দু ঘোষ প্রভৃতিরা। বোমা তৈরির সাফল্যের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর প্রয়োজন হল একটি নির্জন জায়গার। এতদিন পর্যন্ত দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের পঞ্চবটি বনে বিপ্লবীরা পরামর্শ করতেন সেখানে নানা মিটিং হত। কিন্তু এখন একটা নির্জন বাড়ির প্রয়োজন। স্থানীয় বিপ্লবীদের সাহায্যে অবশেষে পাওয়া গেল একটি নির্জন বাড়ি। দক্ষিণেশ্বর মায়ের মন্দিরের কাছে বাচস্পতি পাড়ার একটি বাড়ি। এছাড়া আরেকটি বড় বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেল উত্তর কলকাতার শোভাবাজার স্ট্রিটে। বাড়ি দুইটি ভাড়া নেওয়ার পর চট্টগ্রাম থেকে বিপ্লবীরা আসতে শুরু করলেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাই প্রথম রাজ্য যেখানকার বিপ্লবীরা প্রথম বোমা তৈরি করতে শিখেছিলেন।

চিৎপুর শোভাবাজার মোড় থেকে পশ্চিমে মিনিট দশেক হাঁটা পথে প্রায় গঙ্গার কাছাকাছি বাঁ দিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেড় শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহাসিক বাড়িটি। বিশাল তিনমহলার দোতলা বাড়ি। অনেকটা গোলকধাঁধার মতো। একটু পর পর একতলা থেকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। শতাধিক ভাড়াটের বসবাস, এরকম বাড়ি বিপ্লবীদের লুকিয়ে থাকার পক্ষে আদর্শ।

সময়টা ১৯২৫ সালের ১০ নভেম্বর। কলকাতায় শীত শীত আমেজ। ভোরবেলা অন্ধকার থাকতে পুলিশ ঘিরে ফেলে আড়িয়াদহের বাচস্পতি পাড়ার বাড়িটি। ধরা পড়লেন বিপ্লবী ধ্রুবেশ চ্যাটার্জী, শিবরাম চ্যাটার্জী, অনন্তহরি মিত্র, হরিনারায়ণ চন্দ্র, বীরেন্দ্র কুমার ব্যানার্জী, নিখিল বন্ধু ব্যানার্জী প্রমুখ। চৈতন্য দেব চ্যাটার্জী পাশের বাড়িতে থাকায় বেঁচে গেলেন কিন্তু ধরপাকড়ের খবরটা বুঝতে পারার পর থেকে তার মাথার মধ্যে ঘুরছিল শোভাবাজার স্ট্রিটের বাড়ির কথা, কারণ ওখানে তখন আত্মগোপন করে রয়েছেন মাস্টারদা সূর্য সেন। চৈতন্য চ্যাটার্জী মুহূর্ত দেরি না করে ছুটলেন শোভাবাজার। কিন্তু তার পৌঁছাবার আগেই পুলিশ বাড়িটাকে ঘিরে ফেলল। তিনি দূরে দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে লাগলেন কী ঘটতে চলেছে। পুলিশ বাড়িতে ঢুকে একতলাটা ভাল করে খুঁজলো কাউকেই পেল না। এবার তারা উঠলো দোতলায়। দরজা বন্ধ। ভেতরে ঢোকার উপায় নেই। পুলিশ অনেক ডাকাডাকি করলেও কেউ সাড়া দিলেন না। পুলিশ সামনে দরজা ধাক্কাছে। বিপ্লবীরা সর্বশক্তি দিয়ে ঠেকাবার চেষ্টা করছে কারণ মাস্টারদা ধরা পড়লে বিপ্লবের মহাযজ্ঞ একেবারে ভেস্তে যাবে। বিপ্লবীরা মাস্টারদাকে বললেন, ‘আপনি পাইপ বেয়ে নেমে যান। আমরা যতক্ষণ পারি পুলিশকে ঠেকিয়ে রাখবো।’ কিন্তু অনবরত ধাক্কার পর শেষে দরজা খুলে দিতে বাধ্য হলেন বিপ্লবী প্রমোদ চৌধুরী। কিন্তু ততক্ষণে মাস্টারদা জলের পাইপ বেয়ে লাফিয়ে পড়েছেন পাশের বাড়ির খোলা ছাদে। পায়ে লেগেছে প্রচণ্ড আঘাত। সেই অবস্থায় কোনও রকমে পায়ে কাপড় বেঁধে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এসব ঘটনা বইয়ের পাতায় পড়েছিলাম। ৪নং শোভাবাজার স্ট্রিটের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মুহূর্তে পুরো ঘটনাটা যেন চলচ্চিত্রের মতো ভেসে উঠল। এখন ওই বাড়িতে থাকেন এক প্রাচীন হোসিয়ারি ব্যবসায়ী ননী গোপাল সাহা। লোভ সামলাতে পারলাম না, তাকে জিজ্ঞাসা করলাম বাড়িটির ইতিহাস সম্পর্কে। প্রবীণ মানুষটি জানালেন, তার পরিবার এই বাড়ির দীর্ঘদিনের বাসিন্দা। তিনি ছোটবেলায় বাড়ির বড়দের মুখে শুনেছেন, মাস্টারদা সূর্যসেন এই বাড়ির দোতলার কোণার ঘরটিতে থাকতেন। পুলিশ বাড়ি ঘেরাও করলেও মাস্টারদাকে ধরতে পারেনি। অনেকক্ষণ সময় বাড়িটির চারপাশটা ঘুরে দেখছিলাম। এখন বাড়ির বেশির ভাগ অংশটা গুদাম ঘরে পরিণত হয়েছে। হয়তো আর কয়েক বছর পর বাড়িটি ভেঙে উঠবে বহুতল। চিরকালের মতো হারিয়ে যাবে অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের স্মৃতি বিজড়িত এই বাড়িটি।

তথ্যসূত্র:

১) ভারতের সশস্ত্র বিপ্লব–ভূপেন্দ্র কিশোর রক্ষিত রায়

২) দক্ষিণেশ্বর বোমার মামলা ককোরি ট্রেন ডাকাতি

(সংগৃহীত)

এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত