![বাংলা কবিতায় আধুনিকতা ও মধুসূদন](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/01/20/debashish_abnews1_121524.jpg)
দেবাশীষ আইচ, ২০ জানুয়ারি, এবিনিউজ : ‘বাংলা কবিতায় আধুনিকতা’- এ বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে মধুসূদনের বিকল্প আর কিছুই নেই। বাংলা কবিতার আধুনিকতার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে মধুসূদনের নাম। তার কারণ মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা কবিতার গঠন, রূপ এবং চেতনাকে আমূল পরিবর্তন করেন। মুদ্রার এপিট-ওপিটের মতো তিনি পরিবর্তন করেন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতায় আধুনিকতা আনতে গেলে তার ব্যক্তিজীবনও চলে আসে। কারণ মানুষের অভিজ্ঞতা, ব্যক্তিজীবন, ব্যক্তিভাবনা, ব্যক্তিআচরণ তার কবিতার মধ্যে প্রভাব পড়ে।
যশোরের কেশবপুরের সাগরদাঁড়ির কপোতাক্ষ বিধৌত পলিমাটিতে জন্মগ্রহণ করা দত্ত পরিবারের মধুসূদন কীভাবে বাংলা কবিতায় আধুনিকতা নিয়ে এসেছেন সেদিকে আমরা তাকাতে পারি। মধুসূদন যেমন কবিতায় আধুনিকতা এনেছিলেন, তেমনি ব্যক্তিজীবনেও আধুনিকতা এনেছিলেন। আমরা যদি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ব্যক্তিজীবনের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব, আধুনিকতা বলতে আমরা যাকে স্মার্টনেস বুঝি, সেই স্মার্টনেসের আজ পর্যন্ত ভারতবর্ষে মাইকেল মধুসূদন দত্তের ওপরে তার পোশাকে, আচরণে-আধুনিকতা (স্মার্টনেস) আর কেউ দেখাতে পারেনি। তিনি যে টাই ব্যবহার করতেন, কোর্ট-স্যুট পরতেন এটা ভারতবর্ষের যে কোনো মানুষের আগে তিনি ব্যবহার করেন। তিনি শুধু পোশাকে-আচরণে আধুনিকতা আনেন নি; মেধা-মনন-মগজেও আধুনিকতা নিয়ে আসেন। এই আধুনিকতা আনতে গিয়ে নিজের জীবনে নানা বিড়ম্বনা ও ধারাবাহিক পটপরিবর্তন ঘটেছে।
তিনি খ্রিস্টান ধর্ম অবলম্বন করেছিলেন। খ্রিস্টান হওয়া তার উদ্দেশ্য ছিল না, তার উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীর সেরা একজন আধুনিক মানুষ ও সেরা কবি হওয়া। আর এই কবিত্ব ও আধুনিকতা আনতে গেলে তৎকালীন বিশ্বসমাজ এবং ইংরেজসমাজে খ্রিস্টান ধর্মের যে প্রভাব ছিল তার মধ্যে তিনি প্রবেশ করতে চেয়েছিলেন। শুধু সুযোগ ও অংশগ্রহণ করার সুবিধার্থে। এখান থেকেই তিনি আধুনিকতার ছোঁয়া নিতে পেরেছিলেন।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮২৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার আগে বাংলা সাহিত্যে আমরা কি পেয়েছি, প্রথম ছিল ‘চর্যাপদ’। যা ছিল সম্পূর্ণ বৌদ্ধ ধর্মনির্ভর এবং পরে যে মধ্যযুগ ও অন্ধকার যুগের নাম শুনতে পাই- সেখানে শুধু ধর্মকেন্দ্রিক এবং পির মাহাত্ম্যকেন্দ্রিক সাহিত্যনির্ভর ছিল। যেখানে মানুষের কোনো কথা বলা হয়নি, মানুষের জীবনের কোনো দিক ফুটিয়ে তোলা হয়নি।
দীর্ঘ প্রায় এক হাজার বছর ধরে চলা বাংলা সাহিত্যের এক পঙ্গুত্ব ও ভঙ্গুর অবস্থা চলছিল, সেখান থেকে যিনি বাংলা সাহিত্যের যে রূপ, পটপরিবর্তন এবং সম্পূর্ণ আধুনিকতার ছোঁয়া বয়ে এনেছিলেন তিনিই মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত কীভাবে বাংলা সাহিত্যের কবিতায় আধুনিকতা নিয়ে এসেছিলেন, সেদিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখতে পাব- বাংলা সাহিত্যে কোনো মহাকাব্য ছিল না। বাংলা সাহিত্যে প্রথম যে মহাকাব্য রচনা করা হয় তার নাম ‘মেঘনাথবধ’ মহাকাব্য, যা মধুসূদন দত্তের একমাত্র সার্থক প্রথম মহাকাব্য। এখানে তিনি আধুনিকতা দেখিয়েছেন যে আমাদের রামায়ণ পৌরাণিক আখ্যান, সেই পৌরাণিক আখ্যানে দেবতার গীত-কীর্ত্তন, দেবতানির্ভর, দেবতা বিশ্বাস। এখানে তিনি উনিশ শতকের বাঙালি জীবনের ইংরেজ নিপীড়িত ঔপনিবেশিক সমাজের নির্যাতিত মানুষের চরিত্র, চিত্র এবং তাদের অকাক্সক্ষা ‘মেঘনাথবধ’ কাব্যে তুলে এনেছেন। একটা পৌরাণিক আখ্যানের মধ্যে কীভাবে উনিশ শতকের চেতনা প্রবেশ করানো যায়, তা মধুসূদন দত্ত ‘মেঘনাথবধ’ কাব্যের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন।
আমরা মহাকাব্যের বাইরে যদি ‘সনেট’-এ যাই তাহলে দেখতে পাব যেখানে দেশপ্রেম, মানুষের জীবন, মানুষের আকাক্সক্ষা এবং অহঙ্কারকে নিয়ে এসেছেন। সনেট বাংলা সাহিত্যের একটি নতুন রূপ এবং সার্থক রূপ। ১০২ সনেট রচনা করে তিনি বাংলা সাহিত্যে নবরূপ দান করেন।
প্রহসন:
এরপর যদি আমরা প্রহসনের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম এবং সার্থক প্রহসন রচয়িতা। এই প্রহসনে তিনি আধুনিকতা কীভাবে নিয়ে এসেছেন, আধুনিক সমাজের যে অসংগতি সেই অসংগতিগুলোকে তিনি সাহিত্যের মাধ্যমে চিত্রিত করেছেন। তিনি ‘বুড়ো শালিকের ঘাঁড়ে রো’ প্রহসনে বুড়ো জমিদার ক্ষমতাবানদের যে নারীর প্রতি মোহ, ক্ষমতা এবং তাদের ক্ষমতার বিশৃঙ্খল পরিবেশগুলোকে তিনি সাহিত্যে তুলে এনেছেন।
নাটক:
এরপর যদি নাটকের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব তিনিই প্রথম সার্থক নাটকের রচয়িতা, যার নাম ‘শর্মিষ্ঠা’। তিনি প্রথম বিয়োগান্তক ও ঐতিহাসিক নাটক রচনা করেন, যার নাম ‘কৃষ্ণকুমারী’। ইতিহাস যে নাটকে আসতে পারে, পৌরাণিক কাহিনিকে যে নতুন করে বাংলা সাহিত্যে আনা যেতে পারে সে বিষয়টাকে তিনি এই নাটকগুলোর মধ্যে দেখিয়েছেন।
কাব্য:
মাইকেল মধুসূদন দত্ত একটা পত্রকাব্য লিখেছেন, যার নাম ‘বীরাঙ্গনা’। এই ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যে নারীদের চিত্র তুলে ধরেছেন। এই নারীগুলো পৌরাণিক নারী পুরাণের নয়। তিনি পৌরাণিক নারীকে তৎকালীন আধুনিক সমাজের প্রগতিশীল সমাজের এক নারীসত্তাকে ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের মধ্যে চিত্রিত করেছেন। সূর্পণখা লক্ষণকে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়ায় সূর্পণখার নাক ছেদন করেন লক্ষণ। মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই বীরাঙ্গনা কাব্যে সূর্পণখাকে একজন প্রতিবাদী নারী হিসেবে দেখিয়েছেন, আত্ম-অধিকারের স্বীকৃতিতে সোচ্চার, স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী এক নারী এবং আধুনিক যুগের জীবন ভাবনাময় এক নারীর কথা তুলে ধরেছেন।
আজকে আমরা নারীর যে ক্ষমতায়নের কথা বলি, মধুসূদন দত্ত সেটি দেখিয়ে দিয়েছেন আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে।
অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবক্তা মাইকেল মধুসূদনের হাতে বাংলা কবিতার আধুনিকতা এবং তার ধারাবাহিকতা আজ পর্যন্ত ব্যাপৃত এবং প্রতিষ্ঠিত। ১৯৪তম জন্মবার্ষিকীতে কবির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
লেখক : সাবেক উপ-সম্পাদক (বাংলাদেশ ছাত্রলীগ)