বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

রাজনীতিতে নান্দনিকতা – মেয়র আইভী ও সাংসদ শামীম ওসমান

রাজনীতিতে নান্দনিকতা – মেয়র আইভী ও সাংসদ শামীম ওসমান

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া, ২০ জানুয়ারি, এবিনিউজ : যুক্তরাষ্ট্রের ২৬ তম প্রেসিডেন্ট থিয়োডোর রুজভেল্ট ‘রাজনীতিতে নান্দনিকতার’ আবশ্যকতার কথা উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘কদণ বর্ম্র যরটর্ডধডটফ পধভঢ মত যমফর্ধধড্র ধ্রর্ দণ যমফর্ধধড্র মত ঢণডণভডহ’ অর্থাৎ রাজনীতির অতি বাস্তব দিকটা হলো ’নান্দনিকতার বা সৌন্দর্য্যের রাজনীতি’। সহনশীলতা, ধৈর্য্য, সহিষ্ণুতা, একাগ্রতা, নির্লোভ এই শব্দগুলি রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু দিন যত গড়াচ্ছে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে যত এগিয়ে যাচ্ছে মনে হয় ঠিক তার দ্বিগুন কিংবা ততোধিক বেগে আমাদের নীতিবোধ সহ উল্লেখিত মানবিক গুণাবলী লোপ পাচ্ছে। আমাদের রাজনীতিবিদরা, সমাজপতিরা যারা জাতিকে দিক নির্দেশনা দেবেন, যাদের কাছে এই দেশের হাল তুলে দেয়া, তারা এই সমস্ত গুণাবলীর যে চর্চা করেন বা এর প্রতি তাদের যে বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ আছে, তা তাদের অনেকের কর্মকান্ডে, উচ্চারিত বাক্য দেখে ঠাহর হয়না। এই যে ক্ষয়িষ্ণুতা, এই যে অবক্ষয় সমাজের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে তা জাতির জন্যে, ’আগামীর’ জন্যে কতটুকু ক্ষতিকর তা বলা বাহুল্য। একটা সময় ছিল, এমন কী আমাদের সময়েও, কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি মেধাবী ছাত্র–ছাত্রীদের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে। আজ দেশের রাজনীতির যে হাল বা চালচিত্র দেখি তাতে মনে হয় প্রচলিত প্রবাদ ‘অসির চাইতে মসীর ক্ষমতা বেশী’ অর্থহীন। অতি সম্প্রতি হকার ইস্যুকে কেন্দ্র করে প্রকাশ্যে দিনের আলোয় নারায়ণগঞ্জে যে ‘লংকাকান্ড’ ও ‘পেশী শক্তির’ প্রদর্শন হয়ে গেল তাতে শান্তিপ্রিয় জনগণ কেবল ক্ষুদ্ধ ও বিরক্তই নয়, তারা হতাশ, হতাশ এই ভেবে কার উপর ভরসা করবে তারা। যারা দেশের আইনপ্রণেতা, যারা দেশের জনগণের যা ভাল, যা মঙ্গল তার চিন্তা ভাবনা করবেন এবং সেই মোতাবেক কাজ করবেন, তারা যদি ক্ষুদ্র ও ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে, নিজের ক্ষমতা জাহির করার কারণে, অস্ত্র উঁচিয়ে, পেটোয়া বাহিনী রাস্তায় নামিয়ে ন্যায্য দাবীতে মিছিলকারীদের উপর চওড়া হয়, আক্রমণ করে তাহলে কার উপর ভরসা করবে জনগণ। পত্র–পত্রিকায় পড়েছি, সামাজিক মাধ্যমে ভিডিওতে দেখেছি নারায়ণগঞ্জের সে দিনের মিছিলে নেতৃত্বদানকারী জনগণের ভোটে নির্বাচিত নারায়ণগঞ্জের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর উপর লাঠিসোটা নিয়ে এক দল চওড়া হয়। কেউ কেউ অস্ত্র হাতে নিয়ে আতংক সৃষ্টি করতে চায়। এতে অনেকে আহত হন। মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর অপরাধ ছিল তিনি বেআইনীভাবে ফুটপাত দখলকারীদের উচ্ছেদ করেছিলেন। আমরা সবাই জানি রাজধানী সহ দেশের প্রধান প্রধান শহরগুলির ফুটপাত বেদখলে গেছে হকারদের কাছে। এই নিয়ে গেল সংখ্যায় এই পাতায় লিখেছিলাম, পথচারীর হাঁটার কোন পথ নেই চাটগাঁ শহরে। কেননা প্রায় সবকটি ফুটপাত দখলে গেছে হকারদের। কেবল ফুটপাত নয়, অনেক স্থানে যানবাহন চলাচলের রাস্তার দুদিকের অনেকাংশ চলে গেছে হকারদের দখলে, ফলে পথচারীর পথচলার যেমন সমস্যা হচ্ছে ঠিক তেমনি সমস্যা হচ্ছে স্বাভাবিক যানবাহন চলাচলের। এতে অনেক স্থানে ঘটছে দুর্ঘটনা, কোথায় কোথায় এই সমস্ত অঘটনকে ঘিরে হাতাহাতি, মারামারি এমন কী রক্তারক্তি। এই সমস্ত হকারদের কে বা কারা বসিয়েছে এবং এই হকার বাণিজ্য থেকে কারা লাভবান হচ্ছে তা নগরবাসীরা জানলেও নগর প্রশাসন এবং সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ জানেনা তা মানতে কষ্ট হয়। এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে, টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রকাশ পেয়েছে অনেক প্রতিবেদন। কিন্তু কে দেখে কার সমস্যা, কে শোনে কার কথা। নিজ নিজ পকেট ভরলো কিনা সেটাই বিবেচ্য বিষয়।

মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী মেয়র নির্বাচিত হবার পর আগ থেকেই নানা বৈরিতার মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু তিনি সব কিছুকে উপেক্ষা করে এগিয়ে গেছেন। সাহসের সাথে মোকাবেলা করেছেন সেই সমস্ত বাধা। অনেকে তাকে বলেন, নারায়ণগঞ্জের ‘আয়রন লেডী’। তার সততা, নিষ্ঠা নিয়ে কোন অভিযোগ এখনো কেউ তুলতে পারেননি। ফলে তিনি আছেন জনগণের কাছাকাছি। আর জনগণের কাছাকাছি আছেন বলেই জনগণ গত মঙ্গলবার তাকে ঘিরে ‘ঢাল’ বানিয়ে স্থানীয় সাংসদ শামীম ওসমানের লোকজনের আক্রমণ থেকে বাঁচিয়েছেন জনগণ, যদিও বা তিনি পড়ে গিয়ে সামান্য আঘাত পেয়েছেন বলে প্রকাশ। পরবর্তীতে নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবে মেয়র আইভী সাংবাদিকদের বলেন, ‘শামীম ওসমানের নির্দেশে তার ক্যাডাররা আমার ওপর এবং নিরীহ নগরবাসীর ওপর হামলা চালিয়েছে। এতে আমি সহ নারায়ণগঞ্জের যুবলীগ, ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। আমি নগর ভবন থেকে পায়ে হেঁটে চাষাঢ়া আসছিলাম প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন সম্পর্কে হকারদের সঙ্গে কথা বলতে। ফুটপাত হকারমুক্ত রাখার জন্য নির্দেশ ও হকারদের বসানোর জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করার বিষয়ে কথা বলতে। কিন্তু শামীম ওসমানের নির্দেশে তার সমর্থকরা কোনও কারণ ছাড়াই আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে’’। অন্যদিকে ঘটনার সময় চাষাঢ়ায় বঙ্গবন্ধু সড়কে হ্যান্ড মাইকে সাংসদ শামীম ওসমান বলেন, ‘কেউ কেউ চাচ্ছে গন্ডগোল করে পরিস্থিতি অশান্ত করতে। এটা কোনও রাজনৈতিক সংগ্রাম না। হকাররা চেয়েছে ফুটপাতে বসতে। যারা নিরীহ হকারদের রক্ত ঝড়িয়েছে তাদের বিচার আল্লাহ করবে। নারায়ণগঞ্জকে অশান্ত করতে দেওয়া হবে না।’

শামীম ওসমান নানা কারণে আলোচিত এবং বিতর্কিত। নানা সময় নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনি সংবাদ হয়েছেন। দলে তার একটি শক্ত অবস্থান রয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছাকাছির লোক হিসাবেও তার একটা পরিচিতি আছে। অনেকে বলে তার পেশী শক্তির কারণেই নারায়ণগঞ্জে বিরোধী দল, বিএনপি দাঁড়াতে পারেনি বা পারছে না। আওয়ামী লীগ সেটি জানে আর জানে বলেই, তার অনেক ‘অপছন্দের’ কাজ দল হয় নীরবে মেনে নেয়, না হয় নিশ্চুপ থাকে। এই ধরণের ব্যক্তির বা নেতৃত্বের আজকের যে রাজনীতি দেশে তাতে প্রয়োজন যে আছে সে কথা অস্বীকার করিনে, কিন্তু এবার তিনি যে ইস্যু নিয়ে মেয়র আইভীর বিরুদ্ধে লাগলেন তা কতোটুকু সমর্থনযোগ্য তা দেখার বিষয়। মেয়র আইভী শহরের মেয়র, মেয়র হিসাবে তার অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের কল্যাণে যা করা সম্ভব তা করা। জনগণের দাবী, হকার মুক্ত শহর। মেয়র আইভী এই হকারদের রাস্তা থেকে সরিয়ে জনগণকে তাদের হাঁটার রাস্তা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। জনগণ হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল এবং তাকে অভিনন্দন জানিয়েছিল। কিন্তু সাংসদ শামীম ওসমান এটি অন্যভাবে নিয়েছেন। তিনি যুক্তি দেখালেন, গরীব হকারদের রাস্তা থেকে উচ্ছেদ করে আইভী তাদের পেটে লাথি মারলেন, আর সে কারণে বোধকরি তিনি হাতে লাঠি তুলে নিলেন মেয়রের নেয়া পদক্ষেপকে উল্টিয়ে দেবার জন্যে। শামীম ওসমানের অভিযোগ উড়িয়ে দেবার নয়। কেননা কোথায় যাবে এই সমস্ত গরীব হকাররা, তাদের আহার জুটবে কোত্থেকে? অন্যদিকে মেয়র আইভী বললেন, আমরা তাদের পুনর্বাসের ব্যবস্থা করেছি এবং করছি। তবে কথা হলো গরীবের আহার নেই বলে সে কি আমার আপনার বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়বে? তেমনটি হলে কেউ কি ব্যাপারটিকে প্রশ্রয় বা সমর্থন দেবেন?

যেটাই হোক না কেন, যে কারণেই হোক না কেন, রাজনীতিতে প্রকাশ্যে ক্ষমতাসীন দলের এই দুই নেতার এইভাবে মুখোমুখি সংঘর্ষ মানায় না। এটি শোভন নয়, রাজনীতির কোন শিষ্টাচার, সৌন্দর্যের মধ্যে এটি পড়েনা। কোন যুক্তিতে এই ধরণের কর্মকান্ড মেনে নেয়া যায় না। যুক্তরাষ্টের প্রেসিডেন্ট থিয়োডোর রুজভেল্টের কথায় ফিরে আসি। তিনি রাজনীতিতে সৌন্দর্যের কথা, নান্দনিকতার কথা উল্লেখ করেছিলেন। কেবল বাংলাদেশের কথাই বা বলি কেন। খোদ তার (রুজভেল্ট) দেশে তার উত্তরসুরী ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিকে তাকালেই তো আমরা দেখতে পাই যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃত্বের মান, অবস্থান আজ কোথায় নেমে এসেছে। অবাধ ও মুক্ত গণতন্ত্রের ধারক–বাহক বলে দাবীদার আমেরিকা আজ গণতন্ত্রের, মানুষের অধিকার খর্বকারী রাষ্ট্রগুলির পুরোধা বললে কি বাড়িয়ে বলা হবে? যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশের প্রেসিডেন্ট হাইতি সহ আফ্রিকীয় দেশগুলিকে বলেন, ‘শিট হোল’, বাংলায় যার অর্থ পায়ুপথ। অথচ ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন একটি দেশের প্রেসিডেন্ট যে দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় একদিন ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিংকন, থিয়োডোর রুজভেল্ট, উড্রো উইলসন, জন এফ কেনেডী, ছিলেন লিন্ডন জনসন, জিমি কাটার, রোনাল্ড রিগেন, বিল ক্লিনটন এবং সব শেষে বারাক ওবামার মত ব্যক্তিত্বরা। এদের পাশাপাশি ডোনাল্ড ট্রাম্প ! কোনভাবে কি যায়? যায় না। তারপরও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মত একটি অতি ক্ষমতাধর, গণতান্ত্রিক দেশের প্রেসিডেন্ট। পার্থক্য এই আমেরিকায় আপনি চাইলে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে যা কিছু ইচ্ছে বলতে পারেন, সমালোচনা করতে পারেন। সরকারি বা বেসরকারী কোন বাহিনী আপনাকে বাধা দেবে না। বাধা দিলেও পার পেয়ে যাবে না। সব চাইতে ক্ষমতাশীল ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও সে দেশে চাইলেই প্রেসিডেন্ট সব কিছু করতে পারেন না। তাকেও জবাবদিহিতা করতে হয়, প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। আর হয় বলেই ডোনাল্ড ট্রাম্প তার অনেক অগণতান্ত্রিক ও অমানবিক পদক্ষেপ এখনো বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হননি। সেখানেই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য্য। আমাদের দেশেও তেমনটি হবে, আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা, গণপ্রতিনিধিরা তেমন সুন্দর আচরণ করবেন, যা কিছু নান্দনিক, যা কিছু দেখতে সুন্দর তেমন কাজ করবেন এই প্রত্যাশায়।

(সংগৃহীত)

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত