সৈয়দ ইবনুজ্জামান, ২০ জানুয়ারি, এবিনিউজ :
– আরে মিয়া! হুদাই বকবক করতাছ। সামনে ইলেকশান ওই কামে মন দাও
– রাখো মিয়া! হুদা কথা না, মুসলমানের ঘরে হিন্দুর পোলা বড় হইছে, এইডা কি কম পাপের?
– আরে মিয়া! পোলাডাতো এহনো মুসলমান,
হোক মুসলমান বীজতো হিন্দুর।
– তা খারাপ কত্ত নাই, হুনছি পোলাডা নাকি এহনো একলগে থাকে
– কি কও মিয়া!
– হু! তোয় কি আমি মিছা কই?
– আরে না হেই কথা কেলা কয়! তোয় এইডার একটা সুরাহা হওন চাই।
– তা হইবোনে, এহন চা শেষ কইরা চল ইলেকশানের কামে যাই।
বেলাচর গ্রাম। শহর থেকে বেশ দূরেই বলা চলে। শিক্ষার হার খুবই নিম্ন শিক্ষা বলতে ছেলেদের আরবী শিক্ষা আর মেয়েদের মক্তব এরপর রান্নাশালার রাঁধুনি। সামনে নির্বাচন নিয়ে এখানে যতটানা উত্তেজনা তার চেয়ে বেশি উত্তেজনা মোল্লা বাড়ি ঘিরে। প্রতিদিন কেউ না কেউ নানা ছুতো ধরে মোল্লা বাড়ির আনিসকে দেখতে আসে। আনিসকে এর আগে বহুবার দেখেছে তবে এবার একটু ভিন্ন চোখে দেখে। মোল্লা বাড়ির বড় ছেলে রফিক মোল্লা নিঃসন্তান ছিলেন। আনিসের বয়স যখন ১ কিংবা ২ তখন তিনি আনিসকে অনাথ আশ্রম থেকে বাড়িতে নিয়ে এসে ছেলের পরিচয় দেন। এখন তার বয়স দশ। এক হিন্দু দম্পতি এসে দাবি করছে আনিস তাদেরই সন্তান। তা নিয়ে আজ সালিশ বসবে।
– চুপ করো মিয়ারা! মাতব্বর সাব আইছেন। উনি এইডার একটা সুরাহা করব।
– রফিক তুমি কি জানতা এই পোলা হিন্দুর বীজ?
রফিক মোল্লা কোন কথা বলে না।
তার স্ত্রী জামিলা বেগম মুখ ঢেকে এক কোণা থেকে বলেছে, মানুষ কি ধর্ম নিয়া আসে?
গ্রামের মুরুব্বীরা ক্ষেপে গিয়ে বলেন, নাউযুবিল্লাহ্!
এইডা কোন কথা হইলো মাতব্বর সাব?
– মাইয়া মানুষ সালিশে আইছে ক্যান? রফিক তুমি তোমার বউরে ঘরে যাইবার কউ।
জামিলা কান্না করে বলে, আমি আমার পোলারে না লইয়া যামুনা।
– তোমার পোলা কেমনে হইলো? হে তো মালাউনের বীজ।
আনিস এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। কি যে হচ্ছে কিছুই সে বুঝতে পারছে না।
হিন্দু দম্পতি চেচিয়ে বলল, আমরা আমাগোর পোলারে চাই।
রফিক মোল্লা এবার মুখ খুললো।
–পোলা, পোলা, করেন, ক্যান! পোলারেতো মিথ্যা
পরিচয় দিয়া অনাথ আশ্রমে দিয়া আইছিলেন।
এহন কথা কোন কেমনে! কোন মুখ লইয়া পোলার দাবি লইয়া আইছেন?
মাতব্বর সাহেব ঝেড়ে কাশলেন
–চুপ করো রফিক! ক্ষেপো ক্যান? তারার প্রমাণতো যুক্তিসঙ্গত আর তুমিও তো স্বীকার করছো। ন্যায় বিচার–ই হইবো!
রফিকের স্ত্রী চেঁচিয়ে বলল, মানি না এই বিচার!
–রফিক তোমার বউরে চুপ থাকবার কউ কইলাম!
ন্যায্য বিচার–ই আমি করুম। মিয়ারা আকাশের
অবস্থা ভালো না। আমি রায় দিমু। ঐ মালাউনের বীজরে জন্মদাতা বাপ–মা–র কাছে দিয়া দিতে হইবো। জামিলা যেহেতু এতোদিন হেরে লালন পালন করছে তাই ঐ বাড়িতে মালাউনের বীজ কিছুদিন থাকবো। আমার আবার দিল নরম। কারো দিলে কষ্ট দিবার পারি না। তোয় ঐ বাড়িতে এই মালাউনের বীজের সাথে কারো সম্পর্ক থাকবো না। আলাদা থাকবো, আলাদা খাইবো।
– রফিক! তুমি যদি এ রায় মাইনা না নাও সমাজের কেউ তোমার সাথে সম্পর্ক রাখবো না। কারণ আমরা কেউ জাত–পাত এর ঊর্ধ্বে না।
আনিসকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। রফিক মোল্লা চুপ থাকে। বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। লোকজন যে দিক পারে ছুটে চলে যায়। থাকে শুধু রফিক মোল্লা আর তার স্ত্রী। হাঁটু গেড়ে বসে থাকে রফিক মোল্লা। তার স্ত্রী তাকে প্রশ্ন করে —
– তুমি চুপ থাকলা ক্যান? কও! উত্তর দাও!
–কি কমু বউ? তুমি তো ওরে জন্ম দাও নাই তাই তুমি তো ওর মা না।
– এইডা তুমি কি কউ! বিবি হালিমা কি নবীজীর মা না?
রফিক মোল্লা এবারও নিশ্চুপ।
আকাশের দিকে তাকিয়ে জামিলা উচ্চস্বরে কেঁদে বলে,
ইয়া আল্লাহ্ ! জন্ম দিলেই কি কেবল বাপ–মা হওন যায়?
জামিলা কেঁদে চলেছে আর কেঁদে চলেছে আকাশ। বৃষ্টির পানি মুছে দেবে জামিলার চোখের জল কিন্তু ভেতরের হাহাকার!
২.
– ভাতটা দিয়াই আইসা পড়বা।
–আমি তো মা, কেমনে পারুম।
– মা, না ছাই!
– পরের পোলার লাইগা এতো দরদ কিসের?
– তুমি না আনিসের বাপ!
রফিক মোল্লা পাথর হয়ে যায়। পাথরেরা কথা বলতে জানেনা।
বাড়িটা বেশ বড়। বাড়িতে তার ভাই আনোয়ার মোল্লাও এক কন্যা সন্তান আর স্ত্রী নিয়ে থাকে।
– আনিস দরজাটা খোল বাপ!
– না খুলুম না।
– খোল বাপ! আনিস মুরগির মাংস নিয়া আইছি।
আনিস দরজা খোলে
– বাপ খাইয়া নে
– তুমি না খাওয়াইয়া দিলে আমি কি খাইবার পারি?
জামিলা যখন আনিসকে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে তখন আনোয়ার মোল্লা জানালা দিয়ে দেখে বাড়ির উঠানে এসে চিৎকার করতে করতে বলতে লাগল, ছি: ছি: আমাগো মোল্লা বাড়ির বংশ নষ্ট হইয়া গেল! জামিলা ভাত রেখে দৌড়ে যায় কি হলো তা দেখার জন্য
– এই যে ভাবী, তোমার কি ঘেন্না নাই। তুমি ওই মালাউনের বীজের পোলারে মুখে তুইল্লা খাওয়াইতাছো। ভাত দিছো ভাল কথা।
– ভাইরে! আমি তুইলা না খাওয়াইয়া দিলে ওতো খাইতে পারে না।
– ওতো শত বুঝি না! যাও হাত ধুইয়া আসো।
জামিলা কেঁদে কেঁদে চলে যায়। রাতে তার ঘুম হয় না। ছেলেটা কি খেয়েছে এই চিন্তায়। আনিসের জানালা দিয়ে দেখে খাবার পড়ে আছে আর আনিস ঘুমোচ্ছে।
জামিলা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ চেপে কান্না
করতে লাগলো। কিছু কান্নার শব্দ থাকে না ভাষা থাকে।
এরপর নিজেকে সামলে চুপি চুপি আনিসকে ডাকতে থাকে। আনিস উঠে দরজা খুলে দেয়া মাত্রই সে জামিলাকে জড়িয়ে ধরে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে থাকে।
– মা তুমি কিন্তু আইজ আমারে গল্প শুনাবা। কতদিন তোমার গল্প শুনিনা!
–আচ্ছা বাবা শুনামু, তোরে আগে খাওয়াইয়া দেই।
– না আগে গল্প
– তুই আগে খাইয়া নে বাপ, আমি তোরে শুইয়া শুইয়া গল্প শুনামু।
আনিসকে জামিলা খাইয়ে দেয়। ঘুমানোর সময় শক্ত করে আনিসকে জড়িয়ে ধরে গল্প বলতে শুরু করে।
– এক দেশে এক রাজা আর এক রাণী আছিলো, তাগোর মনে আছিলো বেজায় কষ্ট! তারা একদিন কষ্ট দূর করনের লাইগা একটা বাচ্চা সুখপাখি আনে। পাখিটারে রাণী খুব আদর করতো। পাখিও রাণীরে খুব ভালবাসতো। কিন্তু একদিন সুখপাখি উইরা যায়। আর আসে না। রাণীর কত অপেক্ষা! জামিলা যেন ণিকের জন্য অন্যমনস্ক হলো।
– মা! ও মা! পাখিটা উইড়া গেল ক্যান! সুখপাখিটাও কি আমার মত মালাউন আছিলো?
মালাউন কি? আমি মালাউন ক্যান মা?
জামিলা কান্না চেপে রাখতে পারে না। আনিসকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে থাকে। রফিক মোল্লা সবটাই দেখেছে। আর কেঁদেছে পাথরের মত। পাথরের কান্নায় যেমন শত বর্ষের দীর্ঘশ্বাস থাকে তেমনি।
৩.
বাড়ির প্রতিদিনকার বাজার আনোয়ার মোল্লা করে। রফিক মোল্লার নানা ব্যস্ততার কারণে তাকেই বাড়ির বাজারটা করতে হয়।
– ভাবী! কি বাজার লাগবো কইয়া দাও।
– প্রতিদিন যা আনো আজকেও তা আইননো, তোয় বড় দেইখা একটা রুই মাছ আইনো।
– ক্যান ভাবী, বাড়িতে কি মেহমান আইবো?
না ভাই, পোলাডারে খাওয়ামু।
– ওই মালাউনের বাচ্চার লাইগা?
– ক্ষেইপো না ভাই!
– ঠিক আছে মাছ আনতে কইছো আনমু। তবে সকলের লাইগা হিসাব কইরা টুকরা কইরা কাইটা আনমু। ওই মালাউনের বাচ্চা পাইবো না।
জামিলা চুপ করে থাকে। সে যে এ সংসারে মানবী রূপী মূর্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। আনিস দূর থেকে সবই শুনে।
রাতে বেশ করে সবাই এক সাথে খেল। শুধু জামিলা ছাড়া।
– ভাবী তুমি যে খাইলানা?
– এইতো ভাই তোমাগোরে খাওয়াইছি। এখন আমি খামু।
– আর মালাউনের বাচ্চা খাইছে?
জামিলা নিশ্চুপ থেকে ভাত তরকারি নিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।
নিজের মাছের টুকরো আর যা ভাত ছিল তা নিয়ে আনিসের ঘরে যায়।
– খাইয়া নে বাপ! রুই মাছ আনছি।
– তুমি তো খাও নাই মা!
– কে কইছে আমি খাই নাই?
আনিস জামিলাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে কেঁদে বলে, মা! ও মা! মালাউনগোর কি মা থাকে না?
আনিস কাঁদতে থাকে। আর জামিলার চোখ বেয়ে শুধু পানি গড়িয়ে পড়ে। আনিসের কান্না আর জামিলার চোখের পানির স্বাক্ষী হয় জাত বিহীন ঘরের কোণে বাসা বাঁধা চড়ুই ছানারা আর তাদের মা।
৪.
আনিস বাড়ির উঠোনে একটা তুলসী গাছ এনে লাগিয়েছে। তা কেউ জানে না। এমনিতেও আনিসের বাগান করা খুব শখ। আগামীকাল ঈদ। আনিসের জন্য রফিক মোল্লা পাঞ্জাবী, পাজামা আর শার্ট এনেছে। নারকেল গাছের নিচে বসে আনিস একা মার্বেল খেলছে, রফিক মোল্লা তাকে ডেকে ঘরের ভেতর নিয়ে চুমু খেয়ে বলে, বাবা! বাপ আমার কেমন আছস!
সে কোন উত্তর দেয় না।
– রাগ করিস না! আমার হাত পা শিকলে বাঁধা।
– আব্বা! মালাউন কি?
রফিক মোল্লা কোন উত্তর না দিয়ে তার হাতে ঈদের জামা কাপড় তুলে দেয়। আনিস খুশি হয়ে তার ঘরে চলে যায়। রাতে জামিলাকে ডেকে সব উপহারগুলো দেখায় জামিলা খুব খুশি হয়। এদিকে আনোয়ার মোল্লা রাতে বাড়ি ফিরেই চেচাতে শুরু করে এই নিয়ে যে, কে তুলসী গাছ লাগিয়েছে।
তার মতে, এটা হিন্দু এবং হিন্দুদের গাছ। আনিস জামিলার মানা না শুনে দৌড়ে গিয়ে বলে, চাচা! আমি লাগাইছি।
– শালা! মালাউনের বীজ!
এই বলে সামনে মোটা পাইপ দিয়ে বেধরক তাকে মারতে লাগল। জামিলার বাঁধাতেও কোন কাজ হয় না। রফিক মোল্লা তখন বাড়িতে নেই।
– খবরদার! আমার পোলার শরীরে আর একটাও আঁচড় দিবা না, দিলে কইলাম ছাড়ুম না!
রাগ মিটিয়ে আনোয়ার মোল্লা চলে যায়।
৫.
ঈদের দিন আনিসের ভীষণ জ্বর ওঠে। রফিক মোল্লা দূর থেকে শুধু ঔষধ পাঠিয়ে দিত। ঔষধেও কাজ হচ্ছে না। প্রায় দুই দিন চলে গেল। জ্বর নামছে না। জামিলা সারাদিন শরীর মুছে দিচ্ছে আর মাথায় জল পট্টি। না! জ্বর নামছেই না। জ্বর এতটাই তীব্র যে, সে চোখ পর্যন্ত খুলতে পারছে না।
– ও গো! তুমি একটা ডাক্তার ডাইকা আন!
– যাইতাছি, এহনই যাইতাছি!
আনিস হঠাৎ চোখ খুলে জামিলাকে জিজ্ঞেস করে, মালাউন কি? জামিলা কেবলই কাঁদে
– আমি একটু ঘুমাই মা!
এরপর মালাউনের অর্থ আর কখনো আনিসের জানা হয়নি। ঘুম থেকে যদি কখনো জেগে উঠে তবে হয়তো জানতে পারবে। এ ঘুম ভাঙ্গার নয়। এ যে মালাউনের ঘুম নয়, মানুষের ঘুম।
(সংগৃহীত)