রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৭ বৈশাখ ১৪৩২
logo
ড. মহিউদ্দিন আলমগীরের সাক্ষাৎকার

আয় বৃদ্ধির সঙ্গে বৈষম্য কমে এলে বাজার দ্রুত বিস্তৃত হবে

আয় বৃদ্ধির সঙ্গে বৈষম্য কমে এলে বাজার দ্রুত বিস্তৃত হবে

ঢাকা, ২১ জানুয়ারি, এবিনিউজ : ড. মহিউদ্দিন আলমগীর অর্থনীতিবিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এর পর যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেন পিএইচডি। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে তিনি দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্টে। ছিলেন সংস্থাটির নীতি ও পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক। আলোচ্য সংস্থার জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। হার্ভার্ড ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টে ভিজিটিং স্কলার হিসেবেও কাজ করেন। এ ছাড়া ১৯৭৪-৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, চ্যালেঞ্জ, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাসহ নানা বিষয়ে একটি দৈনিকের সঙ্গে কথা বলেন এ অর্থনীতিবিদ। তা হুবহু তুলে ধরা হলো-

বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

বাংলাদেশের উন্নয়নের পেছনে অনেকগুলো বিষয় থাকলেও মূলত তিনটি এক্ষেত্রে কাজ করছে বলে আমার মনে হয়। এর একটি হলো জনশক্তি। এ কথা স্বীকার করতেই হবে, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের জনবলের উৎপাদন সক্ষমতা কিছুটা কম। কিন্তু তারা অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং তাদের প্রত্যাশা, আরো একটু ভালো করার চেষ্টা— এটা খুব কম দেশেই দেখা যায়। ১৯৭২ সালের দিকে জনগণের মধ্যে পুনর্বাসিত হওয়ার ভীষণ উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল। এখন জনগণের মধ্যে সেই একই উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখছি উন্নয়নের জন্য। ইটের ঘরবাড়ি তৈরি করার জন্য, বাজারে পণ্য নেয়ার জন্য, ছোটখাটো বিভিন্ন ধরনের উৎপাদন কাজ করার জন্য মানুষের মধ্যে বিপুল উৎসাহ রয়েছে। দেশে ক্ষুদ্র ও মধ্যম আকারের শিল্প-কারখানা দ্রুত বাড়ছে। মহাসড়কগুলোর পাশ দিয়ে গেলেই এ ধরনের বিভিন্ন ছোট-মাঝারি কলকারখানা চোখে পড়বে। ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ হচ্ছে। উন্নয়নের আরেকটি দিক হচ্ছে— বাজার। গত ৫০ বছর আমি বিভিন্ন দেশে নানা উন্নয়নমূলক কাজ করেছি। কিন্তু এত স্বল্প পরিসরের মধ্যে এত ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা, (যদিও রাস্তা খারাপ), এত সহজে বাজারে প্রবেশের অধিকার আর কোথাও নেই। গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠান বিশ্বে নাম করেছে। তাদের সাফল্যের পেছনে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক অবস্থা ও মানববসতির বড় অবদান রয়েছে। আপনি ছাগল লালন-পালন করে পাশের বাড়িতেই সেটি বিক্রি করে দিতে পারবেন। আরেকটি হলো, বাঙালিদের প্রযুক্তি গ্রহণ ও খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা অত্যন্ত বেশি। ধোলাই খালে আপনি যেকোনো জিনিস নিয়ে যান, তারা খুলে দিতে পারবে। এমন কোনো জিনিস নেই, যা সেখানে তৈরি হচ্ছে না। শুধু তৈরিই হচ্ছে না, সেটি আবার রফতানিও হচ্ছে। অর্থাৎ তারা জানে প্রযুক্তিকে কীভাবে গ্রহণ করতে হয় এবং এর সঙ্গে কীভাবে মানিয়ে নিতে হয়। অবাক করা বিষয় হলো, যেখান থেকে প্রযুক্তি বা মূল পণ্য এসেছে, অনেক সময় তার থেকেও ভালো জিনিস তৈরি করছে তারা। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাত। একবারে শূন্য থেকে শুরু করে আজ এ খাত ২৮ বিলিয়ন ডলার পরিমাণ পণ্য রফতানি করছে। এ কারণেই অর্থমন্ত্রী বলেন, আজ যেটা বাংলাদেশে অসম্ভব মনে হয়, কালকেই তা সম্ভব করে দেখাচ্ছে এ দেশের উদ্যমী জনশক্তি। আশির দশকে কোরিয়ার একটি কোম্পানি আমাদের এখান থেকে কয়েকজন কর্মীকে সেখানে নিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। আজ পুরো দেশ তৈরি পোশাক শিল্পে ছেয়ে গেছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৯০ শতাংশই কয়েক বছরের মধ্যে নিজেদের কারখানা দাঁড় করিয়েছেন। গার্মেন্ট মালিকদের মধ্যে অনেকের প্রায় কিছুই ছিল না, ব্যবসা সম্পর্কে তেমন জ্ঞানও ছিল না, অথচ তারা আজ বড় বড় কারখানার মালিক। আজ তারা গোটা দুনিয়ার সঙ্গে ব্যবসা করছেন।

বাংলাদেশকে কেন উন্নয়নের বিস্ময় বলা হচ্ছে?

সাধারণত একটি দেশের যখন মাথাপিছু আয় বাড়ে; তখন শিক্ষা, জন্মহার, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়ন নির্দেশকগুলোরও মান বাড়ে। এ নির্দেশকগুলোর উন্নয়ন ঘটানোর জন্য মাথাপিছু আয় বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চিত্রটা ভিন্ন। বাংলাদেশে মাথাপিছু আয়ের তুলনায় সামাজিক উন্নয়ন নির্দেশকগুলো অনেক এগিয়েছে। পরিসংখ্যানের ভাষায় যাকে বলা হয় আউটলায়ার। এ জন্য বাংলাদেশকে উন্নয়নের বিস্ময় বলা হচ্ছে। অমর্ত্য সেন থেকে শুরু করে বিশ্বের নামিদামি অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা একবাক্যে বাংলাদেশের উন্নয়ন বিস্ময়কে স্বীকার করে নিচ্ছেন।

অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় কম হওয়া সত্ত্বেও এ দেশের মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনা বেশ জোরালো। যারা গরিব তাদের মধ্যেও শিক্ষা, ঘরবাড়ি উন্নত করার চেষ্টা রয়েছে। আরেকটি হচ্ছে প্রতিষ্ঠান। অনেকেই বলেন, এখানে প্রতিষ্ঠান ও আমলাতন্ত্র খারাপ। কিন্তু আমরা যা মনে করছি, আমাদের প্রতিষ্ঠান ততটা খারাপ নয়। আমরা হয়তো একটু বেশিই সমালোচনা করছি। মানুষ যেমন নিজেকে নিজে সাহায্য করছে, তেমনি অন্যকেও সহায়তা করছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে বলেই কিন্তু বৈশ্বিক মন্দার মধ্যেও আমরা ৬ শতাংশের বেশি হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছি, দারিদ্র্যের হার ২২ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। উন্নতি হচ্ছে। এখন একে আরো গতিশীল করতে হবে।

অর্থাৎ আপনি বলতে চাইছেন, উন্নয়নের প্রতি মানুষের আকাঙ্ক্ষা অনেক বেশি?

শুধু আকাঙ্ক্ষা বেশি নয়, বরং আকাঙ্ক্ষা এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে।

দুর্নীতির মতো বাধা দূর ও প্রতিষ্ঠান আরো শক্তিশালী হলে কি আরো দ্রুত এগোতে পারতাম না?

দারিদ্র্র্য কমানোর দিক থেকে বাংলাদেশ কিন্তু অভিনব। বাংলাদেশ এখন পোভার্টি ট্র্যাপ থেকে বের হয়ে এসেছে। এখন যে সমস্যা রয়েছে তা হলো— নাজুকতা (ভালনারেবিলিটি)। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে জনগোষ্ঠীর একটি অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে আসছে। এদের জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। টেকসই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে আয় বাড়ে সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে।

এ কথা সত্য, আমাদের প্রতিষ্ঠান যদি আরো শক্তিশালী হতো, আমাদের মাথাপিছু আয় ও উৎপাদন আরো বেশি হতো; তাহলে পরিস্থিতি আরো উন্নত হতো। প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী না হওয়ায় বিভিন্ন অপচয় হচ্ছে, টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে, অবকাঠামো নির্মাণ করতে সময় ও অর্থ বেশি লাগছে ইত্যাদি। কিন্তু সামাজিক উন্নয়ন নির্দেশকের ক্ষেত্রে চিত্রটা ভিন্ন।

আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার চার দশক আগে প্রায় ৩ শতাংশ ছিল, যা এখন ১ শতাংশের একটু বেশি। এ ধরনের পরিবর্তন বিশ্বে বিরল। আগে পরিবারের গড় সদস্য সংখ্যা ছিল ৬ অথবা ৭, আর এখন ৩ অথবা ৪। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত প্রতিটি দম্পতি এখন সচেতন এবং তারা বাস্তবতা বুঝে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। পরিবারের আকার ছোট রাখা, পরিবারের সদস্যদের আরো ভালোভাবে দেখভাল করা এবং সন্তানদের মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে জনগণ। আগে দম্পতিদের মধ্যে মনোভাব ছিল— বেশি সন্তান নেব এবং তাদের মধ্যে থেকে অন্তত দু-একজন তো শেষ বয়সের লাঠি হবেই। এখন এ মনোভাবের পরিবর্তন হয়েছে। এখন একটি বা দুটি সন্তান থাকলেই যথেষ্ট। এর পেছনে মানুষের নিজ প্রচেষ্টা, মনোবৃত্তির পরিবর্তন ভীষণভাবে কাজ করছে। আজ মানুষের আকাঙ্ক্ষাটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। আগে যেমন নামাজ পড়া, ভোরবেলায় গান গাওয়া পারিবারিক ও সামাজিক রীতি ছিল। এখন ওই আকাঙ্ক্ষায় পরিবর্তন এসেছে। বড় হব, বিদেশে যাব, পড়াশোনা করব, ইংলিশ মিডিয়ামে ছেলেকে পড়াব— এ ধরনের আকাঙ্ক্ষাটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে, অর্থাৎ রীতিতে পরিবর্তন এসেছে। আরো বড় হওয়ার এ আকাঙ্ক্ষা সমাজ ও পরিবারের মনোবৃত্তির মধ্যে দৃঢ়ভাবে গেঁথে গেছে। এটি একটি নতুন তত্ত্ব। বাংলাদেশের বিস্ময়টা আসলে এই নতুন তত্ত্ব বা আকাঙ্ক্ষার বিস্ময়। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে কোনো বেকার লোক নেই, কেউ বসে নেই। পয়সা কম পেলেও মানুষ কাজ করছে। এর পেছনে রয়েছে আরো উন্নতির আকাঙ্ক্ষা।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আগে আকাঙ্ক্ষাটা ছিল খুব সীমিত। এজন্য দায়ী ছিল সামাজিক চাপ। যেমন— আমার বাবা ডাক্তার, আমাকেও ডাক্তার হতে হবে— এমন রীতি ছিল। এখন মানুষ উন্নতির জন্য সবকিছু করতে রাজি।

মধ্যম আয়ের দেশে যেতে হলে বাংলাদেশকে কোন কোন বিষয়ের ওপর জোর দিতে হবে?

সহজ কথা হলো, আপনি যা করেছেন, এখনো তা-ই করেন; কিন্তু ভালোভাবে করেন। নতুন প্রযুক্তি, নতুন ব্যবস্থাপনা মডেল নিয়ে এসে আরো ভালোভাবে করেন। এর অর্থ, আগে আপনি যদি ১০ টাকা দিয়ে একটি পণ্য উৎপাদন করতেন, এখন ৩ টাকায় তা করেন। কিংবা আগে ১০ টাকা দিয়ে দুটি পণ্য উৎপাদন করতেন, এখন চারটা করেন। আগে ১০ টাকা দিয়ে পণ্যের মান যা হতো, এখন একই টাকা খরচ করেন কিন্তু মান বাড়ান। মোট কথা, আগে যা করেছেন, এখনো তা-ই করেন; কিন্তু আরেকটু ভালোভাবে। এর দুটো দিক রয়েছে— উৎপাদন বাড়বে এবং ব্যয় কমবে। দ্বিতীয় হলো— নির্দিষ্ট খাতভিত্তিক কার্যক্রম। আমাদের পরবর্তী তৈরি শিল্প হলো— লেদার, ফার্মাসিউটিক্যাল, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, শিপ বিল্ডিং ও শিপইয়ার্ড। নিম্নমধ্যম আয় থেকে উচ্চমধ্যম আয়ে যেতে হলে আরো কিছু খাতের ওপর জোর দিতে হবে। উন্নতির জন্য দুটো জিনিস করতে হবে। একটা হলো— যা করছেন তা ভালোভাবে করা এবং নতুন পণ্য আনা। চিন্তা করতে হবে এভাবে— নতুন পণ্য, নতুন পদ্ধতি, নতুন প্রযুক্তি, নতুন ব্যবস্থাপনা আর নতুন বাজার ও পুরনো বাজারের দরজাটাকে আরেকটু খোলা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন, ২০৪১ (আমরা বলছি ২০৫০) সালে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় হবে ২০ হাজার ডলার। এজন্য আমাদের বাজার সম্প্রসারণ করা জরুরি। এক্ষেত্রে ভারতবর্ষের বাজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমাদের উচিত যতটা সম্ভব ওই বাজারে প্রবেশ করা। আপনি যদি ভালো মানের পণ্য দেন এবং বাজার নিয়মমাফিক পরিচালিত হয়, তবে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

আর কোথায় কোথায় বাজার সম্প্রসারণ করা যেতে পারে?

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, চীন, ভারত, শ্রীলংকার (পণ্যের মান ভালো হলে দক্ষিণ কোরিয়ারও) বাজার যদি ধরা যায় তাহলে এটি হবে আমাদের জন্য অত্যন্ত শক্ত ভিত্তি। যার ওপর ভর করে অন্যান্য বাজারেও আমরা প্রবেশ করতে পারব। এক্ষেত্রে পণ্যের গুণগত মান রক্ষা করা বড় বিষয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজার বাংলাদেশের জন্য মোটামুটিভাবে টেকনিক্যালি স্যাচুরেইটেড। কারণ সেখান থেকে অনেক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। আপনি সেখানে মোটামুটি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য পাঠাতে পারবেন। কিন্তু পণ্য রফতানিতে বড় ধরনের উল্লম্ফন আনতে হলে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, প্যাসিফিক আইল্যান্ডসহ আশপাশের দেশগুলোয় নজর দিতে হবে। যেখানে পরিবহন বা লজিস্টিক ব্যয় কম, সেখান থেকে শুরু করতে হবে।

ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র এখনো আমাদের প্রধান বাজার...

ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রর বাজার সীমিত, ওই বাজার থেকে বের হতে হবে। ভারত আমাদের সত্যিকারের একটি বড় বাজার। চীনও বড় বাজার। তাদের অর্থনীতি বাড়ছে। আমাদের এখানে চীনা পণ্যে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে, তাহলে আমরা কেন ওখানে আমাদের পণ্য পাঠাতে পারব না। আমাদের ব্যবসায়ীদের দেখতে হবে ওখানে কোন কোন পণ্যের চাহিদা রয়েছে। সে চাহিদা ও মান অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন করতে হবে। এর পর বাণিজ্য বাধা দূরীকরণে নজর দিতে হবে। পণ্যের মান নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে মানের প্রশ্নে বিশ্ব এখন কোনো আপস করছে না।

আমরা যদি বিএসটিআইকে শক্তিশালী করতাম, তাহলে তো এ ঝামেলাটা হতো না...

রাজনীতিতে একে অন্যকে দোষারোপের নীতি বজায় রয়েছে। তাই কারো দিকে তাকিয়ে লাভ নেই। আমাদের মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানের করতে হবে, সে বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই। তবে আওয়ামী লীগকে এক্ষেত্রে ক্রেডিট দিতেই হবে। কারণ তারা ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলে, ভিশন ২০২১ নিয়ে কথা বলে, এখন উন্নত দেশ হওয়া নিয়ে কথা বলছে। এত কিছুর মাঝখানেও তারা উন্নয়ন নিয়ে কথা বলছে। একটা স্বপ্নের চিত্র তুলে ধরছে। এটি কম ইতিবাচক বিষয় নয়।

আমাদের কয়েকটি বিষয়ে নজর দিতে হবে। একটা হলো— মাথাপিছু আয় বাড়াতে হবে। তবে গড়পড়তা বাড়ালেই হবে না; অর্থনৈতিক বৈষম্যও কমিয়ে আনতে হবে। আয় বৃদ্ধির সঙ্গে বৈষম্য কমে এলে বাজার দ্রুত বিস্তৃত হবে। অর্থাৎ বৈষম্য কমিয়ে স্থানীয় বাজার বাড়াতে হবে। দেশের বাইরে বাজারের পরিসর বাড়াতে হবে। এর সঙ্গে পণ্যের মান, মার্কেটিং, বাণিজ্যনীতি, রাজনীতি প্রভৃতি জড়িত। একই সঙ্গে আমাদের বাজার সম্প্রসারণ প্রচেষ্টা হওয়া উচিত সুনির্দিষ্টভাবে। বাজার সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে আমাদের নিকটবর্তী দেশগুলোর প্রতি জোর দেয়া উচিত। আফ্রিকা, সুদান, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, তানজানিয়া, সেনেগাল, দক্ষিণ আফ্রিকা বাংলাদেশের পণ্যের জন্য ভালো বাজার হতে পারে। তবে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, চীন, মধ্য এশিয়ার বাজারের ওপর আমাদের সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া উচিত। এ অঞ্চলের বাজারগুলোয় আরো প্রবেশাধিকারের জন্য দ্বিপক্ষীয় চুক্তিসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া উচিত। আমাদের দূতাবাসগুলোর উচিত বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদারের প্রতি নজর দেয়া। আমাদের পররাষ্ট্রনীতিকেও বাণিজ্যকেন্দ্রিক করে সাজাতে হবে।

বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

বিনিয়োগ না হওয়ার মূল কারণ অবশ্যই আস্থার অভাব। আমার হিসাব অনুযায়ী, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ওপর ওঠাতে হলে জিডিপির ৩৫ শতাংশ বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সঞ্চয় ৩০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করতে হবে। এ পরিবেশের মধ্যে বড় তিনটি বিষয় একবারে আটকে রয়েছে। একটি হলো নিরাপত্তা। বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের জন্য নিরাপদ বোধ করছেন না। বগুড়া, যশোর, খুলনায় আগে প্রচুর শিল্প-কারখানা ছিল, কিন্তু এখন বি-শিল্পায়িত হয়ে যাচ্ছে। আরেকটি হলো হয়রানি। শিল্প-কারখানা করতে হলে উদ্যোক্তাদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়। শুধু চাঁদাবাজি নয়, আমলাতান্ত্রিক, প্রশাসনিক, ল অ্যান্ড অর্ডার, জমি— সবকিছুতেই হয়রানি হতে হয়। তৃতীয়টি হলো— একসেস টু ক্যাপিটাল বা মূলধনপ্রাপ্তি। যারা ব্যাংক থেকে ঋণ পাচ্ছেন, তাদের কেউ কেউ পুরো বিনিয়োগ করছেন না, চুরি করছেন। অন্যদিকে যারা সত্যিকার বিনিয়োগ করতে চান, তারা মূলধন পাচ্ছেন না। দক্ষ শ্রমশক্তিরও অভাব রয়েছে। আমাদের প্রচুর শ্রমবল থাকলেও দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে। তবে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য সরকার এখন উদ্যোগ নিয়েছে। আমাদের বিদ্যুৎ ও গ্যাস দরকার, প্রয়োজন শক্তিশালী অবকাঠামো। সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। কিন্তু এগোচ্ছে না। কয়লা বাদ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে না। ক্লিন কোল ও অল্টারনেটিভ এনার্জির দরকার রয়েছে আমাদের। এনার্জি ইফিসিয়েন্সি বাড়াতে হবে। অন্যদিকে রাস্তাঘাট বাড়াতে হবে। সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতি বেসরকারি বিনিয়োগকে নিরুসাহিত করছে।

দেশী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ বাড়ছে। এটিকে কীভাবে দেখেন?

বাইরে (বিদেশে) বিনিয়োগ করতে চাওয়ার দুটি কারণ, একটা- স্থানীয় বিনিয়োগে অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়। আরেকটি হলো, বড় ব্যবসায়ীরা বলবেন— আমার পোর্টফোলিও রয়েছে, আমি এখানে অনেক বিনিয়োগ করেছি। কিন্তু আমার দক্ষতা বা সামর্থ্য অনুসারে এখানে বিনিয়োগের সুযোগ নেই। আমি আমার অর্থ অন্য জায়গায় খাটাতে চাই, আমাকে সুযোগ দেয়া হোক। আমার মতে, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা যেভাবে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিনিয়োগ করছেন, আমাদের ব্যবসায়ীদেরও সে চেষ্টা করতে দেয়া উচিত। আমরা চাইছি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের মধ্যে ঢুকতে। ঘরে বসে থাকলে এটি সম্ভব নয়।

দেখা যাচ্ছে, অনুমোদন ছাড়াই অনেক অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে। এখন যদি বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন দেয়া হয়, তবে কি অর্থ চলে যাওয়ার হার বেড়ে যাবে না?

এমন হবে বলে আমি মনে করছি না। বাংলাদেশে সত্যিকারের উন্নয়ন হচ্ছে। বাংলাদেশের বাজার সম্প্রসারণ হচ্ছে এবং বাজার সম্প্রসারণের আরো সুযোগ রয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশেও বিনিয়োগ হবে। কিন্তু এজন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচার কার্যক্রম দ্রুততার সঙ্গে শেষ করতে হবে। সবাইকে দেশকে ভালোবেসে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।

সুশাসনে আমাদের অগ্রগতি কেমন?

বাংলাদেশের অধিকাংশ সামাজিক উন্নয়ন নির্দেশকগুলোর উন্নতি হয়েছে ব্যক্তিচেষ্টায়। আগেই বলেছি, এক প্রজন্মের মধ্যে মনোভাবে পরিবর্তন এসেছে। এটিই প্রতিফলিত হচ্ছে। আর সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে রাজনীতিকদেরই।

আমি বলব, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ব্যবসায়ীরাই বিনিয়োগের পথ খুঁজে বের করবেন। বাঙালি সবসময় সমস্যাকে জয় করে এগিয়ে গেছে। এরাই বের করবে প্রতিবন্ধকতাকে এড়িয়ে কীভাবে এগোনো এবং প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কীভাবে সমাধান করা যায়।

সরকারের অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারগুলো কী হওয়া উচিত?

সরকারের উচিত বাণিজ্যের বাধা-বিপত্তি কমানো। বিশেষ করে বিনিয়োগের জন্য ভূমি, মূলধনপ্রাপ্তি ও অবকাঠামো-সংক্রান্ত সমস্যা হ্রাস করা উচিত।

মোট কথা হলো, সবকিছুর সঙ্গে সামাজিক পরিবর্তনের সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের এখানে যা এখনো স্থির হয়নি। আমরা এখনো সামাজিক মূল্যবোধের চিরাচরিত নিয়ম ও আধুনিক বাণিজ্যিক মূল্যবোধের মধ্যে দুলছি। এখনো ঈদের সময় মানুষ গ্রামে ছোটে, যাদের মধ্যে অনেকেরই গ্রামে কেউ নেই। এর কারণ সবার মধ্যে আগের মূল্যবোধে ফিরে যাওয়ার একটা প্রবণতা রয়েছে, কারণ তারা সেখানে নিরাপদ বোধ করে। শহরে নিরাপদ বোধের অভাব রয়েছে। এজন্য কোনো বিজনেস বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্লাস গড়ে উঠছে না। এটি গড়তে হবে। যেমন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির গুজরাটে ব্যবসায়ীরা অন্য কোনো চিন্তা না করে হাজার বছর ধরে নিজ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। অথচ আমাদের এখানে তেমন ঐতিহ্য গড়ে উঠছে না। সংঘাতের মতো সামাজিক অস্থিরতা যদি বন্ধ না হয়, তবে সব উন্নয়ন বিনষ্ট হবে। হরতালের মতো সংঘাত-সংঘর্ষকে শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। উন্নয়ন করতে হলে সংঘাতকে না বলতে হবে। গান্ধীর মতো শান্তিপূর্ণ নীতি গ্রহণ করে দাবি আদায় করতে হবে। সমাজের সর্বস্তর সংঘাতমুক্ত করতে হবে। কেন আমরা একই প্রবৃদ্ধিতে আটকে রয়েছি, তা যদি এক কথায় বলতে চাই, তবে বলতে হবে— আমরা এখনো অহিংস, শান্তিপূর্ণ ও বহুত্ববাদী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। এর ভিত্তিতে শাসনসহ অন্যান্য কাজ করলে বাংলাদেশের উন্নতি নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না। (বণিব বার্তা)

এবিএন/সাদিক/জসিম/এসএ

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত