![মুক্তবুদ্ধির দুর্জয় সারথি রশীদ আল ফারুকী](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/01/21/rashid_121793.jpg)
ইসতিয়াক জাহাঙ্গীর, ২১ জানুয়ারি, এবিনিউজ : অতি সম্প্রতি শিক্ষক, কথাশিল্পী আজাদ বুলবুল কর্তৃক সম্পাদিত উপরিউক্ত শিরোনামে একটি স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। আমিও আমার এ ছোট্ট আলোচনায় সম্পাদক কৃত শিরোনামটিই বহাল রাখলাম। গ্রন্থ পাঠে এবং বিভিন্নভাবে ড. রশীদ আল ফারুকী স্যারকে যতটুকু জানি, তাতে করে মনে হয়েছে, বুদ্ধির মুক্তি এবং চিন্তার মুক্তির জন্য যে মানুষটির জন্মই হয়েছে, তাঁকে নিয়ে আলোকপাতে উক্ত শিরোনামই যথার্থ। নামকরণের এই যথার্থতা সার্থকভাবে ব্যবহারের জন্য প্রথমেই একবার সম্পাদক মহোদয়কে সাধুবাদ জানাই।
মোট চব্বিশটি স্মৃতিকথা, স্যারের চারটি নির্বাচিত প্রবন্ধ, একটি গ্রন্থালোচনা, গ্রন্থিত এবং অগ্রন্থিত রচনাপঞ্জির তালিকা, কিছু আলোকচিত্র আর তৎপ্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সাহিত্য পরিষৎ–এর কিছু নথিভুক্ত হয়ে এই স্মারকগ্রন্থটি। খুব সংক্ষেপে এই গ্রন্থ প্রসঙ্গে কবি, প্রকাশক মনিরুল মনির’র কথা কয়টি এখানে প্রনিধানযোগ্য। তিনি জানাচ্ছেন, ‘মিথ যেমন আমাদের কাছে রহস্যাবৃত থাকে, ঠিক তেমনি রশীদ আল ফারুকী আমাদের কাছে রহস্য।’ কেন এই রহস্য? জবাবটিও তিনি দিচ্ছেন, ‘তাঁর সুনির্দিষ্ট কোনো গ্রন্থ আর বাজারে পাওয়া যায় না। ফলে এই সময়ে তাঁর লেখালেখি কিংবা চিন্তা অতটা বুঝবার মতো অবস্থা নেই।’ কতটা দূর্ভাগ্যজনক এবং দূর্ভাগা জাতি হলে পরে রশীদ আল ফারুকীর মতো একজন জনবুদ্ধিজীবির মনন, মানস, চিন্তাকে ভুলে যেতে পারি আমরা। বাস্তবে হয়েছেও তা–ই। করাল সময়ও সে কারণে রাহুগ্রস্ত করেছে আমাদেরও সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি–সব, সবকিছু। এই অন্ধকার সময়ের প্রতিনিধি হয়েও তবু কেউ লণ্ঠন উঁচিয়ে ধরার প্রয়াস নেন। সম্ভবত আজাদ বুলবুল সেই লণ্ঠনটাই উঁচিয়ে ধরার চেষ্টা করেছেন।
প্রথমেই উল্লেখ করেছি; গ্রন্থটিতে চব্বিশটি স্মৃতিকথা রয়েছে। স্মৃতিকথার ভিতর দিয়েও সমসাময়িক প্রসঙ্গ কিংবা এক্ষেত্রে রশীদ আল ফারুকীর মানসচিত্র সবাই যে সমভাবে ধরতে পেরেছেন, তা নয়। তবে সম্পাদক বেশ কৌশলে লেখাগুলোর পরম্পরা সাজাতে পেরেছেন। গ্রন্থভুক্ত প্রথম লেখাটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক শিনথূক ড. মাহবুবুল হক সাহেবের। লেখার শিরোনাম, রশীদ আল ফারুকীর জীবনপঞ্জি। এই লেখাটির মধ্য দিয়ে এক ঝলকের আল রশিদ আল ফারুকের জীবনের চুম্বক অংশ পেয়ে যাবেন। এই সুযোগে আমরা কেবল উনার জন্ম সাল এবং মৃত্যু সালটুকু উল্লেখ করতে চাইছি। জন্ম ১৯৪০ সালের ১৫ মার্চ আর মৃত্যুবরণ ১৯৮৭ সালের ১৯শে ডিসেম্বর। অর্থাৎ জীবনকাল মাত্র ৪৮ বৎসর। যেখানে এই অতি অল্প সময় প্রস্তুতিতেই অনেকের কেটে যায়। সেখানে রশীদ আল ফারুকীর সৃষ্টিশীলতা সময়কেও যেন হারিয়ে দেয়। রাজনীতি, শিক্ষকতা, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড, সাহিত্যরচনাসহ বিপুল কর্মযজ্ঞে সদা ব্যাপ্ত এক বিশাল বৈচিত্র্যময় চরিত্র। এই তাবৎ কর্মকাণ্ডের পেছনের যে উদ্দেশ্য, তার অমোঘ ঘোষণা শুনতে পাই; যখন তরুণ বয়সে সমমনাদেও নিয়ে সুন্দরম্ নামক পত্রিকা বের করছেন। সেখানে জানান দেয়া হচ্ছে, “শিল্প–সাহিত্য শুধু মানবজীবনের এবং ব্যক্তিমানসে বাহ্যশক্তির, প্রতিক্রিয়ার প্রতিচ্ছবি হিসাবেই বিচার্য নয়। অর্থনৈতিক চাপের ফলে জীবনের সম্ভাবনা ব্যাহত হতে থাকলে ব্যক্তির মনে যে প্রতিক্রিয়া সূচিত হয়, তাই যেন আজ সাহিত্যে সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিতে চাইছে, কারণ বৃহত্তর গণজীবনের সমগ্র সত্তাকে আজ ঐ একটি জিনিসেই জড়িয়ে আছে। সমস্যাকে শুধু তুলে ধরার প্রবণতাই সর্বক্ষেত্রে প্রবল দেখতে পাচ্ছি, সমাধানের প্রতি ইঙ্গিতও আমরা করব বাংলা সাহিত্যে।” বৃহত্তর গণজীবনের প্রতি এই দায় থেকেই আমৃত্যু কাজ করে গেছেন রশীদ আল ফারুকী।
পরের রচনাটি আমাদের সবার প্রিয় এক এবং একমাত্র অরুণ দাশগুপ্তর। আয়েশি ভঙ্গিতে পানের রস জারন করার বৈঠকী চালে উনার বশর ভাইকে জ্যান্ত করে তোলার এক সহজ–সরল প্রয়াস। এখানে উল্লেখ্য, সচেতন পাঠকমাত্র জানেন, রশীদ আল ফারুকীর পৈতৃক নাম খায়ের উল বশর। সে সুবাদে তিনি অরুণদার ‘বশর ভাই’। স্মৃতিচারণের সহজ কথার ভিতর দিয়ে অরুণদা কিভাবে রশীদ আল ফারুকীর সামগ্রিকতা তুলে আনছেন, তা দেখা যাক।
‘ তাঁর জ্ঞানচর্চার বিষয় ছিল বিবিধ। তবে এক জায়গায় তিনি স্থির। সেটা হলো, ইহলৌকিক ধর্মনিরপেক্ষ জীবন চেতনা। ভেবে অবাক হই, পিরের সন্তান, প্রথাগত ধর্মচিন্তার পরিবেশে গড়ে ওঠা, মাদ্রাসায় উচ্চ শিক্ষালব্ধ একজন মানুষ কি করে এমন হলেন, কী করে তিনি ছাড়তে পারলেন প্রথানুগত্য ও সনাতন আচারপরায়নতা। দেখেছি বশর যা পড়তেন তা নিয়ে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। যে কোনো লেখক, তিনি বড় চিন্তাবিদ হোন আর অনামীই হোন, কোনো একটা লেখা পড়লে তিনি পূর্বাপর, আদ্যোপান্ত বিবেচনা করতেন। একটি শব্দও সহজে দৃষ্টি এড়াতো না। এভাবেই বোধহয় বিচার–বিবেচনা করতেন বলেই হয়ত তিনি মানবধর্মে ক্রমে অবস্থাশীল হয়ে উঠেছিলেন এবং জীবনভর মানুষের প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাসও অটুট রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন।’ কত সহজ পারঙ্গমতায় অরুণদা মানুষ রশীদ আল ফারুকীকে চিহ্নিত করেন, ভেবে অবাক হই।
তার পরপরই গ্রন্থিত হয়েছে ড. মনিরুজ্জামান, হরিশংকর জলদাস, শিরিন আখতার, মিহির আচার্য, নুরুল আমিন, মিনার মনসুর, মহীবুল আজিজ প্রমুখ। মহীবুল আজিজ স্যার সবসময়ই পরিশ্রমী এবং যথাযথ সৃষ্টিশীলতায় ভরপুর। অন্তর্ভুক্ত দুটো রচনাই তিনি বেশ পরিশ্রম করে যে লিখেছেন, যে কোনো সাধারণ পাঠকই তা অনুভব করবেন। উনার দ্বিতীয় রচনায় রশীদ আল ফারুকীর বেশ কয়টি গ্রন্থেও একটা রুপরেখা দাঁড় করানোর চেষ্টা সে কথাই প্রমান করে। পরের রচনাটি পাই জনাব হোসাইন কবীর’র। সমাজ বিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে তিনি রশীদ আল ফারুকীকে বিচার করার পাশাপাশি কামনা করেন, রাজনীতির সামন্ত প্রভুদের হাত থেকে উদ্ধারকল্পে রশীদ আল ফারুকীর মত জনবুদ্ধিজীবীদেরও মনন, মানস ও চিন্তা আমাদেরও পাঠ পরিধিতে যেন সন্নিবেশিত হয়। আরো যাদের লেখা পাই, আহমদ মমতাজ, সনতোষ বড়ুয়া, জিন্নাহ চৌধুরী, আজাদ বুলবুল, নাজিমুদ্দীন শ্যামল, আলী ইদ্রিস, মারলিন ক্লারা পিনেরু, হাবীব সাখাওয়াৎ, বিকাশ মজুমদার, জামশেদ উদ্দীন, শোভরাজ চৌধুরী বেলাল মাহমুদ প্রমুখ। সবারই প্রচেষ্টায় দেখতে পাই, পিতৃতুল্য এক মানবতাবাদী রশীদ আল ফারুকীকে। অত:পর স্যারের মূল্যবান চারটি নির্বাচিত প্রবন্ধ। প্রবন্ধগুলো বহুমাত্রিক এবং তার সারাংশ আমরা রশীদ আল ফারুকী স্যারের মতামত থেকেই এভাবে মূল্যায়ন করতে পারি, ‘শিল্প সাহিত্যেও বিকাশে অবাধ তার প্রাথমিক শর্ত এবং এর মূল্যায়নে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি তার অপরিহার্য অংশ।’ সেই শর্ত এবং মূল্যায়ন রশীদ আল ফারুকী আজীবন চর্চা করেই গেছেন নি:সন্দেহে।
গ্রন্থভুক্ত পরের বিষয়টি মানুষ হিসাবে আমার ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য অসীম দু:খে। এখানে স্যারের অগ্রন্থিত গল্প এবং প্রবন্ধের যে তালিকা সংযোজিত হয়েছে, তা দেখে আবারো সংক্ষক্ষুদ্ধ চিত্তে বলতে হচ্ছে, আসলেই জাতি হিসাবে আমরা বড় দূর্ভাগা। না হলে কি করে এই মনিষীর এতগুলো সত্যিকারের সাহিত্যমূল্য সম্পন্ন লেখা হেলায় পড়ে থাকতে পারে। তবুও এই আশা করি, করাল সময়ের ভেতর দিয়েও যেভাবে আজাদ বুলবুল’র মতো প্রেমিক পুরুষ ক্ষণজন্মা এই মহান মানুষটির ধ্যান, আকাঙক্ষা ও স্বপ্নের জায়গাটি অনুসন্ধান করে প্রায় বিস্মৃত এই মহান পুরুষের জীবন ও কর্মকীর্তিকে তুলে ধরতে প্রয়াসী হন, তেমনি কেউ না কেউ হয়ত এগিয়ে আসবেন উনার গ্রন্থিত কিন্তু হারিয়ে যাওয়া বইগুলোসহ অগ্রন্থিত রচনা সমূহ প্রকাশে। তাতে করেই হয়ত প্রকৃত অর্থে ধর্মীয় গোঁড়ামী, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদী ধ্যান ধারণার বিপরীতে প্রগতিশীল চেতনায় আলোকে যে সমাজ এবং রাষ্ট্র বিনির্মানের স্বপ্ন রশীদ আল ফারুকী দেখতেন, সেই স্বপ্নকে যেমন এগিয়ে নেয়া যাবে, তেমনি জাতীয় মুক্তির সংগ্রামের এই সাহসী বীরকে শ্রদ্ধা জানানোর পথ প্রশস্ত হয়। আজাদ বুলবুল সম্পাদিত চেতনাকে একটু হলেও নাড়িয়ে দেবার সব কৃতজ্ঞ তাই সম্পাদককে দিতেই হয়।
মুক্তিবুদ্ধির দুর্জয় সারথি: রশীদ আল ফারুকী, সম্পাদক: আজাদ বুলবুল,
প্রকাশক: খড়িমাটি, চট্টগ্রাম, প্রকাশকাল: ১৫ মার্চ, ২০১৭, মূল্য: ৪০০টাকা।
(সংগৃহীত)
এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি