![কর্মমুখী শিক্ষাই সমৃদ্ধ দেশের মূলমন্ত্র](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/01/22/anamul_121867.jpg)
ড. শরীফ এনামুল কবির, ২২ জানুয়ারি, এবিনিউজ : আমাদের দেশে তৈরি পোশাক শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি, পরিবহন ব্যবস্থা, অবকাঠামোগত নির্মাণ শিল্পসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেই দক্ষ জনবলের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। এ ঘাটতি দূর করতে প্রতি বছর মোটা অংকের টাকা খরচ করে বিদেশ থেকে দক্ষ জনবল আমদানি করতে হচ্ছে। অথচ আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার একটা বিশাল অংশ এখনো বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে কর্মমুখী শিক্ষার অপ্রতুলতা এবং জাতীয় উন্নয়নের নানা ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এ শিক্ষা বিস্তারের গতিহীনতাই এর প্রধান কারণ। কারিগরি ও বিশেষায়িত শিক্ষায় যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের দেশে ও আন্তর্জাতিক বাজারে চাকরির ভালো চাহিদা আছে। কিন্তু চাহিদানুযায়ী দক্ষ জনবল সরবরাহে আমাদের বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থা যথোপযুক্ত ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফলে আমাদের দেশের শিক্ষিত বেকাররা ব্যর্থতার বেদনা ও হতাশায় আক্রান্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
বাংলাদেশের শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ বিষয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)। প্রতিবেদনটি বলছে, রফতানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পসহ দেশের সম্ভাবনাময় ১০টি খাতের ৯০ শতাংশ শ্রমিকেরই প্রশিক্ষণ নেই। তাদের দক্ষতার অভাবে বিভিন্ন খাতে প্রত্যাশা অনুযায়ী উৎপাদন হচ্ছে না।
প্রতিবেদনে আগামী ৫-১০ বছরে ১০টি খাতে কত শ্রমিক প্রয়োজন হতে পারে এবং তাদের দক্ষতার ঘাটতি পূরণে কী কী করণীয়, সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এতে আরো বলা হয়, চাহিদা অনুযায়ী আমাদের বিপুলসংখ্যক দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি আছে। এ ঘাটতি পূরণে যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করে তা সফলভাবে বাস্তবায়নের ওপর বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে। ২০১৩ সালের শ্রম জরিপের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। এতে অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনাময় দেশের ১০টি খাত বেছে নেয়া হয়, যেগুলো দেশের কর্মসংস্থান ও জিডিপি বৃদ্ধিতে অনন্য অবদান রাখছে। গুরুত্বপূর্ণ এ খাতগুলো হলো: কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, নির্মাণ, স্বাস্থ্য, পর্যটন, তথ্যপ্রযুক্তি, চামড়াজাত, হালকা প্রকৌশল, তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল ও জাহাজ নির্মাণ শিল্প।
বিআইডিএসের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সবচেয়ে বেশি অদক্ষ শ্রমিক রয়েছে চামড়া খাতে। এ খাতের ৯৫ শতাংশ শ্রমিকেরই প্রশিক্ষণ নেই। কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পে ৯৩ শতাংশ শ্রমিক প্রশিক্ষিত নয়। পোশাক খাতে মাত্র ৮ শতাংশ কর্মী প্রশিক্ষিত। বর্তমানে ৪০ লাখ কর্মী পোশাক শিল্পে সরাসরি নিয়োজিত রয়েছে, যার ৯০ শতাংশ নারী। এ খাতে দক্ষ শ্রমিক নেই— দীর্ঘ সময় ধরে এমন অভিযোগ করে আসছে সংশ্লিষ্ট খাতের উদ্যোক্তারা। দাতারাও দক্ষতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে আসছে। বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নে যে কর্মসূচি চালু আছে, তাও যথেষ্ট নয়। জাতীয় বাজেটে এ বিষয়ে আরো বেশি বরাদ্দের দাবি রয়েছে।
নেতিবাচক অবস্থা পর্যটন খাতেও। এ খাতে ৭৫ শতাংশ জনবলের প্রশিক্ষণ নেই। এ খাতে ইংরেজি বলতে না পারাটাও একটা বড় দুর্বলতা। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ৬০ শতাংশ লোকের প্রশিক্ষণ নেই। এছাড়া নির্মাণ, হালকা প্রকৌশল ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পে প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব যথাক্রমে ৯২, ৮৭ ও ৮৬ শতাংশ। প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের শ্রমবাজারে মোট জনবল প্রয়োজন হবে ৮ কোটি ২৯ লাখ। ২০২০ সালের মধ্যে ৫৪ লাখ এবং ২০২৫ সালে ৭২ লাখ লোককে প্রশিক্ষণ দিতে হবে বলে প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার একসময় বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলেছিলেন। কারণ বাংলাদেশ সে সময় প্রচুর বৈদেশিক অর্থ সহযোগিতা ও ঋণ পেত; কিন্তু তা ঠিকমতো কাজে লাগানো যেত না। ‘বাস্কেট কেস’ হিসেবে বাংলাদেশের পরিচয় ছিল দীর্ঘদিন ধরে। সেই বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে এখন বলা হচ্ছে অমীমাংসিত রহস্য। বিশ্বব্যাংকের বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘দিস ইজ দ্য ক্রাক্স অব দ্য সারপ্রাইজ’। বিশ্বে এখন ধনী দেশগুলোর বাইরে অগ্রসরমাণ বড় অর্থনীতি হিসেবে তারা চারটি দেশের নাম বলছে— ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন। সংক্ষেপে এদের বলা হয় ব্রিকস। বিশ্বখ্যাত মার্কিন বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাচ বলছে, এর পরই রয়েছে ‘নেক্সট ইলেভেন’। এই ১১ দেশের একটি হচ্ছে বাংলাদেশ। আরেক মার্কিন প্রতিষ্ঠান জেপি মরগান বলছে, অগ্রসরমাণ পাঁচ দেশের একটি এখন বাংলাদেশ। তাদের ভাষায়, ‘ফ্রন্টিয়ার ফাইভ’। বাংলাদেশের এ অর্জনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব পাচ্ছে তৈরি পোশাক খাত, প্রবাসী আয় আর কৃষি খাত। তৈরি পোশাক খাতের এ অর্জনের পেছনে আছে এক শ্রেণীর নতুন উদ্যোক্তা। কৃষিতে আছে সরকারের নেয়া অনেক সহায়ক নীতি। তবে প্রবাসী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা খুবই কম।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশী রয়েছে, যাদের ৮৭ শতাংশ কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। বড় একটি অংশেরই নেই কোনো দক্ষতা, শিক্ষাগত যোগ্যতাও তাদের অনেক কম। তার ওপর রয়েছে ভাষাগত জটিলতা। ইংরেজি ভাষা জানা নেই অধিকাংশেরই। ফলে বিদেশে বাংলাদেশীরা ভালো চাকরি পায় না। এতে তারা পারিশ্রমিকও কম পাচ্ছে। অথচ প্রশিক্ষণ থাকার কারণে পার্শ্ববর্তী দেশের শ্রমিকরা একই কাজে চার-পাঁচ গুণ বেশি রোজগার করছে। এমন তথ্য বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও)।
আবার প্রবাসী বাংলাদেশী ও তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স এবং এর ব্যয় নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপের তথ্যমতে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন ৯৫ লাখ বাংলাদেশী রয়েছে, যাদের গড় বয়স ৩২ বছর। তাদের মধ্যে ৮৭ শতাংশ কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। বাকিরা কোন না কোনো প্রশিক্ষণ নিয়ে গেছে। এই ৯৫ লাখ প্রবাসীর মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ নারী শ্রমিক। তাদের মধ্যে ৩৩ শতাংশই আছে লেবাননে। এছাড়া ২৬ শতাংশ সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ১৫ শতাংশ বসবাস করছে সৌদি আরবে।
প্রবাসীরা তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে যে অর্থ পাঠান, তার ৯০ শতাংশই ব্যয় হয় অনুৎপাদনশীল খাতে। এর মধ্যে ৭২ শতাংশ অর্থ খরচ হয় বাড়ি নির্মাণে এবং ১৮ শতাংশ ফ্ল্যাট কেনায়। তবে বাংলাদেশী একজন শ্রমিককে বিদেশে পাঠাতে অন্য দেশের তুলনায় বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়।
সিপিডি বলছে, বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্যে অশিক্ষিত ও আধা প্রশিক্ষিত শ্রমিক বেশি সরবরাহ করছে। এসব শ্রমিক প্রশিক্ষিত বাংলাদেশীর তুলনায় প্রায় ১৫ শতাংশ কম পারিশ্রমিক পাচ্ছে। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কারণে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের শ্রমিকরা মাথাপিছু ৪ হাজার ৮৪৩ ডলার, চীনারা ৬ হাজার ১১২ ও ফিলিপাইনের শ্রমিকরা ৫ হাজার ডলার পেলেও বাংলাদেশীরা পাচ্ছে মাত্র ১ হাজার ৬৭২ ডলার। শিক্ষার দিক থেকে অন্য দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকরা। প্রবাসে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের মধ্যে ৮৬ শতাংশ মাধ্যমিকের গণ্ডিই পেরোতে পারেনি।
বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ভালো বেতন না পাওয়ার প্রধান কারণ ভাষাগত দুর্বলতা ও অদক্ষতা। বেশির ভাগ প্রবাসীই ইংরেজি ভাষা জানে না। তাছাড়া কোনো কারিগরি প্রশিক্ষণ ছাড়াই তারা বিদেশে যায়। এ কারণেই অন্য অনেক দেশের শ্রমিকের তুলনায় বাংলাদেশী শ্রমিকরা অনেক কম বেতন পায়। এমনকি একপর্যায়ে তারা অনেকেই দেশে চলে আসতেও বাধ্য হয়। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে প্রবাসী শ্রমিকরা সবসময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রতি বছরই বাড়ছে এর পরিমাণ। ২০২০ সালের মধ্যে এটি ২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা যায়। বর্তমানে রেমিট্যান্স আয়ের পরিমাণ ১৫ বিলিয়ন ডলার।
কৃষি খামার করে সফলতা অর্জন করেছেন ঈশ্বরদীর ছলিমপুর ইউনিয়নের বড়ইচারা পশ্চিমপাড়া গ্রামের আব্দুল করিম বিশ্বাসের শিক্ষিত ছেলে জিল্লুর। বিএ অনার্স পাস করে চাকরি কিংবা ব্যবসায় না গিয়ে কৃষিকাজে নেমে পড়েন তিনি। তিনি এখন ‘সেভ এগ্রো ফার্মের’ মালিক। পেয়ারা, আম, লিচু, কাঁঠাল, দেশী লেবু, মিষ্টি কুমড়া, গাজর, মুলা, আলু, বেগুনসহ নানা ধরনের সবজি মিলিয়ে তিনি শতাধিক বিঘা জমিতে চাষাবাদ করছেন। প্রতি বছর বৃক্ষরোপণ করে তিনি এলাকায় খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার মতে, লেখাপড়া শেষ করে চাকরির পেছনে সময় নষ্ট না করে কৃষি প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি কৃষিকাজে জড়িয়ে পড়েন। সে সময় তিনি নিজের হাতে লিচু, আম, কাঁঠাল ও পেয়ারার গাছ রোপণ শুরু করেন। এ গাছ এখন বিশাল আকার ধারণ করেছে। এবারে তার খামারে বিপুল পরিমাণ লিচু, আম, কাঁঠাল ও পেয়ারার ফলন হয়েছে। যথাযথ প্রশিক্ষণ, পরিশ্রম ও নিষ্ঠা যে মানুষকে ক্রমে উপরের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়, এর বাস্তব প্রমাণ তিনি নিজেই— বলেন জিল্লুর।
উপসংহারে বলা যায়, কর্মমুখী শিক্ষা থাকলে প্রাত্যহিক জীবনে ছোটখাটো কাজ সম্পাদনে ব্যক্তি নিজেই সচেষ্ট হতে শেখে। উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে সে বিরাট অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। কোনো দেশ ও জাতির প্রধান সম্পদ হলো এর দক্ষ জনশক্তি। পরিকল্পনা ছাড়া জনসাধারণকে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তাত্ত্বিক জ্ঞানের সঙ্গে প্রায়োগিক জ্ঞানের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমেই শিক্ষার যথার্থ রূপান্তর ঘটানো সম্ভব। সম্ভব জনগণকে জনসম্পদে পরিণত করাও। সে লক্ষ্যেই বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রকে ক্রমেই সম্প্রসারিত করে চলেছেন। তবে দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নয়নের জন্য কর্মমুখী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটানো দরকার। এজন্য সরকারের বৃত্তিমূলক শিক্ষা বিস্তারের নীতিকে আরো গতিশীল যেমন করতে হবে, তেমনি সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে। সরকার ও জনগণের যৌথ প্রচেষ্টায় এখনই বাংলাদেশে পর্যাপ্ত বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রয়োজন। তবেই উচ্চতর তাত্ত্বিক ও কর্মমুখী শিক্ষার যুগ্ম ধারায়, কর্মসংস্থানের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে জাতির জীবন। যুগোপযোগী কর্মমুখী শিক্ষাই হতে পারে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নত বাংলাদেশ গড়ার প্রধান হাতিয়ার। (বণিক বার্তা)
লেখক : সাবেক সদস্য, বাংলাদেশ সরকারি
কর্ম কমিশন; সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়