মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫, ৩ আষাঢ় ১৪৩২
logo
  • হোম
  • সাক্ষাৎকার
  • এজেন্ডামুক্ত পরিচালক-এমডি নিয়োগ দিলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক নিরাপদ থাকবে
ড. জায়েদ বখতের সাক্ষাৎকার

এজেন্ডামুক্ত পরিচালক-এমডি নিয়োগ দিলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক নিরাপদ থাকবে

এজেন্ডামুক্ত পরিচালক-এমডি নিয়োগ দিলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক নিরাপদ থাকবে

ঢাকা, ২২ জানুয়ারি, এবিনিউজ : অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ড. জায়েদ বখত। ২০১৪ সালের নভেম্বর থেকে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি দ্বিতীয় মেয়াদে তিন বছরের জন্য ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদে পুনর্নিয়োগ পেয়েছেন। অগ্রণীসহ সামগ্রিক ব্যাংকিং খাত নিয়ে কথা বলেছেন একটি দৈনিকের সঙ্গে। তা হুবহু তুলে ধরা হলো

অগ্রণী ব্যাংকের জন্য বিদায়ী বছর কেমন ছিল?

২০১৭ সাল ছিল অগ্রণী ব্যাংকের জন্য ঘুরে দাঁড়ানোর বছর। বছরটিতে আমরা সত্যিকার অর্থেই ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছি। এখন লক্ষ্য সামনে এগিয়ে যাওয়ার। সে লক্ষ্যে আমরা সুদূরপ্রসারী কর্মসূচি গ্রহণ করেছি। সঠিকভাবে পরিচালিত হলে অগ্রণী ব্যাংক অনেক দূর এগিয়ে যাবে। বিদায়ী বছর অগ্রণী ব্যাংক ৯৫০ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফা করেছে। ২০১৬ সালের তুলনায় ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় ৭১ দশমিক ২৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকের নিট সুদ আয় বেড়েছে ৪৮৮ কোটি টাকা বা ৫৯১ শতাংশ। ২০১৬ সালে সুদ থেকে নিট আয় ছিল মাত্র ৮২ কোটি টাকা। অথচ বিদায়ী বছর সুদ আয় ৫৭১ কোটি টাকার বেশি হয়েছে। ব্যাংকের কলেবর বাড়লেও ২০১৭ সালে পরিচালন ব্যয় বেড়েছে মাত্র ১ শতাংশ। লোকসানি শাখা ৭৮টি থেকে ২০১৭ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ৪৩টিতে।

২০১৬ সাল শেষে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৬ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। ২০১৭ সাল শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ৯৭০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা কমেছে। খেলাপি ঋণ থেকে বিদায়ী বছর আমরা ৫৭৫ কোটি টাকা নগদ আদায় করেছি। পুনঃতফসিলের ফলে ২০১৭ সালে আরো ১ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায় হয়েছে। গত বছর অগ্রণী ব্যাংক অবলোপনকৃত ঋণ থেকেও ৯১ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে। ২০১৭ সালে আমাদের ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ আমানত প্রবৃদ্ধির বিপরীতে ২০ শতাংশের বেশি ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ফলে বিদায়ী বছর শেষে অগ্রণী ব্যাংকের এডি রেশিও ৫৩ থেকে বেড়ে ৬০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংকের কোনো মূলধন ও প্রভিশন ঘাটতি নেই। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে কেবল আমরাই এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা চালু করেছি। সবমিলিয়ে অগ্রণী ব্যাংক বিদায়ী বছর সফলতার সঙ্গেই পার করেছে।

বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্য থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর রহস্য কী?

গ্রাহকদের সঙ্গে ‘ওয়ান টু ওয়ান’ যোগাযোগই ঘুরে দাঁড়াতে মূল ভূমিকা পালন করেছে। ঋণ বিতরণ, খেলাপি ঋণ আদায়সহ ব্যাংকের যেকোনো কাজে গ্রাহকদের নিবিড় তত্ত্বাবধানের প্রয়োজন হয়। কারণ ‘ওয়ান টু ওয়ান’ কন্টাক্ট ছাড়া ব্যাংকিং হয় না। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বর্তমান এমডি শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে গ্রাহকদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। ফলে অল্প সময়ের ব্যবধানে অগ্রণী ব্যাংক প্রাণ ফিরে পেয়েছে। ‘ঋণখেলাপি হয়ে মারা গেলে আপনি জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝখানে ঝুলে থাকবেন’ এমন একটি বাণী অগ্রণী ব্যাংকের ফটকে টাঙানো হয়েছে। ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায়ে এমন প্রচারণাও কাজে দিয়েছে।

বর্তমানের সঙ্গে দুই বছর আগের পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনার মৌলিক তফাত কোথায়?

দক্ষতা ও সচেতনতার দিক থেকে অগ্রণী ব্যাংকের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ অনেক এগিয়ে আছে। এর আগে দায়িত্ব পালনকারীরা এত বেশি সচেতন ছিলেন না। সচেতনতা থাকলে পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায় সততার ছাপ পড়ে। দুর্নীতি করে টাকা আয় করলে ভবিষ্যতে ধরা পড়তে হবে, এমন দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করলে কারো চৌর্যবৃত্তিতে লিপ্ত হওয়ার কথা নয়।

পর্ষদ না ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ, কোনটিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের দুর্দশার জন্য বেশি দায়ী করবেন?

পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ দুটিকেই সত্ ও দক্ষ হতে হবে। এ দুটি পক্ষ সমান্তরালে না চললে কোনো ব্যাংক ভালোভাবে চলতে পারবে না। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ভালো না হলে পর্ষদ যতই সত্ ও দক্ষ হোক, সেটি কাজে আসবে না। আবার চেয়ারম্যানসহ পর্ষদ অসত্ হলে তার প্রভাব ব্যবস্থাপনায় পড়তে বাধ্য। অগ্রণী ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সততা ও সচেতনতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। অগ্রণী ব্যাংকের ৯৩৫টি শাখাই অনলাইনের আওতায় রয়েছে। এ কারণে প্রাণ, সিটি, ক্রাউন সিমেন্টের মতো বড় করপোরেট গ্রুপগুলো অগ্রণী ব্যাংকের সেবা নেয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। সিবিএসের আওতায় থাকা সারা দেশে বিস্তৃত আমাদের ব্যাংকিং নেটওয়ার্ককে শিল্পগ্রুপগুলো টাকা লেনদেনের জন্য ব্যবহার করতে চায়। এটি অগ্রণী ব্যাংকের জন্য বড় ধরনের ব্যবসায়িক সফলতা। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। পর্ষদের সদস্যরা চাইলেই এটি সম্ভব হতো না।

অগ্রণী ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের পরিস্থিতি কী?

রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য ব্যাংকগুলোর শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ রয়েছে। এক্ষেত্রে অগ্রণী ব্যাংকের ঋণ ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা। শীর্ষ ঋণখেলাপিরা রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া যায় না। ২০১৫ সালে বড় বড় খেলাপিদের ঋণ পুনর্গঠন করে দেয়া হলেও তাদের অনেকেই আবার খেলাপি হয়ে গেছেন। এদের মধ্যে এমন দু-একজন রয়েছেন, যারা সবসময়ই খেলাপি হওয়ার কিনারায় গিয়ে কিস্তি পরিশোধ করেন। ফলে আমরা টাকা আদায়ে কিছুটা আশান্বিত হই। এ ধরনের খেলাপিরা জানেন, ব্যাংক মামলা করলে তারা ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবেন। আবার সবদিক থেকে কার্যকর ব্যবস্থা নিলে, বড় ঋণখেলাপিরা কারখানা বন্ধ করে দিয়ে শ্রমিক অসন্তোষ তৈরি করবেন। এ নিয়ে সারা দেশে হইচই তৈরি হলে তারা পার পেয়ে যাবেন। রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে থাকার কারণেই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায় সম্ভব হচ্ছে না। তবে শীর্ষ খেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ে ব্যাংকের পক্ষ থেকে কার্যকর উদ্যোগ রয়েছে।

ঋণ দেয়ার জন্য এ মুহূর্তে আপনাদের ওপর কোনো চাপ আছে কিনা?

আমার মনে হয় ঋণ দেয়ার জন্য দুটি স্তর থেকে রাজনৈতিক চাপ তৈরি হয়। এর একটি হলো— রাজনৈতিক বিবেচনার ভিত্তিতে পর্ষদের পরিচালক হওয়া। এখনো রাজনৈতিক বিচার-বিবেচনার ভিত্তিতেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পর্ষদে পরিচালক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। তার মানে এটা নয় যে, রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া পরিচালকদের নিজস্ব এজেন্ডা থাকবে। এর আগে অগ্রণী ব্যাংকের পর্ষদে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, তারা অনেক বেশি রাজনৈতিক পরিচয়ধারী ছিলেন। তাদের কেউ কেউ নিজস্ব এজেন্ডা নিয়ে পর্ষদের বৈঠকে আসতেন বলে শুনেছি। তবে এটি এখন কমেছে। ঋণ দেয়ার জন্য পর্ষদের বাইরে থেকেও রাজনৈতিক চাপ এখন অনেক কম।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায় আরো স্বচ্ছতা আনার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর কী কী করণীয় আছে?

অর্থ মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর এমডি ও ডিএমডি নিয়োগ দিয়ে থাকে। দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে যদি জিএম থেকে ডিএমডিতে পদোন্নতি দেয়া হয়, তাহলে যোগ্যরা উঠে আসতে পারবেন। বয়স থাকলে সবাইকে ডিএমডি হতে হবে, এটি কোনো যুক্তি হতে পারে না। কোনো এমডি নিয়োগ পাওয়ার পর যদি তার মেয়াদ বৃদ্ধির চিন্তায় থাকেন, তাহলে তিনি বিশেষ বিশেষ গ্রাহক বা ব্যক্তিকে খুশি রাখার চেষ্টা করবেন। ফলে ব্যাংক ক্ষতির মুখে পড়তে বাধ্য। এমডি নিয়োগের পর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিয়ে যদি তা পর্যালোচনার ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে ব্যাংকগুলোর গতি বাড়বে। লক্ষ্য অর্জিত হলে এমডির মেয়াদ বাড়ানো হবে। লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলে বিদায় জানানোর সংস্কৃতি চালু করতে হবে। তাহলে কাউকে খুশি করার মনোবৃত্তি থেকে এমডিরা বেরিয়ে আসবেন। আশার কথা হলো, আগে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর এমডি নিয়োগের জন্য যতটা রাজনৈতিক আনুগত্য বিবেচনা করা হতো, এখন তা হচ্ছে না। এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে এখন দক্ষতাকেই বেশি প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে সততা, দক্ষতা ও কর্মক্ষমতার বিচার করতে হবে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ পদোন্নতি ও অবসরে যাওয়ার পর পেনশনের টাকা তুলতে ঘুষ দিতে হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। অগ্রণী ব্যাংকও এর বাইরে নয়। বিষয়টি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

অভিযোগগুলো পুরনো। নিয়োগ ও পদোন্নতিতে আগে অনেক টাকার লেনদেন হতো। এমনকি কর্মকর্তাদের পদায়নেও ঘুষ দিতে হতো বলে জানি। কিন্তু পরিস্থিতি এখন পাল্টে গেছে। ঘুষের লেনদেন জিরো হয়ে গেছে, এটি আমি বলব না। তবে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে ডিজিএম ও জিএম পদোন্নতির বোর্ডগুলোয় আমি থাকি। সেগুলোয় প্রভাবশালীদের ফোনেও কাজ হয় না। সেজন্য সবাই জানে এখানে সুপারিশ করে লাভ হবে না। নিচের স্তরের পদোন্নতিতেও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ স্বচ্ছ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

একজন অর্থনীতিবিদ ও গবেষক হিসেবে আগামী দিনের বাংলাদেশ নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কী?

গত এক দশকে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের উল্লম্ফন হয়েছে। তড়িত্ গতিতে দেশে বড় বড় অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও শক্তিশালী নেতৃত্ব আগামীর বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বের কাতারে দাঁড় করাবে বলেই আমি বিশ্বাস করি। তবে উন্নত দেশ হতে হলে আমাদের বিমানবন্দর, নৌবন্দর ও মহাসড়কের সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। (বণিক বার্তা)

এবিএন/সাদিক/জসিম/এসএ

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত