![৪২ ধনী বনাম ৩৭০ কোটি দরিদ্র](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/01/25/kamrul-hasan_122494.jpg)
কামরুল হাসান বাদল, ২৫ জানুয়ারি, এবিনিউজ : গেল বছরে বিশ্বে সৃষ্ট ৮২ ভাগ সম্পদের মালিক হয়েছেন ১ শতাংশ বিত্তবান ব্যক্তি। এর বিপরীতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্ধেকই কিছুই পায়নি। বিশ্বের সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এমন বৈষম্যের তথ্য উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফামের প্রতিবেদনে। গত সোমবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে অক্সফাম। বিশ্বের ধনী গরিব সম্পদের বৈষম্য নিয়ে প্রতি বছরেই প্রতিবেদন প্রকাশ করে অক্সফাম।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে মাত্র ৪২ জন ধনী ব্যক্তির হাতে যে সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে আছে তা বিশ্বের অর্ধেক গরিব মানুষের হাতে থাকা সম্পদের সমান। অর্থাৎ ওই ৪২ ধনী ব্যক্তি বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যা ৩৭০ কোটি দরিদ্রতম মানুষের সমান সম্পদের অধিকারী। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে ২০১৭ সালে বিশ্বে যে পরিমাণ সম্পদ উৎপাদিত হয়েছে তার ৮২ শতাংশই গেছে মাত্র ১ শতাংশ ধনীর কাছে। ২০১৭ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে অক্সফাম বলেছিল, বিশ্ব জনসংখ্যার দরিদ্রতম অর্ধেক মানুষের সমান সম্পদ কুক্ষিগত করেছে মাত্র ৬১ জন ধনী ব্যক্তি। ২০০৯ সালে এই ধনীর সংখ্যা ছিল ৩৮০ জন। আর এ বছর অক্সফাম বলছে মাত্র ৪২ জনের হাতে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের সমান সম্পদ কুক্ষিগত রয়েছে। সংস্থাটির মতে, গত ১২ মাসে ধনকুবেরদের প্রতি দুইদিন পরপরই সম্পদ অর্জনের নতুন রেকর্ড গড়তে দেখা যায়। অথচ একই সময়ে বিশ্ব জনসংখ্যার দরিদ্রতম ৫০ শতাংশ মানুষের সম্পদের পরিমাণ বাড়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। ২০১৭ সালে নতুন করে সৃষ্ট প্রতি দশ ডলারের ৮ ডলারই গেছে ১ শতাংশ বিত্তশালীর পকেটে। ২০১০ সালের পর থেকে বিশ্বে শ্রমিকদের সম্পদ যে হারে বেড়েছে তার ছয়গুণ হারে বেড়েছে ধনকুবেরদের সম্পদ। ব্রিটিশ দাতব্য সংস্থাটির প্রতিবেদনে সম্পদের ক্ষেত্রে নারীদের বঞ্চিত করার বিষয়টিকে বলা হয়েছে, বিশ্বের ১০ জন ধনকুবেরের মধ্যে ৯ জনই পুরুষ। আর নারী শ্রমিকরা এখনো পুরুষের তুলনায় কম মজুরি পেয়ে আসছেন। অক্সফামের নির্বাহী পরিচালক উইনি বিয়াইমার বলেন, যাঁরা আমাদের পোশাক তৈরি করেন এবং কৃষিকাজের মাধ্যমে আমাদের খাবারের যোগান নিশ্চিত করেন তারাই শোষণের শিকার। সুলভে খাবার সরবরাহ এবং ধনকুবের বিনিয়োগকারী ও বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা নিশ্চিত করার জন্য ওই শ্রমিকদের শোষণ করা হয়। তিনি আরও বলেন, ধনকুবেরদের সম্পদের এই প্রবৃদ্ধি সার্বিক অর্থনীতির প্রমাণ করে না বরং তা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ব্যর্থতার লক্ষণ।
সংস্থাটির প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বলা হয়েছে ন্যূনতম মজুরি পাওয়ার জন্য লাখ লাখ মানুষ সংগ্রাম করছে এবং এত অল্প সংখ্যক মানুষের হাতে এতো বেশি সম্পদ কুক্ষিগত থাকাটা অগ্রহণযোগ্য। বৈষম্য কমাতে কর ফাঁকির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং শ্রমিকদের মজুরি নিশ্চিত করতে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহবান জানিয়েছে অক্সফাম।
অক্সফাম প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে প্রতি বছর পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার এক ভয়াবহ ও অমানবিক চিত্র ফুটে ওঠে। ধনী গরিবের যে আকাশ সমান বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে এটি হলো তার প্রামাণ্যচিত্র। মাত্র ৪২ ব্যক্তির হাতে পৃথিবীর অর্ধেক জনসংখ্যার অর্থাৎ ৩৭০ কোটি মানুষের সমান সম্পদ থাকবে এটি গ্রহণযোগ্য নয়। এটি মেনে নেওয়া যায় না। একটি অবিশ্বাস্য তথ্য দিয়েছে অক্সফাম। গত ১২ মাসে ধনকুবেরদের প্রতি দুইদিন পরপরই সম্পদ অর্জনের নতুন রেকর্ড গড়তে দেখা গেছে। অথচ তার পাশাপাশি বিশ্ব জনসংখ্যার দরিদ্রতম ৫০ শতাংশ মানুষের সম্পদের পরিমাণ বাড়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দারিদ্র্য কমলেও ভয়াবহভাবে বেড়েছে ধনী দরিদ্রের বৈষম্য। বাংলাদেশের চিত্র কী বলে এক্ষেত্রে? বলা হচ্ছে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। যাকে বলা হচ্ছে দরিদ্র দেশ হতে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম একটি অর্জন। দেশের এখন মাথাপিছু আয় ১৬১০ মার্কিন ডলার। গত অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১৪৬৫ ডলার । বাংলাদেশের জিডিপি ২০১৬–১৭ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। জিডিপি বৃদ্ধি পাওয়া এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাওয়া নিঃসন্দেহে সুসংবাদ এবং একটি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির লক্ষণ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই চিত্র কি দেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক চিত্র তুলে ধরতে পারছে? ১৬১০ ডলারের কত অংশ দেশের গরিবদের আয়ের অংশ? দেশে কি ধনী দরিদ্রের বৈষম্য কমেছে?
এটি স্বীকার্য যে, দেশে দারিদ্র্যের সংখ্যা কমেছে। কমেছে হত দরিদ্রের সংখ্যাও। প্রায় মানুষের আয় বেড়েছে, বেড়েছে ক্রয়ক্ষমতাও। কিন্তু দরিদ্রের এই আয় বৃদ্ধির সাথে ধনীর আয় বৃদ্ধির পরিমাণের
ফারাকটা কি আকাশ–পাতাল নয়? অক্সফাম বিশ্বের ধনী–দরিদ্রের যে বৈষম্য তুলে ধরেছে সে চিত্র কি বাংলাদেশেও বিদ্যমান নয়। বাংলাদেশেও কি কতিপয় লোকের হাতেই দেশের অধিকাংশ সম্পদ কুক্ষিগত নয়। বাংলাদেশে কি সম্পদের সুষম বন্টন বিদ্যমান। ব্যাংক–বীমা–কলকারখানার সিংহভাগ মূলধনও লভ্যাংশ কি মাত্র কয়েকটি পরিবারই লুটেপুটে খাচ্ছে না।
খাচ্ছে তারা লুটপাট করছে এবং এভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। এই লুটপাটের অর্থ তারা বিদেশেও পাচার করছে। আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ঔপনিবেশিক শাসকরা দখলকৃত ভূখন্ডের জনগণের সম্পদ দেশের বাইরে পাচার করতো। প্রকৃতপক্ষে তারা বাইরে থেকে আহরিত ও লুক্তিত সম্পদ নিজ দেশে পাচার করে নিজ দেশকে সমৃদ্ধ করতো। আজ এখন বিদেশিরা নয়, নিজ দেশের সন্তানরাই নিজদেশের সম্পদ, জনগণের সম্পদ লুন্টন করে বিদেশে পাচার করছে। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়ায় গড়ে তুলছে সেকেন্ড হোম।
অক্সফাম বিশ্বের যে চিত্র তুলে ধরেছে বর্তমান বাংলাদেশের তেমন কোনো চিত্র আপাতত হাতে নেই। গত শতকের মাঝামাঝিতে অর্থনীতিবিদদের অনেকে মনে করতেন, মাথাপিছু আয় ও প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পেলে তার সুফল নিচের দিকে গড়িয়ে পড়বে। এই ধারণাটিকে কধডপফণ ঢমষভর্ দণমরহ বলা হতো। এতে মনে করা হতো বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তাদের সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বাড়লে তার সুফল সমাজের নিচের দিকে অর্থাৎ গরিবদের দিকে গড়িয়ে পড়বে। এই তত্ত্বের অনুসারীরা মনে করতো আগে সম্পদ বাড়তে দেওয়া হোক পরে একটি পর্যায়ে সম্পদের সুষম বন্টন করা যাবে। আমরা লক্ষ করব, পাকিস্তান সৃষ্টির পর পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে শিল্পগুলো প্রতিষ্ঠিত হলো ব্যক্তি মালিকানায় তার জন্য জমিদান করা থেকে নানা প্রকার সাহায্য সহযোগিতা করেছিল তৎকালীন সরকার। সে আমলে কল–কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, বিশেষ করে চট্টগ্রামে তার অধিকাংশ রেল ও বন্দরের জায়গায়। এই প্রবণতা এখনো আছে। শিল্প স্থাপনের জন্য তাদের নানাবিধ সুবিধা প্রদান করে সরকার। তার বিনিময়ে কিছু ট্যাক্স (ফাঁকিবাজীও করে অনেকে) ও কিছু মানুষের কর্মসংস্থান হয়। এর বিনিময়ে অধিক মুনাফালোভী কিছু কিছু ব্যক্তি কোটি কোটি টাকার মালিক হলেও শ্রমিক–কর্মচারীদের ভাগ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটে না। নামমাত্র মূল্যে এদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া কিংবা স্থায়ী লিজ দেওয়া সরকারি সম্পত্তির প্রকৃত মালিক জনগণ হলেও এ ধরনের শিল্পোদ্যোক্তারা নিজেদেরই ভাগ্য বদল করেছেন শুধু। তাতে শ্রমিক শ্রেণি বা গরিবের তেমন কোনো লাভ হয়নি।
মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস, অ্যামাজন ডট কমের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস বা ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুফারবার্গ নিজেদের মেধা ও উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে বিশ্বের সেরা ধনীতে পরিণত হয়েছেন। তারা নিজ দেশের সম্পদ পাচার করেন নি কিংবা ব্যাংকের টাকাও লোপাট করেন নি তথাপি তারা তাদের অর্জিত সম্পদের সিংহভাগ (জেফ বেজোস ছাড়া) বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করেছেন। নিজেরাও এমন দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন কিন্তু বাংলাদেশের ধনীদের চেহারা ও ভূমিকা এক্ষেত্রে ভিন্নতর। এদেশে মুষ্টিমেয় কিছু ধনী ও শিল্প পরিবার ছাড়া অধিকাংশই ব্যাংকের টাকায় অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন এবং এদের মধ্যে অনেকের কারণে ব্যাংকগুলো দৈন্যদশায় পতিত হয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের খ্যাতিমান কিছু শিল্প পরিবার স্বাস্থ্য–শিক্ষা ও জনহিতকর কাজে তাদের লভ্যাংশের উল্লেখযোগ্য অংশ খরচ করেন। বাংলাদেশে খুব কম বিত্তবান আছেন যারা এধরনের কাজে জড়িত। এ দেশের বিত্তবানদের অধিকাংশই হাসপাতাল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার বদলে মসজিদ–মাদ্রাসা নির্মাণেই আগ্রহ বেশি যাদের অধিকাংশের আয়ের বৈধতা নিয়ে প্রচুর প্রশ্ন আছে।
মূল সমস্যাটি আসলে পুঁজিবাজার অধুনা মুক্তবাজার অর্থনীতির। পুঁজিবাদ যেহেতু পক্ষান্তরে ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করে সেহেতু মানুষের মধ্যে সহজেই ধনী হয়ে উঠে সকল কিছু ভোগ করার স্পৃহা তৈরি হয়। পুঁজিবাদ ভোগবাদকে উৎসাহিত করে আর ভোগবাদী সমাজ সকলকিছুকে অর্থের মানদন্ডে বিচার করে। ফলে অর্থই হয়ে ওঠে তখন প্রধানতম ঈশ্বর। এবং যার কাছে অগাধ অর্থ আছে তখন তিনি হয়ে পড়েন চরমভাবে বেপরোয়া। যে ধারণাটি গত শতকের মাঝামাঝি ভাবা হয়েছিল, ‘টিকল ডাউন থিয়োরি’। অর্থাৎ বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তাদের সুবিধা দিয়ে মাথাপিছু আয় ও প্রবৃদ্ধির বৃদ্ধি ঘটালে তা নিচের দিকে চুইয়ে পড়বে। দেখা যাচ্ছে, এখন ঘটছে তার উল্টোটি। অর্থাৎ ভোগবাদ উপর থেকে নিচে নেমে আসছে। সমাজের প্রান্তিক শ্রেণির মানুষটিও সুযোগ পেলে ভোগবাদীতায় গা ভাসাচ্ছে। এর ফলে সমাজে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। টাকা–পয়সা করার জন্য, ধনী হয়ে ওঠার জন্য সমাজে নগ্ন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। নীতি–আদর্শ বিসর্জন দিয়ে টাকা হাতানোর কাজে নেমে গেছে সবাই। আর যেহেতু টাকা কামানোর জন্য ক্ষমতার দরকার সেহেতু অধিকাংশই এখন রাজনীতিকে করে তুলেছেন হাতিয়ার হিসেবে। জনগণের সেবা করার নামে রাজনীতি করার নামে মূলত এরা নিজেদের আখের গুছিয়ে নিতে চায়। তবে আমার ধারণা এই প্রবণতা বেশিদিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। পৃথিবীর অর্ধেক জনসংখ্যার সমান সম্পত্তি শুধু ৪২ জনের হাতে থাকবে এমন অসাম্য ও বৈষম্য বিশ্বে বেশিদিন চলবে না। অক্সফাম ওই পরিস্থিতিকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ উল্লেখ করে ধনী–দরিদ্রের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য কমিয়ে আনার ব্যাপারে উদ্যোগী হতে বিশ্ব নেতাদের তাগিদ দিয়েছেন। বিশ্বনেতারা এই পরামর্শ শুনবেন বলে মনে হয় না। কারণ তারাও পরিচালিত হয়ে থাকেন পুঁজিপতিদের আনুকূল্যে। পরিবর্তন যা করার তা সাধারণ মানুষকেই করতে হবে, বঞ্চিত কিন্তু সংখ্যাগুরু মানুষদেরই করতে হবে। মানুষকেই জেগে উঠতে হবে। তার অধিকার তাকেই ছিনিয়ে নিতে হবে। কয়েক শ মানুষ বিশ্বের সাড়ে সাত শ কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ন্তা হবে, প্রভু হবে, মাথার ওপর ছড়ি ঘোরাবে তা হয় না। এই অসভ্যতা, অশোভনতা এবং এই অনাচার বেশিদিন চলতে দেওয়া যায় না।
(সংগৃহীত)