বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

যশোর রোডের মহাশিরীষ গাছ ও একাত্তরের ইতিহাস – কিছু প্রশ্ন

যশোর রোডের মহাশিরীষ গাছ ও একাত্তরের ইতিহাস – কিছু প্রশ্ন

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া, ২৭ জানুয়ারি, এবিনিউজ : গাছের উপকারিতা সম্পর্কে কমবেশি আমরা সবাই জানি। গাছ মানুষকে ছায়া দেয়। মানুষ যখন দিনের তপ্তদাহে ক্লান্ত তখন গাছতলে গামছা বিছিয়ে শুয়ে পড়ে, রাখাল বালক মাঠে গরু চড়াতে গিয়ে গরম থেকে নিজেকে বাঁচাতে একটুখানি জিরিয়ে নেয় গাছতলায়। এই গাছ একাত্তরে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিল। একাত্তরের ভয়াবহ দশটি মাস শহর ছেড়ে কখনো গ্রামের নিজ বাড়ি, কখনো মামার বাড়ি, কখনো দিদির শ্বশুরবাড়ি ঘুরে ঘুরে কাটিয়েছি। কাছ থেকে যুদ্ধকে দেখেছি, দেখেছি মুক্তিযোদ্ধাদের, অস্ত্র হাতে। আমাদের গ্রামের টানা লম্বা বাড়িটার সামনে বড় উঠোনে বসে সন্ধ্যের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার শুনেছি। একাত্তরের মাঝামাঝি সময়ে যখন মামার বাড়িতে (ঊনাইনপুরা) এক সকালে উদ্দেশ্যহীন একটু দূরে মন্দিরের দিকে হেঁটে চলেছিলাম, একা। এমন সময় মাথার উপরে উড়ে এলো কটি হেলিকপ্টার, পাক বাহিনীর। উপর থেকে গুলি ছুড়ছে নীচে হেঁটে চলা নিরীহ মানুষের উপর। প্রাণভয়ে ভীত সামনের দিকে দৌড়াতে থাকি সেই সময়ে কিশোর এই আমি। দেখি পেছনে আমার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে দৌড়ে আসছে চারু মাসী, নিজের প্রাণের তোয়াক্কা না করে। উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়ে আশ্রয় নেই মন্দির ফেলে শ্মশান ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা বিশালদেহী বটগাছগুলোর নীচে। এই গাছ সেদিন বাঁচিয়েছিল আমার প্রাণ। গাছের কাছে আমি আজন্মের ঋণী। কেবল আমি কেন? গাছের কাছে গোটা মানব জাতি ঋণী। এই ধরা ঋণী, কেননা এই ধরাকে ধরে রেখেছে গাছ, যেন পরম মমতায়। মমতায় তো বটে, কেননা গাছেরও তো প্রাণ আছে। সে কথা ময়মনসিংহে জন্ম (১৮৫৮) নেয়া বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু সেই ১৯০০ সালে প্রমাণ করে গেছেন তা শৈশবে পড়েছি। আর আমরা মানব জাতি সমানে এই গাছকে ধ্বংস করে চলেছি। বিরামহীন, দেশে–বিদেশে। গাছ ধ্বংস করার পাশাপাশি ধ্বংস করছি জীব–জানোয়ার, পাখি এবং জানা–অজানা সহস্র প্রাণী। জঙ্গল উজাড় করে পশুদের অস্তিত্বকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছি প্রতিনিয়ত।

গাছ আমাদের কেবল যে ছায়া দেয় তা নয়। গাছ আমাদের জন্য ক্ষতিকর নাইট্রোজেন অক্সাইড, এমোনিয়া, সালফার ডাইওক্সাইড গ্রহণ করে তা বিশুদ্ধ করে। আমাদের অক্সিজেন দেয়। আমরা কি জানি যে একটি পরিপূর্ণ গাছ ১৮ ব্যক্তির জন্যে সারা বছরের অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে? শহর ও নগরকে ঠান্ডা রাখে এই গাছ। এক তথ্যে জানা যায় গত ৫০ বছরে আমেরিকার লস এঞ্জেলেসের তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রী ফারেনহাইট বেড়ে গেছে কেবল গাছ কাটার ফলে এবং গাছ কেটে বাড়ি, সড়ক তৈরি করার ফলে। আমরা কি জানি যে একটি সিঙ্গেল পরিবারের বাড়ির কাছে যদি তিনটি বড় আকারের গাছ থাকে তাহলে তা এয়ার কন্ডিশনের ৫০% ভাগ চাহিদা কমায়। গাছ মাটিকে ধরে রাখে, ধ্বস কমায় সে তো আমাদের সবার জানা। গাছ যে বৃষ্টির পানিকে বিশুদ্ধ করে সে কি আমাদের সবার জানা? গাছ স্কিন ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। অনেক গাছ আমাদের আহার জোগায়, যেমন জোগায় পশু–পাখীদের। গাছ মানুষের শিক্ষক এবং খেলার সাথীও। বোধিবৃক্ষের তলে বসে গৌতম বুদ্ধ ধ্যানে বসেছিলেন। ঋষি–সন্যাসীরা এই গাছের নীচে ধ্যান–সাধনা করেন। গাছ এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য বাড়ায়। গাছের সাথে জড়িয়ে থাকে সুখ–দুঃখের অনেক স্মৃতি, থাকে ইতিহাস, ব্যক্তির, রাষ্ট্রের। যেমনটি জড়িত বাংলাদেশের সৃষ্টির ইতিহাস। যশোর রোডের প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহাসিক রেইন ট্রি বা মহাশিরীষ গাছগুলির কথাই বলছি। গাছের এতগুলি গুণাবলী স্বত্বেও আমরা এই যশোর রোডের দু–পাশে চোখ জুড়ানো, মন ভরানো সারিবদ্ধ গাছগুলিকে উন্নয়নের ধুয়া তুলে, সড়ক বড় করার কথা বলে নষ্ট করতে চাইছি। প্রকৃতি–প্রেমীর অভাব আমাদের দেশে। ঢাকা শহরের মাঝখানে যে সমস্ত আকাশ ছোঁয়া গাছগুলি দাঁড়িয়ে এই উষ্ণ নগরীকে শীতল ছায়া দিচ্ছিল তার বারোটা বাজিয়েছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। ঢাকাকে তিলোত্তমা বানাতে গিয়ে তিনি ঢাকা নগরীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলি কেটে রাস্তা বড় করেছিলেন, পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে। একই কারণে প্রকৃতি বিনাশে অতি উৎসাহী ও স্বার্থশ্রেণি উঠে পড়ে লেগেছেন যশোর রোডের এই ঐতিহাসিক, প্রাচীন গাছগুলিকে কাটার। পত্রিকান্তরে জেনেছি এই ব্যাপারে প্রকল্প অনুমোদন সম্পন্ন, যদিও বা কোর্টের নির্দেশে ছয় মাসের জন্যে প্রকৃতি ধ্বংস করার এই প্রকল্প স্থগিত করা হয়েছে। হলে কী হবে? শকুনদের নজর পড়েছে এই গাছের উপর, তাতে আছে কোটি টাকার ব্যবসা, পকেট ভর্তির ব্যাপার–স্যাপার। পরিবেশ জাহান্নামে যাক, আমার কী লাভ হলো, কী প্রাপ্তি হলো সেটাই মুখ্য বিষয়।

ইউরোপে যে দেশে বসবাস তার প্রায় প্রত্যেকটি বাড়ির সামনে আছে সরকারি উদ্যোগে লাগানো গাছ। সরকার কেবল গাছ লাগিয়েই ক্ষান্ত না, এই গাছ নিয়মিত পরিচর্যার জন্যে আছে নির্ধারিত বিভাগ, গাড়ী নিয়ে কর্মচারী আসে, করে নিয়মিত পরিচর্যা। যদি কেউ, কোন নাগরিক, কোন কারণে এই গাছগুলি (আকারে এখনো ছোট) কাটে বা নষ্ঠ করে তাহলে জরিমানা হিসাবে তাকে গুনতে হবে কম করে পাঁচশো ইউরো, যা পঞ্চাশ হাজার টাকার সম পরিমাণ। ইতিহাসের সাথে জড়িত যে কোন কিছুই ইউরোপের প্রতিটি দেশে অতি সযত্নে লালন–পালন করা হয়। অথচ আমাদের দেশে কি চরম নিষ্ঠুরতায় এই ইতিহাস–সাক্ষী গাছগুলিকে কেটে ফেলার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। যশোর–বেনাপোলের এই সড়কটি ঊনবিংশ শতাব্দীতে তৈরি করেন যশোরের জমিদার, কালীপদ পোদ্দার। রাস্তার দু–পাশে তিনি লাগান এই মহাশিরীষ বা রেইন ট্রি। রাস্তাটি যশোর থেকে এগিয়ে গেছে কলকাতা। পাকিস্তানি আমলে কালীপদ পোদ্দারের নাম মুছে ফেলা হয়, নতুন নামকরণ করা হয় যশোর রোড। বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের সাথে এর সড়কের রয়েছে এক অবিচ্ছিন্ন ইতিহাস। এই পথ ধরে ভারতে শরণার্থী শিবিরের দিকে খালি পায়ে, ক্লান্ত দেহে এগিয়ে গিয়েছিলো হাজারে নয় লাখো লাখো অসহায় নর–নারী, শিশু, বৃদ্ধ–বৃদ্ধা। অনেকে পথেই ক্লান্তিতে, অনাহারে, ক্ষুধায়, রোগে–শোকে মারা পড়েন। এই পথ ধরে এগিয়ে গিয়েছিল দেশি–বিদেশি সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা। এই পথ ধরে শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে গিয়েছিলেন আমেরিকা থেকে আসা অ্যালেন গিন্সবার্গ। শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় প্রার্থীদের দুঃখ দুর্দশা দেখে তিনি রচনা করেছিলেন হৃদয়স্পর্শী ’’সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’’ কবিতা।

”Millions of babies watching the skies

Bellies swollen, with big round eyes

On Jessore Road -long bamboo huts

No place to shit but sand channel ruts

Millions of fathers in rain

Millions of mothers in pain

Millions of brothers in woe

Millions of sisters nowhere to go” (সংক্ষিপ্ত)

অ্যালেন গিন্সবার্গের কলম থেকে সৃষ্টি সেই কবিতাকে গানের সুরে বিশ্ব বিবেক নাড়া দেন গিন্সবার্গের বন্ধু, নোবেল বিজয়ী গায়ক, বব ডিলান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে বিশাল ভূমিকা পালন করেন তিনি। এই সড়ক ধরে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সহ মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য, মুক্তিযোদ্ধারা, দেশ–বিদেশের সাংবাদিকরা ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর দেশের প্রথম মুক্ত জেলা শহর, যশোরে জনসভা করেন। সে সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল যশোর রোডের গায়ে যশোর টাউন হল মাঠে। ভাবি আর কতভাবে বর্ণনা করলে এই যশোর রোডের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন সেই সমস্ত ক্ষমতাবানরা যারা এই ঐতিহাসিক সড়কটির দু–পাশে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রেইন্‌ ট্রি–গুলোকে কেটে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছেন? প্রশ্ন জাগে তারা কি কেবল গাছগুলো কেটে ফেলতে চাইছেন? নাকি দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বলে এই গাছগুলোকে সহ্য করতে পারছেন না? প্রকারান্তরে তারা কি ইতিহাস মুছে ফেলতে চাইছেন? প্রশ্ন জাগে এই কারণে এই ধরনের অনেক ষড়যন্ত্র এই হতভাগা দেশ নীরবে অবলোকন করেছে অতীতে। এই দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস, সাক্ষী উপড়ে ফেলার, মুছে ফেলার প্রচেষ্টা, অপপ্রয়াস বারবার হয়েছে এই দেশে, সে স্বাধীনতার পর থেকেই। এ দেশের স্বাধীনতাকে এখনো মেনে নিতে পারেনি তেমন লোকের সংখ্যা তো কম নেই এ দেশে। যশোর রোডের দু–পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাক্ষী এই রেইন্‌ ট্রিকে রাস্তা সম্প্রসারণ নামে ইতিহাসকে মুছে ফেলার অপপ্রয়াস নয় তাই বা কে জানে!

লেখক: হল্যান্ড প্রবাসী

(সংগৃহীত)

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত