![বিভাগোত্তর বাংলা কবিতায় আধুনিকতার রূপকার](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/01/27/poeter-writer_122770.jpg)
শিবলু শফি, ২৭ জানুয়ারি, এবিনিউজ : বাংলা কাব্য সাহিত্যে ঊনবিংশ শতকের শুরুতেই আধুনিকতাকে ধারণ ও বরণ করার প্রস্তুতি নিয়েছিল। যদিও ১৮১৮ সালে শ্রীরামপুর মিশনারির সহযোগিতায় ও জন ক্লার্ক মার্শম্যানের সম্পাদনায় “সমাচার দর্পণ” নামের একটি ঐতিহাসিক সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় । ১৮৫১ সাল পর্যন্ত চলা এই পত্রিকাটি একই সাথে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম সংবাদপত্রের মর্যাদার পাশাপাশি বাংলায় আধুনিক সাংবাদিকতা বা জার্নালিজমের উন্মেষ ঘটায়। এই সূত্রে সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদক ও কবি ঈশ্বরগুপ্তই সেই মধ্যযুগ থেকে আধুনিক সমাজ, সাহিত্য ও ইতিহাসের রূপান্তরিত সময়ের উজ্জ্বল প্রতিনিধি । তবে বাংলা কবিতার আধুনিকোত্তর বিনির্মাণের শুরুর দিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল বিহারীলাল চক্রবর্তী ও মাইকেল মধুসূদন দত্ত । আর ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের বাংলা সাহিত্য, আধুনিকতার বৈশ্বিক ভূগোলে পরিব্রাজনের প্রথম সার্থক প্রবেশদ্বার কিন্তু বাংলা কবিতা । বলা চলে বাংলা কবিতার হাত ধরেই বাংলা সাহিত্যের মানববৈশ্বিক উজানবাহী বহুমাত্রার আধুনিকতার উন্মেষ প্রক্রিয়া শুরু হয়, তারই বহু বিস্তৃত মনন ও চেতনার শিখা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সাহিত্যের অন্যান্য শাখা ও সমাজের নানান স্তরে । সম্ভবত বাংলা কবিতাই সর্ব প্রথম বিংশ শতাব্দীর আধুনিকতাকে আপন মহিমায়, মূল্যবোধে, পরিপ্রেক্ষিতে, প্রেক্ষাপট এমনকি মনস্তত্ত্বেও সমান্তরালভাবে বিজাড়িত করে সফলতা পেয়েছিল । যাহোক, হাজার বছরের বহু বাঁক উপবাঁক পেরিয়ে বাংলা কবিতা রবীন্দ্রনাথের হাতে এসে যে বিচিত্র শাখা প্রশাখা, ফুল ফল, পত্র পল্লবে মহীরূহে বিকাশ লাভ করেছিল; পরবর্তীতে তা “গীতাঞ্জলী’র মধ্য দিয়ে বিশ্ব সাহিত্য ও সভ্যতার এমন চূড়ায় ওঠে গেল যার নজির খুবই বিরল । সবচেয়ে কৌতূহলময় ব্যাপার হচ্ছে এমন ঔপনিবেশিক ঘেরাটোপের মধ্যে থেকেও ঔপনিবেশিক শাসকেরই হাত ধরে প্রবেশ করা গণতন্ত্র ও আধুনিকতার বিচিত্র গতি প্রকৃতি, জ্ঞান– বিজ্ঞান ও শিক্ষাদীক্ষা আত্মস্থ করলেন বটে; কিন্তু তাঁর কাব্য সাহিত্যে এ ব্যাপারটিকে মোটেও ধারণ ও প্রতিফলন ঘটালেন না। বরং ঐ কলোনিয়্যাল ধারার শোষণকামী আধুনিক ও বাজার বস্তুবাদী তরঙ্গের উর্ধ্বে ওঠে এমন এক বিপরীতে স্রোতের উজানে সাহিত্যতরী বাইতে লাগলেন যেখানে কলোনিয়্যাল ধ্যান–ধারণার আধুনিকতাও চমকে উঠলো। রবীন্দ্রনাথের হাতে হাজার বছরের বাংলা কবিতার মানব মেটাফর ও মানবতাবাদের এপিক ভাইব্রেশন যে নবতর মৃন্ময়ী ও মৃন্ময়ী গভীর সৌন্দর্যকল্প সৃজিত হলো তা বরং কলোনিয়্যাল আধুনিকতাকে অন্যভাবে শোষণ করে তা নিজস্ব প্রকৃতির উদবন্ধে শাশ্বত
মানবতাবাদ ও মানুষের পক্ষে অবস্থান নেয় । যেখানে ইউরোপের জ্ঞান বিজ্ঞান , ধারণা, দর্শন, কলা ও গতির বিচিত্র তীব্র ঝলকে কাঁপন ধরা সমাজ ব্যবস্থায় রবীন্দ্র সাহিত্যকর্ম মহীরূহের মতো স্থির অবিচল মূল্যবোধে দীক্ষিত। একদিকে পৌরাণিক “রামায়ণ” ও “মহাভারত”–এর অন্ত: ও বহি: আদর্শে প্যারালাল ব্রাহ্মণ্য ভাবাদর্শী কিংবা ভারতবর্ষ’কে তাঁর সৃজিত কাব্যমজ্জায় যেমন ঠাঁই দিলেন না তেমনি আবার তাঁর কাব্য সাহিত্যের মহিমা ইউরোপের বস্তুবাদী অস্থির ও প্রচণ্ড শক্তির অপ্রাকৃতিক ছাঁচ থেকে বের করে আনে আপন মূল্যবোধের সুবর্ণরেখায় ; যা বাংলা কবিতার সার্বিক পরিমণ্ডলকে অপার সম্ভাবনার উৎসে পরিণত করার ইতিবাচক স্বপ্নবলয় রচিত করে দেয় ।
রবীন্দ্র সাহিত্যের দোর্দণ্ড প্রতাপে যখন বুদ হয়েছিল বাংলা কবিতার মানচিত্র; আবার তার ভেতরও পরিবর্তন ও বৈচিত্র্যের প্রসাদ খুঁজছিল কেউ কেউ । তিরিশের দশক সেই দিক থেকে বাংলা কবিতার আরেক স্বর্ণালী অধ্যায়ে পরিব্রাজনের বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতা । যা বাংলা কবিতায় নতুন ভাষা ও শব্দের যোগানের সাথে সাথে কবিতার অন্তর্গত ভাববৈচিত্র্য, নাটকীয় আঙ্গিক শৈলীর অভিযোজন, ধারণা, মতবাদ ও আধুনিকতাকে আরো বিস্তর পরিসরে আয়ত্ত ও উপস্থাপনের সুযোগ এনে দেয় । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর প্রাক দশকের সেই অস্থির সময়ে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত “কল্লোল” ও কবিতা পত্রিকাকে ঘিরে জীবনানন্দ দাশ, সুধীনন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে ও অমিয় চক্রবর্তী’র মতো প্রথাবিরোধী ও ভিন্ন ট্রেকের মেধাবী কবিদের উত্থান ঘটে । তিরিশের পাঁচ–তারা কবিদের অভিনব আবেদনময়ী ভাষা যেমন নতুনতর পোশাক পরিচ্ছদে প্রাণচঞ্চল তেমনি দ্বন্দ্ব ও মনস্তাত্ত্বিক জটিলতায় বৈচিত্র্যময় ও ছদ্মবেশি । বলে চলে বিংশ শতাব্দীর এই পাঁচ–তারা কবিরা, গভীরভাবে অর্ধ শতাব্দীর অধিক রবীন্দ্র কর্তৃত্ববাদ ও মোহগ্রস্ত বাংলা কাব্য মনীষার ভূগোলে এ প্রথাবিরোধী ধারা নতুন দিকে ঘুরে নীরবতা ভাঙ্গে; যা অভিনবত্বে আর সংবেদনশীলতায় বিচিত্র উপাখ্যানে ও সুরে নবতর এক কবিতা– সন্দর্ভ ভিত্তি গড়লো যা একই সাথে কবিতায় ধ্যানী কিংবা ধ্যান পরায়ণ ও স্বভাব কবি ও কবিতার পরিমণ্ডলকে বহুরৈখিকভাবে পিছু হটিয়ে দেয়। বাংলা কবিতায় মেধাবী ও প্রতিভাবানদের প্রতিষ্ঠা পাকাপোক্ত হয়। অন্যদিকে প্রথাগত বাংলা কবিতার গ্রহণ বর্জনের যে বাধা বিপত্তি তা সমূলে উৎপাটন করে, এর অন্তরে বাহিরের সমীকরণ, পরিসংখ্যান ও স্ট্রাটেজি’সহ খোল–নলচে পাল্টে দেয় । এতে বাংলা কবিতা বহুমুখী, বহুগামী, অবিশ্বাস, বিচ্ছিন্নতা, নৈরাজ্য, বাস্তবতা ও সময় সমান্তরাল নানামুখী অন্তঃ ও বহিঃমুখীনতায় অদ্ভুত ধারালো ব্যক্তিত্ব অর্জন করে । স্পষ্টতই আধুনিক ও আধুনিকোত্তর প্রজন্মের কাছে তিরিশের এই পর্বটি কৌতূহল ও অভিনবত্বের বৈচিত্র্যময় মাত্রা নিয়েই হাজির হয়। ফলে বাংলা কবিতার প্রোফাইল ও পার্সোনালিটি’ ঋদ্ধ মেধাবিস্তৃত যোজনায় নতুনদের জন্য আগামী দিগদর্শনের এক অনন্য ও অনুরণীয় বাতিঘর হয়ে উঠে ।
আবার কলকাতায় বাঙালি হিন্দু সমাজ, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক নবজাগরণমুখী সেই অভিযাত্রার প্রক্ষিপ্ত আলোটি যদি একটু ঘুরিয়ে ঠিক সেই সময়ের বাঙালি মুসলমানদের কাব্য তথা সাহিত্য চর্চার হাল হকিকতের উপর ফেলি তবে দেখা যাবে সম্পূর্ণ উল্টো এক চিত্র । ইসলামের পুনর্জাগরণের নামে আরবী ও উর্দু মিশ্রিত কাল্পনিক সব ধর্মীয় ও আরব্যকাহিনী নির্ভর দোভাষী পুঁথি সাহিত্য ছাড়া পুরো ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক অর্থাৎ এই ১২০– ৩০ বছর পর্যন্ত বাংলা কবিতার ধারে কাছেও ঘেষঁতে পারেনি বাঙালি মুসলমানেরা। বৃটিশ শাসিত উপমহাদেশের কলকাতাকেন্দ্রিক নবজাগরণের সেই আধুনিকতার আলোকিত প্রেক্ষাপট কিংবা প্ল্য্যটফর্ম থেকে বিচ্যুত বাঙালি মুসলমানেরা নিজেদের রেডিক্যাল ও ফ্যানাটিক অতীতমুখী উগ্র ধর্মীয় শৃঙ্খল বিবরে চরম অশিক্ষা, সর্বপ্রকার প্রাগ্রসর সমাজ চিন্তা, জ্ঞান, ভাবনা ও অগ্রগতিবিমুখ কুপমণ্ডুকতার বৃত্তে আবদ্ধ রয়ে গেছে। এই সকল ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ যেমন নিজেরা অশিক্ষিত ধূর্ত ,চরম অবাস্তব আর্ত–সামাজিক অপ্রাগ্রসর জীবন মননের তিমিরে যেমন নিপতিত তদ্রুপ পুরো বাঙালি মুসলমান জাতিসত্তাটিকে তাদের নিকৃষ্ট ও ভয়ংকর কূট আর আত্মঘাতি ধর্মীয় রাজনীতির বাতাবরণে আটকে ফেলার হীন প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিল; আজকের বাংলাদেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ধর্মীয় উগ্রতা মৌলবাদ, সর্বদা খড়গ হস্ত ও এক্সট্রিম’ ও রেডিক্যাল’ ইসলামের উত্থান মূলত ঐ সকল পূর্বসূরীদের ছাই চাপা পড়া বিষবৃক্ষেরই আধুনিক প্রজনন। অন্যদিকে রেডিক্যাল ও ফ্যানাটিক ধর্মীয় মতবাদ আরবী ও উর্দুকে বেইজড করে ঐ সকল ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ সব সময়ই বাংলাভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ধর্ম– রাজনৈতিক কাউন্টার বা প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর হীন প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকতো; কারণটা সম্ভবত এই যে বাঙালি প্রাণের ভাষা ও সংস্কৃতি’কে হটাতে না পারলে এই বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে রেডিক্যাল ও ফ্যানাটিক ইসলামের সম্পূর্ণ বিকাশ আদৌ সম্ভব নয় । ফলে ধর্মীয় ফ্যানাটিসিজম বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অনেকক্ষেত্রে মুখোমুখি অবস্থান নিতো । তাদের এইসব উদ্ভট ধর্ম রাজনৈতিক অদূরদর্শীতা, অশিক্ষা, দ্বিচারীতা, দ্বিধা ও হুজুগেপনায় ঘাড়টেরা টানাপোড়নে বাঙালি মুসলমানদের চিন্তা চেতনায় অনেকখানি প্রভাব ফেললেও বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির গভীর লৌকিক মুকুর থেকে উৎসজাত; সাধারণ বাঙালি মুসলমানেরা ঐ উগ্র মৌলবাদী চক্রটিকে ভাষা সংস্কৃতি, জাতিগত কিংবা রাজনৈতিক দিক দিয়ে নানানভাবে পরাজিত করে আসছে যুগ যুগ ধরে; বাঙালি মুসলমানদের আর্থ–সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের দিক থেকে এর প্রকৃত উদাহরণ হচ্ছে দেশ বিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গে ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন । সেই উদাহরণটি আরো পরিষ্কার হয়ে উঠতে দেখি যখন অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসে সেই বৃটিশ উপনিবেশ শক্তির ভীত ও সময় কাঁপানো অবিস্মরণীয় একজন কীর্তিমান কবি নজরুল ইসলাম, একজন পল্লীর মেঠৌ পথ, ধানক্ষেত কিংবা নকশি কাঁথাসহ গ্রাম জনপদ ও জীবনের কবি জসীম উদ্দীন আরেকটু পরবর্তীতে বাঙালির অবিস্মরণীয় আরেক প্রাণের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে
১৯৫২ থেকে ৭১ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের এই সকল রক্ত উন্মাতাল রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনা প্রবাহের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই এই ঊনিশ–বিশ বছরে ধর্মীয় উগ্রতাসহ জাতি হিসেবে সমস্ত ধর্মীয় অপশক্তি, মোল্লাতান্ত্রিক কলুষতা ও ষড়যন্ত্রকারীদের সমূলে হটিয়ে ভয়ঙ্কর রক্তাক্ত ত্যাগ–তিতিক্ষার ভেতর দিয়ে পূর্ববাংলার বীর বাঙালি জাতি সব পূর্বানুমানকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন ভূখণ্ডসহ সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে । অন্তত ১৯৭৫’রের পট পরিবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত এই সকল ঘটনা প্রবাহ বাঙালি জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে ।
এই সূত্রে বঙ্গে ‘লৌকিক ইসলাম’ শীষর্ক প্রবন্ধে ড. মুহম্মদ এনামুল হক কৌতূহলময় এক বক্তব্যে উল্লেখ করেন “ যেসকল সূফি ইসলামের সহিত এদেশীয় চিন্তা–ধারার যোগ ঘটাইলেন, তাঁহারাই সাধারণ শ্রেণির মুসলমানদের হৃদয় অধিকার করিলেন । ইহাতে ফল হইল এই যে, বাঙালার সাধারণ শ্রেণির মুসলমানদের মধ্যে এমন এক প্রকার নূতন ইসলাম জন্মলাভ করিল, যাহাকে “লৌকিক ইসলাম্” নাম দেওয়া যায় । বাংলার এই লৌকিক ইসলামের রূপ অতি চমৎকার ও কৌতুকবহ । ইহাতে হিন্দুধর্ম যেমন স্থান পাইয়াছে, বৌদ্ধধর্ম জায়গা করিয়া লইয়াছে এবং আর্য্য, অন্যার্য্য ও বৈঞ্চব–বিশ্বাস প্রবেশ করিয়াছে। “ আবার”পারস্য সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যস্থতায় তুর্কী, পাঠান ও মুঘলদের দ্বারা এদেশে ইসলাম বিস্তৃতি ও স্থায়িত্ব লাভ করায়, পারসিক “ লৌকিক ইসলামের” কোন কোন বস্তু বঙ্গের “লৌকিক ইসলামে” ঢুকিয়া গিয়াছে । তিনি আরো বলেন “ লৌকিক ইসলাম” বাঙালি মুসলমানের মানসপুত্র । ইহার সহিত বাঙালী মুসলমানের প্রাণের দরদ এত বেশি এবং ইহা বাঙালার মুসলিম জীবনে এমন অস্থিমজ্জাগত হইয়া পড়িয়াছে যে, আজ যদি কোনো সংস্কার–পন্থী মুসলমানও ইহার মূলোৎপাটনে প্রয়াসী হয়, কাল তাহার জীবন অবসান ঘটিবার সম্ভাবনার আছে ।“ এখানে যে ব্যাপারটি অন্ধকারে রয়ে গেছে তা হলো গবেষক ড. এনামুল হক তথাকথিত সংস্কারপন্থার নামে ফ্যানাটিক বা উগ্রবাদীদের পক্ষে নাকি ঐ লৌকিক পন্থার বাঙালি মুসলমানদের পক্ষে ! বলা চলে ড: এনামুল হকের এই মত কিংবা ভাবনাকে অবলম্বন করেই মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের প্রধানতম বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা তাঁর “বাঙালি মুসলমানের মন” শীর্ষক প্রবন্ধে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন যে “ মূলত বাঙালি মুসলমানেরা ইতিহাসের আদি থেকেই নির্যাতিত একটি মানবগোষ্ঠী। বাঙালি মুসলমানরা অধিকাংশই বাংলার আদিম কৃষিভিত্তিক কৌম সমাজের লোক । “ উপমহাদেশের প্রবাহমান সময়ের নানামুখী ধর্ম রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিক বিবর্তনে ড. এনামুল হকের এহেন মতামতে অনেক মতান্তর ও বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও গূঢ় কিছু সত্যকে উচকে দেয়ার পাশাপাশি বাঙালি মুসলমানের জাতিসত্তাগত মৌলিক কিছু ভাইব্র্র্রেশন’ও আমাদের সামনে তুলে ধরে ।
যাহোক ঊনিশ শতকে বঙ্কিমচন্দ্রের সমসাময়িক মীর মোশাররফ’কে (১৮৪৭–১৯১২) একজন গুরুত্বপূর্ণ গদ্য শিল্পী হিসেবে ধরা হলেও তাঁর সৃষ্টিকর্মের বেশিরভাগ অংশজুড়েই ইসলামী পুনর্জাগরণ ও ধর্ম ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের হাঁক–ডাক। বঙ্কিমের সাহিত্যিক ঘরানা বিরোধী একরকম সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতা তৈরির পাশাপাশি পুঁথি সাহিত্যের কাল্পনিকতা ও কাণ্ডজ্ঞানহীনতার যে একমুখী মধ্যযুগীয় পথচলা তাঁর বিখ্যাত “বিষাদ–সিন্ধু” গ্রন্থটি মূলত তারই এক বিশদ ধারাবাহিকতা। বাংলা গদ্যে বাঙালি মুসলমানেরা ছিটে–ফোটা কিছু সৃষ্টির মধ্য দিয়ে এগুতে থাকলেও বাংলা কবিতায় এ পর্যন্ত সে অগ্রগতির ধারা একেবারেই শূন্য বলা যায়। তথাকথিত ধর্মীয় জাগরণ, সংস্কারের নামে চরম চিন্তা বিকাশহীন অতীতমুখী মধ্যযুগীয়তাকে উপজীব্য করে মুসলিম লেখকদের গৌন অনেক লেখনি চলতে থাকলেও শতাব্দী কালের অধিক বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকেরা কী গদ্যে কী পদ্যে উদ্ভট আধুনিকতাহীন বন্ধ্যাত্বে নিপতিত ছিল। আধুনিক সমাজ কিংবা বিজ্ঞানমনস্ক ও চিন্তা, প্রগতি বা অগ্রগতিমূলক সামাজিক বিকাশের দিকে শত শত বছরের ব্যবধানেও সে মাথা তুলে দাঁড়াতে আজো যেখানে সক্ষম হয়নি সেখানে অবশ্য সাহিত্যতো আরো পরের বিষয়। তবে বিশ শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে কবি নজরুলের কোলাহলময় ঝলকে উঠার পূর্বে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। পূর্ববঙ্গে রংপুরের পায়রাবান্দায় জন্ম গ্রহণকারী এ গুনী লেখিকা তৎকালে অধপতিত নিগৃহীত, নির্যাতীত নারী সমাজের অন্ধতা, কুসংস্কার ও জড়তা দূরকল্পে দৃঢ় হাতে কলম ধরার পাশাপাশি গার্লস হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করে নারীদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারেও অভাবনীয় ভূমিকা রাখেন। পর্দা প্রথাসহ নারীদের প্রতি সমস্ত অত্যাচার অবিচার বিরুদ্ধে অদমনীয় ও সোচ্চার তাঁর লেখনি পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে অবিচল লড়ে গেছেন । পুরুষতন্ত্রের লৌহ কঠিন ব্যুহ ভেদ করে ক্ষুরধার ব্যঙ্গ বিদ্রুপ ও স্যাটায়ারের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশে বেগম রোকেয়াই সর্বপ্রথম লৈঙ্গিক সমতার বীজ বা ব্যাপারটি “অবরোধবাসিনীসহ” অন্যান্যগ্রন্থে নারী জাগরণের ঐ কল্যাণমূলক ধারাটি বাঙালি মুসলমানদের সামাজিক জাগরণের (অন্তত সাহিত্যে) ধারায় যোগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, বেগম রোকেয়াকে নারী জাগরণের অগ্রদূত, পথিকৃত ইত্যাদি তথাকথিত তকমায় অভিহিত না করে বরং বাংলার নারী সমাজকে আদি ও মধ্যযুগের পুরুষতান্ত্রিক পরিবার প্রথার দাসত্ব থেকে বের করে এনে পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নতুন সমাজ বিনির্মাণের পথে ধাবমান করার লক্ষ্যে যে ক্ষুরধার লেখনি, প্রস্তাবনা ও প্রস্তুতি নিয়েছিলেন সেটাও একদিক থেকে কিছুটা নীরব হলেও এক অভিনব সমাজ সংস্কারমূলক কাউন্টার (লৈঙ্গিক) জাগরণ বা রেনেসাঁ । যেটি মূলত ঊনিশ শতকের সবচেয়ে আলোড়িত ঘটনা রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কার আন্দোলনগুলোর চেয়ে কোনো অংশেই কম ছিল না । সেই হিসেবে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রায় বিংশ শতক জুড়ে বেগম রোকেয়া অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক প্রজন্মা লেখিকা। এইসব গুরুত্বপূর্ণ দিক বিবেচনায় আমার মতে উপমহাদেশের প্রথম বাঙালি মুসলমান গদ্যকার মীর মোশারফ হোসেনের সাহিত্য চর্চার চেয়ে বেগম রোকেয়ার সাহিত্য ও প্রথাবাহীত নারী সমাজ সংস্কারের যে অভূতপূর্ব আলোড়ন তুলেছিলেন সেটা বরং উভয়বাংলা’র হিন্দু–মুসলিম উভয়ের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীজাত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নতুন করে পুনর্মূল্যায়নের দাবি রাখে।
৩০’ দশকের বাংলা কাব্য সাহিত্যের ধারায় আরো দুটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা হচ্ছে; এক, কবি নজরুল ইসলামের আমিত্ব কারিশমার উপনিবেশ বিরোধী টগবগে আর উল্লম্ফী কবিতা, ব্যাপারটিকে অনেকটা সেই সময়ের শাষকবর্গের রক্তচক্ষুর কারাগার হাতুড়ি দিয়ে ভাঙার মতো এক প্রলেতারিয়েৎ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় নজরুলের এ কাব্য চর্চার ভেতর দিয়ে । রুটির দোকানে কাজ করা থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সৈনিক হিসেবে অল্প শিক্ষিত নিম্ন বর্গ থেকে উঠে আসেন তিনি । পশ্চিম বঙ্গের আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করলেও তিনি ৪৭’ পরবর্তী’তে পূর্ববঙ্গে স্থায়ী হওয়া এ কবি ১৯২২ সালে “ধূমকেতু” পত্রিকায় “দুর্দিনের যাত্রী” প্রকাশের মধ্য দিয়ে আধুনিক বাংলা কবিতার প্রাঙ্গণে অনেকটা ধূমকেতুর মতোই আবির্ভূত হন । এটির পাশাপাশি তাঁর বিখ্যাত সৃষ্টিকর্ম “অগ্নিবীণা” থেকে শুরু করে ঔপনিবেশিক শক্তির ভীত কাঁপানো ঐসকল বিদ্রোহাত্মক লেখনির কারণে পর পর প্রায় পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ বৃটিশ সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করার সাথে সাথে কবিকেও স্বয়ং কারারুদ্ধ হতে হয়। সেই অর্থে নজরুলকে উপমহাদেশের বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে ফুয়েল ও বারুদ যোগানোর অন্যতম এক প্যারোডি’ কাব্যকারও বলা যেতে পারে । রবীন্দ্র কাব্যচর্চার পরিমণ্ডলের বাইরেও যে বাংলা কবিতা বিকশিত হওয়ার বহুমুখী পথ রয়েছে নজরুল প্রথম সেটা ভিন্ন স্বাদ ও মেজাজে আবিষ্কার বা প্রমাণ করলেও কাব্য চর্চার মৌলিক তথা শাশ্বত স্থিতিশীলতা ও গভীর উপলব্দিজাত বোধ ও মনন তেমনটা জাগ্রত ছিল না । বৃটিশ বিরোধী উত্থাল সময়ের সেই প্রচণ্ড অস্থির ও কোলাহলমুখর পরিপ্র্রেক্ষিতকে তাঁর কবিতায় অনেকটা শিশুসুলভ একরোখা আবেগী কোলাহলের ঝলকানিতে উচ্চকিত করে তোলায় প্রয়াশি হলেও কাব্য–কবিতা, ছোটগল্প, নাটক, সিনেমা স্ক্রিপ্ট কিংবা উপন্যাসের চেয়েও মূলত সঙ্গীতেই তাঁর মৌলিক প্রতিভার অনন্য বিকাশ আমরা দেখতে পাই। দুই,- ৪৭’ এর দেশ বিভাগ, এক অর্থে বাংলা সাহিত্যের দ্বিখণ্ডিত স্রোতের দুইমুখী অগ্রযাত্রার যে মিছিল শুরু হয়, সেই বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে কবি নজরুলের কাব্য ও সাহিত্য চর্চার ধরন–ধারণ সম্পর্কে কবি প্রগতীবাদী লেখক হুমায়ন আজাদের কৌতুহলময় একটি বক্তব্যে হচ্ছে “তিনি (কবি নজরুল ইসলাম) বাঙালি মুসলমানকে সংযুক্ত করেছিলেন বাংলা কবিতার সাথে, কিন্তু আধুনিকতার সাথে নয়।” উপমহাদেশের তিন জনপ্রিয় কবির প্রধান রবীন্দ্রনাথ যিনি জীবিত ও মৃত দুই অবস্থাতেই সম্মানে স্বীকৃতিতে বিশ্বব্যাপী যেমন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিলেন তেমনি শতাব্দি কালেরও অধিক তার ফলোয়ার বা অনুসরণকারীও রয়েছে প্রচুর। সেইদিক থেকে কিছুটা মিল রয়েছে জীবনানন্দ দাশের সাথে, যদিও তিনি জীবিতকালে সম্মান ও স্বীকৃতির কিছুই পাননি কিন্তু মৃত্যুর পর উভয় বঙ্গেই তিনি নিরঙ্কুশ জনপ্র্রিয়তা অর্জন করেন এবং সেই জনপ্রিয়তায় এখনো তিল পরিমাণও কমেছে বলে মনে হয় না; শুধু তাই নয় রবীন্দ্রানথের পর বাংলা কাব্য সাহিত্যে এমন আইকনিক’ তথা ফলোয়ার’ময় কবি বাংলা কাব্যসাহিত্যে এখনো পর্যন্ত দেখা মেলেনি । [চলবে]
(সংগৃহীত)