![প্রশ্ন ফাঁস, জিহাদি ঘুষের অর্থ, এক ভিসির উদ্ধারকারী দল, ফেসবুক বন্ধ](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/01/27/afsan_122846.jpg)
আফসান চৌধুরী, ২৭ জানুয়ারি, এবিনিউজ : লজ্জিত হবার ক্ষমতা নিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে কেউ যদি সম্পৃক্ত থাকেন, তবে তার জন্য এটি একটি খারাপ সময় হতো। কিন্তু তেমন একটিও লজ্জিত মুখ দেখা যাচ্ছে না। কারণ, প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়াটা চূড়ান্তভাবে সবার ব্যর্থতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় অসহায় শিক্ষামন্ত্রীর সমাধান হলো প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে পরীক্ষার সময় ফেসবুক বন্ধ করে দেওয়া। উচ্চ মাত্রার অযোগ্যতাই এতে প্রতিফলিত হয়েছে এবং খোদ সরকারের আইটি মন্ত্রীই এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বর্তেছে আইটি উপদেষ্টার হাতে, অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর পুত্রের ওপর।
এই ‘ফেসবুক বন্ধ করার’ সমাধানটি দেবার মাত্র দুই দিন আগে জিহাদি কানেকশন থাকা একটি স্কুলের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে মন্ত্রীর ব্যক্তিগত স্টাফকে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো তুলে নিয়ে যায়। স্কুলটিকে সেনাবাহিনীর হাতে হস্তান্তর করা হয়েছে, মালিকদের গ্রেফতারও করা হয়েছে।
এর মাত্র কয়েক দিন আগে মন্ত্রী মহোদয় বিপুলভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন ‘সহনীয় মাত্রায় ঘুষ’ নেবার পক্ষে কথা বলে। অবশ্য পরে তিনি অস্বীকার করেছিলেন, যদিও কেউ তা বিশ্বাস করেনি। এটা অদ্ভুত যে সরকারের আস্থা আছে এমন মানুষের ওপর। তবে শিক্ষা হয়তো সরকারের অগ্রাধিকার খাত নয়। এসব কেলেঙ্কারির কথা তখনই জানাজানি হলো যখন সবস্তরের প্রতিবাদী স্কুলশিক্ষকেরা ব্যাপক হারে অনশন ধর্মঘট করেন ঢাকার রাস্তায়। অনশন ভঙ্গ হয়েছে, কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি।
তবে শিক্ষামন্ত্রী অনড়। তিনি রাজনৈতিক বোঝায় পরিণত হলেও তাকে বরখাস্ত করার মানে হবে সরকারের ব্যর্থতা স্বীকার করে নেয়া। ২০১৮ সালের শেষ দিকে নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে এবং ২০০৮ সালে ক্ষমতা গ্রহণের সময়ের পর থেকে সবচেয়ে বেশি নাজুক মনে হচ্ছে সরকারকে। কিন্তু প্রকাশ্যে কোনো ধরনের উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে না। নিশ্চিতভাবেই এটি প্রশ্নটির আরো বেশি রহস্যময় একটি অংশ।
ভিসির উদ্ধারকারী দল
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি বিক্ষোভরত ছাত্রদের আটাকায় পড়ে নিজেকে উদ্ধারের জন্য পুলিশের বদলে তার রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের ডাকায় তার সামর্থ্য ও উদ্দেশ্য যথেষ্ঠ সমালোচনার সম্মুখিন। কে আসলে বিশ্ববিদ্যালয় চালায়, সে প্রশ্নও সৃষ্টি হয়েছে। এই ভিসির আমলে শিক্ষক ও ছাত্রদের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে মারপিট নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তার কার্যালয়ে বিক্ষোভকারী ছাত্র-ছাত্রীরা প্রক্টর এবং বামপন্থী গ্রুপগুলোর ছাত্রদের ওপর সহিংসতা চালানোর দায়ে ক্ষমতাসীন দলের তথা ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মীকে বহিষ্কারের দাবি করছিল।
এক পর্যায়ে আটকে থাকা ভিসি তাকে উদ্ধারের জন্য পুলিশের বদলে পার্টি ক্যাডারদের ডাকেন। ফলে ঘটনাটি খারাপ অবস্থায় রূপ নেয়। প্রতিবাদী ছাত্ররা ছাত্রলীগের যেসব সদস্যের বহিষ্কার দাবি করছিল, উদ্ধার মিশনটি পরিচালনা করে তারাই।
ভিসিকে উদ্ধার ও পাহারা দিয়ে তার কক্ষে নিয়ে যাওয়ার পর উদ্ধারকারীরা বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ও পেটায়, ছাত্রীরাও রেহাই পায়নি। ছাত্রীদের পেটানোর কাজটি করে ক্ষমতাসীন দলের নারী কর্মীরা।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বদলে যে রাজনৈতিক দলের প্রতি বর্তমান ভিসি অনুগত, উদ্ধারের জন্য সেই দলের ক্যাডারদের ডাক দেওয়ার মধ্যেই সমস্যার সূত্র রয়েছে। টিকে থাকার জন্য রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হলে কি হয় তার চিত্রও রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলেরই অনুগত আরেক ভিসিকে উৎখাত করে ক্ষমতায় আসা বর্তমান ভিসি ও তার অনুগত গ্রুপটি টিকে থাকার জন্য ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের ওপর নির্ভর করছেন অনেকটা। ফলে ক্যাম্পাসটি যতটা না ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে, ততটা ভিসি’র নয়। ফলে পুলিশের বদলে তিনি ক্যাডারদের ডাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। ভিসি যখন ক্ষমতাহীন, তখন অন্য ক্ষমতা কেন্দ্রের আবির্ভাব অনিবার্য এবং এই ঘটনা তা-ই প্রকাশ করেছে।
অস্বস্তিমুক্ত প্রশাসন?
প্রশ্নপত্র ফাঁস, দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিগত স্টাফের ‘সন্ত্রাসবাদে’ অভিযুক্ত স্কুল থেকে ঘুষ গ্রহণ, শিক্ষকদের অনশন ধর্মঘট, অসহায় ভিসি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক ক্যাডারের তৎরপতা- এগুলো ক্ষমতাসীন সরকারকে কিন্তু খুব একটা বিব্রত করছে বলে মনে হচ্ছে না।
পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক সিপিডি (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ)’র তীব্র সমালোচনা করেছেন। কারণ, পরিসংখ্যান ব্যবহার করে সংগঠনটি দেখিয়েছে, বর্তমান সরকারের আমলে ধনী ও গরিবদের মধ্যকার ব্যবধান ব্যাপকভাবে বেড়েছে…। মজার ব্যাপার হলো, সিপিডি যেসব তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করেছে, সেগুলো সরকারী তথ্য। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তথ্য নয়, রাজনৈতিক কথাই শেষ কথা।
লেখক: কলাম লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক।