
ঢাকা, ২৮ জানুয়ারি, এবিনিউজ : সৌদি আরব দেশের এক দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের সময় আটক হওয়া ধনকুবের প্রিন্স আলওয়ালিদ বিন তালাল মুক্তি পেয়েছেন। নভেম্বর মাসে ওই অভিযান শুরু হয়েছিল।
প্রিন্স তালালের পারিবারিক সূত্রগুলো রয়টার বার্তা সংস্থাকে বলেছেন, রিয়াদের একটি বিলাসবহুল হোটেল থেকে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। প্রিন্স তালাল ওই হোটেলে মুক্তি পাওয়ার আগে ৩০ মিনিট ধরে রয়টার্সকে এক সাক্ষাৎকার দেন। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা হয়নি, এবং তিনি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে সমর্থন করেন। এ হোটেলে তিনি আটক ছিলেন গত নভেম্বর মাস থেকে। আটক হওয়ার পর সৌদি আরবের অত্যন্ত প্রভাবশালী ও ধনকুবের এ ব্যবসায়ী এই প্রথম একটি সাক্ষাৎকার দিলেন। তার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন: প্রধান প্রশ্ন হচ্ছে আপনি এখানে কেন?
উত্তর: এখানে আরও বেশ কয়েকজন আছেন। আমরা সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছি কারণ আমিও সরকারের একটি অংশ। আমি সৌদি শাসক পরিবারেরও অংশ। আমাদের আলোচনা চলছে। আমার বিশ্বাস আর অল্প ক’দিনের মধ্যেই আমরা সবকিছু শেষ করে আনতে পারব।
প্রশ্ন: আপনার বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ আনা হয়েছে?
উত্তর: কোনো অভিযোগ নেই। সরকার ও আমার মধ্যে কিছু বিষয়ে শুধু আলোচনা হচ্ছে। অনেক বিষয় আছে যা আমি এখনই প্রকাশ করতে পারবো না। প্রথমে আপনাকে আশ্বস্ত করছি যে এ গল্পের প্রায় শেষ পর্যায়ে আমরা পৌঁছে গেছি। তবে আমি ভালো আছি কারণ আমি তো আমার নিজের দেশেই আছি। নিজের শহরেই আছি। আমার মনে হচ্ছে যে আমি আমার বাড়িতেই আছি। এখানে কোন সমস্যা নেই। সবকিছু ঠিক আছে।
যেসব কারণে আপনি আমার সাথে কথা বলছেন এর সবগুলোই গুজব যা বিশেষ করে বিবিসিতে এসেছে। এতে আমি খুব হতাশ হয়েছি। খোলামেলা-ভাবে বলতে গেলে এর সবই মিথ্যা। এই হোটেলে আমি সবসময়ই ছিলাম এবং এখানে সবকিছুই ঠিক আছে। আমি ব্যায়াম করছি, সাঁতার কাটছি, হাঁটাচলা করছি। আমার আমার ডায়েট খাবারও পাচ্ছি।
এখানে প্রতিদিন আমার পরিবারকে ডেকে পাঠাই। এটা আমার অফিসের মতো। আমার ব্যক্তিগত অফিস, রাজ পরিবারের অফিস, আমার কিছু দেশসেবার কাজ- সবকিছুর সাথেই আমার যোগাযোগ আছে। সবকিছুই ঠিকঠাক মতো চলছে।
প্রশ্ন: বিশেষ কোনো গুজবে আপনি হতাশ হয়েছেন?
উত্তর: এটা আমি বিবিসি এবং অন্য জায়গাতেও দেখেছি। সেখানে বলা হয়েছে যে, আলওয়ালিদকে অন্য জায়গায় আসল কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এবং তাকে নির্যাতন করা হয়েছে। এসব খবর খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
আমি বের হওয়ার সাথে সাথেই একটি সাক্ষাৎকার দেওয়ার পরিকল্পনা করছিলাম। এবং কয়েক দিনের মধ্যেই এটা হবে। কিন্তু এই সাক্ষাৎকারটি আমি এখনই দিচ্ছি কারণ নানা রকমের গুজ ছড়িয়ে পড়ছে। এসব একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। এসব এক গাদা মিথ্যা কথা।
প্রশ্ন: কিন্তু কী অভিযোগের কারণে আপনাকে এখানে আটকে রাখা হয়েছে?
উত্তর: দেখুন, আমি খুব শীর্ষস্থানীয় একজন ব্যক্তি, জাতীয়ভাবে, আঞ্চলিকভাবে এবং আন্তর্জাতিকভাবে। আমি অনেক প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত আছি। আমার গোপন করার কিছু নেই। আমি এখানে খুব ভালো আছি। আরাম করছি। আমি এখানে শেভ করি, যেমন বাড়িতেও করি। নাপিত এখানে এসে চুল কাটে। সত্যি করে বলি, আমার মনে হয় যে আমি আমি বাড়িতেই আছি। এখানে বিশেষ কিছু নেই। খুব সাধারণ কিছু বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। আমি সরকারকে বলেছি, তারা যতো দিন চায় আমি এখানে থাকবো। কারণ আমি চাই সত্যটা বেরিয়ে আসুক।
প্রশ্ন: কোন কোন ডিল ঠিক ছিল না বলে তারা বলছে?
উত্তর: এখানে ঠিক বেঠিকের কিছু নেই। সবকিছুই ঠিক আছে।
প্রশ্ন: কিন্তু দুর্নীতিবিরোধী অভিযান তো চলছে।
উত্তর: দুর্নীতিবিরোধী এটি একটা বড় কথা। এখানে অনেকেই আছেন যাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই আনা হয়নি। কারণ আমি জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে এতো সব প্রকল্পের সাথে জড়িত আছি, এতো সব স্বার্থ, আমি তাদের বলেছি, আপনারা আপনাদের সময় নিন। সবকিছু খতিয়ে দেখুন। তারপরেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
আসলে আমি আরও কিছু দিন আগেই এখান থেকে চলে যেতে পারতাম। আমাকে এরকম প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমি না করে দিয়েছি। বলেছি সবকিছু সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমি এখান থেকে যাব না। কারণ সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাওয়া খুবই জরুরি। আর সেটাই হতে যাচ্ছে।
প্রশ্ন: আপনার সঙ্গে কোনো ধরনের বোঝাপড়া নিয়ে আলোচনা হচ্ছে? সরকার আপনার কাছে কতো অর্থ চাইছে? তারা কি সম্পদ চায় নাকি কোম্পানিতে ভাগ চাইছে?
উত্তর: এ রকম কথা আসলে আমি ব্লুমবার্গে পড়েছি। তারা বলছে যে সরকার আমার কাছ থেকে ছ'শো কোটি ডলার এবং কিংডম হোল্ডিং এর বড় একটা অংশ নিতে চাইছে। কিন্তু এসব মিথ্যা। আসলে আমি এসব নিয়ে কোনো কথা বলতে চাইনি। কিন্তু আমাকে নির্যাতন করার কথা যখন বলা হয়েছে তখনই আমি এই সাক্ষাৎকারটি দিতে রাজি হই।
প্রশ্ন: আপনি চলে যাওয়ার সময় কী আর্থিক বোঝাপড়া হতে পারে?
উত্তর: সে রকম কিছুর দরকার নেই। আমি ফাঁস করতে পারবো না। কারণ এখানে দুটো পক্ষ আছে। এখনও পর্যন্ত ভালোই আলোচনা হয়েছে। যখন আমার মতো একজন হাই-প্রোফাইল ব্যক্তিকে ঘিরে কিছু সন্দেহ তৈরি হয় তখন সেগুলো পরিষ্কার করে ফেলা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সারা বিশ্বেই আমার বিনিয়োগ আছে। পুরোপুরি সত্যতা নিশ্চিত করেই আমি এখান থেকে যাবো। ধীরে ধীরে আমার তার দিকেই অগ্রসর হচ্ছি।
প্রশ্ন: এটা কিভাবে সমাধান হতে পারে বলে আপনি আশা করছেন? আপনি কি কোনো ধরনের ডোনেশন দেবেন?
উত্তর: সরকারের সাথে আমরা এখন আলোচনা করছি। তাদের সাথে চূড়ান্ত আলোচনায় আপনাকে আসতে দিতে পারি না। তবে আমরা সেরকম একটা চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছে গেছি।
প্রশ্ন: এখানে কি রাজনীতির কোন ভূমিকা আছে? আপনার পিতা প্রিন্স তালালের কোন বিষয় কি আছে যে তিনি চান না যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ক্ষমতায় আসুক? নাকি এটা শুধুই দুর্নীতির বিষয়?
উত্তর: এখানে রাজনীতির কিছু নেই। অর্থনীতি বা দুর্নীতির সাথেও কিছু নেই। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি এখানে আছি। আছি সত্যটাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। এই সত্য ১০০ ভাগ প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত আমি এখানে থাকতে চাই। আমি বলতে পারি আমরা এর ৯৫ শতাংশ অর্জন করেছি।
প্রশ্ন: রিটজ হোটেল ছেড়ে যাওয়ার পর কি হতে পারে বলে আমি আশা করেন? আপনি কি সৌদি আরবেই থাকবেন?
উত্তর: আমি সৌদি আরব ছেড়ে যাব না। এটা নিশ্চিত। এটা আমার দেশ। আমার পরিবার, আমার সন্তান, আমার নাতি নাতনিরাও এখানে। এখানে আমার সহায় সম্পত্তি আছে। বাদশাহ, যুবরাজ কিম্বা সৌদি আরবের প্রতি আমার যে আনুগত্য সেটা নিয়ে কোনো আপস করা যাবে না।
প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন যে কোনো একটা পর্যায়ে আপনার কোনো সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে তুলে দিতে হবে?
উত্তর: না, না, এ রকম কিছু নয়। এ রকম কিছুই হবে না। এ রকম কিছু হয়নি।
প্রশ্ন: আপনি কি আপনার কোম্পানির লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে পারে?
উত্তর: হ্যাঁ, কিংডম হোল্ডিংয়ের প্রতিনিধিরা যখনই কথা বলতে চেয়েছেন তারা আমার সাথে কথা বলতে এখানে এসেছেন। যখনই দরকার হয়েছে আমি তাদের সাথে কথা বলেছি। কখনও প্রতিদিন আবার কখনও দুই একদিন পর পর। এবং আমার পরিবারের সাথেও। এই তো ছেলের সাথে, মেয়ের সাথে আজ কথা বললাম। আমার নাতনিদের সাথেও আমি আজ কথা বলেছি।
প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন যে সৌদি আরবে আপনার বাড়ির মালিকানা আপনারই থাকবে?
উত্তর: হ্যাঁ, দোষ প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রত্যেক মানুষই নির্দোষ। আমি জানতাম আপনি এ রকম একটা প্রশ্ন করতে পারেন। আমি একজন সৌদি নাগরিক এবং রাজ পরিবারের সদস্য। আমি জানি, লোকজন জিজ্ঞেস করছেন আলওয়ালিদ এখানে কেন। এটা জানতে চাইছে কারণ এটার কোন অর্থ হয় না। আমি দান করি, দেশপ্রেমের মতো কাজ আছে আমার। এখানে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে এবং এটা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে।
প্রশ্ন: ভবিষ্যতের আয় থেকে কিছু দেওয়ার ব্যাপারে কি অঙ্গীকার করেছেন? এসব নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে? আরামকোতে বিনিয়োগের মতো কিছু?
উত্তর: না না, ও রকম কিছুই না।
প্রশ্ন: তার মানে আপনি কোন ধরনের ডোনেশন দিচ্ছেন না?
উত্তর: না, কিছুই না।
প্রশ্ন: মুক্তি পাওয়ার পর আপনি কি করবেন?
উত্তর: সেই আগের মতোই। অন্য কিছু নয়। আমি বাইরে যাবো। আমি আমার অফিসে যাবো। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আমি মরুভূমিতে যাবো। এবং নিরামিষাশী হিসেবে আমি আমার জীবন চালিয়ে যাব।
প্রশ্ন: এই হোটেলে আপনি প্রতিদিন কি করেন?
উত্তর: এই যে আমার টেনিস খেলার জুতা। আমি হাঁটি, সাঁতার কাটি, ব্যায়াম করি, আমি খবর দেখি।
প্রশ্ন: আপনি যখন সরকারের সাথে কথা বলেন তখন তারা আপনাকে কি বলে?
উত্তর: সেটা তো আমি প্রকাশ করতে পারবো না। তবে আমরা গত ৩০ বছর ধরে সৌদি আরবে কাজ করছি। এখন দেশটিতে নতুন নেতৃত্ব পেয়েছি। তারা এখন খুঁটিনাটি সবকিছু করার চেষ্টা করছে। আমি বলেছি, ঠিক আছে, আমার কোনো সমস্যা নেই। আপনারা অগ্রসর হোন। আমি সম্পূর্ণ সহযোগিতা করব।
প্রশ্ন: এই বিষয়টি কি বিচার পর্যন্ত গাড়ে পারে এবং আপনি কি জেলেও যেতে পারেন?
উত্তর: বিচারের কোনো সম্ভাবনা নেই। জেলের প্রশ্নও আসে না।
প্রশ্ন: যে প্রক্রিয়াটা চলেছে আপনি কি মনে করেন এটা সৌদি আরবের জন্যে ভালো?
উত্তর: আমার মনে হয় তারা পক্ষপাতহীন ও সৎ ভাবেই কাজ করেছেন। সৌদি আরবে যে দুর্নীতি আছে সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে দুর্নীতিবিরোধী এক ব্যক্তিও এই পাকের মধ্যে পড়ে গেছে। বহু লোক এখানে এসেছেন। প্রায় তিনশোর মতো। আমার মনে হয় এদের বেশিরভাগই এখন মুক্ত। এবং সত্যি কথা বলতে বেশিরভাগই নির্দোষ। বাকিদের জন্যে সমঝোতা হয়েছে। তবে সেটা শুধু তাদের ও সরকারের মধ্যে।
গত দশকে প্রচুর অর্থের অপচয় হয়েছে। সরকারের কোন কোন ব্যক্তি দুর্নীতির সাথেও জড়িত ছিলেন। আমার মনে হয় এসব আগাছা উপড়ে ফেলা ভালো। এর মধ্য দিয়ে সৌদি আরব আরো পূত পবিত্র হয়ে উঠবে। আমি শুধু বলবো যে আমি বাদশাহ এবং যুবরাজ যে নতুন সৌদি আরব তৈরির জন্যে কাজ করছেন আমি তাতে পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছি।
সূত্র : বিবিসি
এবিএন/সাদিক/জসিম/এসএ