
ঢাকা, ২৮ জানুয়ারি, এবিনিউজ : ড. কামরুল হাসান খান, অধ্যাপক ও উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)। কর্মরত আছেন পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের মহাসচিব ও ইন্টারন্যাশনাল ফিজিশিয়ান্স ফর দ্য প্রিভেনশন অব নিউক্লিয়ার ওয়ারের (আইপিপিএনডব্লিউ) বোর্ড সদস্য হিসেবে। ১৯৮২ সালে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে। পরে ১৯৮৪ সালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। এরপর তিনি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন তত্কালীন আইপিজিএমআরে (বর্তমানে বিএসএমএমইউ)। ছিলেন সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির সাবেক সভাপতি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মেডিকেল জার্নালে তার বহু প্রবন্ধ প্রকাশ হয়েছে। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবাসংক্রান্ত নানা বিষয় নিয়ে একটি দৈনিকের সঙ্গে কথা বলেন অভিজ্ঞ এ চিকিৎসক। তা হুবহু তুলে ধরা হলো-
বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
ভালো-মন্দ সব মিলিয়ে একটা পর্যায়ে আছি, এটা সত্য কথা। কিন্তু আমরা যারা দেশের চিকিৎসা শিক্ষার নীতিনির্ধারণের সঙ্গে যুক্ত, আমাদের কিছু পর্যবেক্ষণ রয়েছে। এ ভূখণ্ডে আধুনিক চিকিৎসা বলতে গেলে শুরু হয়েছে ১৯৪৬ সালে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। মাত্র ছয়জন ছাত্র নিয়ে এ প্রতিষ্ঠানের যাত্রা। যেকোনো কিছু বুঝতে চাইলে সেখানে আমাদের একটা স্কেল বা মানদণ্ড থাকা দরকার। প্রতিটি ক্ষেত্রে মান নির্ধারণ করতে হলে আমাদের ভিত্তিটা হবে আর্থরাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক। এর ওপর ভিত্তি করে ৪৬ বছরে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আমাদের প্রত্যাশা নির্ধারণ করতে হবে। প্রত্যাশার সঙ্গে এখানে বাস্তবতার একটি মারাত্মক গ্যাপ রয়ে গেছে। যেমন— অনেক মানুষ সিঙ্গাপুর, ভারতের বেসরকারি ক্লিনিকগুলোয় ও লন্ডনে যাচ্ছে। তারা বাংলাদেশে ভালো চিকিৎসা প্রত্যাশা করে। নিশ্চয়ই এখানে ভালো চিকিৎসা রয়েছে কিন্তু অনেক রোগী বা তার আত্মীয়স্বজন তা মনে করে না। ফলে এ জায়গায় মানসিক একটি মারাত্মক গ্যাপ থেকে যায়। এটি একটি সমস্যা।
আমাদের এখানে মেডিকেল কালচারের আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে আবেগ। আমরা আবেগ দিয়ে সবকিছু চিন্তা করি। ফলে এখানে পেশাদারিত্ব থাকে না। আপন আপন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে এটি প্রতিবন্ধক। আরেক সমস্যা, সময়ের অপচয়। যেমন— আমার একটি বড় সময় যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালে অপ্রয়োজনীয় মানুষ সরাতে। আমি চাই ওয়ার্ডটা ঝকঝকে থাকবে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবে। নার্স রোগীকে দেখাশোনা করছে, সময়মতো ওষুধ খাওয়াচ্ছে। দায়িত্বরতরা বাদে অপ্রয়োজনীয় কোনো লোক থাকবে না। বিকালবেলায় আত্মীয়স্বজন আসবে। দেখা করে চলে যাবে।
লক্ষণীয়, বাংলাদেশ ১৭ কোটি মানুষের দেশ। এর মধ্যে কত শতাংশ আধুনিক চিকিৎসার আওতায় আসছে? অনেক হিসাব মিলিয়ে ৫০ বা ৬০ শতাংশ বলা হয়। বাকিদের আমরা ধরতে পারছি না। এটাও দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার একটি সমস্যা।
বাংলাদেশে আরো একটি সমস্যা হচ্ছে, এখানে রেফারেল সিস্টেম চালু হচ্ছে না। উপজেলায় যার চিকিৎসা হয়, সে কেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) বা ঢাকা মেডিকেল কলেজে আসবে? এ জায়গাটি আমরা করতে পারছি না। এটা করলে কিন্তু সবকিছু ভালো হয়ে যায়।
চিকিৎসক হিসেবে আপনার ব্যক্তিগত যাত্রাটা বলুন?
আমি ময়মনসিংহ মেডিকেলে পড়েছি। চিকিৎসক হয়েছি, পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করেছি। পরে বিএসএমএমইউর শিক্ষক হয়েছি। এখন ভিসি হয়েছি। দীর্ঘ পথের ভ্রমণ। চিকিৎসক হওয়ার পর থেকে আমি আন্দোলনের সঙ্গেও রয়েছি। আমাদের দেশে ইন্টার্নদের আন্দোলন হয়েছে সবসময় চাকরির জন্য। ইন সার্ভিস আইনেও তা-ই ছিল। আগে ইন সার্ভিস ট্রেনিং বলা হতো। ওই ট্রেনিংয়ের পরে অটোমেটিক চাকরি পাওয়া যেত। কিছু করা লাগত না। মেডিকেল অফিসার হয়ে যেতেন। কিন্তু ১৯৭৯ থেকে সরকার চিন্তা করেছে চাহিদা থাকায় সরকারি চাকরি দিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে নিয়োগ দেয়ার। বিশ্বের কোথাও এ সিস্টেম নেই। তবে সরকার ১৯৮৬ সালে সেটি বন্ধ করে দিয়েছে। এর পর থেকে অটোমেটিক চাকরি আর হয় না। আগে আন্দোলন হতো চাকরির ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য। আন্দোলন করতে বিএমএতে আমি ছিলাম, এখনো আছি। বাংলাদেশে চিকিৎসা শিক্ষায় যা কিছু ঘটেছে, সরকারি পর্যায়ে আমার একটি যোগাযোগ আছে। কারণ আমি বেশির ভাগ সময় লিয়াজোঁ কমিটির সঙ্গে থাকতাম। আমাদের স্বাস্থ্য নীতি কী হবে বা মানবসম্পদ নীতি কী হবে, আমাদের কী কী সম্প্রসারণ করা দরকার, কোথায় সমস্যা হচ্ছে— এসব বিষয়ে আমি মোটামুটি সবসময় কাজ করেছি।
মেডিকেল শিক্ষা সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
এখন দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১০৫টি মেডিকেল কলেজ। বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের মতো অত বড় দেশে মাত্র ১১০টি মেডিকেল কলেজ। এখন আমাদের দেশের একটা বড় সমস্যা হলো, মেডিকেল শিক্ষকের প্রচণ্ড ঘাটতি। একজন শিক্ষার্থী শিক্ষক পেল না, রোগীই দেখল না, সে কীভাবে চিকিৎসক হবে? আমরা এ জায়গাটি নিয়ে সবসময় বলে আসছি। দেশে অনেক বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হয়েছে, বলতে গেলে তাদের কিছুই নেই। হয়তো মিনিয়াম স্টাফ দিয়ে চালাচ্ছে। তাহলে একটি মেডিকেল কলেজ কীভাবে চলবে?
বর্তমানে চিকিৎসা শিক্ষায় ১১টি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউশন আছে। ৪২টি ইনস্টিটিউশনে আমরা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্স পরিচালনা করছি এবং ৫২টি কোর্স হচ্ছে রেসিডেন্সি প্রোগ্রাম। আর বাংলাদেশে ৯৪টি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্স পরিচালনা করছি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এর মধ্যে কিছু কমন আছে। যেমন— গাইনোকলজিতে এমএসও আছে আবার ডিজিও আছে। কোনো বিষয়ে শুধু ডিপ্লোমা আছে। ডিপ্লোমার ক্ষেত্রে আমরা চিন্তা করি যে, দুই বছরের কোর্স। তারা পাস করে গ্রামীণ এলাকায় বা মফস্বল শহরে চিকিৎসা দেবে। সরকারের পরিকল্পনাটাও তা-ই।
চিকিৎসাসেবায় আমাদের কোনো গৌরবের বিষয় আছে কি?
গোটা বিশ্বে বাংলাদেশের একটি গৌরবের বিষয় হলো, এখানে চিকিৎসাসেবায় পাবলিক হাসপাতাল প্রিডমিনেট করছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় মূলত এজন্য চিকিৎসাটা হচ্ছে। এখন বেসরকারি চিকিৎসাসেবার বিকাশ ঘটছে। এটাকে আমরা স্বাগত জানাই। কারণ একা সরকারের পক্ষে তা সম্ভব নয়। সবাই ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি রাশিয়াও ব্যর্থ হয়েছে। সৌদি আরবে আমি দেখেছি, তারা সরকারি ব্যবস্থাপনায় পূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা দিত। কিন্তু তারাও সেখান থেকে সরে আসছে। কারণ সম্ভব নয়। সে কারণে দেশে আরেকটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, তা হলো— ইউনিভার্সেল হেলথ কভারেজ (ইউএইচসি)। এটা শুধু কালিহাতীতে ছিল। কিছুদিন আগে মধুপুর ও ঘাটাইলে মন্ত্রী মহোদয় উদ্বোধন করে এসেছেন। এটা মানে কো-শেয়ারিং। কালিহাতীতে বোধহয় ৩০ হাজার মানুষকে সাপোর্ট দিচ্ছে। প্রতি বছর তারা জনপ্রতি ১ হাজার টাকা করে দেবে। সেখানে তারা ৫০ হাজার টাকার চিকিৎসা ফ্রি পাবে। এটা একটি চর্চায় আনার চেষ্টা করছে। কারণ বাইরে উন্নত দেশে মূলত বীমার মাধ্যমেই চিকিৎসাটা হয়। যার চিকিৎসা দরকার, সেই টাকা দিচ্ছে কিন্তু বীমার মাধ্যমে। বাংলাদেশের মতো দেশে চট করে এ চিন্তা করা যাবে না। সময়ের বিবর্তনে তা প্রয়োজন হবে। এখনো চিকিৎসা নিতে ব্যক্তির পকেট থেকে খরচ হচ্ছে ৬৩ শতাংশ। কেন মানুষ এত খরচ করবে? অন্তত ৫০ অনুপাত ৫০ শতাংশ হওয়া উচিত।
বিএমএ থেকে আমরা আপত্তি করেছি, ব্যবসার জন্য মেডিকেল কলেজ করা হলে হবে না। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ কিন্তু আইনগতভাবে লাভজনক প্রতিষ্ঠান নয়। আমি তিন বছর একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের চেয়ারম্যান ছিলাম। সেখানে আমরা দেখেছি মালিকরা ব্যবসা করার জন্যই করেন। অথচ লাভজনক প্রতিষ্ঠান নয়। তাহলে কীভাবে করেন? চুরি করে। অফিশিয়ালি কিন্তু করতে পারেন না। এ ধরনের অনেক বিষয় আছে।
১০৫টি মেডিকেল কলেজ আছে। ১১টি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউশন রয়েছে। এখন বিএসএমএমইউ একটি। চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে আরো দুটি বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেছে। তারা এখনো একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করেনি। প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম রয়েছে তাদের। আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের পর্যায়ে আছে। আইন প্রণীত হচ্ছে। সেটিও শেষ পর্যায়ে। সেটি সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা তুলনা করলে কী বলবেন?
তুলনামূলক একটি বড় জায়গা হচ্ছে, আমাদের দেশের অর্থনীতি। আরেকটি বিষয় হলো, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। দুটি জিনিস বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের ৪৬ বছরের মধ্যে প্রায় ২৮ বছর গেছে অস্থিতিশীল অবস্থায়। ভয়াবহ আন্দোলন-সংগ্রাম, রাজনৈতিক সংঘাত, বঙ্গবন্ধু হত্যা, নব্বইয়ের আন্দোলন, ওয়ান ইলেভেন— সব মিলিয়ে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এটা একটি দিক। আরেকটি দেশের সব স্ট্যাটাস নির্ভর করে মাথাপিছু আয়ের ওপর। এখন আমাদের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৬০২ ডলার। অর্থনীতিবিদরা বলেন, যে দেশের মাথাপিছু আয় ৫ হাজার ডলারের নিচে, সেই দেশে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা কঠিন এবং সেখানে সামাজিক অস্থিরতা বিরাজ করবেই। আমাদের আয় ১ হাজার ৬০২ ডলার আর দক্ষিণ কোরিয়ার মাথাপিছু আয় ৩৪ হাজার ৯৮৫ ডলার। বলতে গেলে, বলিষ্ঠ অর্থনীতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে সমবয়সী অনেক দেশ আমাদের চেয়ে এগিয়ে গেছে।
স্বাস্থ্য খাতে কি দ্বৈত প্রশাসন আছে?
এক্ষেত্রে আমি সরাসরি বলব যে, আমরা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ জায়গাটা খুব ক্লিয়ার করতে পারিনি। এখন মেডিকেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন আছে। আবার জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আরেকটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রয়েছে। এটা কেন হবে। কনফ্লিকটিং জায়গাটা ক্লিয়ার করতে হবে। সিভিল সার্জন আছে, ডিসি কেন তার ওপর খবরদারি করবেন? এটা তো হতে পারে না। আবার থানা শাসিত প্রশাসক যারা আছেন, তারাও যে যথার্থ ভূমিকা পালন করতে পারছেন, তাও কিন্তু নয়। সে কারণে আমাদের একটি বড় দাবি ছিল, মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর স্বায়ত্তশাসন। সেটা হয়নি। আমরা সবগুলো চেয়েছিলাম। কিন্তু বিএসএমএমইউয়ের ক্ষেত্রে এ দাবি পূরণ হয়েছে। এজন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অন্য হাসপাতালের পার্থক্য সহজেই বোঝা যায়। আঙ্গিক থেকে শুরু করে সবকিছুই আলাদা। যেমন— আমরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারি। এ জায়গাটা হলে ভালো। স্বাস্থ্যনীতিতেও আছে যে, বিশেষায়িত (টারশিয়ারি) হাসপাতালগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত (অটোনোমাস)। জেলা হাসপাতালগুলো হবে অটোনোমাস আবার সরকারিও। আর প্রাইমারি হাসপাতাল হবে পুরোপুরি সরকারি। এমন প্রস্তাব স্বাস্থ্যনীতিতে রয়েছে।
আমাদের চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে একটি সাধারণ অভিযোগ আছে যে, তারা গ্রামে থাকতে চান না...
এরা কি সত্যি থাকছেন না। কেন থাকছেন না? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, আনঅথরাইজড অ্যাবসেন্ট থাকতে পারেন কিনা। আইন অনুযায়ী, কেউ আনঅথরাইজড অ্যাবসেন্ট থাকতে পারেন না। কেন চিকিৎসকরা গ্রামে থাকছেন না? তাহলে এ জায়গায়টার দায়িত্ব কার। এখানে স্বাস্থ্য প্রশাসন ও স্থানীয় নেতাদের দায়িত্ব রয়েছে। জেনে বুঝে চাকরি নেয়ায় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে অবশ্যই নির্দিষ্ট কর্মস্থলে থাকতে হবে। এক্ষেত্রে হয়তো বেশি কঠোর হওয়া যাবে না। এখানে বরং ব্যবস্থাপনাটা উন্নত করতে হবে। মোটিভেশন বাড়াতে হবে।
কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকাটা একটি দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত। উন্নত দেশে কল্পনাই করা যায় না, একজন লোক অফিসে যাবে না। আমাদের বিএসএমএমইউর কোনো স্টাফ চিন্তাই করতে পারেন না যে, তিনি অফিসে আসবেন না। তাহলে এটা কীভাবে সমাধান হবে? সেখানে ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী হতে হবে, তাদের আপসহীন হতে হবে। কর্মীদের উপস্থিতি উচ্চতর কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে। আলোচ্য কর্তৃপক্ষ এ জায়গায় আপস করতে পারবে না।
ইউজিসির মতো মেডিকেল শিক্ষায় একক কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। এক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে কিনা?
আমরা সবাই চাই, দেশের সব মেডিকেল শিক্ষার মান একই থাকবে। মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির পেছনেও একটি উদ্দেশ্য ছিল যে, আন্ডার গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের শিক্ষা একই ছাতার নিচে আসবে। আগে আমরা বলতাম— ত্রয়ী প্রশাসন। এটি এখনো আছে। সেটি এ রকম— মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে ভর্তি পরীক্ষা নেয়, বিএমডিসি কোর্স-কারিকুলাম ঠিক করে আর সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরীক্ষা নেয়, সার্টিফিকেট দেয়। এ ত্রয়ী প্রশাসন থেকে বেরিয়ে আসতে আমাদের মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি ছিল। এ দাবি ছিল তিন দশকের। ১৯৬৯ সাল থেকে এ দাবি করে আসছি আমরা। সুনির্দিষ্ট দাবি ছিল— ত্রয়ী প্রশাসন থেকে বেরিয়ে স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে দেশের সব মেডিকেল কলেজকে একটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা হোক। সেটি তো হয়নি। এখন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এবং আমরাও যেটি চেয়েছি, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। আরো তিনটি হবে। যেমন— চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সেখানে অবস্থিত সব মেডিকেল কলেজ, নার্সিং ইনস্টিটিউট, হেলথ টেকনোলজি থাকবে। একইভাবে আমাদের বিএসএমএমইউর আইনে আছে, ঢাকার সব মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এর অধীনে চলে আসবে। এটি বাস্তবায়নাধীন।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজের কী অবস্থা?
বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো সম্পর্কে সরকারকে বলেছি। আমি বলেছি মান নিয়ে কোনো আপস (কম্প্রমাইজ) করা যাবে না। কোনো মেডিকেল কলেজ মান বজায় রাখতে না পারলে প্রয়োজনে সেটি বন্ধ করে দেয়া উচিত। কিছু বন্ধ করা হয়েছে। শুধু ব্যবসার জন্য মেডিকেল কলেজ হবে, এটি হতে পারে না। যেখানে শিক্ষক নেই, হাসপাতাল নেই, ছাত্ররা রোগী দেখতে পারে না, সেসব জায়গায় মেডিকেল কলেজ থাকার দরকার নেই।
অনেক সরকারি মেডিকেল প্রতিষ্ঠানেও নির্দিষ্ট শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত বজায় থাকছে না। এটাকে কীভাবে দেখেন?
৬৩ শতাংশ শিক্ষক সংকট নিয়ে দেশের মেডিকেল শিক্ষা চলছে। এটি গণমাধ্যমের জরিপ। এক্ষেত্রে আমরা যেটি পরিষ্কার করে বলি, তা হলো মেডিকেল শিক্ষার মান নিয়ে কোনো সমঝোতা করার সুযোগ নেই।
বেসরকারি খাতে চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি। এটাকে কীভাবে দেখেন?
চিকিৎসা ব্যয় বেশি— এক্ষেত্রে আমি একটু দ্বিমত করি। গোটা বিশ্বে চিকিৎসা একটি ব্যয়বহুল ব্যবস্থা। যেহেতু আধুনিক চিকিৎসা ইনভেস্টিগেশননির্ভর, সেহেতু ব্যয় বেশি। শুধু প্রেসক্রিপশন লিখে দিলে রোগীরা পছন্দ করে না। বলে, আমাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন না। হয়তো শুধু জ্বর এসেছে। কিন্তু তাদের পরীক্ষা না করে ওষুধ দিলে তাতে তারা অখুশি হয়, মন খারাপ করে। ফলে এ বাবদ কিছু বাড়তি ব্যয় হয়। এখানে আবার দালালিও আছে। অনেক সময় রোগীকে সুনির্দিষ্ট চিকিৎসক ও চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যায় তারা। সব মিলিয়ে ব্যয় বেশি।
বিদেশে রোগী যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এটা কেন?
বাড়ছে না। এটা ঠিক নয়, বরং কমছে। কারণ আমাদের বেশির ভাগ রোগীর যেহেতু কার্ডিয়াক প্রবলেম, সেহেতু এখন এখানে অনেক জায়গায় কার্ডিয়াক সার্জারি হচ্ছে। এ খাতে অনেক বিশেষজ্ঞ, অভিজ্ঞ সার্জন রয়েছেন। বিভিন্ন জায়গায় এ সার্জারি হচ্ছে। আমাদের দেশে প্রায় ১৫০ জন কার্ডিয়াক সার্জন আছেন এবং তারা ভালো করছেন। ফলে কার্ডিয়াক রোগী বিদেশে কম যায়। এটি একটি বিষয়। দুই. ক্যান্সারের কিছু রোগী যায়। কিন্তু এখন আমাদের ক্যান্সারের রোগীর চিকিৎসার সুযোগ অনেক হয়েছে। এমনকি সিরাজগঞ্জের মতো জায়গাও একটি ভালো ক্যান্সার সেন্টার হয়েছে। আমাদের হিসাবে, গত বছর ভারতে ৫৬ লাখ বাংলাদেশী গেছে। এটি একটি জরিপে দেখা গেছে। আমার ধারণা, এ ৫৬ লাখের মধ্যে ৮০ শতাংশকেই আমাদের মেডিকেল গ্র্যাজুয়েটরা চিকিৎসা দিতে পারেননি। বাংলাদেশের মানুষ জানে না, এখানে কী ধরনের চিকিৎসা আছে। জুনিয়র চিকিৎসক জানেন না, ঢাকা মেডিকেল বা বিএসএমএসইউতে কী ধরনের চিকিৎসা হয় বা কত অগ্রগতি হয়েছে।
দু-একটি বাদে বাংলাদেশে সব ধরনের চিকিৎসা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষাও প্রায় সবগুলোই এখানে করা যায়। দু-একটি বাদে। হাইটেক প্রযুক্তি আনলে সেগুলোও এখানে করা যাবে। ভারত এটাকে ব্যবসা হিসেবে নিয়েছে এবং এ ঢাকা শহরে তাদের ৩০০ এজেন্ট আছে। বিএসএমএমইউর কি কোনো এজেন্ট আছে? বেসরকারি বড় হাসপাতালগুলোর হয়তো এজেন্ট আছে। ৩০০ এজেন্ট কী করে? এটা তাদের চাকরি। তাদের রুটি-রুজির বিষয়। তারা মার্কেটিংটা করছে। এজেন্টরা রোগীদের বলছে, এ চিকিৎসা এখানে নেই। ওখানে যান, ভালো চিকিৎসা, কম খরচে হবে। ওখানে গিয়ে যেসব রোগী ফিরে আসে, তাদের পরিসংখ্যান এখানে আছে? কত যে লাশ হয়ে আসে, তার হদিস আছে? আমাদের এখানে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, রোগীর সংখ্যা বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে তো ৭০০ বেডের ওপর কোনো হাসপাতাল নেই। বিএসএমইউতে এরই মধ্যে বেডের সংখ্যা ১ হাজার ৯০৪। আমরা আরো এক হাজার বেড বৃদ্ধি করছি। একটি অনকোলজি বিল্ডিং করছি। সেখানে আরো ১ হাজার ৫০০ বেড যোগ হবে।
রোগীদের অভিযোগ, বাংলাদেশের চিকিৎসক এক রকম বলছেন আবার ভারতীয় চিকিৎসকরা বলছেন অন্য রকম। এটাকে কীভাবে দেখবেন?
ভারতে কিন্তু স্বাস্থ্যসেবাকে আইন করে ‘পণ্য’ ঘোষণা করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে মানুষের এত অভিযোগ। সেখানে ১৯৯৪ সালে তাদের রাজ্যসভায় স্বাস্থ্যসেবাকে ‘পণ্য’ ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৪ সালে বিএম সম্মেলনে বাংলাদেশ-ভারতের স্বাস্থ্যসেবার তুলনামূলক বিচার করেছিলাম। তুলনা করে দেখেছি, পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অনেক ভালো। এটি একটি বিষয়। দুই. পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কেমন, সেটি সেখানকার মানুষের কাছে জানতে হবে। আমাদের চেয়ে অনেক বেশি সমালোচনা সেখানে। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, গোটা ভারতেরই এ অবস্থা। ওই দেশের মানুষের কাছে জিজ্ঞেস না করলে কিন্তু ভুল হবে।
বাংলাদেশে রোগীর অভিযোগের প্রতিকারের ব্যবস্থা নেই। ফলে অনেক সময় সহিংসতাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এটা ভালো লক্ষণ নয়...
এ জায়গায় সাংস্কৃতিক কিছু সমস্যা আছে। অনেকেই চট করে লিখে ফেলে— ভুল চিকিৎসা। ভুল চিকিৎসা কে নির্ধারণ করবে? আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় প্রধান কিছু সমস্যা রয়েছে। এক. কাউন্সিলের ওই রকম সিস্টেমটা নেই। কারণ চিকিৎসকের পক্ষে তো সব সম্ভব নয়। চিকিৎসক রোগীর অপারেশন করবেন, না কাউন্সেলিং করবেন? তার পরও করেন। খারাপ সিচুয়েশন আমাদের একটি শিক্ষার পার্ট। খারাপ সিচুয়েশন হলে আমাদের রোগীর লোকদের জানাতেই হবে। এটা আমাদের দায়িত্ব। প্রতিটি সার্জনেরই অপারেশনের সময় রোগীর আত্মীয়স্বজনের লিখিত সম্মতি নেয়া উচিত। আমাদের চিকিৎসক-রোগী সম্পর্কের উন্নয়ন কোনো মহলেই সেভাবে করেনি। সত্যিকার অর্থেই চিকিৎসকরা খুবই ব্যস্ত। যারা চাকরি কিংবা প্র্যাকটিস করেন, যারা একটু জনপ্রিয় ডাক্তার, তারা রোগীকে যে সময় দেবেন তা পারেন না। আমি যখন ২৪ মার্চ যোগদান করলাম, বিএসএমএমইউর আউটডোরে তখন আসত চার হাজার রোগী, এখন আসে সাত-আট হাজার। একজন ডাক্তারের পক্ষে ৮টা থেকে আড়াইটার মধ্যে কয়জন রোগী দেখা সম্ভব? দেরি হলে পেছন থেকে চিত্কার করে ওঠে— দেরি হচ্ছে কেন? আবার কথা ঠিকমতো না বললে তা নিয়েও অভিযোগ করে। এত বিপুলসংখ্যক রোগীকে সেবা দেয়ার জন্য আমাদের চিকিৎসা জনশক্তি পর্যাপ্ত নয়।
সরকারি মেডিকেল প্রতিষ্ঠানগুলোয় কেবল বেলা ২টা পর্যন্ত রোগী দেখা হয়। বিকালে সেবা চালু করলে রোগীর চাপ কমত...
এখন কিছু উন্নয়ন হচ্ছে। বিএসএমএমইউতে আমরা কিন্তু বৈকালিক প্রোগ্রাম চালু করেছি। এটাকে আমরা জোরদারের চেষ্টা করছি। আবার মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে সিরিয়াসলি চিন্তা করছে বৈকালিক সেবা দেয়ার জন্য।
বিএসএমএমইউতে অদূরভবিষ্যতে কী পরিকল্পনা রয়েছে?
আমরা এখন অনলাইনে আউটডোরের টিকিট করার চেষ্টা করছি। এটা পাইলটিং শুরু করব বিকালে। সকালে পারা যাবে না। এখানেও ব্যবসা শুরু হয়ে যাবে। একজন হয়তো ১০টা টিকিট করে ফেলল। সব চিন্তাভাবনা করে শিগগিরই এ সেবা চালু করব। আমাদের এখানে বোন ম্যারো প্লান্টেশনের সুযোগ নেই। এটাও হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য এরই মধ্যে প্রজেক্ট পাস হয়ে গেছে। (সৌজন্যে : বণিক বার্তা)
এবিএন/সাদিক/জসিম/এসএ