বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

গডফাদার শামীম ওসমানকে পোষণের রাজনীতি আর কতদিন?

গডফাদার শামীম ওসমানকে পোষণের রাজনীতি আর কতদিন?

ড. মইনুল ইসলাম, ২৮ জানুয়ারি, এবিনিউজ : সম্প্রতি নারায়নগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের জননন্দিত মেয়র ডাঃ সেলিনা হায়াৎ আইভীর ওপর নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের মাস্তান বাহিনীর নেতৃত্বে মারমুখো হকারদের পরিকল্পিত আক্রমণের ঘটনা সারা দেশে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। নারায়ণগঞ্জের মূল রাজপথ বঙ্গবন্ধু এভেনিউ’র ফুটপাত থেকে হকারদেরকে সরিয়ে দেয়ার পর অন্যত্র তাদেরকে পুনর্বাসিত করার ব্যবস্থা করেছিলেন মেয়র ডাঃ আইভী। ঐ এলাকার সংসদ সদস্য মেয়র আইভীর সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছিলেন, নারায়ণগঞ্জের সাধারণ জনগণও তাঁর এই সিদ্ধান্তে খুবই খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু, ঐ হকারদের কাছ থেকে মাসে মাসে সংগৃহীত আনুমানিক এক কোটি চল্লিশ লাখ টাকা চাঁদার মূল ফায়দাভোগী পার্শ্ববর্তী নির্বাচনী এলাকার ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সংসদ সদস্য’, সারা দেশের মানুষের কাছে ত্রাসের প্রতিমূর্তি ও ঘৃণার পাত্র গডফাদার শামীম ওসমান এহেন লোভনীয় বাণিজ্য হারাতে রাজি নন। অতএব, উচ্ছেদ হওয়া হকারদের পক্ষ নিলেন তিনি ও তাঁর মাস্তানবাহিনী। ঘটনার দিন সকালে তিনি টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে দম্ভভরে ঘোষণা দিলেন, ‘এটা অনুরোধ নয়, আমার নির্দেশ। ওখানে হকার বসবে’। ফুটপাত থেকে হকার সরানোর আদেশ দিয়ে তা বাস্তবায়ন করা মেয়র আইভীর আইনানুগ অধিকার। এই পরিপ্রেক্ষিতে, প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করে অবৈধভাবে হকার বসানো অব্যাহত রাখার এই এখতিয়ার–বহির্ভূত নির্দেশ জারির পরও রহস্যজনকভাবে এই গডফাদারকে নিবৃত্ত করার কোন পদক্ষেপ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি। এহেন চ্যালেঞ্জ যে মেয়র আইভীকে একটি সুচতুর ফাঁদে ফেলার আয়োজন ছিল সেটা মেয়র আইভীও হয়তো সম্যক উপলব্ধি করতে পারেননি। জনগণের ভালবাসায় সিক্ত বিপুল জনপ্রিয় মেয়র আইভী গরীব হকারদের পেটে লাথি মেরেছেন, এটাই ছিল শামীম ওসমানের প্রোপাগান্ডা, যা মেয়র আইভীর জনপ্রিয়তা ক্ষুণ্ন করার একটি কূটচাল ছিল। তা ঠিকমত ধরতে না পেরে ডাঃ আইভী চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে তাঁর জনসমর্থনের ওপর ভরসা রেখে হকারদের ক্ষোভ নিরসনের জন্যে তাঁর সমর্থকদের সাথে অকুস্থলে গিয়ে আলোচনার সিদ্ধান্ত নিলেন। অপরদিকে, শামীম ওসমানের মাস্তানবাহিনী যথেষ্ট সময় পেয়ে গেলো একটি সুপরিকল্পিত ‘এমবুশ’ সংঘটনের জন্যে। প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো বিবদমান দুপক্ষের অবস্থানের কারণে উদ্ভূত এহেন বিস্ফোরণোম্মুখ পরিস্থিতি দেখেও কোন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করলো না। পুলিশ দুই মারমুখো জনতার মাঝখানে অবস্থান নিলে এই মারামারি হতে পারত না বলে মেয়র আইভীও অভিযোগ করেছেন। এই একতরফা আক্রমণের ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর এখন আন্দাজ করতে অসুবিধে হচ্ছে না যে এই প্রশাসনিক নির্লিপ্ততা অহেতুক বা কাকতালীয় ছিল না। যেহেতু প্রশাসনের কর্মকর্তা–কর্মচারী এবং পুলিশ বাহিনীও ঐ চাঁদার মূল ভাগীদার, তাই এসব সরকারী বাহিনীর গোপন সমর্থনও শামীম ওসমানের অবস্থানের পক্ষে ছিল বোঝা যাচ্ছে। কারণ, মেয়র আইভী যখন মঙ্গলবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের জনগণের বিশাল একটি মিছিল নিয়ে সংক্ষুব্ধ হকারদের সাথে আলোচনার উদ্দেশ্যে ঐ এলাকার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তখন কোন উস্কানি ছাড়াই পুলিশ বাহিনীর উপস্থিতিতে বিপরীত দিক্‌ থেকে শামীম ওসমানের মাস্তানবাহিনী ও কথিত হকাররা ঐ বিশাল মিছিলের ওপর বৃষ্টির মত ইট–পাথর নিক্ষেপ করে আক্রমণ চালায়। ঘটনার বেশিরভাগ সময় দু’পক্ষের ধাওয়া–পাল্টা ধাওয়া বারবার চলা সত্ত্বেও পুলিশ কোন পক্ষকেই মারপিট বা আক্রমণ থেকে নিবৃত্ত করেনি। শামীম ওসমানের মাস্তানদের কয়েকজনের হাতে ছিল খাপখোলা পিস্তল ও লাঠিসোঁটা, অথচ মেয়রের পক্ষের কারো কোন আক্রমণাত্মক প্রস্তুতি ছিল না। একজন পিস্তলধারীকে বাগে পেয়ে মেয়র আইভীর সমর্থকরা উত্তম–মধ্যম দেয়ার চিত্রও দেখা গেল। কারণ, টেলিভিশনে এই সশস্ত্র আক্রমণের পুরো চিত্রই ‘লাইভ’ দেখার সুযোগ পেয়েছে সারা বিশ্ব, আমরাও সবই চাক্ষুষ সাক্ষী হয়ে গেলাম পুরো ঘটনার। ঐ আক্রমণে মেয়র আইভী সহ প্রায় পঞ্চাশজন ব্যক্তি আহত হয়েছেন। পায়ে ইটের আঘাত পেয়ে ডাঃ আইভী রাজপথে পড়ে যাওয়ার পর তাঁর সমর্থকরা তাঁর চারিদিকে বেষ্টনী তৈরী করে তাঁকে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবে নিয়ে যায়। ঐ সময় দেখা গেল, একদল মাস্তান সমভিব্যাহারে বিজয়ীর বেশে শামীম ওসমান রাজপথ পরিব্রাজনে নামলেন, যেন যুদ্ধজয়ের পর সেনাপতির যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয় মিছিল। কোন সন্দেহ নেই যে এই চাতুরির খেলায় ডাঃ আইভীর হার হয়েছে। হয়তো এই বিপর্যয়ের মনোবেদনা সইতে না পেরে পরদিন তিনি মেয়রের অফিসকক্ষেই স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে গেলেন। ঢাকার ল্যাব এইড হাসপাতালে শয্যাশায়ী হয়ে ছয়দিন ব্রেইন হ্যামারেজ–এর চিকিৎসা নিয়ে সম্প্রতি তিনি বাড়ী ফিরেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নাকি এই ঘটনার জন্যে উভয় পক্ষের ওপর খুবই রুষ্ট। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার জন্যে দলের অন্তর্কোন্দল–উদ্ভূত এহেন সংঘাত খুবই বিপর্যয়কর হয়েছে, বলাই বাহুল্য। তাঁর স্নেহধন্য শামীম ওসমানের ঔদ্ধত্য ও ‘ড্যাম কেয়ার’ মনোভাব যে পুরো ঘটনার জন্যে এককভাবে দায়ী সেটা–ও হয়তো তিনি বুঝতে পারছেন। তবে, শামীম ওসমানের মত একজন চিহ্নিত গডফাদারকে তিনি গত নয়বছর ধরে যেভাবে বারংবার সস্নেহ আশকারা ও ছত্রচ্ছায়া প্রদানের ন্যক্কারজনক নজির সৃষ্টি করেছেন তারই অবশ্যম্ভাবী ফল যে এহেন সন্ত্রাসী আক্রমণ, এ–কথাটা বলতেই হবে বারবার। এর মাশুল গুনতেই হবে আওয়ামী লীগকে।

২০১৪ সালের মে মাসে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত আমার কলামে যে আশংকা প্রকাশ করেছিলাম তা এই পর্যায়ে পাঠকদেরকে স্মরণ করতে বলি। নারায়ণগঞ্জের ভয়ংকর সাত খুনের কাহিনীটা স্মরণ করুন। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র জনাব নজরুল ইসলাম এবং নগরীর খ্যাতনামা আইনজীবী এডভোকেট চন্দন সরকার সহ সাতজন ব্যক্তিকে অপহরণের কয়েকদিন পর শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তাঁদের বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধারের ঘটনায় সারাদেশে শোকের মাতম ও ক্ষোভ–বিক্ষোভ–প্রতিবাদের ঝড় বয়ে চলেছিল অনেকদিন। প্রকাশ্য রাজপথে এই অপহরণ কর্মকান্ড চালানো হয়েছিল দিনে দুপুরে কমান্ডো স্টাইলে, অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর উপস্থিতিতেই। অপহৃত ব্যক্তিদেরকে যে যানবাহনগুলোতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তার মধ্যে একটির গায়ে নারায়নগঞ্জে কর্তব্য পালনে নিয়োজিত এলিট ফোর্স র‌্যাব–১১ এর স্টিকার ও সাইনবোর্ড লাগানো ছিল, প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই সেটা স্বচক্ষে দেখেছেন বলে প্রমাণ মিলেছে। অপহরণ ঘটনার পরপরই এজন্যে শামীম ওসমান এবং সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নুর হোসেনকে অভিযুক্ত করে নারায়ণগঞ্জে এবং সারাদেশে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হলেও প্রায় দুদিন নুর হোসেন নারায়ণগঞ্জে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নাকের ডগায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়িয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। অথচ, ঐ দুদিন তাকে জিজ্ঞাসাবাদের বা গ্রেফতারের কোন প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি কোন সংস্থাই, যা খুবই রহস্যজনক। জনমনে ধারণা জন্মেছিল যে নুর হোসেন গা ঢাকা দেওয়ার পরই তাকে ধর–পাকড়ের লোক দেখানো তোড়জোর শুরু করা হয়েছিল, এবং জনমনে প্রবল সন্দেহ যে তাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা সম্পন্ন হওয়ার পরেই এসব নাটকের অবতারণা করা হয়েছিল। এরপর বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধারের পর শুধু নুর হোসেনকেই এই নৃশংস হত্যাকান্ডের একমাত্র নায়ক বানানোর জন্যে আরেকটা সাজানো নাটকের মঞ্চায়ন জোরেশোরে এগিয়ে চলেছিল বলে সন্দেহ করার কারণ রয়েছে। জনমনে সন্দেহটা দৃঢ়মূল হওয়ার প্রধান কারণ শামীম ওসমানের একটা রহস্যজনক সমাবেশ এবং সংবাদ সম্মেলন, যেখানে তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সরাসরি নুর হোসেনকে হত্যাকান্ডের মূল নায়ক হিসেবে চিহ্নিত করে বেশ কিছু কথিত প্রমাণ উপস্থাপন করেছিলেন। তখন তাঁর এহেন পদক্ষেপ আসল আসামীগণকে আড়াল করার অপপ্রয়াস বলে সন্দেহ জোরদার হয়েছিল।পরবর্তীতে নুর হোসেনসহ অপরাধীরা ধরা পড়েছে। গত তিনবছরে ঐ মামলার প্রাথমিক বিচারও সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু, বিচার সম্পন্ন হলেও নারায়ণগঞ্জের সাধারণ জনগণের ধারণা খুনের পেছনের কাহিনী ঠিকমত উদঘাটিত হয়নি। গডফাদারের ইংগিত ছাড়া এতবড় হত্যাযজ্ঞ নারায়ণগঞ্জে সংঘটিত হতে পারে না, এটাই এ–ধরনের সন্দেহের জন্ম দিয়ে চলেছে।

এ–পর্যায়ে বলা প্রয়োজন, শামীম ওসমানের ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জের জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের সন্দেহ ও অবিশ্বাসের মূল কারণ তাঁর ও তাঁর পরিবারের প্রতি পুঞ্জীভূত ঘৃণা ও ক্রোধ। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে নারায়ণগঞ্জের এক সময়ের নামী রাজনীতিবিদ এবং আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা খান সাহেব ওসমান আলীর বংশধরদের চারিত্রিক ও রাজনৈতিক অধঃপতনের মূর্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছেন শামীম ওসমান। এখন এদেশের রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের ক্লাসিক উদাহরণ শামীম ওসমান। জনমনে বিভীষিকা সৃষ্টিকারী পলিটিক্যাল গডফাদারের প্রসঙ্গ উঠলেও সবার আগে নাম আসবে তাঁরই। তাঁর আরেক ভাই সেলিম ওসমান জনৈক প্রধান শিক্ষককে জনসমক্ষে অপমানিত করার পর কিভাবে ঐ শিক্ষক ইসলাম ধর্মকে কটুক্তি করেছেন অভিযোগ তুলে ধর্ম–ব্যবসায়ী গোষ্ঠিগুলোকে মাঠে নামিয়ে দিয়েছিল সে কাহিনীও জনগণ এখনো ভুলে যায়নি। এই একটি পরিবারের কাছে পুরো নারায়ণগঞ্জবাসী ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে আক্ষরিক অর্থেই জিম্মি। কোন এক অজ্ঞাত কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্নেহের প্রস্রবণ অব্যাহত বয়েই চলেছে শামীম ওসমানের ওপর, তাঁর এহেন ভয়ংকর গডফাদার ইমেজ সত্ত্বেও। প্রধানমন্ত্রীর অন্ধ স্নেহ দিনদিন আরো বেপরোয়া করে তুলছে শামীম ওসমান ও তাঁর বিশাল মাস্তান বাহিনীকে। ২০১৩ সালে ত্বকী হত্যাকান্ডের সাথে তাঁর ভাইপো আজমেরী ওসমানের সংশ্লিষ্টতার নানা বিশ্বাসযোগ্য আলামত পাওয়ার পরও মামলাটাকে যেভাবে ধামাচাপা দেয়া হয়েছে তাতে নারায়নগঞ্জবাসীর মনে দৃঢ়মূল বিশ্বাস জন্মেছে যে শেখ হাসিনা যদ্দিন ক্ষমতায় আসীন থাকবেন তদ্দিন শামীম ওসমানের গুম–খুন, জোরজুলুম, দখলবাজি, চাঁদাবাজি ও মাস্তানি থেকে তাঁদের পরিত্রাণ নেই। অথচ, এটা খুবই আশ্চর্যজনক যে নারায়নগঞ্জ সিটি করপোরেশনের জননন্দিত মেয়র ডাঃ সেলিনা হায়াৎ আইভী আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও শেখ হাসিনার অবজ্ঞা এবং সযতন অবহেলার শিকার হয়ে চলেছেন। কোন এক অজ্ঞাত কারণে ডাঃ আইভী শেখ হাসিনার স্নেহ থেকে বঞ্চিত বলে একটা ধারণা গড়ে উঠেছে! ২০১২ সালের মেয়র নির্বাচনেই নারায়ণগঞ্জের ভোটাররা শেখ হাসিনাকে ব্যালটের মাধ্যমে তাঁদের সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তাঁরা শামীম ওসমানকে নয়, ডাঃ আইভীকে চান তাঁদের নির্বাচিত মেয়র হিসেবে। এক লাখেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে শামীম ওসমানকে হারিয়েছিলেন আইভী, শেখ হাসিনা সরাসরি শামীম ওসমানকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রদান সত্ত্বেও। এ পরাজয়টাকে শেখ হাসিনা হয়তো মেনে নিতে পারেননি। তবু বলা প্রয়োজন, ভোটারদের এই বিপুল প্রত্যাখ্যান সত্ত্বেও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে শামীম ওসমানকেই আবার মহাজোটের প্রার্থী করাটা শেখ হাসিনার একগুঁয়েমির পরিচায়ক ছিল। কিন্তু, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যাওয়ায় শামীম ওসমানকে দ্বিতীয়বার প্রত্যাখ্যানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন নারায়ণগঞ্জবাসীরা, সেটা নির্দ্বিধায় বলা চলে। এতদ্‌সত্ত্বেও শেখ হাসিনার এহেন জেদাজেদি যে আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়ে যাচ্ছে এই কথাগুলো বলার সাহস এ–মুহূর্তে দলের কারোরই নেই বোধগম্য কারণে। আর, একই কারণে নারায়ণগঞ্জের প্রশাসনের কর্মকর্তারাও বুঝে গেছেন যে চাকরি বাঁচাতে হলে শামীম ওসমানের ব্যাপারে অন্ধ–কালা–বোবা সাজা ছাড়া তাঁদের গত্যন্তর নেই। ২০১৭ সালের মেয়র নির্বাচনে ডাঃ আইভীকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেয়ায় মনে হচ্ছিল যে হয়তো তিনি শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার মন জয় করতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু, এবারই পরীক্ষা হয়ে যাবে যে শামীম ওসমানের প্রতি শেখ হাসিনার অন্যায় পক্ষ পাতিত্বের অবসান হয়েছে কিনা!

কিন্তু, সারা দেশের মানুষের ঘৃণার পাত্র শামীম ওসমানের অব্যাহত ‘অসহনীয় তান্ডব’ চলতে দিলে তা আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পতনকে তরান্বিত করবে, সময় থাকতে এটুকু শেখ হাসিনাকে জানিয়ে দিতে চাই। গডফাদার ও মাস্তান পোষণের রাজনীতি যদি তিনি অব্যাহত রাখেন তাহলে ২০০১ সালের নির্বাচনী বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তির জন্যেও তাঁকে প্রস্তুত থাকতে হবে। এটাও দুঃখজনক যে, গডফাদার ও মাস্তান পোষণকে শেখ হাসিনা তাঁর রাজনীতির জন্যে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে থাকেন। এটা তাঁর ১৯৯৬–২০০১ মেয়াদের শাসনামলেও প্রমাণিত হয়েছিল। ঐবারও ২০০১ সালের নির্বাচনে ফেনীর জয়নাল হাজারী, নারায়নগঞ্জের শামীম ওসমান ও লক্ষ্মীপুরের আবু তাহেরের মত দেশের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী–গডফাদাররা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বিজয়কে সুনিশ্চিত করে দেবে বলে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল। ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমান জয়নাল হাজারীর সীমাহীন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সমালোচনা করায় কুপিত হয়ে শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের সামনে মন্তব্য করেছিলেন,‘আমার আরো ২৯৯ জন জয়নাল হাজারী প্রয়োজন’। তারপর নির্বাচনের আগে সেনাবাহিনীকে যখন মাঠে নামানো হয়েছিল তখন জয়নাল হাজারী, শামীম ওসমান এবং আবু তাহেরের মত বীর পুরুষরা প্রাণভয়ে ভেগে পগার পার হয়ে গিয়েছিল, এটাও এখন ইতিহাস! নির্বাচনের আগে ঐ সাফল্যে উৎফুল্ল হয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার জনাব আবু সাঈদ জাতিকে জানিয়েছিলেন,‘দুষ্ট লোকেরা সব ভেগে গেছে’। অবশ্য তিনিও সত্য বলেননি, প্রকৃতপক্ষে সেনাবাহিনীর ধাওয়া খেয়ে ঐ সময় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা দেশছাড়া হলেও তাদের জায়গাটা ঠিকই দখল করে নিয়েছিল বিএনপি–জামাতের সন্ত্রাসী ও ক্যাডাররা। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভাবনীয় বিপর্যয়ের পেছনে এই ফ্যাক্টরটাও অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল, এটা প্রমাণিত সত্য। ২০১৪ সালে সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আবারো বিএনপি–জামায়াত নির্বাচনে জিতে ক্ষমতাসীন হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা ছিল। বেগম জিয়া ও তাঁর পুত্র তারেক জিয়ার চালের ভুলে ঐ চান্স তারা হারিয়েছে, কোনই সন্দেহ নেই। ঐ ভুলের ফায়দাভোগী হয়ে শেখ হাসিনা এখন উপর্যুপরি দুবার ক্ষমতার মসনদে বসার সৌভাগ্যে সৌভাগ্যবতী হয়েছেন। যেভাবেই সুযোগটা আসুক না কেন, এই স্বর্ণ–সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করাটাই তাঁর জন্যে, আওয়ামী লীগের জন্যে এবং দেশের জন্যে মঙ্গলজনক হবে বলে আমি মনে করি। মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগ এদেশের গণমানুষের কাতার থেকে উঠে আসা দল, এটা ক্যান্টনমেন্টের প্রিয়পাত্র কখনোই হতে পারবেনা। তাই, হারানো জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধার করে আরেকটি সুষ্ঠু নির্বাচনে জয়লাভ করেই আওয়ামী লীগকে তার নৈতিক জনপ্রতিনিধিত্বের দাবিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ২০১৪ সালের মত ধুরন্ধর চাণক্য নীতির প্রতিযোগিতায় জিতে ক্ষমতার মসনদ আঁকড়ে থাকার বর্তমান অস্বস্তিকর অবস্থানের আশু অবসান ঘটাতেই হবে, এই গণ–ম্যান্ডেটহীন শাসন আওয়ামী লীগকে মানায়না। কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে সাফল্য অর্জন করে জনগণের মন জয় করতেই হবে। শামীম ওসমানের মত গডফাদারদের ক্ষমতামদমত্ত তান্ডব, ছাত্রলীগ বা যুবলীগের মাস্তানি, অস্ত্রবাজি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, খুনোখুনি কঠোরভাবে নির্মূল করতে হবে। গডফাদারদের পেশীর জোরে কিংবা অস্ত্র ও ক্যাডারের জোরেনির্বাচনী ফলাফল ছিনতাইয়ের বদখেয়াল পরিত্যাগ করতে হবে। ডাঃ সেলিনা হায়াৎ আইভীর মত নেতা–নেত্রীর হাতে আওয়ামী লীগের ঝান্ডা তুলে দিতে পারলে নির্বাচনে জেতার জন্যে আওয়ামী লীগের মাস্তানের প্রয়োজন পড়বেনা।আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, শামীম ওসমানের মত গডফাদার পোষণ নয় মেয়াদের বাকি সময়টায় সুশাসন প্রদানের কঠোর সাধনা চালিয়ে যাওয়াই আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার জোয়ারে অভিষিক্ত হয়ে নির্বাচনে জেতার একমাত্র পথ। ২৫ জানুয়ারি ২০১৮

লেখক : অর্থনীতিবিদ; ইউজিসি প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

(সংগৃহীত)

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত