রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৭ বৈশাখ ১৪৩২
logo

৮ ফেব্রুয়ারি আদালত কী রায় দেবেন?

৮ ফেব্রুয়ারি আদালত কী রায় দেবেন?

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, ৩০ জানুয়ারি, এবিনিউজ : ৮ ফেব্রুয়ারি তারিখটির দিকে দেশের অনেক মানুষ আগ্রহভরে তাকিয়ে আছে। এই দিন বিএনপি নেত্রীর বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির মামলার রায় ঘোষিত হওয়ার কথা। এই মামলায় মা খালেদা জিয়া এবং ছেলে তারেক রহমান দুজনই অভিযুক্ত। দুজনই বিএনপির শীর্ষ নেতা। সেই এক-এগারোর সরকারের আমলে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট নিয়ে দুর্নীতির মামলায় তাঁরা অভিযুক্ত হন। এরপর দীর্ঘকাল ধরে মামলাটি চলেছে। এত দীর্ঘকাল ধরে একটি মামলা ঝুলে থাকার কারণ কী—সে সম্পর্কে দেশবাসীর মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। একটি কারণ সম্ভবত বেগম জিয়ার আইনজীবীদের বারবার আদালতের কাছে সময় চাওয়া এবং বেগম জিয়ার বিভিন্ন তারিখে আদালতে গরহাজির থাকা।

শেষ পর্যন্ত এই মামলার বিচারকাজ শেষ হয়েছে এবং তার রায় ঘোষিত হতে যাচ্ছে, এটা দেশের মানুষের জন্য একটা বড় সুখবর। কারণ খালেদা জিয়া দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেত্রী। তিনি তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং ভবিষ্যতে তাঁর দল ক্ষমতায় গেলে তিনি যে আবার প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা প্রায় নিশ্চিত। এমন একজন নেত্রীর গায়ে যদি দুর্নীতির গন্ধ লেগে থাকে এবং সেই গন্ধ নিয়ে তিনি ক্ষমতায় বসেন, তা দেশের জন্য ভালো হবে না।

সুতরাং দেশের আদালতের বিচারে তিনি যদি নির্দোষ বিবেচিত হন, তাহলে তিনি ক্ষমতায় থাকুন আর না থাকুন, তাঁর রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্রেডিবিলিটি সম্পর্কে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না। আর তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁকে আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে আদালতের রায় মেনে নিতে হবে। ভারতের দীর্ঘ ১২ বছরের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পর্যন্ত আদালতের রায় মেনে তিহার কারাগারে ঢুকেছিলেন।

৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের দুর্নীতির মামলায় আদালত কী রায় দেবেন, তা আমাদের জানা নেই। দেশের মানুষ তাই উত্সুক আগ্রহে এই রায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। এই রায়দান যদি কোনো কারণে আদালত মুলতবি রাখেন, তাহলে দেশের মানুষের মনে নানা প্রশ্ন দেখা দেবে। অনেকে তার মধ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও খুঁজে বের করবে। দেশের আরেকটি সাধারণ নির্বাচনের আর মাত্র কয়েক মাস বাকি। এই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে, এটাই সবার প্রত্যাশা। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে খালেদা জিয়ারই তাতে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা। কিন্তু তিনি একটি মামলায় ঝুলে থাকলে তাঁর নেতৃত্বের ক্রেডিবিলিটি নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। দেশের রাজনীতিতে অনিশ্চিত অবস্থা বিরাজ করবে। আদালত দেশে এই অবস্থা সৃষ্টি হতে দেবেন বলে মনে হয় না। সুতরাং আশা করা যায়, ৮ ফেব্রুয়ারি নির্দিষ্ট তারিখেই এই মামলার রায় ঘোষিত হবে।

এই রায় নিয়ে বিএনপি মহলেই উৎকণ্ঠা সবচেয়ে বেশি। তারা প্রচার করছে, বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। অথচ দেখা গেছে বিএনপি নেত্রীর একাধিক আইনজীবী বলছেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের ঠিকানা তাঁরা জানেন না। অর্থাৎ এই অরফানেজের অস্তিত্বই ছিল কি না সন্দেহ। অথচ এই ট্রাস্টের তহবিলে বিদেশ থেকেও প্রচুর অর্থ সাহায্য এসেছে। সেই অর্থ কোন ব্যাংকে, কোন অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে? প্রশ্নটির সদুত্তর নেই।

তথাপি যদি ধরে নেওয়া যায়, বিএনপি নেতাদের প্রচারণাই সত্য, অর্থাৎ তাঁদের নেত্রীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই আদালতে প্রমাণিত হয়নি, তাহলে তাঁরা আগেভাগেই রায়ের বিরুদ্ধে চিৎকার শুরু করেছেন কেন? সরকার বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য এই রায় ম্যানিপুলেট করছে বলে অভিযোগ তুলছেন কেন? এটা কি চোরের মনে পুলিশ পুলিশ ভাব? বিএনপি নেতারা ধরেই নিয়েছেন, এই মামলার রায় তাঁদের বিরুদ্ধে যাবে। তা যদি হয়, তাহলে তাঁরা আদালতের রায় মানতে রাজি নন। এরই মধ্যে তাঁরা ফেসবুকে এবং অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় সারা দেশের বিএনপির নেতাকর্মীদের ৮ ফেব্রুয়ারির আগে ঢাকায় জমায়েত হয়ে গণ-অভ্যুত্থান ঘটানোর ডাক দিয়েছেন। এই অভ্যুত্থান কার বিরুদ্ধে? সরকার, না দেশের আইনের শাসনের বিরুদ্ধে?

খালেদা জিয়া যদি ৮ ফেব্রুয়ারি আদালতের রায়ে দোষী সাব্যস্তও হন, তিনি উচ্চ আদালতে আপিলের নিশ্চয়ই সুযোগ পাবেন এবং জামিনও পাবেন। এই অবস্থায় নির্বাচনে দলকে নেতৃত্ব দিতে তাঁর বাধা কোথায়? জেনারেল এরশাদ দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত হয়ে কারাগারে থাকাকালে নির্বাচনে একসঙ্গে পাঁচ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হয়েছেন। অবশ্য নির্বাচন কমিশন বিএনপি নেত্রীকে আদালতের শাস্তিদানের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অযোগ্য ঘোষণা করলে অন্য কথা; কিন্তু উচ্চ আদালতে চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন তা করবে মনে হয় না।

সবচেয়ে মজার কথা, এই রায়ে যদি বেগম জিয়াকে নির্দোষ বলা হয়, তাহলে বিএনপি বলবে, বিচার সুষ্ঠু হয়েছে, আর দোষী সাব্যস্ত হলে বলবে বিচারের নামে প্রহসন হয়েছে। সরকার নির্বাচনের আগে এই কারচুপি করেছে। এটা তারা নির্বাচন সম্পর্কেও বলে। নির্বাচনে তাদের জয় হলে বলে, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। আর হার হলে বলে, ‘নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। আমাদের জয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে।’ কোনো দল যদি জয়-পরাজয়কে সমানভাবে মেনে নিতে না পারে, তাহলে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে তাদের অবস্থান অচল।

খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বারা নয়, একটি সেনা প্রভাবিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁকে অভিযুক্ত করে। সেই সরকার ক্ষমতায় থাকলে বেগম জিয়ার ভাগ্যে কী ঘটত, তা বলা মুশকিল। এটি কোনো রাজনৈতিক মামলা নয়। যেমন রাজনৈতিক মামলা ছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। আইয়ুব-মোনেম সরকারের এই রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রমূলক মামলার বিরুদ্ধে জনগণ বিদ্রোহ করেছে, নেতাকে মুক্ত করেছে। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে ১৯টি মামলা দেওয়া হয়েছিল, তার প্রতিটি মোকাবেলা করে তিনি হাইকোর্টের রায়ে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছিলেন।

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বর্তমানে যে মামলা তা কোনো রাজনৈতিক মামলা নয়। দুর্নীতির মামলা। তাই এই মামলার বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। যেটুকু প্রতিক্রিয়া তা বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বেগম জিয়া সাহসী নেত্রী হলে এই মামলায় লড়বেন, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবেন। অন্যথায় তাঁকে আদালতের রায় ভালোমন্দ যা-ই হোক, মেনে নিতে হবে। রাজনৈতিক বাধার পাঁচিল তুলে তার আড়ালে বাঁচতে চাইলে বাঁচতে পারবেন না। দলকেও বাঁচাতে পারবেন না।

বিএনপি নেতাদের প্রচারণা হলো, আওয়ামী লীগ সরকার তাঁদের নেত্রীকে কারাগারে পাঠাতে চায়। তাহলে আগামী নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বহারা হবে এবং দলটি ভাগ হয়ে যেতে পারে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিশ্চিত পরাজয় থেকে রেহাই পাবে। আমার ধারণা, আওয়ামী লীগ নেতারা বোকার স্বর্গে বাস না করলে এই ধরনের ষড়যন্ত্রে পা দেবেন না। তাঁরা অতীতে দেননি। যদি আওয়ামী লীগ চক্রান্ত করে বেগম জিয়াকে কারাগারে পাঠায় এবং জনসাধারণ তা বুঝতে পারে, তাহলে হিতে বিপরীত হবে। কারাবন্দি বেগম জিয়ার জনসমর্থন বিপুলভাবে বেড়ে যাবে এবং নির্বাচনে বিএনপিকে তা অপ্রত্যাশিত সাহায্য জোগাবে। জেনারেল এরশাদ কারাগারে বসে নির্বাচনে তাঁর দলকে নেতৃত্ব দেননি? নিজে পাঁচটি আসনে জয়ী হননি?

আর বিএনপির ভাগ হওয়ার কথা? বিএনপি এবারও নির্বাচনে না এলে এমনিতেই দলটি ভাগ হয়ে যাবে। বাইরে থেকে কাউকে চেষ্টা করতে হবে না। বিএনপি বর্তমানে সাংগঠনিকভাবে খুবই দুর্বল।

আন্দোলন করার শক্তি তার নেই। একমাত্র নির্বাচনে অংশ নিলে মাঠপর্যায়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ফিরে আসবে। বিএনপিতে ঐক্য দেখা দেবে। অন্যথায় হতাশ নেতাকর্মীদের মধ্যে বিক্ষোভ দেখা দেবে। দল বিভক্ত হতে পারে। আমার ধারণা, দলকে ঐক্যবদ্ধ ও সংহত রাখার স্বার্থেই বিএনপি এবার নির্বাচনে যোগ দেবে।

বিএনপি নেতারা হুমকি দিচ্ছেন, আদালতের রায়ে বেগম জিয়াকে সাজা দেওয়া হলে তাঁরা দেশে গণ-অভ্যুত্থান ঘটাবেন। এটা আদালতের সঠিক বিচার ও রায়কে প্রভাবিত করার চেষ্টা, যা সমর্থনযোগ্য নয়। এ ধরনের হুমকি জামায়াত নেতারা একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারেও দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, গোলাম আযম ও নিজামীদের দণ্ড দেওয়া হলে সারা দেশে আগুন জ্বলবে। সে আগুন জ্বলেনি। কারণ যুদ্ধাপরাধীদের পেছনে জনসমর্থন ও জনসহানুভূতি ছিল না।

আমি জানি না, ৮ ফেব্রুয়ারির রায়ে বেগম জিয়া নির্দোষ, না দোষী সাব্যস্ত হবেন। যদি দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে এই রায়ের বিরুদ্ধেও কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে বিএনপি ব্যর্থ হবে। কারণ এ ব্যাপারে জনসমর্থন ও জনসহানুভূতির অভাব। তবু ৮ ফেব্রুয়ারির আদালতের রায় যা-ই হোক, দেশের রাজনীতিতে একটা পরিবর্তন আসবে। বিএনপির বর্তমান খালেদা-তারেক নেতৃত্ব টিকে থাকবে কি থাকবে না, তা এবার পরীক্ষিত হবে। এমনকি রাজনৈতিক ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে বিএনপির একটি নবরূপান্তরণ ঘটতে পারে।

৮ ফেব্রুয়ারির রায়ের জন্য আমিও তাই অনেকের মতো অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি। (কালের কণ্ঠ)

লন্ডন, সোমবার, ২৯ জানুয়ারি ২০১৮

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত