![বিদেশী মেহমান ও সংবাদপত্রের সংবাদ](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/01/30/ahidul-alam_123416.jpg)
ডাঃ কিউ.এম. অহিদুল আলম, ৩০ জানুয়ারি, এবিনিউজ : ১৯৭৬ সালে আমি ছাত্র ছিলাম প্রবাসে। খণ্ডকালীন চাকুরী করতাম গ্রীষ্মের ছুটিতে। এক বৃটিশ ইউনিভার্সিটির ছাত্র আমার সাথে কাজ করত। তাকে বললাম– আমি গরীব মানুষ তাই কাজ করছি কিছু টাকা সঞ্চয়ের জন্য। তুই ধনীদেশের মানুষ, কাজ করছিস কেন? বৃটিশ তরুণ আমাকে জবাব দিল যে পরবর্তী সামারে সে হলিডে করবে ক্যারিবীয় দ্বীপ জ্যামাইকাতে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম–এত দেশ থাকতে তুমি জ্যামাইকা যাবে কেন? তার উত্তর–জ্যামাইকাতে খুব সস্তায় হিরোইন, গাঁজা, পাওয়া যায়। কদিন এসব খেয়ে ফূর্তি করব। তখনো জ্যামাইকার মাথাপিছু আয় ৪/৫ হাজার ডলার। কিন্তু নেশাতে অভ্যস্ত পুরো জাতি। মাথা পিছু আয় আর সামাজিক প্রশান্তি এক কথা নয়।
এ আলোচনার অবতারণা করার কারণ–আমাদের উন্নয়নের গল্প সামাজিক প্রশান্তির সাথে যেন মিলছে না সম্প্রতি। ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখার্জী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডি–লিট গ্রহণ করেন। এক অসাধারণ বক্তৃতা দেন তিনি। কয়েকটি চ্যানেল সরাসরি প্রচার করায় আমরা এই বক্তৃতা শুনি। উনি অনেক কথা বলেছেন। কিন্তু শ্রোতাদের এই কান দিয়ে ঢুকে ঐ কান দিয়ে বের হয় সচরাচর। তিনি বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্বন্ধে দীর্ঘ আলোকপাত করেন। এসবই আমাদের জাতির জন্য গর্বের বিষয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্য সব পেয়ে বসে পরের দিন ভোরে প্রকাশিত চট্টগ্রামের পত্রিকার পাতায়। ভারতীয় রাষ্ট্রপতি রাত কাটিয়েছিলেন চট্টগ্রামে। তিনি বিদ্বান এবং পড়ুয়া মানুষ। তিনি আগের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিন্দ সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে যত পুলকিত হয়েছিলেন পরের দিনের চট্টগ্রামের জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে নিশ্চয়ই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। যে দৈনিকে অত্যন্ত হাস্যোজ্জ্বল উপাচার্য ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির পুলকিত ছবিটি ছেপেছিল সেই দৈনিকের কয়েকটি খবর দেখুন–
(১) প্রকাশ্য দিবালোকে জামালখানে কলেজিয়েট স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্রকে ছুরিকাঘাতে হত্যা
(২) সিমেন্ট ক্রসিং এ শ্বাসরোধ করে গৃহবধূ হত্যা
(৩) নারায়ণগঞ্জে ত্রিমুখী সংঘর্ষে মেয়র আইভিসহ শতাধিক আহত,
(৪) চকরিয়ায় পুকুর থেকে যুবকের লাশ উদ্ধার
(৫) ইয়াবা পাচারের জন্য কারাদণ্ড
(৬) দুর্বৃত্তের গুলিতে পেকুয়ায় শিক্ষক আহত।
এসবই রিপোর্টেড ক্রাইম। পত্রিকায় ছাপেনি এমন কত ঘটনা আছে। আবার এসব তো কেবল চট্টগ্রাম অঞ্চলের। সারা দেশের অপরাধের খবর এক সাথে করলে আরেকটা ছোটখাট দৈনিক হবে। এমতাবস্থায় কারে শোনাবেন কি কাহিনী! বিদেশী মেহমান বাংলা পত্রিকা পড়ে যা বোঝার বোঝেই গেলেন।
বাংলাদেশ পেনাল কোড এ ‘ক্রাইম’ এর কোন সংজ্ঞা নেই। শাস্তিযোগ্য কোন কাজকে অপরাধ বলা হয়। শাস্তিযোগ্য কাজের তালিকা দীর্ঘ।
অক্সফোর্ড ডিকশনারীতে প্রচলিত আইন ভংগ করাকে অপরাধ বলা হয়েছে। ‘ক্রাইম’ এর সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও সমাজ সংশ্লিষ্ট সংজ্ঞা দিয়েছেন ইটালিয়ান ক্রিমোনলজিস্ট রাফায়েল গারোফানো ও বৃটিশ সমাজ তত্ত্ববিদ সাদারল্যান্ড। তাদের মতে–ক্রাইম হচ্ছে সামাজিক নৈরাজ্যের উপসর্গ।
আমাদের দেশে নিম্নোক্ত কয়েক রকমের ক্রাইম উল্লেখযোগ্য
(১) ভায়োলেন্ট ক্রাইম
(২) সম্পত্তি বিষয়ক ক্রাইম
(৩) পলিটিক্যাল ক্রাইম
(৪) ড্রাগ বিষয়ক ক্রাইম
(৫) নারী–পুরুষ যৌন সম্পর্কজনিত
এ দেশে ক্রাইম বাড়ছে। এ সংক্রান্ত সরকারি তথ্য থেকে বাস্তব অবস্থা ভয়াবহ।
যেমন ড্রাগ সম্পর্কিত ক্রাইম
২০০৫ সালে ২৫ লক্ষ
২০০৯ সালে ২৮ লক্ষ
হত্যা জনিত ক্রাইম
২০০৮ সালে ৪০৯৯
২০১৪ সালে ৪৫১৪
মহিলাদের ওপর ভায়োলেন্স
২০০৮ সালে ১৫২৪৬
২০১৪ সালে ২১২৯১
আর বেশী উদাহরণের ও পরিসংখ্যানের প্রয়োজন নেই। জিডিপি, উন্নয়ন বাড়ার সাথে সাথে ক্রাইমও বাড়ছে। এটাকে সমাজের জন্য একটা অশনি সংকেত বলা যায়। যেখানে সমাজই আক্রান্ত সেখানে রাষ্ট্রের অন্য সব অর্জন গৌন হতে বাধ্য।
এদেশ কবি–সাহিত্যিকদের তীর্থভূমি। নৈতিক রাজনীতির চারণভূমি কিন্তু কোথায় গলদটা হচ্ছে? সবাই যদি সামাজিক নৈরাজ্য প্রসূত ওসব ক্রাইম প্রতিরোধে এগিয়ে না আসি তবে আমাদের অবস্থা হবে সেই আশির দশকের জ্যামাইকার মতো। তারা যেমন নেশা–প্রবণ জাতিতে পরিণত হয়েছিল আমরাও তেমনি অপরাধ প্রবণ জাতিতে পরিণত হব। কোন বিদেশী মেহমান এদেশ থেকে কী বার্তা নিয়ে ফিরবেন?
(সংগৃহীত)