বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

নারী, এ তোমার অপমান নয়

নারী, এ তোমার অপমান নয়

কামরুল হাসান বাদল, ০১ ফেব্রুয়ারি, এবিনিউজ : এবার আট মাসের এক শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। আর সে ধর্ষক ২৮ বছর বয়সী শিশুটির কাজিন। পুলিশ গ্রেফতার করেছে ধর্ষককে। ঘটনাটি ঘটেছে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে।

কাজ শেষে বাড়ি ফিরে শিশুটির বিছানা রক্তে ভেসে যেতে দেখে বাবা–মা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। শিশুটির অবস্থা গুরুতর। দিল্লির নারী বিষয়ক কমিশনের প্রধান স্বাতী মালিওয়াল মেয়েটিকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। মেয়েটিকে দেখে তিনি তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন শিশুটির অবস্থা ভয়াবহ। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে শিশুটির শরীরে অপারেশন করা হয়েছে। ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটেছিল গত রোববার। এই সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর সোমবার থেকে শিশু ধর্ষণের ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ছে দিল্লিসহ অন্যত্র।

মাত্র কয়েকদিন আগে চট্টগ্রাম নগরের আকবর শাহ বিশ্ব ব্যাংক কলোনিতে আয়শা–মমতাজ মহল নামে পাঁচতলা একটি ভবনের দ্বিতীয় তলার সিঁড়ির পাশ থেকে নয় বছর বয়সী এক শিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ বলছে, ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ ফেলে রাখা হয়েছিল।

প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। ধর্ষণ থেকে আট মাসের শিশু থেকে ৭২ বছর বয়সী নারীও রেহাই পাচ্ছে না। মাস দুয়েক আগে ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যে ডাকাতি করতে গিয়ে ডাকাতরা এক ৭২ বছর বয়সী ধর্মযাজিকাকে ধর্ষণ করে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানায় এক প্রবাসীর বাড়িতে ডাকাতি করতে গিয়ে বাড়ির গৃহবধূদের ধর্ষণ করে ডাকাতরা। অতি সম্প্রতি বলিউডের এক সময়ের হাটথ্রব নায়িকা জিনাত আমান। যার বয়স বর্তমানে ৬৮ বছর। তিনি তাঁর শ্রীলতাহানির বিচার চেয়ে তাঁর এক পারিবারিক বন্ধুর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।

আট মাস বয়সী শিশুকে ধর্ষণ করা যেতে পারে। এই বয়সী শিশুও পুরুষের কাছে এমন কি তার কাজিন অর্থাৎ জ্ঞাতিভাইয়ের কাছেও নিরাপদ নয়। এটা জেনে এবং বিষয়টি নিয়ে ভাবতে গিয়ে আমি নিজেই বিমর্ষ হয়ে পড়ছি। আমি বুঝতে পারছি না, পুরুষের সমস্যা কোথায়? কী হয়েছে পুরুষের? একটি আট মাসের শিশু, একজন প্রায় অশীতিপর বৃদ্ধা, একজন ৬৮ বছরের অভিনেত্রী কেউই ধর্ষণের ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকতে পারছেন না। আসলে কেই–বা ধর্ষণের ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকতে পারছেন সেটাই বড় প্রশ্ন। এই পরিস্থিতি কি শুধু বাংলা–ভারত উপমহাদেশে? না, এই সমস্যা বিশ্বজুড়ে। খোদ আমেরিকাতেও কোনো নারী পূর্ণ নিরাপদ নয়।

বিশ্বে যৌন হয়রানির শিকার না হওয়া নারীর সংখ্যা খুব বেশি হবে বলে মনে হয় না। সেটি এখন পশ্চিমা বিশ্বের মতো খোলামেলা সমাজে হোক কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের মতো রক্ষণশীল সমাজেই হোক। নারীকে নারী হিসেবেই দেখা হয় সব সমাজে এবং ভোগের সামগ্রী হিসেবেই গণ্য করা হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে।

অপরাহ উইনফ্রে বিশ্ব নন্দিত টিভি উপস্থাপিকা। সাংবাদিক ও বিশ্বের ক্ষমতাধর নারীদের মধ্যে অন্যতম। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় তাঁর টিভি শো’র নাম, অপরাহ উইনফ্রে–শো। তাঁকে বলা হয় ‘কুইন অফ অল মিডিয়া’। তিনি এখন এক জীবন্ত কিংবদন্তি, যিনি নবাবের ভয়াবহ দ্বন্দ্বের মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন এবং সকল বঞ্চনা ও সামাজিক বৈষম্যকে উপেক্ষা করে প্রবণ প্রতিকূলতা জয় করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

অপরাহর বেড়ে ওঠা সহজ, স্বাভাবিক ছিল না। ছিল না শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের মতো আনন্দময়। কালো বলে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রবল বিরোধিতা, অবহেলা প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে তাঁকে। সেই উইনফ্রে মাত্র ৯ বছর বয়সে তার কাজিন দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিলেন। এমন ঘটনা যে তার জীবনে মাত্র একবারই ঘটেছিল তা কিন্তু নয়। আমাদের সমাজে যা ঘটে থাকে সাধারণত অর্থাৎ অপরাহর ঘটনা শুনে এই দেশের নারীরাও চমকে যাবেন যে, তাদের নিজেদের জীবনের অনেকের সাথে মিলে যাবে উইনফ্রের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার সাথে। উইনফ্রে বলেছেন সে ঘটনার পর তিনি আরও কয়েকবার ধর্ষিত হয়েছিলেন এবং তা তাঁর আঙ্কেল, মায়ের বয়ফ্রেন্ড, পরিবারের বন্ধু এবং অন্য আরেক কাজিন দ্বারা। প্রথম নয় বছর বয়সে তিনি ধর্ষিত হওয়ার পর গর্ভবতী হয়ে পড়েছিলেন। নয় বছরের একটি শিশুর জন্য বিষয়টি কত নিষ্ঠুর বিভীষিকাময় তা হয়ত আমরা কল্পনাও করতে পারব না। সে দুঃসময় পার করে এসেছেন অপরাহ। শুধু তাই নয়, নিজের আত্মবিশ্বাসের জোরে নিজেকে অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি। অতি সম্প্রতি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বলে আলোড়নও তুলেছেন। পরে অবশ্য তিনি সে ধরনের কোনো কোনো পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়ে দিয়েছেন।

যৌন হয়রানির শিকার হয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা দেশে অসংখ্য নারী আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। অপরাহ সে বিষয়ে বলেছেন ‘এই সমাজের কুসংস্কার, সামাজিক অন্ধত্বগুলো নিজের ওপর হওয়া অবিচারকে চিরতরে শেষ করার দায়িত্ব নিতে হবে আপনাকেই। তাই আবারও বলছি আত্মহত্যা নয়, নিজেকে বঞ্চিত ভেবে পরাজয় মেনে নেওয়া নয়, সমাজের শৃঙ্খল ভেঙে আপনিই হোন আপনার পরবর্তী প্রজন্মের আদর্শ।

সম্প্রতি দপ্তর পরিবর্তন হওয়া প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে পূর্ণিমা রাণী শীলকে নিয়োগ দিয়ে আলোচনায় এসেছেন এবং ব্যাপকভাবে নন্দিত হয়েছেন। ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী থেকে তারানা হালিমকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়ে তারানা হালিম তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে পূর্ণিমাকে নিয়োগ দেন এবং তাকে বুকে জড়িয়ে ধরা একটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেন। এই ছবি সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাল হয়। অধিকাংশ মানুষ তারানার এই সিদ্ধান্ত এবং পূর্ণিমার সংগ্রামকে স্বাগত ও প্রশংসা করলেও কিছু কিছু নিন্দুক এর মধ্যে ত্রুটি বের করার চেষ্টা করেছে দেখে আমি ব্যক্তিগতভাবে দুঃখ পেয়েছি।

অনেকের মনে থাকা–কথা ২০০১ সালে নির্বাচনে জয়লাভের পর জামায়াত–বিএনপি জোট সরকার সারাদেশে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনে মেতে উঠেছিল জামায়াত–বিএনপির নেতাকর্মীরা। সে সময় শিশু পূর্ণিমাকে দল বেঁধে ধর্ষণ করেছিল সেসব দুর্বৃত্তরা। পরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী পূর্ণিমার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। সারাদেশের মানবিকবোধসম্পন্ন মানুষগুলো পূণির্মার পাশে দাঁড়িয়েছিল এবং সে ট্রমা ও ক্ষত ভুলে যেতে তাকে প্রেরণা যুগিয়েছিল।

তারানা হালিমের সাথে পূণির্মার এই ছবি দেখে এবং তাকে চাকরি দেওয়ার সংবাদ প্রচার হওয়ায় অনেক নিন্দুক ও ছিদ্রান্বেষী এর মধ্যে পুনর্বার পূণির্মা ধর্ষিত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। আমি সেসব নিন্দুকদের জানাতে চাই, পূণির্মার ধর্ষণের সংবাদ যতবার প্রচারিত হবে ততবার লজ্জা পাবে পূর্ণিমা নয়। তার ওপর অত্যাচার করা দুবর্ৃৃত্তরা, তাদের পৃষ্ঠপোষকতাকারী রাজনৈতিক শক্তি আর তৎকালীন সরকার। ধর্ষিত হওয়া নারীর লজ্জা নয়, এই লজ্জা রাষ্ট্রের, সমাজের এবং পুরুষের।

আমি এ বিষয়ে প্রভাকে সম্মান করি। কয়েক বছর আগে তার একটি ভিডিও ভাইরাল করে দিয়েছিল তার প্রাক্তন প্রেমিক। আমাদের পুরুষশাসিত ভ্রষ্ট সমাজের অনেকেই সে সময় প্রভাকে দোষ দিয়েছিল। সবচেয়ে ঘৃণিত কাজ করা তার সেই প্রেমিককে নয় অনেকে সব দোষ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল প্রভার ওপর। আমি অভিবাদন জানাই প্রভাকে। তিনি সে দুঃসময়কে খুব দক্ষভাবে মোকাবেলা করেছেন এবং সে যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন। সে ঘটনার দায় প্রভার নয়, তার প্রাক্তন প্রেমিকের যে সকল বিশ্বাস ভঙ্গ করে এবং সভ্যতার সীমা লঙ্ঘন করে তাদের গোপন ভিডিওটি জনসমক্ষে ফাঁস করে দিয়েছিল। সমাজের সবার উচিত ছিল সে লম্পট প্রেমিককে ঘৃণা জানানোর। কিন্তু আমি সে সময় দেখেছি, অনেকে এমনকি তার মধ্যে নারীরাও ছিলেন, কী নিষ্ঠুর ও অমানবিকভাবে প্রভাকে অপমান করার চেষ্টা করেছিল।

আজকাল প্রায় দেখতে পাই গোপন ভিডিও করে, তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে নারীদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করা হয়। অনেকে সে ফাঁকে আটকে পড়ে। অনেকে বাঁচার জন্যে আত্মহননের পথ বেছে নেন। কিন্তু মেয়ের আত্মহননের সিদ্ধান্ত তো কোনো দিক দিয়েই মেনে নেওয়ার নয়। লজ্জাতো শুধু নারী বা মেয়েটির নয়। এই লজ্জা বরং ওই দুর্বৃত্তের এবং ওই সমাজের। যে সমাজ সে সব দুর্বৃত্তদের হাত থেকে নারীদের রক্ষা করতে পারে না। শিশু–কিশোরী থেকে শুরু করে পূর্ণ বয়স্কা নারী যারা এমন ঘটনায় মুষড়ে পড়েন, ভেঙে পড়েন এবং শেষে লোক লজ্জার ভয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন তাদের জন্য অপরাহ উইনফ্রের অভিজ্ঞতা খুব বেশি করে তুলে ধরা দরকার। কারণ যৌন হয়রানির শিকার হওয়া বা ধর্ষিত হওয়ার পর সবকিছু শেষ হয়ে গেছে বলে ভাবার দরকার নেই। বরং প্রবলভাবে বেঁচে থাকতে হবে, লড়াই করতে হবে আর কোনো শিশু যেন এমন নির্যাতনের শিকার না হয়।

অপরাহ’র জীবনেই শুধু নয়, প্রায় প্রতিটি মেয়ে শিশু তার পরিবারের কারো না কারো দ্বারা প্রথম যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। এক্ষেত্রে প্রতিটি বাবা–মায়ের খুব সচেতন থাকা দরকার। ছোটবেলা থেকে কিছু শিক্ষাদান করা উচিত। শিশুদের অভিযোগ ও আপত্তি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত। কোনো শিশু যদি কারো সাথে থাকতে আপত্তি জানায়, সে যেই হোক, কিংবা কারো কাছে পড়তে যেতেও আপত্তি জানায় তাও বিবেচনায় নিতে হবে অভিভাবকদের।

ছোটবেলা কিংবা যে কোনো সময় কোনো নারী যদি যৌন হয়রানির শিকার হন, ধর্ষিত হন তাকে সাহস দিতে, প্রতিবাদ করতে এবং ধর্ষকের বিচার দাবি করতে ওই নারীর পক্ষে দাঁড়াতে হবে। তাকে ভরসা দিতে হবে। জানিয়ে দিতে হবে যে, ধর্ষিত হওয়ার লজ্জা তার নয়, এই লজ্জা আমাদের। আর আমাদের এই লজ্জা দূর করার দায়ও আমাদের সকলের।

[email protected]

(সংগৃহীত)

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত