বিকাশ বড়ুয়া, ০৩ ফেব্রুয়ারি, এবিনিউজ : চন্দনাইশ উপজেলায় গত মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামানের উচ্চারিত কথাগুলি ভালো লাগলো। তিনি যথার্থই বলেছেন, ‘সমাজে আলোকিত, সমাজ সচেতন ও বিবেকমান মানুষের অভাব হলেই ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতা হানা দেয়’। তিনি বলেন ‘আজকে যারা শিক্ষার্থী তাদের সমাজ সচেতন হওয়ার পাশাপাশি প্রগতিশীল, বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে’। ধর্মানুরাগী, ধর্মভীরু ভালো কিন্তু ভালো যা নয় তা হলো ধর্মান্ধতা। অন্ধত্ব – সে ধর্ম কেন, সকল ক্ষেত্রে মন্দ বই সুফল বয়ে আনে না। সন্তানের প্রতি অন্ধ স্নেহও অনেক সময় কুফল বয়ে আনে। আমাদের দেশে শিক্ষার হার বেড়ে চলেছে, ফি বছর বাড়ছে জিপিএ–৫ পাওয়া ছাত্র–ছাত্রীর সংখ্যা। শিক্ষার হার বাড়ছে বটে কিন্তু শিক্ষার মান কী পরিমাণ বাড়ছে সেটি বিচার্য বিষয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে জ্ঞান দেয়ার পরিবর্তে, পরীক্ষায় পাশ করার কিংবা ’সোনার হরিণ’ জিপিএ–৫ অর্জনের শর্ট–কাট রাস্তা দেখিয়ে দেয়ার প্রতিযোগিতা চলমান। শিক্ষা অর্জনের চাইতে জিপিএ–৫ অর্জনই হয়ে উঠে মুখ্য। পাশ করার জন্যে বা জিপিএ–৫ পাবার জন্যে যা যা পড়া দরকার, কেবল তাই পড়া, এর বাইরে নয়। অথচ আমাদের সময় আমরা কয়েক কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে পাবলিক লাইব্রেরী যেতাম পাঠ্য বইয়ের বাইরে ‘অন্য বই’ পড়তে। ইতিহাস, গল্প, উপন্যাস, রোমাঞ্চকর কাহিনী। সে সময় কারো জন্মদিনে, বিয়েতে বই উপহার দেবার একটা রেওয়াজ ছিল। আমরা তখন পাড়ায়, এমন কী গ্রামেও নিজেদের উদ্যোগে ‘লাইব্রেরী’ চালু করেছিলাম। যেখান থেকে বই দিন কয়েকের জন্যে ধার নেয়া যেত। একজন থাকতো যে, কে কোন বই ধার নিলো তা একটি বড় খাতায় টুকে রাখতো। কোন আর্থিক প্রাপ্তিযোগ ছিলনা এই কাজে, কিন্তু কাজটি করা হতো প্রচন্ড উৎসাহে। প্রচন্ড উৎসাহে আমরা করতাম। এখন সে সবের বালাই নেই। আমি জানিনা বাংলাদেশে এখন স্কুলে ’বাইরের বই’ পড়ার জন্যে ছাত্র–ছাত্রীদের উৎসাহিত করতে বা তাদের মাঝে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে কোন পদ্ধতি চালু রয়েছে কিনা। প্রযুক্তির কারণে কেবল বাংলাদেশেই নয় উন্নত বিশ্বেও ছেলে–মেয়েরা বইয়ের চাইতে ইন্টারনেটে আগ্রহী। সেটি কোন দোষের নয়, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারপরও বই পড়ার অভ্যেস গড়ে তোলার জন্যে ইউরোপের স্কুলগুলিতে ছাত্র–ছাত্রীদের বাধ্যতামূলক ‘বাইরের বই’ পড়তে দেয়া হয়। সেটি গল্পের হতে পারে, উপন্যাস হতে পারে, ইতিহাস ভিক্তিকও হতে পারে। কিন্তু সে যে পাঠ্য বইয়ের বাইরেও ‘বাইরের’ বইগুলি পড়েছে তার প্রমাণ কী? প্রমাণ হিসাবে তাকে ঐ বই সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট তৈরি করে ক্লাসে জমা দিতে হবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। আমাদের দেশে বর্তমানে এই প্রথাটা যদি চালু না থাকে তাহলে কর্তৃপক্ষ এই বিষয়টি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে দেখতে পারেন বলে মনে করি।
আসাদুজ্জামান নূর তার বক্তব্যে ধর্মান্ধতার কথা বলেছেন। একটু তাকাই বৌদ্ধ ধর্মানুরাগীদের দিকে। আজকাল ফেইস বুক খুললেই দেখি বৌদ্ধ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ছড়াছড়ি, চোখ ধাঁধানো মন্দির এবং যেটি চোখে পড়ার মত সেটি হলো তরুণরাই এই সমস্ত কর্মকান্ডে ব্যস্ত। দেখি আর ভাবি যদি এই ধরণের কর্মকান্ডের কিছুটা যদি শিক্ষা ক্ষেত্রে করা হতো তাতে দেশ ও দশের অনেক কল্যাণ হতো। ধর্মান্ধতা বাংলাদেশে বৌদ্ধ সমাজের মাঝে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ‘অসুস্থ হারে’ বেড়ে গেছে বলে কেবল আমার নয়, অনেকের ধারণা। ধর্মের নামে এক ধরণের অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মাঝে, বিশেষ করে নব্য টাকাওয়ালা ও ব্যবসায়ীদের মাঝে। কে কার চাইতে বেশি চাঁদা, অনুদান ধর্মীয় অনুষ্ঠানে দিতে পারেন তার প্রতিযোগিতায় নামেন এরা। গতকাল এই সময় ছিলাম সুইজারল্যান্ডের চমৎকার শহর, জেনেভায়। সেখানে কথা হচ্ছিল এক প্রবাসী বাংলাদেশি বৌদ্ধ নাগরিকের সাথে। পরের কল্যাণে সদা ব্যস্ত এই ভদ্রলোক সক্রিয় এক মানবাধিকার কর্মী। বাংলাদেশে যখন ধর্মের নামে অত্যাচারের খড়গ নেমে আসে, সেখানে তিনি হয়ে উঠেন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে ঝাঁপিয়ে পড়েন এই অকৃতদার সমাজের কল্যাণে। তিনি বললেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলিতে চট্টগ্রামের অনেক বৌদ্ধ গ্রামে কোটি কোটি টাকা খরচ করে গড়ে উঠছে চোখ জুড়ানো বৌদ্ধ মন্দির। অথচ তার ক্ষুদ্র একটি অংশ যদি তারা গ্রামের গরীব, মেধাবী ছাত্র–ছাত্রীদের কল্যাণে ব্যবহার করতো তাহলে ব্যক্তির, সমাজের, দেশের উন্নয়ন হতো’। উপস্থিত আর এক বৌদ্ধ তরুণ, বছর কয়েক আগে দেশে গিয়ে বিয়ে করেছেন, তার সাথে সুর মিলিয়ে বলেন, ‘অনেক সময় লজ্জায় পড়ে টাকা দিতে হয়’। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘শ্বশুড় বাড়ি গেলাম বেড়াতে। এক সময় শ্বশুড় বললেন, বৌদ্ধ মন্দিরটা একবার ঘুরে এস’। মন্দিরে গেলে বিহারের ভিক্ষু চেপে ধরেন মন্দিরের জন্যে চাঁদা দেবার জন্যে এবং যেহেতু ইউরোপ থাকি এক লক্ষ টাকার কমে হবে না বলে পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন এবং দিতে বাধ্য হলাম’। একই কাহিনী প্যারিস থেকে আসা তার ছোট ভাইয়ের। সে বিয়ে করেছে মাস কয়ে আগে। তাকেও দিতে হয়েছে তার শ্বশুড় বাড়ির বৌদ্ধ মন্দিরের জন্য এক লক্ষ টাকা। এদের মন্তব্য এক শ্রেণির বৌদ্ধ ভিক্ষু মন্দিরের নামে চাঁদাবাজিতে নেমেছে। যে মানবাধিকার কর্মীর কথা বলছি, তিনিও এক সময় বৌদ্ধ ভিক্ষু ছিলেন। তিনি বলেন, এখনকার বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পাঁচ শো টাকা দান (দক্ষিণা) দিলে তারা রাগ করেন। মুখের উপর বলে দেন, ‘লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে বাড়ি বানালেন, আর আপনি কিনা মাত্র পাঁচ শো টাকা দান দিলেন’? একটা সময় দেখেছি বৌদ্ধ ভিক্ষুরা টাকা স্পর্শ করতেন না। আর এখন?, তার প্রশ্ন।
জেনেভার বুকে দেখা এই বাংলাদেশী বৌদ্ধ ‘ধর্মান্ধতা’ প্রসঙ্গে এক মজার গল্প বললেন। বাংলাদেশের প্রবীণ এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর বলা একটি গল্পের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গ্রামের এক লোক খুব ভোরে ট্রেন ধরবে বলে স্টেশনের দিকে রওনা দেয়। পথিমধ্যে তার নিম্নচাপ শুরু হলে সে রাস্তার উপরেই মল ত্যাগ করে। কর্ম সেরেই দৌড় দেয় ট্রেনের উদ্দেশ্যে। খানিকবাদে ওই পথ দিয়ে এক পথচারী আসছিল। সে মল দেখে পাশের পুকুর থেকে কচুরিপানা এনে তা ঢেকে দিল। কচুরিপানায় ছিল কয়েকটা ফোটা ফুল। এর পর আর এক পথচারী রাস্তার ধারে ফুল সহ কচুরিপানা দেখে ভাবলো পবিত্র কিছু। সে প্রণাম করে চলে গেলো। তা দেখে তার পেছনে আসা অন্যরাও প্রণাম শুরু করলো, কেউ টাকা দিল, কেউ মোমবাতি জ্বালাতে শুরু করলো। একদিন সেখানে গড়ে উঠলো মন্দির। ভক্তরা এসে পূজা অর্চনা শুরু করলো আর ধর্মগুরু ’ধর্মীয় বয়ান’ দিতে শুরু করলো। ধর্মান্ধতা হচ্ছে এর জ্বলন্ত উদাহরণ। এই প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বর্ণনা উল্লেখ না করে পারলাম না।
আমাদের গ্রামের বাড়ির পেছনে পুকুর ফেলে ধানী জমি। সে জমি পেরোলে উঁচু ভিটা। নানা গাছ গাছালিতে ভরা সে ভিটা। সেটি আমাদের পারিবারিক শ্মশান। পুরো গ্রামে এই একটিই পারিবারিক শ্মাশান। সেখানে আছে মা–বাবা, জেঠা–জেঠীমাদের স্মৃতি মন্দির, এমন কী ঠাকুরদারও। তাদের যেখানে দাহ করা হয়েছে ঠিক সেখানেই গড়ে উঠেছে স্মৃতি মন্দির। মানুষের পদচারণা তেমন ঘটে না বলে সেটি অনেকটা বনের মত। সাপের ভয়েও কেউ সেখানে রাতের বেলায় তো বটে, দিনের বেলায়ও যায় না। হটাৎ একদিন দেখা গেল এক বৌদ্ধ ভিক্ষু সেখানে কাউকে কিছু না বলে হাজির। বাঁশের ছাউনি জাতীয় কিছু একটা দিয়ে তিনি সেখানে গেড়ে বসলেন। বললেন, তিনি স্বপ্নে দেখেছেন এই স্থানটি এবং এখানে ধ্যানে বসবেন। চাউর হলো, এই বৌদ্ধ ভিক্ষু তিন মাসের বেশি কোন স্থানে থাকে না। শুনেই বললাম, ‘ও তিন মাস নয়, তিন বছরেও এই স্থান থেকে যাবে না’। আমার এই অনেকের মতে ’ঔদ্ধত্যপূর্ণ’ কথা শুনে অনেকে বলে, ‘অমন করে বলো না, পাপ হবে’। গ্রামের অনেকে এমন কী আমার নিকটজনদের কেউ কেউ ‘অন্ধ ভক্তিতে’ তাকে আশ্রয় দিলো, দান–দক্ষিণ দিল। বছর মাথায় দেশে গেলে বাবা–মায়ের স্মৃতি মন্দিরে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে দেখি, গোটা ভিটার দুই তৃতীয়াংশ জায়গা ইতিমধ্যে বেদখলে চলে গেছে ওই বৌদ্ধ ভিক্ষুর গড়া আশ্রমে। শুরুতে যেটি ছিল এক চিলতে একটি খড়ের ঘর সেটি এখন হয়ে উঠেছে শতাধিক লোকের বসার ঘর। এখন সেখানে শুনেছি গ্রামবাসীরা এমন কী আশপাশের গ্রাম থেকে দল বেঁধে লোকজন আসে, পূজাদি সারে। রাতভর মাইক বাজিয়ে বৌদ্ধ মন্ত্রপাঠ চলে। সে মন্ত্র প্রযুক্তির কল্যাণে পৌঁছে ইউরোপের এই দেশেও। এখানেও ভক্তকুলের কেউ কেউ শোনেন, পুণ্য অর্জন করেন। শুরুতে যখন বলেছিলাম এই লোক (ভিক্ষু) তিন মাস নয়, তিন বছরেও এই জায়গা থেকে যাবে না, শুনে সবাই আমার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে ছিল। যেন আমি এই কথাটা বলে মহা অন্যায় করে ফেলেছিলাম। যেন গোটা পৃথিবীটা আমার মাথার উপর ভেঙে পড়বে। আজ তিন বছর নয়, প্রায় পাঁচ বছর হতে চলেছে। আমাদের পারিবারিক শ্মশান একটু একটু করে এখন প্রায় বেদখলে চলে গেছে। ভাবি আমার যখন ওই স্থানে যাবার সময় হবে, যেতে পারবো তো? নাকি তখন গোটা ভিটেটাই বেদখলে চলে যাবে? একে কি বলবো? ধর্ম? এখন সেখানে কেবল গ্রামের অশিক্ষিত লোকেরাই যে যাচ্ছে তা না, সেখানে যাচ্ছে গ্রামের শিক্ষিত সমাজ, যাদের অনেকের বসবাস শহরে। যারা সেখানে যেতে পারছেন না, তারা অর্থ পাঠিয়ে, মোবাইলে ধর্ম দেশনা শুনে ’স্বর্গে’ যাবার পথ সুগম করছেন। এটিও কি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের ’ধর্মান্ধতার’ আর একটি জ্বলন্ত প্রমাণ নয়? এই ধর্মান্ধতার বেড়াজাল থেকে বের হতে না পারলে আমাদের সামনে যে ঘোর অন্ধকার তাতে কোন সন্দেহ নেই।
লেখক: হল্যান্ড প্রবাসী
(সংগৃহীত)