বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

শওকত আলী: প্রান্তিক ও প্রাকৃতজনের কণ্ঠস্বর

শওকত আলী: প্রান্তিক ও প্রাকৃতজনের কণ্ঠস্বর

আহমেদ মাওলা, ০৩ ফেব্রুয়ারি, এবিনিউজ : কথাশিল্পী শওকত আলী (জন্ম : ১৯৩৬, ১২ ফেব্রুয়ারি–মৃত্যু : ২০১৮, ২৫ জানুয়ারি) অবশেষে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। অখণ্ড ভারতেই তাঁর জন্ম, দেখেছেন সাতচল্লিশের দেশভাগ, দেশভাগের অনিবার্য পরিণতি, সব হারিয়ে জন্ম ভিটা ছেড়ে পাড়ি জমান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। তারপর বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন, বামপন্থী রাজনীতিতে জড়িত থাকার অপরাধে দশ মাসের জেল জীবন, উনিশ’শ একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধ প্রায় বিরাশি বছরের জীবন–অভিজ্ঞতা নিয়ে গড়ে উঠেছে তাঁর বিশাল কথন বিশ্ব। শওকত আলীর দীর্ঘ লেখালেখির জীবনে প্রধান হয়ে উঠেছে দেশভাগ এবং দেশভাগজনিত ক্ষত, উদ্বাস্তু মানুষের মর্মযাতনা, মানবিক কষ্টের কথা। চেতনাগতভাবে শওকত আলী ছিলেন আম্প্রদায়িক, শোষণহীন, প্রগতিশীল সমাজের স্বপ্নময় বিশ্বাসী একজন মানুষ। তাই স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতিতে ধর্মের অনুপ্রবেশ, শাসক দলের সীমাহীন ব্যর্থতা, সামরিক অপশক্তির ক্ষমতা দখল ও অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, কল্যাণকামী রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তে, ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি, জনগণের ইচ্ছা–আকাঙক্ষাকে তোয়াক্কা না করে ব্যক্তি ও দলের স্বার্থে দেশের সম্পদ লুট করে নেয়ার এই রাজনীতিকে শওকত আলী তাঁর লেখায় তীব্রভাবে সমালোচনা করেছেন। শওকত আলী প্রথাগত ধারার তথাকথিত জনপ্রিয় লেখক ছিলেন না, তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন, গভীর তাৎপর্য অনুসন্ধানী লেখক। তাঁর লেখায় ব্যক্তির ক্ষয়, আত্মবিনাশ, রাজনীতির অভিঘাতে ব্যক্তি মানুষের জীবন বিপর্যস্ত বিপন্ন হওয়ার করুণ চিত্র যেমন আছে, তেমনি দেশভাগজনিত উন্মূল উদ্বাস্তু মানুষের মর্ম যাতনা, অশ্রুময় ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। বলা যায় দেশকাল এবং রাজনীতির দহনজ্বালার কথা প্রধান হয়ে উঠেছে শওকত আলীর কথা সাহিত্যে।

শওকত আলীর বাবা শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. খোরশেদ আলী সরকার, মা সালেমা খাতুন, স্ত্রী শওকত আরা বেগম, তিন ছেলে, আরিফ শওকত পল্লব, আসিফ শওকত কল্লোল, গালিব শওকত শুভ। ১৯৫৯ সালে ঠাকুরগাঁও কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। এর আগে কিছুকাল সাংবাদিকতা, দিনাজপুর বীরগঞ্জ হাইস্কুলে মাস্টারিও করেছেন তিনি। ১৯৬২ সাল থেকে একটানা ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত জগন্নাথ কলেজে তারপর বাংলাদেশ জেলা গেজেটিয়ার অফিসে সম্পাদক পদে যোগ দেন এবং ১৯৯৩ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তার প্রকাশিত উপন্যাস : পিঙ্গল আকাশ (১৯৬৩) যাত্রা (১৯৭৬) প্রদোষে প্রাকৃতজন (১৯৮৪) অপেক্ষা (১৯৮৪) দক্ষিণায়নের দিন (১৯৮৫) কুলায় কালস্রোত (১৯৮৬) পূর্বরাত্রি পূর্বদিন (১৯৮৬) সম্বল (১৯৮৬) গন্তব্যে অতঃপর (১৯৮৭) ভালোবাসা কারে কয় (১৯৮৮) যেতে চাই (১৯৮৮) ওয়ারিশ (১৯৮৯) উত্তরের খেপ (১৯৯১) প্রেমকাহিনী (১৯৯১) পতন (১৯৯২) অবশেষে প্রতাপ (১৯৯৬) দলিল (২০০০) জননীয় ও জাতিকা (২০০১) হিসাব নিকাশ (২০০১) স্ববাসে প্রবাসে (২০০১) তনয়ার স্বীকারোক্তি (২০০১) জোড়–বিজোড় (২০০১) ঘরবাড়ি (২০০১) শেষ বিকেলের রোদ (২০০১) এক ডাইনীর খেলা (২০০১) নাঢাই (২০০৩) বসত (২০০৫) স্থায়ী ঠিকানা (২০০৫) দুই রকম (২০০৫) কাহিনী ও কথোপকথন (২০০৭) মাদার ডাঙ্গার কথা (২০১১) গল্পগ্রন্থ : উম্মূল বাসনা (১৯৬৮) লেলিহান সাধ (১৯৭৮) শুন হে লখিন্দর (১৯৮৮) বাবা আপনে যান (১৯৯৪) দিনগুজরান (২০০৬) এবং শওকত আলীর প্রবন্ধ সমগ্র প্রকাশিত হয়েছে ২০০৩ সাথে। (শওকত আলী সংখ্যা ‘গল্পকথা’–২০১৬)

সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য শওকত আলী অর্জন করেছেন অনেকগুলো পুরস্কার : বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৮) হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৭) অজিত গুহ পুরস্কার (১৯৮৪) ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬) আলাওল পুরস্কার (১৯৮৯) একুশে পদক (১৯৯০)। সবচেয়ে বড় পুরস্কার, তিনি এদেশের মূল ধারার সাহিত্য পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন, পেয়েছেন তাঁদের অকৃত্রিম ভালোবাস এবং শ্রদ্ধা।

শওকত আলীর প্রথম উপন্যাস ‘পিঙ্গল আকাশ’ (১৯৬৩), এই উপন্যাসেই মূর্ত হয়ে উঠেছিল জীবন সম্পর্কে তাঁর গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, চরিত্র চিত্র দক্ষতা এবং মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা বিশ্লেষণের অসাধারণ উপন্যাসিক সামর্থ্য। এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মঞ্জু। সপ্তদর্শী মঞ্জু রিক্ত, অসহায়, প্রতিকূল ও লাঞ্চনা জর্জর আঘাতের মধ্যেও সম্ভ্রম রক্ষার সংগ্রামশীলতা অব্যাহত রাখে এবং বিরূপ পরিস্থিতিতেও সুস্থ্য, সুন্দর, প্রদীপ্ত জীবনের বাসনা লালন করে। চৌধুরী সাহেব ও সালেহার সংসারে ছয়সন্তান কিন্তু এই ছয় সন্তানের রয়েছে তিনটি প্রস্থের পিতৃমাতৃ পরিচয়। চৌধুরী সাহেব এবং সালেহার এটি দ্বিতীয় বিবাহ। চৌধুরী সাহেবের প্রথম ঘরের সন্তান আনিস, ফরিদা, বাহুল। সালেহার প্রথম সংসারের সন্তান মঞ্জু, পরে চৌধুরী সাহেব ও সালেহার বর্তমান সংসারে জন্ম নেয় পুতুল এবং মম। চৌধুরী সাহেবের দ্বিতীয় বিয়ে, তার আগের ঘরের তিন সন্তান আনিস, ফরিদা, রাহুল কেউ মেনে নেয় না। স্বামীর পূর্ব সন্তানদেরকে সালেহা মায়ের মমতা দিয়ে কাছে টানতে চেষ্টা করে না। চৌধুরী সাহেবও পিতার দায়িত্ববোধ থেকে সন্তানদের প্রতি কোনো সহানুভূতি প্রকাশ করে না। ফরিদা সরাসরি পিতাকে স্বার্থপর, ভোগবাদী হিসেবে দায়ী করে দ্বিতীয় বিয়ের কারণে। মঞ্জু ও তার মা সালেহার বিরুদ্ধে অনুরূপ অভিযোগ করে কিন্তু তা কখনো প্রকাশ্যে উচ্চারণ করে না।

এভাবে একটি সংসারের তিন প্রস্থের সন্তানের মধ্যে তাদের মা–বাবার প্রতি ঘৃণা, বিরূপতা, ক্ষোভের কারণে তাদের সুস্থ জীবন গঠনে অন্তরায় সৃষ্টি করে। সংসারের প্রতিটি সন্তানের মধ্যে অসহায়ত্ব, শূন্যতাবোধ, নীরব কান্নার স্রোত বয়ে যায়। পরিবারের বড় ছেলে আনিস ঢাকায় পড়ালেখার জন্য যায় কিন্তু দু’বছরেও একবার বাড়ি আসে না এবং শেষ পর্যন্ত চাকরি নিয়ে পরিবার থেকে দূরেই চলে যায়। ফরিদা পিতার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে সংসার ত্যাগ করে চলে যায়। পড়ালেখা অমনোযোগী রাহুলের অশান্ত মনের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া মাঝে মাঝে প্রকাশ্য রূপ নিয়ে সংসারকে অশান্ত করে তোলে। সংসারে একমাত্র মঞ্জু ধীরস্থির, অনৈতিক ও প্রবৃত্তিপরায়ণতার প্রবল চাপের মধ্যও সে তার সকল যন্ত্রণা ও বেদনা নিয়ে সুস্থ জীবনের আকাঙক্ষায় দৃঢ় থাকে। তার মা সালেহা দ্বিতীয় বিয়ে করেই শান্ত হয়নি। স্বামীর সংসারে থেকেও সে পরপুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। সালেহার এই ইন্দ্রিয় উপভোগ নিজ তরুণী মেয়ে মঞ্জুর সামনে স্পষ্ট হলেও সে কুণ্ঠিত হয় না। তার ব্যভিচারের ঘটনা স্বামীর কাছে ধরা পড়ার পরও সে লজ্জিত হয় না, সংসার ত্যাগ করে না, এমন কি অনৈতিক কাজ থেকে সে নিবৃত্ত হয় না। সালেহার এ বেপরোয়া, নিঃসংকোচ, ভোগপরায়ণতা সংসারটিকে বসবাসের অনুপযোগী করে তোলে। ‘পিঙ্গল আকাশ’ উপন্যাসে মঞ্জুর প্রেক্ষণবিন্দুর মাধ্যমে নারী দেহ মনের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। মঞ্জুর বান্ধবী রঞ্জু, নাসিমা, তাজিনা, মীনা, জেহরা, হাস্না, শেলী, জাহনারা প্রমুখ তরুণীরা তাদের দেহ–মনে তারুণ্যের ছোঁয়া লাগার সঙ্গে সঙ্গে বিচিত্র মানসিকতা ধারণা করে। তারা নিজেদের দেহসৌন্দর্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে, সেই সৌন্দর্যের প্রতি তরুণদের আকর্ষণকে পুঁজি করে জীবন উপভোগের চেষ্টা করে। ফলে এরূপ মোহগ্রন্থ জীবনে নানা দুর্ঘটনা, স্খলন, পতন ঘটে। এভাবে মেয়েদের জীবন বিপন্ন হয়, কেউ কেউ এসব অসততায় অভ্যস্ত হয়ে অন্ধকার জীবনের দিকে পা বাড়ায়। এক্ষেত্রে পুরুষের দেহ লোলুপতা, ভোগবাদী মানসিকতায় মেয়ে অবলীলায় শিকারে পরিণত হয়। লেখক এক্ষেত্রে মেয়েদের ভুল ও অপরিণত মনের প্রান্থগুলোকে পরিচর্য করেছেন। নারী জীবনের দুর্ভোগের কারণ কেবল পুরুষের পাশবিকতা দায়ি নয়, নারীর অসংযত আচরণ, লোভলালসাও অনেকাংশে দায়ি। উপন্যাসের এক জায়গায় মঞ্জু বলছেণ্ড

‘মা’র ভেতরে কোথায় একটা লোভী লোক হাত বাড়িয়ে দেয় সম্মুখের দিকে বারবার’। ‘মার লোভ ছিল রক্তে–মাংসে। লোভের পৃথিবীতে বিরাট উল্লাস রয়েছে। মা জীবনে পেতে চেয়েছিল সেই উল্লাস।… এখন উল্লাসের সেই অভ্যাস তাকে টেনে নামিয়েছে ঘৃণা আর লোভের তরঙ্গিত সমুদ্রে।’

মঞ্জু তার মায়ের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে এভাবে এবং এর মধ্যে দিয়ে মা সালেহার ভোগবাদী মানসিকতা স্পষ্ট হয়। পাশাপাশি পুরুষের পাশবিকতার দিকটিও উন্মোচিত হয় ‘পিঙ্গল আকাশ’ উপন্যাসে।

প্রদোষে প্রাকৃতজন’ (১৯৮৪) উপন্যাসের পটভূমি সেন রাজত্বের শেষ এবং ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের সময়ের। বাংলায় তখন ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, কায়স্থ, শূদ্র বর্ণভেদ প্রথায় বিপর্যস্ত সমাজ। লক্ষণ সেনের রাজধানী ছিল গৌড়। তার নামানুসারে তখন গৌড়ের নাম হয় লক্ষণাবতী। ধোয়ী, শরণ, জয়দেব, গোবর্ধন প্রমুখ ছিল তার রাজসভার কবি। ১২০৪ সালে বখতিয়ার খিলজি যখন লক্ষণ সেনের রাজ্য আক্রমণ করেন। তখন প্রজারা ভেবেছিল ঘোড়া ব্যবসায়ী, রাজ দরবারে ঘোড়া বিক্রি করতে আসছেন। তুর্কিরা এসেই প্রথমে প্রাসাদ রক্ষিদের হত্যা করে। লক্ষণ সেন তখন মধ্যাহ্ন ভোজে লিপ্ত ছিলেন, তুর্কি আক্রমণের কথা শুনে তিনি নগ্নপথে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসের দুই প্রধান চরিত্র শ্যামাঙ্গ ও বসন্তদাস। এ দু’জন প্রাকৃতজন প্রতিনিধি। তাদের ব্যক্তিজীবন, সমাজ পরিস্থিতির মহাসামন্ত হরিসেন এবং পিপ্পলী হাটের ভয়ঙ্কর ঘটনা, যবনদের আগমন নিয়েই উপন্যাসের কাহিনী গড়ে উঠেছে। শ্যামাঙ্গ মৃৎ শিল্পী কিন্তু সে নিজের ইচ্ছে মতো শিল্পকর্ম সৃষ্টি করতে পারে না। বাসুদেব তাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয় না। মন্দিরের গায়ে শ্যামাঙ্গ সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে মৃত্তিকাপটে। কিন্তু বাসুদেব নিষেধ করে– ‘কোনভাবেই তোমার ফলতে ব্রাত্য প্রসঙ্গ না থাকে।’ একোন শাস্ত্রাচার? এ কোন কৌলিন্য প্রথা যে, শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, ক্ষত্রিয়ারাই শ্রেষ্ঠ, উৎকৃষ্ট? শুদ্ররা, নামহারা, গোত্রহারা, অচ্ছুৎ? শ্রামাঙ্গ গুরু বাসুদেবকে প্রশ্ন করেছিলণ্ড ‘গুরুদেব, ব্রাত্য মুখচ্ছবিতে অপরাধ কি?’ মন্দিরে ব্রাত্য মুখচ্ছবি থাকলে তা অপবিত্র হয়। ম্লেচ্ছ, ব্রাত্যদের মন্দিরে প্রবেশাধিকার নেই। গুরুর উত্তরে শ্যামাঙ্গর কৌতূহল মেটেনি। তাহলে দেবতা কি? ভগবান কি? শ্যামাঙ্গ গুরু বাসুদেবকে ত্যাগ করে। শিল্পীর চেতনা তাকে আচ্ছন্ন করে। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈশ্য সুখী কেবল ব্রাত্য শূদ্রের ঘরে অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, গৃহের চালা নেই। তাদেরকে কেবল শুনতে হয় সামন্তদের কর্কশ ধ্বনি-‘দূরহ পামরের দল।’ বসন্তদাস ব্রাত্যজনের এই দুর্দশা লক্ষ করে বলেছেনণ্ড

‘ভাবোতো, যদি সকল প্রাকৃতজন একত্রে…প্রতিরোধ করে তাহলে কি হতে পারে?

যুগ যুগ ধরে প্রাকৃতজন একইভাবে প্রতিরোধ করে। লাঞ্চিত হয়, নিহত হয়, ধ্বংস হয়ে যায়, কিন্তু তথাপি ঐ একই সঙ্গে সে প্রতিরোধ করতে ভোলে না–হয়তো বিচ্ছিন্ন, হয়তো একাকী এবং শাস্ত্রবিহীন তথাপি তার দিক থেকে প্রতিরোধ থেকেই যায়।’ এই প্রাকৃতজনের প্রতিরোধ সংগ্রামের চেতনাকে সঞ্জিবনী মন্ত্রের মতো সঞ্চার করে দিয়েছেন শওকত আলী তাঁর প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসে। মহাসামন্ত হারিসেন একটি মন্দির নির্মাণ করার জন্য তাঁর অঞ্চলের হাটগুলোতে কর বসায়। বড় ছোট সব বণিকই কর দিতে বাধ্য হয়। কর দিতে অস্বীকার করলেই তার পণ্য আত্মসাৎ করে, লাঞ্চনা, অত্যাচার নেমে আসে প্রাকৃতজনের উপর। পিপ্পলী হাটে নৃশংস ঘটনা ঘটে অত্যাচারকে কেন্দ্র করে ব্রাত্যজনের প্রতিবাদের ফলে। পুনর্ভবা, আত্রেয়ী, করতোয়া নদীর উভয় তীরের জনপদগুলোর তখন দুরবস্থা। ঐ অঞ্চলে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের যাতায়াত ছিল। পুনর্ভবা তীরে প্রতাপশালী সামন্তপতি হরিসেন। পিপ্পলী হাটে হরিসেনের কর আদায় করতো ব্রজসেন, তার সঙ্গে ডোম রমণীর কলহ হয়। বজ্রসেন ঐ রমণীকে শাসন করতে গেলে ব্রাত্যজনেরা তার দুই অনুচরকে হত্যা করে। হরিসেন এর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে হাটের বিশাল জনাসমাবেশের মধ্যে ডোম রমণীর যৌনাঙ্গে অগ্নিশলাকা প্রবেশ করিয়ে হত্যা করে। তার দুই শিশুপুত্রকে দ্বিখণ্ডিত করে। উজবটের উত্তরপাট গ্রাম আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। ইতিহাসের তিনটি ঘটনা একবিন্দুতে মিলিত হয়েছে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসে।

লক্ষণসেনের শাসনের অন্তিম পর্যায়ের তিনটি দ্বন্দ্ব– সামন্ত মহাসামন্তদের সঙ্গে ব্রাত্য, প্রাকৃতজনের বিরোধ, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সঙ্গে হিন্দু সনাতন ব্রাহ্মণদের দ্বন্দ্ব এবং যবন তথা তুর্কীদের আক্রমণ। প্রধান চরিত্র শ্যামঙ্গ, বসন্তদাস, লীলাবতী, ময়ারতী, যোগমায়া, দীনদাস, শুকদেব, ছায়াবতী, সোমজিৎ, বিভাবতী, মিত্রানন্দ, মাধব আচার্য। রাজা লক্ষণসেনের প্রধানমন্ত্রী হলায়ুধমিস্ত্র প্রসিদ্ধ পন্ডিত হলেও মূলত কৌলিন্যপ্রথার জবরদস্তিমূলক ব্রাহ্মাণ্য প্রতিনিধি। আমরা দেখি, মৃৎশিল্পী শ্যামাঙ্গ মন্দিরপৃষ্ঠে ব্রাত্যমুখচ্ছবি তৈরি করায় গুরু বসুদেবের গৃহ থেকে বিতাড়িত হয়ে শুকদেবের বাড়িতে আশ্রয় পায়। সেখানে লীলাবতির প্রণয়াসক্ত হয়ে পড়ে। মায়াবতীর অনুরোধে বসন্তদাসকে সন্ধান করতে নবগ্রাম হাটে গিয়ে শ্যামাঙ্গ হরিসেনের সৈন্যের হাতে ধরা পড়ে সর্বস্ব হারিয়ে এক কুম্ভুকারের কাছে আশ্রয় পায়। লীলাবতী হারিসেনের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য পালাতে গিয়ে যবনদের হাতে ধরা পড়ে প্রাণরক্ষার্থে যবন ধর্মগ্রহণ করে কিন্তু শ্যামাঙ্গ বলেণ্ডআমরা এই মৃত্তিকার সন্তান, বহু যুগধরে পুরুষানুক্রমে আমরা নিজ ধর্ম পালন করে আসছি। আমাদের চিন্তাভাবনা, আনন্দ শোক, আবেগ কল্পনা সমস্তই যেমন আমাদের ধর্মাশ্রয়ী।

তেমনি আবার মৃত্তিকাশ্রয়ী, এ ধর্ম ত্যাগ করার অর্থ নিজেকেই ত্যাগ করা।’ বসন্তদাস তার স্ত্রী ময়াবতীর সঙ্গে দাম্পত্য টানাপোড়েন থাকলেও দুষ্কালের দুর্গতি অতিক্রমের জন্য বন্ধু মিত্রানন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কিন্তু শোষণ নিপীড়ন থেকে পরিত্রাণ পায় না। মায়াবতীকে সে বলেণ্ড ‘এই কি মানুষের জীবন? সুখ নেই, স্বস্তি নেই, গৃহ নেই, কেবলই প্রাণ নিয়ে পলায়ন করতে হচ্ছেণ্ড এর শেষ কোথায়? এ জীবন কি যাপন করা যায়? কতদিন এভাবে চলবে? ওদিকে আবার যবনরা আসছে, তাদের তরবারির নিচে কত মানুষের শির ছিন্ন হবে তাও কেউ বলতে পারে না।” ‘প্রদোষে প্রকৃতজন’ এবং ‘দুষ্কালে দিবানিশি’ দুটি পর্বে ভাগ করে লেখক ইতিহাসের এক দ্বন্দ্ব–ক্ষুব্ধ সময়কে শৈল্পিকভাবে পরিচর্যা করেছেন শওকত আলী।

অনুরূপভাবে ‘দক্ষিণায়নের দিন’ ‘কুলায় কালস্রোত’ ‘পূর্বরাত্রি পূর্বদিন’ ট্রিলজি উপন্যাসটিতেও বিভাগোত্তর বাংলাদেশের ষাটের দশকের উত্তাল বাম রাজনৈতিক ধারাকে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেছেন। দক্ষিণায়ন’ শব্দটির অর্থ, সূর্যের দক্ষিণ দিকে গমনকাল–২২ শে জুন থেকে ২২ শে ডিসেম্বর। দক্ষিণপন্থী, অর্থাৎ বামপন্থী রাজনৈতিক ধারার প্রতীকি তাৎপর্যকে অভিব্যঞ্চিত করেছেন নামটি। প্রধান চরিত্র রোকেয়া আহমেদ রাখি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এম এ ডিগ্রি বের হওয়া ছাত্রী, তাকে ঘিরে আবর্তিত হয় উপন্যাসের কাহিনী। প্রথমে ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি, ভালোবেসে ইতিহাসের অধ্যাপক জামানকে বিয়ে করা, জামানের কাছে প্রতারিত হয়ে ঢাকা ছেড়ে ঠাকুরগাঁয়ে কলেজে যোগ দেয়া, সেখানে সেজানের সঙ্গে দেখা, সেজান বাম রাজনীতির আর্দশবাদী কর্মী, কলেজের গভার্নং বোডির প্রধান এসডিও নিজামের লামপট্য, বড় ভাই রাজনৈতিক কর্মী মনির নির্মম মৃত্যু, বড় বোন বুলুর মর্মন্তুদ কাহিনী এভাবে প্রেম অপ্রেমের মধ্যে রাখি সেজানের অনাগত সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে। সেই পেটের সন্তানকে উদ্দেশ্য করে বলে– ‘এই যে রাস্তাটা সেজান মিছিল নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল, তুইও এই রাস্তা দিয়ে মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাস, হ্যাঁরে, পারবি তো?’ এই সংগ্রামশীলতা, এই আন্দোলনের পথে হাঁটতে গিয়ে হয়ত ব্যক্তিজীবন বিপন্ন হয়, ব্যক্তি হয়ত পরাজিত হয় কিন্তু আন্দোলন চলতে থাকে। বেঁচে থাকার সংগ্রাম, টিকে থাকার লড়াই, প্রান্তিক, প্রকৃতজনের এগিয়ে যাওয়ার এই চেতনাকেই শওকত আলী তাঁর উপন্যাসে শিল্পাবায়ব দিয়েছেন। ইতিহাস এবং সময়কে শওকত আলী একটি শিল্পমাত্রা ব্যবহার করেছেন তাঁর সাহিত্যে। সময়ের গর্ভে লুকায়িত সমাজ–সত্যতে ধারণ করা, প্রান্তিক ও প্রাকৃতজনের জীবন তুলে ধরাই ছিল শওকত আলীর সমগ্র জীবনের শিল্প প্রয়াসের প্রধান লক্ষ্য। (সংগৃহীত)

এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত