বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

আকাশলতার সাথে একদিন

আকাশলতার সাথে একদিন

দীপক বড়ুয়া, ০৪ ফেব্রুয়ারি, এবিনিউজ :

ওরা হাঁটে।

একজন মেয়ে। একজন ছেলে। পাশাপাশি।

পেছনে আমি। বিশ বাইশ হাত দুরত্বে। ভোরের আলো থৈ থৈ করে চারদিকে। খাস্তগীর ইশকুলের অপর ফুটপাত ধরে হাঁটছি।

হঠাৎ উ: শব্দ কানে বাজে। দেখি প্রচণ্ড আর্তনাদে সামনের হাঁটা ছেলেটি মাটিতে লুটে ছটফট করছে। পাশে মেয়েটি।

চারজন যুবক বিদ্যুতবেগে আমার পাশ দিয়ে চলে যায়। ওদের চোখেমুখে ভয়। কে যেন বলছিলো, সকালের যাত্রাটা শুভ হলো।

ঘড়ি,মোবাইল,টাকা,সোনার চেইন।

অন্যজনে বলে, বেশি আঘাত করেছিস। ভালো হয়নি কাজটি। পিস্তলের ভয়ে এমনিতেই সব দিয়ে দিতো।

সন্ত্রাসীদেরও ভালো মন আছে তা’হলে।

আমার সামনে মেয়োটি আহত ছেলেকে ধরে কাঁদছে। কি করবে ভাবছে।কাছাকাছি হয়ে প্রশ্ন করি,

–কি – কি হলো?

–আমার স্বামীকে ছুরি মেরে সব কেড়ে নিয়েছে ওরা। প্রচণ্ড রক্ত ঝরছে। আমাকে একটু সাহায্য করবেন?রক্ত বন্ধ না হলে আমার স্বামীকে বাঁচানো যাবেনা।

–কি সাহায্য করবো?

–একটা ট্যাক্সিতে তুলে দেবেন।হাসপাতালে নিয়ে যাবো।

আমারও ভয়ে শরীর কাঁপছে। কি বলবো ভাবি।

আশেপাশে কেউ নেই।থাকলেও দেখে হেঁটে যাচ্ছে।এটা আজকাল নিয়ম।বিপদে কেউ এগিয়ে আসেনা।

একটি ট্যাক্সিকে হাত দেখাতে দাঁড়ায়। দু’জনে ধরে ছেলেটাকে ট্যাক্সিতে বসাতেই মেয়েটি বলে,

–আমার সঙ্গে যাবেন?

আমি চুপ। ভাবি

এসব কাজে জড়াতে নেই। ঝামেলায় পড়তে হয়।

মেয়েটির জন্য করুণা হলো। কিছু না ভেবে ড্রাইভারের পাশে বসি।

মেডিকেল হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে দু’হাতেই ব্যান্ডেজ করার পর রক্ত বন্ধ হয়।ডাক্তার বলেন,

–একটু বসুন।খানিক পরে যাবেন।

আমার বাবা বলতেন,বিপদে রক্ষা করে একমাত্র ধর্ম। তাই প্রতিদিন সকাল–সন্ধ্যা প্রার্থনা করবি।

প্রতিদিন সকালে–সন্ধ্যায় বুদ্ধের সামনে বসে প্রার্থনা করি।আজকেও করেছি। হয়তো তাই আজ বিপদে পড়িনি। বেঁচে গেলাম।এই বিপদটা আমারও হতে পারতো।

মেয়েটি বলে,অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। বিপদে সাহায্য করলেন।

– ওমা ওটা অমন কি? পাশে ছিলাম,তাই করলাম। তা’ এতো সকালে কোথায় যাচ্ছেন?

– মাকে দেখতে। মায়ের প্রেসার বেড়েছে। প্রচণ্ড জ্বরও। ঐতো জামালখানে মার বাসা। জানতাম না হঠাৎ বিপদটা হবে।

–ওরা কি বলেছে?

–পকেটে কি কি আছে দে। দেরি করতেই ছুরি মারলো। অন্যজনের হাতে পিস্তলও ছিলো। কি ভয়ানক ওরা।

–এটা কিছুদিন কম ছিলো।আজকাল বেড়ে গেছে।কিযে হবে দেশের মানুষের!কে নেবে মানুষের নিরাপত্তার দায়িত্ব।

–কেন, সরকার।সরকার নিতে পারে না?

–দেশে কয় কোটি মানুষ আছে জানেন? প্রত্যেকের নিরাপত্তার জন্য কয়জন পুলিশের প্রয়োজন ভাবছেন? সেটাতো কিছুতেই সম্ভব নয়।সত্যি কথা কি জানেন, মানুষের মানবতাবোধ এক্কেবারে নেই।

সভ্যতা বলতে কি আছে। অবক্ষয়তায় দেশ ভরে গেছে।

–তা’হলে কি এই পরিবেশ থেকে মুক্তির কোন পথ নেই?

–আছে।থাকবেনা কেন? নিজেকে ভালো হতে হবে, সৎ হতে হবে। মানুষের প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে। তদুপরি কাজ করতে হবে। কাজ না করে হাইজ্যাক, মাস্তানিতে টাকা ছিনতাইয়ে কি জীবন যাবে? না, তাই সবাইকে কাজ করতে হবে।

– কাজ থাকলেতো!

– কাজ খুঁজতে হবে। চেষ্টা করতে হবে।

– কিছু মনে করবেননা। আপনার পরিচয়টা?

–আমি অতি সাধারণ একজন। কাজ নেই। অবসর জীবন। ডায়াবেটিকস রুগী। ডাক্তারের নির্দেশ প্রতিদিন তিন–চার মাইল হাঁটতে হয়। ঘাম ঝরাতে হয়। তার উপর হাই প্রেসার। সার্সন রোডে বাসা। বাসা থেকে বেরিয়ে জামালখান হেঁটে হেমসেনলেইনে ঢুকে আসকার দিঘির পশ্চিম পাড় হয়ে বাসায় ফেরা। আর আপনাদের পরিচয়।

–আমি লুৎফর নাহার লতা।স্বামী আসাদুজ্জামান আকাশ। ব্যাংকার।

–ছেলে মেয়ে?

–বিয়ে হলো বছরখানেক। এখনও ভাবিনি সন্তানের কথা।

–ভুল করেছেন এটা। আজকাল ছেলে বউদের সন্তান আসেনা। বড়ো দুঃখে আছে।বিয়ের পরপর সন্তান নেয়াটা মঙ্গল। তা’ছাড়া মানুষ করার ব্যাপার আছে না!

–সত্যিতো, ঠিক বলেছেন। কোনদিনও ভাবিনি। আমার স্বামীও। আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলে চলতে আগ্রহী। আমিও তাই। দুজনে তিনজন হতে সহজ। আগে জীবনের সখটাতো মিটাই।

–জানেন,জীবনটা খুবই ছোট।বড়ো নয়।সত্যি কথা কি,আমরা ভাবি বয়স বাড়ছে। আসলে তা নয়। জীবন থেকে বয়সটা ধীরধীরে কমছে। ক্রমশ: মৃত্যুর দিকে পা রাখছি।

মেয়েটি আমার কথায় চুপ থাকে। কিছু বলেনা। একটু পরে বলে,

–আমরা তা’হলে ভুল করলাম?

–আমার মনেতো তাই। দেরী করা ঠিক নয়।

–এবার আপনার কথা বলুন। কে কে আছে?

–আমি, আমার স্ত্রী, ছেলে, ছেলের বউ,নাতনি।জানেন লতা, বড্ডো সুখের ছোট্ট ঘর আমাদের।

আহামরি টাকাকড়ি নেই ঠিক। কিন্তু সুখ সংসার সাগরে ভীষণ আনন্দে আছি।

আকাশ বলে,-লতা, চলো এবার ফিরি।

–কেমন লাগছে এখন। আমি প্রশ্ন করি।

–অনেকটা ভালো। আপনার কাছে অনেক ঋণী।

– ছিঃ, এটা কি বলছেন। সব মানুষের নৈতিক দায়িত্ব এটা।

–কেউতো আসেনি সাহায্য করতে।

–কেউ না কেউ অবশ্যই আসতো।

লতা বলে, কিছুক্ষণ আগে ধর্মের কি যেন বলছিলেন, ধর্ম মানুষকে ভয়ানক বিপদ থেকে রক্ষা করেণ। আজ সেটা উপলব্ধি করলাম।

–যেমন!

–আমার স্বামী একজন ব্যাংক ম্যানেজার। শত ব্যস্ততার মাঝেও পাঁচবার নামাজ পড়ে। হয়তো সেই একটি কারণে আজ বেঁচে গেলো। জীবনের প্রদীপটা নিভতে পারতো সহজে। নিশ্চয়ই ধর্মই রক্ষা করলো। আল্লাহ মেহেরবান। আল্লাহকে ধন্যবাদ।

–সত্যি তাই।আর দেরি নয়। এবার বাসায় ফেরা যাক।আকাশের বিশ্রামের প্রয়োজন।

–হ্যাঁ, তা’হলে তাই করি।

–আমি একটি ট্যাক্সি দেখি।

বাইরে অনেক ট্যাক্সি।

হাত ইশারায় একটি ট্যাক্সি দাঁড়ায়। আমি ডাকলাম, লতা আসেন।

আমি আকাশকে এক হাতে, লতা আরেকটা হাত ধরে আকাশকে তুলে দেই।

কি ভেবে লতা আমার পায়ে হাত রেখে বলে,

–আপনি আজ বাবার কাজটি করেছেন। আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। আমাদের দোয়া করবেন। কিছুদিনের মধ্যে যেন একজন গর্বিত মা হতে পারি।

আমি লতার সুন্দর কথাটির উপযুক্ত কোন উত্তর খুঁজে পাইনি তখন। ফাঁকে লতা ট্যাক্সিতে উঠতেই সোঁসোঁ শব্দে ট্যাক্সিটা চলে যায়।

ট্যাক্সির চলে যাওয়া দেখে ভাবি,

কি আশ্চর্য! এযুগে এখনও শ্রদ্ধা,সম্মান করার ছেলেমেয়ে আছে।

(সংগৃহীত)

এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত