![মুক্ত ও কান্তিযুক্ত](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/02/05/kanti_124450.jpg)
মহীবুল আজিজ, ০৫ ফেব্রুয়ারি, এবিনিউজ : রুদ্ধতার প্রেক্ষাপটে এমন শিরোনাম আশাপ্রদ করে কিংবা আনন্দ দেয় কিন্তু যে মুক্তির প্রত্যাশী এবং যে সুন্দরের অন্বেষী তার পথ কতটা মসৃণ সেটাই বিবেচ্য। জিওডার্নো ব্রুনো’র হত্যাকাণ্ডের জন্যে আজ ভ্যাটিকানের মানুষেরাই দুঃখবোধ করে কিন্তু সেদিন তাঁর বিজ্ঞানকে কর্তৃপক্ষ ব্লাসফেমি বলে রায় দিয়েছিল। অনিন্দ্য আবিষ্কারের জন্যে আমরা গ্যালিলিওর প্রশংসায় মুখর কিন্তু তাঁকেও প্রার্থনা করতে হয়েছিল মা। বিজ্ঞান যে সত্য ও সুন্দরের শক্তি দিয়ে এই সমগ্র বিশ্বকে, বিশ্বের মানুষকে সামনে যাওয়ার জন্যে সহায়তা যুগিয়ে যাচ্ছে সেই বিজ্ঞানকেও দাঁড়াতে হয় কাঠগড়ায়। তাই সত্য–সুন্দরের অন্বেষা কথাটা শুনতে যতই মধুর লাগে বাস্তবে তা রূঢ়–কঠিন আয়তনের আঁচে দগ্ধ প্রতিনিয়ত।
প্রণয় কান্তি এমনই এক সত্য–সুন্দরের প্রত্যাশী ছিলেন। ‘ছিলেন’ কথাটা বলতে হয় দুঃখের সঙ্গে। মরণব্যাধি তাঁকে তাঁর যাত্রাপথ থেকে সহসা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে হ্যাঁচ্কা টানে। যে–যাত্রা তাঁর শুরু হয়েছিল ছাত্রজীবন থেকে তার আকস্মিক যতিপাত না ঘটলে তিনি নিশ্চয়ই আরও ফলপ্রসূ হতেন। সেই প্রায় ঊষাকালে এই শহর পেয়েছিল তাঁর সুমনের পরিচয়। প্রগতিশীল ভাবনাঋদ্ধতায় শুধু নয় জীবনবিরোধী শক্তির বিপক্ষে লড়ুয়ে হওয়ার মানসিকতা তাঁর সহজাত। যখন কালান্তক ব্যাধির কবলে তখনও তিনি নিভে যেতে দেন না তাঁর আলোর আধারটিকে। ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যয়নের সুবাদে পাশ্চাত্যের চিন্তা–দর্শন–সাহিত্য প্রভৃতির বিস্তর পাঠের অবকাশ তাঁর হয়। অথচ পাশ্চাত্যের এই আলোকাবগাহন তাঁকে উন্মূল বা উন্মার্গ করে না। তাঁর সমস্ত ভাবনার কেন্দ্রে থাকে স্বদেশ–স্বজাতির কল্যাণ–চেতনা। যেসব লেখালেখি তিনি রেখে গেছেন এবং যেগুলোর বৃহদংশই আজও অগ্রন্থিত সেসব পাঠের সুযোগ যাঁদের ঘটেছিল তাঁরা অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন কেন তাঁর কবিতার বইয়ের নাম হয় ‘বুদ্ধির মুক্তি’ যিনি ‘অধরা মাধুরী’র পরে ভেসে যেতে পারতেন অধিকাবেগের স্রোতে। ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আমাদের মনে করিয়ে দেয় গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকের আলোকমুখী মননযাত্রাকে। তাহলে কী আলোকের গন্তব্য আজও অধরা রয়ে গেছে। এর জবাব হ্যাঁ–বোধক হলে বুঝতে হবে তাঁর ‘মাধুরী’ বহু কারণেই অধরা। এবং তাঁর মাধুরী আবেগের আতিশয্যে ভেসে গিয়ে প্রাপ্তির ঘোরে উদ্বেল নয়, সেখানে মিশে রয়েছে এক অপ্রাপ্তিজনিত দীর্ঘশ্বাস।
মূলত বিজ্ঞানচেতন গদ্য এবং কবিতা এই দুই ডানায় ভর করে পথ কাটতে চেয়েছিলেন প্রণয় কান্তি। যে–রুদ্ধতার কথা বলা গেল লেখাটার গোড়াতেই তাঁর গদ্য ছিল সেই রুদ্ধতাকে লক্ষ্য করে ছোঁড়া পার্থ–তীর। বৈরিতার প্রেক্ষাপটে অনেককেই আমরা দেখেছি রূপক–প্রতীকের আড়ালে ভাষ্য রচনা করতে। কিন্তু প্রণয় কান্তি বক্তব্য–প্রকাশে ছিলেন দৃঢ় ও সাহসী। যুক্তি তাঁর প্রাথমিক হাতিয়ার। ‘শিখা’–গোষ্ঠী নিঃসন্দেহে একটা ঐতিহাসিক প্রণোদনা তাঁকে যোগায় যেহেতু তাঁর বইতে জেনেশুনেই তিনি সে–নাম গ্রহণ করেন। আসলে যাকে তিনি বুদ্ধি বলতে চান সেটা হচ্ছে যুক্তি আর কে না জানে যুক্তির নেপথ্যে থাকে বিজ্ঞানের শক্তি। সাহিত্যেস্নাত প্রণয় কান্তির মন ও মননে প্রকৃত অধিবাস ছিল বৈজ্ঞানিক জিগীষার। ফলে, তিনি প্রবলভাবে ইহজাগতিক। তাঁর কবিতায়ও তাঁর সেই ইহজাগতিকতাকে অনুভব করা যাবে। ধরা যাক তাঁর ‘বুদ্ধির মুক্তি’র প্রথম কবিতাটির কথাণ্ড এটির শিরোনাম ‘ভালোবাসার সমীকরণ’। কবিতাটিতে কবির আরাধ্য জনের প্রতিকৃতিটা এসেছে এভাবেণ্ড
“প্রিয়তম মানুষ হও,
পুরুষ নয়… মানুষ হও
হয়ে ওঠো আলোকিত মানুষ আমার ভালোবাসায়।
মনে রেখো, আমি এসেছি তোমায় সেই মানুষ বানাতে।”
প্রণয়কান্তির অনেকগুলি কবিতার কথা বলা যাবে যেখানে পুরুষ আর মানুষের মধ্যে চলে দ্বৈরথ। বস্তুত তাঁর নিজের ভেতরকার পুরুষ–সত্তার উপলব্ধি থেকে তিনি চলে যান অন্য এক উপলব্ধির দিক যে–জায়গাটাতে ‘অপর’–সত্তার জন্যে সংরক্ষিত থাকে খানিকটা জমিন। যে–পুরুষের বিসর্জন তাঁর চিন্তা ও দর্শনের একটি কেন্দ্রীয় বিষয়। প্রেমের মধ্যেও প্রণয় কান্তির অন্বেষণ পুরুষ–বিযুক্ত অবস্থিতিণ্ড ‘পুরুষ নাকি প্রেমিক’ নামক কবিতা থেকে চারটে লাইন পড়ে দেখা যাকণ্ড
“তুমি পুরুষ হলে চাইবে উগ্র জাতীয়তাবাদ
তুমি প্রেমিক হলে চাইবে বিশ্ব মানবতাবাদ
তুমি পুরুষ হলে বন্ধ করবে আমার সার্বিক বিকাশ
তুমি প্রেমিক হলে মুক্ত থাকবে আমার সকল আকাশ।”
কবির পুরুষ–ভাবনা কখনও–কখনও পৌঁছায় এক উত্তুঙ্গ অবস্থানে যেখানে কবি নিজেকে কল্পনা করেন অপৌরুষেয় সত্তায়। রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা চরিত্রটি মনে পড়ে। চিত্রাঙ্গদায় বিশ্বকবি প্রকৃতির মৌন শক্তির গভীরে নিহিত এ্যানথ্রোপি’র মত স্ফূরণ– ক্ষমতার সম্ভাবনাকে চিত্রিত করেছেন। প্রচলিত দৃষ্টির নারীসত্তাকে বদলে দিয়ে চরিত্রের ভেতরকার সম্ভাবনাকে তিনি যাচাই করে দেখেছেন। বলতে পারি চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের কথা যাঁর বিন্যাসে অনুপম নারী আরও অকল্পনীয় অনুপম হয়ে ওঠে তাদের মৃত্তিকা তথা সৃষ্টিসংলগ্ন পটক্ষেপে পেশল শক্তিমূর্ততায়। প্রণয়কান্তি নারীকে কামনা করেন তার শতভাগ বিকশিত সত্তায়, নইলে সে–নারী তাঁর নিকটে ‘ক্রীতদাসের’ মতন। কাজেই নারীকে তিনি বলছেনণ্ড “এখনই সময়/ যাও উড়ে বৃত্ত ছেড়ে মুক্ত চিন্তার আভাসে।” প্রশ্ন উঠতে পারে, কীভাবে নারী উড়বে বৃত্ত ছেড়ে। আমাদের মনে পড়বে ইবসেনের ডলস্ হাউজ নাটকের কথা যেখানে নোরা তার স্বামীর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে এবং নরওয়েতে নাট্যমঞ্চে এই দৃশ্যটাই অবিকল দেখানো হয়েছিল তখন। অন্যদিকে একই নাটকের জার্মান অনুবাদে দেখা যাবে, নোরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে–পড়তে মঞ্চের ভেতরের দিকে মানে অন্তপুরের দিকে ঢুকে যাচ্ছে আবার ইংরেজি অনুবাদে সেখানকার দর্শকদের সামনে ইবসেনের নোরা কাঁদতে–কাঁদতে মুখ ঢেকে ফেলে এবং তার সামনে দিয়ে যবনিকা পড়ে যেতে থাকে। তাই দেখা যাচ্ছে, নোরা চরিত্রটিরও আসলে অনুবাদ হয়ে গেল। মূল নোরার ভার্সান হলো অন্তত আরও বাড়তি দু’টি। নোরার এই রূপান্তর তিনভাবে হওয়ার কারণ নিহিত ছিল নরওয়ে–জার্মানি এবং ইংল্যান্ডের সামাজিক প্রেক্ষাপটের মধ্যে। রক্ষণশীল মন নোরার রূপান্তরকে গ্রহণ করতে অপারগ ছিল।
প্রণয় কান্তির আরাধ্য নারী অবশ্যই বৈপ্লবিক, তাই উদার এবং সবচেয়ে বড় কথা সে পুরুষের সমান্তরাল সহযাত্রী। ‘ভালোবাসার বসতবাটি’ কবিতায় অনেকটা আরোহী দার্শনিকতার ঢংয়ে উত্থাপিত হয়েছে বিষয়টিণ্ড
“প্রথম এসেছে কে আমিনা তুমি?
কোন্ সে সত্তা? পুং না স্ত্রী? … …
প্রাণ যদি জল হয়
জল হয় যদি মেঘ আর জলাশয়
প্রাণ তবে কী হলো?
প্রাণ ভেঙে হলো সত্তা পুং আর স্ত্রী
দুই ধারা মিলে সাজায় প্রকৃতি”
নারী–সম্পর্কিত জিজ্ঞাসাটিকে নমুনা হিসেবে নিলে প্রণয় কান্তির চেতনাটিকে বুঝতে পারা যায়। নারীর সত্তা তাঁর মধ্যে মীমাংসিতভাবে বিরাজমান। কিন্তু কথা হলো তাঁর সেই মীমাংসা সমাজের নিকটেও মীমাংসা কিনা। প্রণয় কান্তির মতন যাঁরা এরকম শুভত্বের প্রেরণায় জীবন ও জগতকে স্বচ্ছ দৃষ্টিতে দেখতে চান তাঁদেরই কিন্তু অন্তিমে পোহাতে হয় কষ্ট ও দুঃখ। সেটা আমরা যেমন জানি, কবির নিজেরও তা জানাণ্ড “ভুলের কারাগারে বন্দীর অঝোর ক্রন্দন”। রক্তপাত জেনেও কবির তবু মাথা ঠুকে যাওয়া কোন এক অশেষ অসম্ভবের পায়ে।
কবি প্রণয় কান্তিকে দেখতে গিয়েছিলাম যখন তিনি অন্তিম শয্যায়। দেখতে পাই জীবন তাঁকে প্রবলভাবে জীর্ণ করে দিয়েছে। সব কিছু লুণ্ঠন করে নিয়ে গেছে। জীবনের সঙ্গে তাঁর ধস্তাধস্তির প্রভূত ছাপ তাঁর শারীরাঙ্গিকে কিন্তু মনের মধ্যে তখনও তিনি জ্বালিয়ে রেখেছেন আশ্চর্য আলোক। প্রায় ভাবলেশহীন বা প্রতিক্রিয়াশূন্য তাঁর কণ্ঠেও কিন্তু ছিল না রোগ–শোকের কথা। নেই কোথাও কোন সমর্পণ–শঙ্কার চিহ্ন। তিনি বলছিলেন লেখালেখির কথা, নানা পরিকল্পনার কথা, অসমাপ্ত বা মাঝপথে থেমে পড়া কর্মের কথা। মানুষের জীবনের একটা বড় বেদনা তো তার এই অপরিতৃপ্তি। প্রণয় কান্তি কিন্তু তার জন্যেও করেন না খেদ। আলতো স্বরে তিনি আমাকে বলছিলেন, বহুদিন এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা হলো, এখন অন্য এক অভিমুখে যেতে হবে। আমি মনে–মনে ভাবি কী সেই অভিমুখ! প্রণয় কান্তি আমাকে বলেন, তাঁর সেই নির্মোহ–নিজস্ব স্বরেণ্ড বহুদিন বেঁচে থাকা হলো, এখন মেঘের কাছে যাচ্ছি। তাহলে জীবন থেকে চলে যাওয়া মানে উড়ে মেঘের কাছে চলে যাওয়া। সেটা বলতে তিনি কী বোঝাচ্ছিলেন আমি জানি না কিন্তু অবশ্যই বোঝান নি কোন স্বর্গ বা নরককে, কেননা, অলৌকিক নয় এই বিশ্বতেই তিনি স্বর্গ–নরকের অধিষ্ঠান বর্তমান বলে বিশ্বাস করতেন। তাহলে মেঘ মানে আসলে কল্পনাণ্ড কল্পনাই তখন প্রণয় কান্তির সান্ত্বনা। আমার তখন মনে পড়ে ভ্লাদিমির মায়াকভস্কিকে। তাঁর ‘ক্লাউড ইন প্যান্টস্’ (পাতলুনে মেঘ) কবিতা। দীর্ঘ কবিতাটির পংক্তিগুলো উচ্ছ্রিত হতে–হতে আসে আমার দিকেণ্ড
“আগুন লেগে পুড়ে যাচ্ছে যে–ঘর
কখনও–কখনও হতে পারে তা–ও
যাযাবরের আশ্রয়।”
প্রণয় কান্তি চলে যাচ্ছেন, সবাই তাই ভাবছিলণ্ড হয় আজ নয় কাল নয় পরশু। হয়তো তিনি নিজেও ভাবছিলেন তাঁর সেই অন্তিম যাত্রা সম্পর্কে। সারাজীবন বাস্তবের মধ্যে লিপ্ত থেকে, কঠিন–কঠোরভাবে লিপ্ত থেকে এই অন্তিমে এসে তিনি বললেনণ্ড মেঘের কাছে যাচ্ছি। কবি–প্রাবন্ধিক প্রণয় কান্তি কী নিজেকে নিয়ে লেখা কোন এক গ্রন্থের নামকরণ করে গেলেনণ্ড ‘মেঘের কাছে যাচ্ছি’! মেঘ সুদূরে থাকলেও বাস্তব, দেখা যায়। যা দৃশ্যমান নয় তাতে প্রণয় কান্তির বিশ্বাস ছিল না। (সংগৃহীত)
এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি