![সাম্প্রতিক শিক্ষা ও শিক্ষক আন্দোলনের গতিপ্রবণতা: একটি আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/02/06/non-mpo_124610.jpg)
কানাই দাশ, ০৬ ফেব্রুয়ারি, এবিনিউজ : আমাদের দেশের পুরো শিক্ষাব্যবস্থা যে সংকটগ্রস্ত হয়ে পড়েছে তা এখন আর যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। গত কয়েক মাস ধরে সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন স্তরের শিক্ষকদের একের পর এক আন্দোলন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে প্রকৃত অর্থেই শিক্ষা তথা মানবসম্পদ উন্নয়নের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত নিয়ে নৈরাজ্য চলছে এবং শিক্ষার ব্যবস্থাপনা ও অর্থায়নের প্রশ্নে এ সরকারের সাথে অতীতের কোন সরকারের পার্থক্য নেই বরং ’৭৫ সালের পর থেকে প্রত্যেকটি সরকার শিক্ষা ও শিক্ষকদের সমস্যা ও সংকট নিয়ে এক ধরনের কপটতার আশ্রয় নিয়ে চলেছে এবং শিক্ষাখাতে বিশেষ করে দেশের শিক্ষার ৯০ শতাংশের ভার বহনকারী বেসরকারি শিক্ষার বিনিয়োগকে অপচয় বলে মনে করেছে। বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবারো বেসরকারি শিক্ষকদের এম.পি.ও.ভুক্তিকে “বোগাস” সিস্টেম বলে অভিহিত করেছেন। আরেকটি চমকপ্রদ তথ্য জানলাম তাঁর সাম্প্রতিক বক্তব্য থেকে যেণ্ড শিক্ষানীতি ২০১০ নাকি তাঁর নিজের হাতে ড্রাফট করা এবং সেই পলিসি নিয়ে তিনি কাজ করছেন। শিক্ষানীতি প্রণয়ন, শিক্ষার অর্থায়ন, পলিসি নির্ধারণসহ মূল কাজগুলো যদি দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বাদ দিয়ে অর্থমন্ত্রী নিজের চিন্তা অনুযায়ী করে থাকেন তাহলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দু’জন মন্ত্রী রাখার প্রয়োজন কি আমার বোধগম্য নয়। অনেক ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতাসহ শিক্ষানীতি ২০১০ শিক্ষক সমাজ মেনে নেয়ার পরেও সরকার তা বাস্তবায়ন যে করছে না তা শিক্ষকদের দাবি ও বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট। অনেকেই বলবেন সরকারের শেষ বছরে অনেকটা চাপ প্রয়োগের কৌশল থেকে শিক্ষক সমাজের নানা অংশ একের পর এক আন্দোলনে নেমেছে। কথাটা হয়তো আংশিক সত্য কিন্তু শিক্ষকদের দাবিগুলো কী অযৌক্তিক বা নতুন কোন কিছু? সরকার ও আমলাতন্ত্রের ক্রমাগত অবহেলা, তাচ্ছিল্য, ঔদাসীন্য আজকে শিক্ষকদের পথে ঠেলে দিয়েছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন বৈষম্যের আন্দোলন, সরকারি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নন এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির আন্দোলন, এবতেদায়ী মাদ্রাসা জাতীয়করণের দাবিতে মাদ্রাসা শিক্ষকদের আন্দোলন এবং সবশেষে এমপিওভুক্ত সাড়ে ৫ লাখ বেসরকারি শিক্ষকদের ৯টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত শিক্ষক–কর্মচারী সংগ্রাম কমিটির শিক্ষা জাতীয়করণসহ ১১ দফার চলমান আন্দোলন দেশের শিক্ষাঙ্গনকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। শিক্ষার সংকটসহ শিক্ষকদের আর্থিক সব দাবিগুলোর মূল নির্যাস হলো শিক্ষা জাতীয়করণ ও শিক্ষা খাতে ইউনেস্কো সুপারিশ মোতাবেক পর্যাপ্ত নয় বরং প্রয়োজনীয় বরাদ্দ প্রদানের দাবি। ১৯৯৬ থেকে এ সরকার তার ৩ মেয়াদে ১৪ বছর সময়কালে এ দুটো মৌলিক দাবির কোনটাকেই গুরুত্ব দেয়নি। মনে রাখতে হবে শিক্ষা জাতীয়করণ শুধুমাত্র শিক্ষকদের প্রয়োজনে নয় শিক্ষক–শিক্ষার্থী ও শিক্ষার সামগ্রিক সংকট মেটাতে শিক্ষার দায়িত্ব সরকারের হাতে তুলে নেয়ার নামই তো শিক্ষা জাতীয়করণ। এ নীতি কি ’৭২ এর বঙ্গবন্ধু প্রণীত সংবিধানের মৌলিক নাগরিক অধিকার ও ড. কুদরত–ই–খুদা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশের সাথে সাংঘর্ষিক? তাই যদি না হবে তাহলে বঙ্গবন্ধুর নামে দল ও সরকার চালিয়ে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও কাজ মানব সম্পদ গড়ে তোলা এবং সচেতন, দেশ–প্রেমিক সেকুলার তথা সোনার মানুষ গড়ে তোলার বঙ্গবন্ধুর আরদ্ধ স্বপ্নকে তাচ্ছিল্য করার দুঃসাহস অর্থমন্ত্রণালয় ও আমলারা পায় কোথা থেকে? এসব আন্দোলনের পাশাপাশি আমার মত অবসরে যাওয়া হাজার হাজার শিক্ষক যদি কয়েক বছর বকেয়া পড়ে থাকা তাদের ন্যায্য অবসরভাতা ও কল্যাণ ফান্ডের টাকার জন্য এ মুহূর্তে পথে নামেন বা জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে অনশনে যান তাঁদের কি দোষ দেয়া যাবে? শিক্ষক সমিতিগুলো হিসাব করে দেখিয়েছে সরকার যদি এম.পি.ও.ভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর টাকা সরকারি ফান্ডে নিয়ে যায় তাহলে সরকার ঐ সমস্ত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের বেতন ও প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো উন্নয়ন বাবদ যে টাকা বর্তমানে দিচ্ছেন তা থেকে সামান্য বাড়তি দিলে শিক্ষা জাতীয়করণ করা যায় বরং তাতে সরকার আর্থিকভাবে লাভবান হয়। এতে করে শিক্ষার বাণিজ্যায়ন কমবে, নানা কিসিমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হবে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জঙ্গী তৈরির বিপদ অনেকাংশে হ্রাস পাবে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এ সরকার আর্থ–সামাজিক প্রশ্নে সামরিক সরকারগুলোর পদাংকই অনুসরণ করছে।
আমাদের দেশের রাজনীতিতে, দুই বৃহৎ দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মধ্যে ন্যূনতম কার্যকর সম্পর্ক ও সৌহার্দ্য নেই। কিন্তু শিক্ষা ও শিক্ষকদের সমস্যার প্রশ্নে অভিন্ন অবস্থানের কারণে জাতীয় পার্টি, বিএনপি–জামাত জোট সরকার ও মহাজোট তথা আওয়ামী লীগ সরকারসহ প্রত্যেকটি সরকারের আমলে শিক্ষকদের বার বার রাজপথে নামতে হয়েছে। এ গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে এ তিন দলীয় সরকার যে কার্যত এক তার আরেকটি জ্বলন্ত উদাহরণ হলো শিক্ষায় অর্থায়ন নিয়ে তাদের একই বিন্দুতে অবস্থান। প্রত্যেকটি দেশের আর্থিক সক্ষমতা ও শিক্ষার গুরুত্ব বিবেচনা করে শিক্ষাখাতে রাজস্ব বাজেটের ন্যূনতম শতকরা ৬ ভাগ ব্যয় করার ইউনেস্কোর জোর সুপারিশ থাকলেও বিগত ৪৬ বছরে বাংলাদেশে তা কখনো শতকরা ২.৫ ভাগের উপরে উঠেনি এবং ২০১৫ সালের বাজেটের মত মাঝে মধ্যেই তা শতকরা ২ শতাংশেরও নীচে নেমে গেছে। বলাবাহুল্য হবে না যে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের শিক্ষাখাতের ব্যয় সর্বনিম্ন। এর মধ্যেও শিক্ষার যদি কোন অগ্রগতি হয়ে থাকে তার জন্য শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের ধন্যবাদ জানাতেই হয় বৈকি।
শিক্ষকদের আর্থিক সমস্যা ও পেশাগত নিরাপত্তার দাবি–দাওয়ার কথা ছাড়াও রয়েছে বিরাজমান শিক্ষা সংকট নিরসনের দাবি। সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার মানের অধোগতিসহ শিক্ষা সংকট ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। শিক্ষার নির্বিচার প্রাইভেটাইজেশন, প্রশ্নপত্র ফাঁস, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী তথা সাম্প্রদায়িক পাঠক্রম, শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় গণবিরোধী আমলাতন্ত্রিক খবরদারি, অপরিকল্পিত ও সার্কুলারভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনা, শিক্ষক নির্যাতন, ছাত্র রাজনীতির নামে ক্ষমতাসীনদের ছাত্র ক্যাডারদের দুর্বৃত্তপনা, চাঁদাবাজি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দখল ইত্যাদি হল আমাদের দেশের শিক্ষা সংকটের কিছু বৈশিষ্ট্য। এছাড়াও রয়েছে বহুমুখী শিক্ষার ধারা বা নানা মাধ্যম এবং পাঠক্রমভিত্তিক বহুধাবিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থা। শুধু প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে ১৩ রকমের পাঠক্রম ও প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও মাধ্যমিক পর্যায়ে রয়েছে অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজ এর সিলেবাস ভিত্তিক ‘ও’ লেভেল এবং ‘এ’ লেভেলের মতো ব্যয়বহুল বিলাসী ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাক্রম, বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমের ন্যাশনাল কারিকুলাম ভিত্তিক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাক্রম, মাদ্রাসাভিত্তিক পাঠক্রম, যা আবার খারিজি আর কওমী দুই ধারায় বিভক্ত। মোটামুটি এ চার ধারায় বিভক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মান ও মনন পরস্পর বিপরীত। এটা বুঝবার জন্য যদি চার ধরনের প্রতিষ্ঠানের একই শ্রেণির ৪ জন শিক্ষার্থীকে এক জায়গায় জড়ো করা হয় দেখা যাবেণ্ড এরা কেউ কাউকে চিনেনা। মনে–মননে, আদব–কায়দায়, পোশাক–পরিচ্ছদে, রুচি–সংস্কৃতিতে এরা পরস্পর থেকে অনেক অনেক দূরে। এভাবে আমাদের দেশকে আমরা ইতোমধ্যে খন্ডবিখন্ড করে ফেলেছি। মাদ্রাসা শিক্ষার পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষা ও ইংরেজি মাধ্যমের বেশকিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে একটি ছাড়া অন্য কোনো সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয় না এবং সেখানে উন্নত শিক্ষার নামে আধুনিক ইংরেজি শিক্ষা আর ধর্ম শিক্ষার এক ককটেল পরিবেশন করা হচ্ছে আর শিক্ষার্থীদের ধর্মাশ্রয়ী আচার–আচরণ, আদব–কায়দা, রুচি–সংস্কৃতিতে গড়ে তোলা হচ্ছে। আইডিয়াল স্কুলের নামে চলছে সমাজে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের রুচিহীন ঘৃণা ও পরমত অসহিষ্ণুতার নন আইডিয়াল কর্মকান্ড। সরকার বিরোধী দলকে মাঠছাড়া করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কিন্তু সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক ও বহুমুখী শিক্ষার কারণে মননের মাঠে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী, মুক্তচিন্তা বিরোধী শক্তির কাছে নতজানু হয়ে চলেছে। এভাবে সাম্প্রদায়িক সামাজিক মনস্তত্ত্ব ক্রমে পুরো সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী শিবিরের শক্তি এখানেই। শিক্ষা বাণিজ্য হল সমাজে সাম্প্রদায়িকতা প্রসারে কার্যকর হাতিয়ার। (চলবে)
লেখক : অধ্যাপক, কলাম লেখক
(সংগৃহীত)