![পাপ বাপকেও ছাড়ে না](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/02/07/bru_abnews_124853.jpg)
মশিউর রহমান, ০৭ ফেব্রুয়ারি, এবিনিউজ : পরপর তিনবার দুর্নীতিতে হ্যাট্রিক করতে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়েছিল তারা। তাদের নেতৃত্বেই বাংলাদেশ হয়েছিল যুদ্ধাপরাধী আর চোর রাঘব বোয়ালদের অভয়ারণ্য। গণতন্ত্র হত্যা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতীসহ দেশের সার্বভৌমত্ব ধুলিস্যাৎ করার অপচেষ্টাও হয়েছিল বারবার তাদেরই মাধ্যমে। কে বা কারা তারা?
পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদী আদর্শ বুকে ধারণ করে ক্যান্টনমেন্ট থেকে জন্ম নেওয়া সেই অপরাজনৈতিক দলের কর্ণাধার তারা। জনগণের পরিশ্রমের ঘাম মিশ্রিত রাজস্বের যে টাকা ব্যয় হবার কথা ছিল আর্তমানবতার সেবায়। সেই টাকা দিয়ে তারা নির্মাণ করেছিল পাহাড়সম দুর্নীতির এক মহাদুর্গ! বিশ্বজনীন দুর্নীতিতেও অবদান কম নয় তাদের! সামঞ্জস্যহীন জীবনমান ও ভঙ্গুর অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করা দেশটিকে মিত্রতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে যখন বহির্বিশ্বের দেশগুলো ত্রাণ তথা অর্থ সাহায্য পাঠাতো, সেই অর্থও নিজেদের কুক্ষিগত রাখতে ভুল করেনি জাতীয়তাবাদের নামধারী এই দলটি। এমনিভাবেই বাংলার মেহনতি মানুষের রক্ত পান করা আরেক ইতিহাসের নাম জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট তথা জিয়া এতিমখানা। এটি এমন এক এতিম খানা যার আদৌ কোন ঠিকানা বা অস্তিত্ব আজ পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়নি দেশবাসীর কাছে।
বেগম খালেদা জিয়ার সীমাহীন দুর্নীতি যজ্ঞের ফসল এই জিয়া এতিম খানা। প্রশ্ন হচ্ছে কোথায় এই এতিমখানা? বেগম খালেদা জিয়া বা তার সম্মানিত আইনজীবিগণ এখন পর্যন্ত কোনো ঠিকানা উল্লেখ করতে পারেননি এই এতিমখানার। হ্যাঁ! তারা অবশ্য ঠিকানা দিয়েছেন একটা। ক্যান্টনমেন্টের মইনুল রোডের বেগম খালেদা জিয়ার বাসভবন! হাস্যকর সত্য হলো, ব্যক্তিগত ঠিকানায় এতিমখানার ঠিকানা দেওয়া যায় না এমন আইন থাকলেও বেগম খালেদা জিয়ার কথিত এতিমখানা তার নিজ বাস ভবনেই অবস্থিত! তাহলে কে বা কারা থাকে এই এতিমখানায়? নিয়ম অনুযায়ী, কোনো এতিম খানায় অন্তত দশজন এতিম থাকতে হয়। কিন্তু তথ্যানুসন্ধানে এরকম কোনো তথ্য পায়নি বিজ্ঞ আদালত। এমনকি বেগম খালেদা জিয়ার নিজের পরিবারকে ধরলেও দশ জন সদস্য পূর্ণ হয় না। তাহলে এ কেমন এতিমখানা? কার অনুমতি নিয়ে কিসের ভিত্তিতে এতিমখানা গঠন করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া? এতিমখানা বা অরফানেজ গঠন করার জন্য সমাজ কল্যান মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেওয়ার বিধান আছে বাংলাদেশের সংবিধানে। কিন্তু জিয়া অরফানেজ গঠনের জন্য অনুমতি নেওয়ার কোনো তথ্য বা নথি নেই বাংলাদেশের কোনো দপ্তরে। তাহলে কি এক সময়ের সাবেক প্রধানমন্ত্রী তার অবৈধ ক্ষমতা বলে নির্মাণ করেছিলেন এই কাল্পনিক অরফানেজ? ভিত্তিহীন অরফানেজ হয়তো নেই বা ছিল না কখনো, কিন্তু তার নামে ফান্ড তো ছিল! কেমন ছিল সে অরফানেজ এর নীতিমালা? একটি অরফানেজ ফান্ড এর টাকা কিভাবে এতিমদের মধ্যে ব্যয় করা হবে, তারও একটি নীতিমালা থাকা আবশ্যক এরকম প্রতিষ্ঠান এর জন্য। তথ্যানুসন্ধান বের হয়ে আসে এরকম কোনো কিছু আদৌ ছিল না বা নেই এ ফান্ডের। মূলত এটি ছিল একটি এক মুখি ফান্ড। যেখানে শুধু টাকা আসতো, এতিমদের নামে ব্যয় হতো না। অনেকটা ফ্রি ইনকামিং আর ফ্রি আউট গোয়িং নীতির মত!
তাহলে কোথায় যেতো এ অরফানেজ ট্রাস্ট এর টাকা?
দৃষ্টিপাত করা যাক ২৭ বছরের আগের সময়ের দিকে। প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছেন বেগম খালেদা জিয়া। এসময় এতিমদের সহায়তা গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিল নামে সোনালী ব্যাংক, রমনা শাখায় একটি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। যার হিসাব নং-৫৪১৫। হিসাবের স্বত্বাধিকারী হিসেবে স্বয়ং খালেদা জিয়াই স্বাক্ষর করেন সে হিসাবে। ১৯৯১ সালের জুন মাসে সৌদি কমার্শিয়াল ব্যাংক এর ডিডি মারফত ১২ লাখ ৫৫ হাজার ডলার বা ৪ কোটি ৪৪ লাখ ৮১ হাজার টাকা জমা হয় এ হিসাবে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, টাকা এসেছিল এতিমদের সহায়তার জন্য। অথচ দু’বছর তা অলস পড়ে ছিল ব্যাংক এ! ১৯৯৩ সালে এতিমদের পুঁজি করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ৬/মইনুল রোডের নিজ বাস ভবনে নির্মিত হয়েছিল কথিত সেই এতিমখানা। যদিও বাস ভবনে এতিমখানা নির্মানের কোনো বিধান নেই। একই বছর কুয়েত থেকেও সাহায্য এসেছিল এতিম খানার নামে। কিন্তু এতিমদের মধ্যে বন্টন না করে নিজ পুত্র দুর্নীতির আইকন তারেক ও কোকোসহ আত্নীয় স্বজনদের মধ্যে এফডিআর করে রাখা হয়েছিল এসব টাকা। এ টাকাগুলোও ছিল তার ছেলেসহ স্বজনদের ব্যাংক হিসাবে। হায়রে এতিম প্রীতি!
এতিমদের নামে আসা টাকা ব্যাংক এ সুদে আসলে বেড়ে কয়েক গুন হয়েছে ব্যাংকে এবং তাও তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত হিসাবে। ট্রাস্ট গঠনের পর নয় বছর ক্ষমতায় ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। কিন্তু সে নয় বছর এমন কি বিগত ২৫ বছরেও দৃশ্যমান হয়নি সে এতিমখানা। এতিমখানার অবস্থান নিয়ে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল তার ব্যক্তিগত আইনজীবিদের, তখন তার উত্তর দিতে লজ্জাজনকভাবে ব্যর্থ ছিলেন তারা। তবে থলের বিড়াল বেড়িয়ে আসে ঠিকই এবং ঠিক সময়েই। খালেদার ১৫ জন আইনজীবিদের মধ্যে একজন সেই টাকায় বগুড়ায় জমি কেনার তথ্য জানিয়েছেন। হদিসও মিলেছে সেই জমির। তারেক রহমানের নামে কেনা সেই জমি তারা এতিমখানার জমি দাবি করলেও তাদের নিকট জাতির প্রশ্ন, তাহলে ২৫ বছরে কেন নির্মিত হয়নি জিয়া এতিমখানা?
এই কি ছিল বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতি?
জঙ্গী পৃষ্ঠপোষকতা, যুদ্ধাপরাধী লালন ও তাদের ক্ষমতায়ন, বোমাবাজি, গ্রেনেড হামলা, পেট্রোল বোমা দিয়ে মানুষ পোড়ানো এসবই কি বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতি? কে দেবে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর? কে করবে এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত? ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ করা আছে যেন কেউ এতিমের হক বিনষ্ট না করে। আল্লাহ্’র রাসুল (সঃ) নিজেও এতিম ছিলেন এবং এতিমদের যথার্থ প্রাপ্য তাদের ফিরিয়ে দেবার নির্দেশ ও দিয়েছেন। কিন্তু ধর্মের নামে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে নিয়ে এ কেমন রাজনীতি বেগম খালেদা জিয়ার?
কিসের ধর্ম পালন করে তারা?
আজ সময় এসেছে তাদের এ অধর্মকে রুখে দেবার। আজ সময় এসেছে তাদের পাপের বিচার করবার। ৭১-এর খুনি দালালদের পাপের হিসাব যুদ্ধাপরাধের বিচার দন্ড প্রদানের মাধ্যমে দিতে সক্ষম হয়েছে জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাঙালি জাতি। পাকিস্তানি প্রেতাত্মাদের ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলিয়ে প্রমাণ করেছে পাপ বাপকেও ছাড়ে না। নিস্তার পাওয়া যায় না কোনো অপকর্মেরই। সত্যের জয় হবেই হবে, তা যত পরেই হোক না কেন। আজ আবার সময় এসেছে পাপকে রুখে দেবার। আজ আবার সময় এসেছে বাঙালি জাতির জাগ্রত হবার। আজ আবার সময় এসেছে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার। অসহায় এতিমদের হক বিনষ্টকারীদের ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে রঞ্জিত এ বাংলায় অপরাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই, থাকতে পারে না।
দুর্নীতি দমন কমিশন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করে। দীর্ঘ দশ বছর শুনানির পর রায়ের দিন ঠিক করেছেন বিজ্ঞ আদালত। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী ৩৬০ দিনের মধ্যে এ মামলা শেষ করার নিয়ম। কিন্তু আমরা দেখেছি বেগম খালেদা জিয়া এ মামলায় নানারকম অজুহাতে দিনের পর দিন অনুপস্থিত থেকেছেন। অপ্রাসঙ্গিক বিভিন্ন ইস্যুতে উচ্চ আদালতে গিয়ে সাড়ে চার বছর মামলা স্থগিত করেন। পরে বিজ্ঞ আদালত মামলা চলার নির্দেশ দেন। অপরাধী নিজের মুখে কখনো তার দোষ স্বীকার করে না। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিজ্ঞ আদালত সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে মামলার রায় দেবে। মনে রাখতে হবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নয়, এ রায় একজন অপরাধীর বিরুদ্ধে। আজ বাঙালি জাতি বদ্ধপরিকর সময়ের সাথে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার। আজ বাংলার আকাশ আবারো মুখরিত জয় বাংলা স্লোগানে। আমার সোনার বাংলায় দুর্নীতিবাজদের ঠাঁই নাই। আজ জাগ্রত বাঙালি জাতি সকল অপশক্তিকে বুঝিয়ে দিতে চায়, “পাপ বাপকেও ছাড়ে না ”।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু পরিষদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।