
ড. মইনুল ইসলাম, ২৮ জানুয়ারি, এবিনিউজ : বাংলাদেশ সরকার দাবি করেছে যে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে দশ লাখেরও বেশি অভিবাসী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অভিবাসন গ্রহণ করতে সমর্থ হয়েছেন, যেটা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বছরওয়ারী অভিবাসন প্রবাহ। এটাকে বর্তমান সরকারের একটা প্রশংসনীয় সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। সারা বিশ্বে এখন এক কোটি দশ লাখ থেকে ত্রিশ লাখ বাংলাদেশী অভিবাসী বসবাস করছেন ও কর্মরত রয়েছেন বলে ধারণা করা হয়। তাঁরা প্রতি বছর বাংলাদেশে ১৩–১৫.৩২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন বৈধ চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে। ২০১৪–১৫ অর্থ–বছরে এই বৈধ রেমিট্যান্স প্রবাহ সর্বোচ্চ ১৫.৩২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর পর গত দুই অর্থ–বছরে তা কমে ১৩ বিলিয়ন ডলার ও ১৪ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে উঠানামা করছে। এর মানে বুঝতে হবে যে আসলে বৈধপথে রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার মূল কারণ নানা অবৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে যাওয়া। হুন্ডি প্রক্রিয়া হলো এই অবৈধ চ্যানেলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ধারণা করা হয় যে প্রতি বছর প্রায় ৮–১০ বিলিয়ন ডলার প্রবাসী আয় হুন্ডি চক্রের মাধ্যমে দেশে না এসে তার সমপরিমাণ টাকা প্রবাসীদের পরিবারের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। অতএব, বৈধ–অবৈধ চ্যানেলে দেশের অর্থনীতিতে প্রবেশ করা প্রবাসী আয় ২২–২৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ হবে। এই মোট রেমিট্যান্স প্রবাহ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক অর্থে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের সরাসরি বিকল্প হিসেবে ভূমিকা পালন করছে।
যে সব দেশী–বিদেশী বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জিএনআই প্রবৃদ্ধির হারকে একটা ‘প্যারাডক্স’ হিসেবে অভিহিত করেন তাঁদের এহেন অভিমত আসলে একধরনের ভ্রান্তিপ্রসূত মতামত। বৈধ অর্থনীতির সমান্তরালে বাংলাদেশে যে একটা ক্রমবর্ধমান আয়তনের ‘প্যারালেল ইকনমি’ বিদ্যমান রয়েছে সে ব্যাপারটায় গুরুত্ব না দেয়াতেই তাঁরা এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে চলেছেন। বৈধপথে আসুক কিংবা ইনফরমাল চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে আসুক এই বিশাল রেমিট্যান্স প্রবাহ তৃণমূল পর্যায়ের অর্থনীতিতে দৃশ্যমান বিনিয়োগের জোয়ার সৃষ্টি করছে। অতএব, ২০১৬–১৭ অর্থ–বছরে বাংলাদেশের জিএনআই প্রবৃদ্ধির হার ৭.২৮ হয়েছে বলে সরকার যে দাবি করছে তাকে বিনিয়োগ–জিডিপি’র হার সমর্থন করে না বলে যাঁরা শোরগোল তুলেছেন তাদেরকে অনুরোধ করবো, এই ইনফরমাল রেমিট্যান্স প্রবাহের অবদানকে বিবেচনায় নিলে ঐ প্রবৃদ্ধির হারকে তেমন অবিশ্বাস্য মনে হবে না। (সরকার তো রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার জন্যে প্রবৃদ্ধির হারকে কিছুটা বাড়িয়ে দেখাবেই, এতে অবাক হওয়ার তেমন কিছু নেই!) আমার দৃঢ় অবস্থান হলো, গতানুগতিক প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রবাহের চাইতে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্যে এই রেমিট্যান্স প্রবাহ (২২–২৫ বিলিয়ন ডলার) অনেক বেশি ইতিবাচক। গ্রামে কিংবা শহরে দেশের সব জায়গায় কমবেশি যে পাকা বাড়িঘর–দোকানপাট–বাজার উন্নয়নের মত অবকাঠামো উন্নয়ন, যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, কৃষিখাতের আধুনিকায়ন, সেনিটারী ব্যবস্থার উন্নয়ন, পানি সরবরাহের সুব্যবস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ ও শিক্ষাগ্রহণের অগ্রগতি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিকাশ ও আধুনিক চিকিৎসা গ্রহণের অগ্রগতি এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের আরো অনেক ডাইমেনশানে বাংলাদেশে চমকপ্রদ গতিশীলতা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে সেগুলোকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করলে দেখা যাবে যে রেমিট্যান্স প্রবাহ হয়তো গতানুগতিক বহুজাতিক করপোরেশনের বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রকল্পের চাইতে অনেক বেশি জন–বান্ধব বিকল্প। বাংলাদেশ এই বৈধ–অবৈধ রেমিট্যান্স প্রবাহের সুফল পাচ্ছে বলেই অর্থনীতির এই ক্রমবর্ধমান গতিশীলতায় কোন ‘প্যারাডক্স’ নেই। তবে, বিবিধ অবৈধ চ্যানেলের রেমিট্যান্স প্রক্রিয়া বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্যে যে কিছু চরম ক্ষতিকর অভিঘাতও সৃষ্টি করে চলেছে সেগুলোর দিকেও আমি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই আজকের কলামে।
পাঠকদের জ্ঞাতার্থে বলছি, প্রতি বছর বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রায় সতর/আঠারো লাখ কর্ম–প্রত্যাশী মানুষ প্রবেশ করলেও দেশের অর্থনীতি সাত/আট লাখের বেশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে আজো অপারগ রয়ে গেছে। প্রতি বছর বৈধ–অবৈধ পথে ছয়/সাত লাখ মানুষ বিদেশে চলে যাওয়ার সুযোগ না পেলে বাংলাদেশের সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে প্রচন্ড বিপর্যয়কর অবস্থার সৃষ্টি হতে বাধ্য। তাই, আন্তর্জাতিক অভিবাসনকে তাত্ত্বিকভাবে ‘মেধা পাচার’ হিসেবে দেখার যুক্তি থাকলেও বেকারত্ব ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির চ্যালেঞ্জের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের মত জনাকীর্ণ দেশের জন্যে এটাকে ‘সেফটি ভাল্ব’ হিসেবে দেখাই যৌক্তিক। জীবন ও জীবিকার তাগিদে বাধ্য হয়ে এই অভিবাসীরা বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়লেও তাঁদের অভিবাসন প্রক্রিয়ায় সরকারের কৃতিত্ব নেয়ার তেমন অবকাশ নেই। বরং আমার গবেষণাগুলোতে বারবার ফুটে উঠেছে, পুরো অভিবাসন প্রক্রিয়াকে ঘিরে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লোভাতুর ‘আদম ব্যাপারী চক্রের’ দোর্দন্ড প্রতাপ অভিবাসন–প্রত্যাশীদেরকে শোষণ, প্রতারণা ও লুণ্ঠনের অসহায় শিকারে পরিণত করে চলেছে। বিশ্বের যে কোন দেশের অভিবাসীদের তুলনায় বাংলাদেশী অভিবাসীদের সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ করে বিদেশে পাড়ি জমাতে হয়। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, ভিয়েতনাম এবং মেক্সিকোর অভিবাসীদেরকে বাংলাদেশীদের তুলনায় এক–তৃতীয়াংশও খরচ করতে হয়না। পুরো অভিবাসন প্রক্রিয়ায় গেড়ে বসে থাকা ‘আদম বেপারীরা’ যেভাবে অভিবাসীদের রক্তচোষার ভূমিকা পালন করে চলেছে তার কোন প্রতিকার বাংলাদেশের কোন সরকারের পক্ষ থেকেই আজো পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে বরাবরই ব্যর্থতার নজির হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এ দেশকে তথাকথিত ‘সস্তাশ্রমের’ বিশাল যোগানের ক্ষেত্র বলে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী প্রচার–প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের হিসাব–নিকাশে বাংলাদেশ এখনো মোটেও আকর্ষণীয় বিবেচিত হয় না। একটি দেশে প্রচুর জনসংখ্যা থাকলেই সে দেশকে শ্রমশক্তিতে সমৃদ্ধ বলা যায় না। ঐ শ্রমশক্তি শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিজ্ঞান, দক্ষতা ও কর্মনিষ্ঠার দিক থেকে যথেষ্ট আকর্ষণীয় না হলে সে দেশকে বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্যে আকর্ষণীয় করে তোলা যাবে না। কারণ, কোন দেশে অদক্ষ বা কম দক্ষ শ্রমিক প্রচুর সংখ্যায় থাকতে পারে। কিন্তু, আজকের দিনের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দানকারী বিশ্বের বহুজাতিক করপোরেশনগুলো যে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকে ঐ প্রযুক্তি ব্যবহারের যোগ্যতা ওসব শ্রমিকের আছে কিনা সেটাই মূল বিবেচ্য। মনে রাখতে হবে, ‘সস্তা শ্রমশক্তি’ বলতে বোঝায় যে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা অন্যান্য দেশের সাথে তুলনীয় হওয়া সত্ত্বেও যার মজুরী কম সে শ্রমিককেই সস্তা বলা যাবে। যে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা কম হওয়ার কারণে মজুরী কম সে শ্রমিক প্রকৃত প্রস্তাবে সস্তা নয়। আর, শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা শুধু ব্যক্তি–শ্রমিকের ব্যক্তিগত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিজ্ঞানের ওপর নির্ভর করে না। কী প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে সেটাই শ্রমিকের উৎপাদনশীলতার প্রধান নিয়ামক। এর পাশাপাশি ঐ দেশের বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ, গ্যাস সরবরাহ, টেলিযোগাযোগ, তথ্য প্রযুক্তি নেটওয়ার্ক, সড়ক ও জনপথ পরিবহন, রেলপথ, বন্দর ও বিমান বন্দর সুবিধার মত ভৌত অবকাঠামোর পর্যাপ্ততা ও দক্ষতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির সহনীয় অবস্থা, কর্ম পরিবেশ, কর্মনিষ্ঠা ও শৃঙ্খলা, আইনের শাসন, অভ্যন্তরীণ বাজারের আয়তন ইত্যাদিও শ্রমের উৎপাদনশীলতা ও বৈদেশিক বিনিয়োগের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পুঁজি সারা বিশ্বে ছুটে বেড়াচ্ছে মুনাফা–সর্বোচ্চকরণের উদ্দেশ্যে। যেখানে হিসেব–নিকেশ থেকে দেখা যাবে এই উদ্দেশ্য পূরণের সর্বোচ্চ সম্ভাবনা কোন একটি দেশের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সে দেশে পুঁজি বিনিয়োগের প্রবাহ ক্রমেই শক্তিশালী হতে থাকবে। গত চার দশক ধরে গণচীন উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলোর বিবেচনায় বিশ্বের বহুজাতিক করপোরেশনগুলোর কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় গন্তব্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। অথচ, গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এখনো নিজেকে একটি ‘সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি’ বলে দাবি করছে। চীনের একদলীয় শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে প্রতীচ্যের কথিত গণতান্ত্রিক দেশগুলো বরাবরই সমালোচনায় মুখর হওয়া সত্ত্বেও ওসব দেশের পুঁজিপ্রবাহ চীনের শিল্পায়নে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছে। পার্শ্ববর্তী ভিয়েতনামের ক্ষেত্রেও গত দু’দশক ধরে বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রবাহের এহেন মহা–উল্লম্ফন লক্ষ্য করা যাচ্ছে একই ধরনের বিষয়গুলোর বিবেচনায়। অথচ, ভিয়েতনামও নিজেকে এখনো সমাজতান্ত্রিক দেশ দাবি করে থাকে। অন্যদিকে দেখুন, ভারত বিশাল জনসংখ্যা অধ্যুষিত একটি গণতান্ত্রিক দেশ হওয়া সত্ত্বেও অতীতে খুব বেশি বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারেনি। কিন্তু, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যখন ভারতের জিএনআই প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে ৭–৮ শতাংশে পৌঁছে গেছে তখন তাদের বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রবাহেও জোয়ারের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে এহেন জোয়ার আনতে হলে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতেই হবে।
দুঃখজনক হলো, বাংলাদেশী অভিবাসীদের ৯৫ শতাংশই শিক্ষা এবং দক্ষতার দিক থেকে বিশ্বের অন্য দেশের অভিবাসীদের চাইতে পেছনে অবস্থান করছেন। তাই, সবচেয়ে কম মজুরীর ‘থ্রি ডি জব’ গুলোই (ডার্টি, ড্যানজেরাস এন্ড ডিমান্ডিং জবস) তাঁদের ভাগে জুটছে। কিন্তু, পরিবারের মা–বাবা, স্ত্রী–পুত্র–কন্যা, ভাই–বোনদের ভরণ–পোষণের দায়িত্ব পালনের জন্যে বাংলাদেশের অভিবাসীরা তাঁদের এই নিম্ন আয়ের ৫০–৭৫ শতাংশই নিয়মিতভাবে রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে প্রেরণ করেন। বিশ্বের রেমিট্যান্সের–গন্তব্য দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন ষষ্ঠ — ভারত, মেক্সিকো, ফিলিপাইন, তুরস্ক এবং ইন্দোনেশিয়া বাংলাদেশের চাইতে এগিয়ে রয়েছে এ ব্যাপারে। আমার গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশী অভিবাসীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ‘হুন্ডি’ পদ্ধতিতেই দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে চলেছেন। হুন্ডি চক্রগুলোর হাতে অভিবাসীদের সঞ্চয়ের বিপুল একটা অংশ পাচার হয়ে যাচ্ছে। এই হুন্ডি ডলার বাজারদেশের অর্থনীতির জন্যে মারাত্মক তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে পুঁজি পাচার ও মানি লন্ডারিংকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে। (মানি লন্ডারিং বা কালো টাকা ধৌতকরণ (বা সাদা করা) হচ্ছে দুর্নীতিকে হালাল করা, জায়েজ করা বা লুকিয়ে ফেলার তাবৎ ধুরন্ধর প্রক্রিয়া।) সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হুন্ডি ডলার বাজারে পাচার হওয়া বাংলাদেশী অভিবাসীদের সঞ্চয়ের এই বিশাল প্রবাহটার প্রধান ফায়দাভোগীতে পরিণত হয়েছে চোরাচালানী ও মানিলন্ডারাররা এবং দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচারকারী ব্যবসায়ী, গার্মেন্টস মালিক–শিল্পপতি, দুর্নীতিবাজ আমলা ও পুঁজি–লুটেরা রাজনীতিবিদরা। যতই দেশপ্রেমের ধুয়া তোলা হোক্ না কেন, বাংলাদেশী অভিবাসীদের বৃহদাংশের হুন্ডি পদ্ধতি ব্যবহারকে সহজে নিরুৎসাহিত করা যাবে না। কারণ, হুন্ডি পদ্ধতির কতগুলো সুবিধা প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয় মনে হওয়াই স্বাভাবিক। যেমন, ডলারে এক/দেড় টাকা বেশি বিনিময় হার পাওয়ার পাশাপাশি অতি দ্রুত রেমিট্যান্সের টাকা প্রাপকের কাছে গোপনীয়তার সাথে পৌঁছে দেওয়া হয়। পাঠানোর কোন খরচও বহন করতে হয় না প্রেরককে। প্রতিবেশীরা বা আত্মীয়–স্বজনরা জানতেও পারে না কখন কত পরিমাণ টাকা রেমিট্যান্স পাওয়া গেছে। ফলে, চোর–ডাকাত–প্রতারকরা টের পাওয়ার আগেই টাকাটা ব্যাংকে জমা করে দেওয়া যায়। এখন মোবাইল টেলিফোনে টাকা পাঠানোর খবরটা প্রাপককে জানানো যায়, তেমন কোন খরচ পড়ে না। আর, যেহেতু বিশ্বস্ততাই এই ব্যবসার আসল চাবিকাঠি, তাই টাকা মেরে দেওয়ার তেমন ঝুঁকি থাকে না। আমার গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে, হুন্ডি ডলারের রমরমা ব্যবসা সহজে বন্ধ হবে না। গ্লোবাল ফাইনেন্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি কর্তৃক প্রদত্ত তথ্যে বাংলাদেশ থেকে বছরে ৯ বিলিয়ন ডলার পুঁজি পাচারের কথা বলা হচ্ছে।
আমদানি ওভারইনভয়েসিং দেশ থেকে ব্যাংক–পুঁজি পাচারের সবচেয়ে বহুল–ব্যবহৃত পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত হলেও এর পাশাপাশি বাংলাদেশের ব্যাংক–ঋণের একটা বিপুল অংশ যে হুন্ডি পদ্ধতিতে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে সেটা না বোঝার কোন কারণ নেই। ব্যাংক–ঋণ খেলাপীদের ওপর ২০১০ সালে প্রকাশিত আমার ও মহিউদ্দিন সিদ্দিকীর গবেষণা গ্রন্থ ই রেমতধফণ মত ঈটভপ ীমটভ ঊণতটলর্ফ ধভর্ দণ রেধশর্টণ ওণর্ডমর ধভ ঈটভথফটঢণ্রদ এ উপস্থাপিত বাংলাদেশের ১২৫ টি ঋণখেলাপী প্রতিষ্ঠানের ওপর পরিচালিত জরিপের সংগৃহীত তথ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে ঐসব প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মালিকরা তাঁদের ব্যাংক–ঋণের একটা বড়সড় অংশ বিদেশে পাচার করে দিয়েছেন। বিশেষত, ঐ বইয়ে প্রকাশিত ৩১জন ‘স্টার ঋণ খেলাপীর’ কেস স্টাডিতে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে যে তাঁদের বেশিরভাগই ১৯৭২–২০০৭ পর্যায়ে ব্যাংক ঋণ বাগিয়েছেন তাঁদের রাজনৈতিক ও আমলাতাত্রিক কানেকশান কিংবা দুর্নীতির বখরা ভাগাভাগির ‘সিস্টেমের’ ফায়দাভোগী হয়ে। এ প্রবণতা গত ১১ বছরে আরো মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এখন বাংলাদেশের ধনাঢ্য–উচ্চবিত্ত–উচ্চ মধ্যবিত্ত এমনকি মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সামরিক–বেসামরিক আমলা ও পেশাজীবীদের ধ্যান–জ্ঞান হয়ে গেছে যে তাঁদের পরিবার–পরিজন–সন্তানদের জন্যে বাংলাদেশ আর বাসযোগ্য জায়গা বিবেচিত হওয়ার যোগ্য নয়, এবং তাঁদেরকে যথাসম্ভব শীঘ্রই বিদেশে পাড়ি জমাতেই হবে। বলা বাহুল্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই তাঁদের বিবেচনায় স্বপ্নের স্বর্গরাজ্য। কিন্তু ঐদেশে অভিবাসী হওয়া খুবই দুরূহ। তাই কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, ইতালি এবং সম্ভব হলে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে পাড়ি জমানোর প্রাণপণ প্রয়াস এখনকার সচ্ছল পরিবারগুলোর অহর্নিশ সাধনায় পরিণত হয়েছে। এটাই এখনকার বাংলাদেশী উচ্চবিত্ত–মধ্যবিত্তের জীবনে প্রধান মিশনে রূপান্তরিত হয়েছে বলা চলে। অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমার কাছে বিষয়টার আপত্তিজনক দিক হলো, দেশের ব্যবসায়ী–শিল্পপতিদের বৃহদংশই ব্যাংক–ঋণ পাচারকেই তাঁদের এই মিশনের মূল ‘মিকানিজম’ হিসেবে ব্যবহার করছেন, যার ফলে দেশের মহামূল্যবান বিনিয়োগযোগ্য পুঁজি থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি বঞ্চিত হয়ে চলেছে। প্রকল্প ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংকারদের সহযোগিতায় ‘ইনফ্ল্যাটেড প্রজেক্ট কস্ট’ এবং ‘ওভার ইনভয়েসিং’ পদ্ধতিতে কোটি কোটি ডলার যে ব্যবসায়ী–শিল্পপতিদের বিদেশের ব্যাংক একাউন্টে পাচার হয়ে থাকে এটা পুরানো খবর। কিন্তু, বিপুল পরিসরের ‘হুন্ডি ডলারের বাজার’ এখন এহেন পুঁজি পাচারকে একেবারেই সহজ করে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, রাজনীতিবিদ এবং আমলাদের ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি ও পুঁজি–লুণ্ঠনের তান্ডব থেকে উদ্ভূত অনর্জিত কালো টাকাকে বিদেশে পুঁজি পাচারের (ডটযর্ধটফ তফধথর্দ) মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি থেকে চিরতরে পলায়নের ব্যবস্থাকে মারাত্মক বেগবান করে চলেছে এই হুন্ডি পদ্ধতি। আরেকটি গুরুতর খবর হয়তো অনেকেরই জানা নেই যে বাংলাদেশের অভিবাসীদের এই হুন্ডি প্রক্রিয়া মানি লন্ডারিংকে একেবারেই সহজ করে দিয়েছে। বিদেশে অবস্থানকারী একজন বাংলাদেশী তাঁর প্রবাসের আবাসস্থলে বা কর্মস্থলে কী কাজ করছেন বা আদৌ উপার্জনশীল কিছু করছেন কিনা তা জানার কোন আইনি ব্যবস্থা এদেশের সরকারগুলো গড়ে তোলার কথা চিন্তাই করতে পারবেনা। কারণ, এধরনের তথ্য সংগ্রহের ব্যাপারটা যেমনি স্পর্শকাতর, তেমনি এহেন তথ্যের সত্য–মিথ্যা যাচাই করা দুরূহ। আর, দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স যেহেতু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে তাই এধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করাটাই হয়রানি বিবেচিত হবে। কিন্তু, প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক প্রবাসীর যেহেতু ফরেন এক্সচেঞ্জ একাউন্ট খোলার সুযোগ রয়েছে, তাই ঐ একাউন্টের মাধ্যমে যত অর্থই দেশে প্রেরিত হোক সেগুলো বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করতেই হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে।হুন্ডি ডলারের একটা বড়সড় অংশ মানি লন্ডারিং করে দেশের দুর্নীতিবাজরা তাদের কালো টাকাকে বৈধ করার জন্য ব্যবহার করে যাচ্ছে। অনেকেই হয়তো বিশ্বাসই করতে চাইবেন না, যে ১৩–১৫ বিলিয়ন ডলার বৈধ রেমিট্যান্স আসছে বলে দাবি করা হচ্ছে তার একটা অংশ আসলে দেশের অভ্যন্তরে সৃষ্টি হওয়া দুর্নীতিজাত কালো টাকা, যা প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের সহায়তায় পরিচালিত হুন্ডি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রং বদলে ফেলতে সক্ষম হচ্ছে। মানে, দেশের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতিজাত কালো টাকা ধোলাইয়েও হুন্ডি প্রক্রিয়া দেদারসে অপব্যবহৃত হচ্ছে। পুঁজি পাচার ও মানি লন্ডারিংকে আমি জাতিদ্রোহিতা বলতে চাই।
লেখক : অর্থনীতিবিদ; ইউজিসি প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
(সংগৃহীত)