বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

ভাষাদূষণের সমাজে অসহায় মাতৃভাষা

ভাষাদূষণের সমাজে অসহায় মাতৃভাষা

অজয় দাশগুপ্ত, ০৯ ফেব্রুয়ারি, এবিনিউজ : বাংলা ভাষার বারোটা বাজতে আর কতদেরী? এই প্রশ্ন করাটা কি অন্যায়? কিছুদিন আগে দেশে গিয়েছিলাম। সাকুল্যে হপ্তা খানেকের ভ্রমণ । তারপরও আমি যা দেখেছি তাতে একথা বলতে পারি আ মরি বাংলাভাষা কথাটা এখন সত্যিকার অর্থে ফলবতী হতে চলেছে। আ মরি শব্দ বা কথাটা যে কারণেই বলা হোক এখন আমরা মরি আর অন্য ভাষারা বাঁচে বাংলাদেশে। তারুণ্যের সাথে কথা বলা যায়না। তাদের কথ্যভাষার সাথে প্রমিত বাংলার কোন মিল নাই। সর্বনাশ করে ছেড়েছে নাটক। তাদের ধারণা বাংলাদেশের ভাষা আলাদা হতে হবে। এই আলাদা করণের পেছনে যে খোঁড়া যুক্তি আর ভাষা সাম্প্রদায়িকতা সেটা আমরা সবাই বুঝি। কিন্তু বলা বারণ। সবদেশের সবজাতির একটা ভাষা ভিত্তিক ঐতিহ্য আছে। এমনকি সে অন্যভাষার অধীনে থাকলেও তার সুষমা বা মর্যাদা রাখার কাজ হয় সেসব দেশে। আমাদের সবকিছু উল্টো। যখন আমরা জেগে উঠেছিলাম তখন এমন ই যে আমাদের অগ্রজেরা প্রাণ দিতেও কুণ্ঠিত হয়নি। আর আজ যখন আমরা ভাষাভিত্তিক স্বাধীন দেশের মানুষ তখন সেই ভাষাকেই করা হচ্ছে বলৎকার।

বলে রাখি ভাষার সংগ্রাম বা ইতিহাসে আমরা একক জাতি না। অনেকে জানেন সাউথ ইন্ডিয়ানরাও ভাষার ব্যাপারে আবেগী। আমাদের আগে তাদের দেশে মানুষ ভাষার জন্য আত্মত্যাগ করেছিল। পার্থক্য এই তাদের কেউ গুলি করেনি তারা করেছিল আত্মহত্যা। সে অবদান ও ঐতিহাসিক। কিন্তু আজো তারা ভাষার ব্যাপারে সংবেদনশীল। সেখানে কালো কালো তামিল বা কেরালিয়ান বা অধিবাসীরা হিন্দী বলেনা। রাষ্ট্রভাষা হবার পর ও সেখানকার সরকার স্কুলে হিন্দী শেখানো নিষেধ করে রেখেছে। এমন বহু মানুষ আছেন যারা ভারতীয় হবার পর ও সেদেশের বলিউড সিনেমা বোঝেননা। তাদের এই স্বাজাত্যবোধ এবং স্বাধীনতা ভাষাকে রেখেছে নিরাপদ। আমরা বুঝে নাবুঝে এক হুজুগে জাতি। উর্দুর বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রামকে আমরা ভাষার সংগ্রাম বললেও হিন্দী গিলে খেয়েছে সমাজ।আর সে বিষয়কে এখন আমরা মনে করি আভিজাত্য কিংবা জাতে ওঠা।

আপনি অনেক ভাষা জানেন বা বোঝেন বা বলতে লিখতে পারেন সেটা আপনার গুণ। এবং তার কদর আমরা করি। কিন্তু আপনিতো এগুলো জানেননা। সিনেমা দেখে টিভি দেখে বলতে শিখেছেন। এর কোন অর্থ হয়? দেশের ছেলেমেয়েরা দেখলাম একজন আরেকজনকে বলে , আমি বিন্দাস আছি। তুই কেমন? এই বিন্দাস শব্দের উৎপত্তি বা এর ব্যবহার কি তা তারা জানেনা। শুধু হিন্দী কেন বিকৃত বাংলার দৌড়ে জীবন অতিষ্ঠ। টিভির অতিথি বলেন, দৌড়ের ওপর আছি। খাইতেসি যাইতেসি এগুলো আঞ্চলিক ভাবে ব্যবহার হতেই পারে। কিন্তু আমরা যদি সে ধরনের কোন চরিত্রে অভিনয় না করি তো আমাদের মুখের ভাষা ও লেখা কি প্রমিত হ ওয়া উচিৎ না? সে নিয়ম কেউ মানছেনা। এজন্যে দায়ি আমাদের স্বার্থপর ব্যবসায়ী কর্পোরেট জগত আর কিছু সুশিলেরা। নামধরেই বলি। আমাদের দেশে সর্বাধিক জনপ্রিয় নামে পরিচিত দৈনিকের সাংবাদিক ম্যাক্সিম গোর্কির পর নিজেকে আরেক মা গ্রন্থের জনক ভাবা আনিসুল হক এসেছিলেন সিডনিতে। তাঁর জনপ্রিয়তা নিঃসন্দেহে ব্যাপক। তো আবেগের ঠেলায় ভাষণ দিতে গিয়ে বললেন, তিনি নাকি স্বপ্ন দেখেন একদিন খবরের কাগজের শিরোনাম হবে, চীনের নেতা আইছিলো। তাঁরে গণভবনে ল ইয়া গিয়া ব্যাপক সংবর্ধনা দেয়া হ ইছিল। হে বড় খুশি। কি সর্বনাশ। আমার পালা এলে আমি তাঁর কাছে বিনয়ের সাথে জানতে চেয়েছিলাম , এ ধারণা বা এইভাবনায় যদি তিনি সত্যি বিশ্বাস করেন তো তাঁর একটি বইতেও এমন ভাষার ব্যবহার নাই কেন? কেন তিনি এই ভাষায় বই লেখেননি? বলাবাহুল্য সেই মতিময় হাসিতে তিনি তা এড়িয়ে গেলেন। এই হচ্ছে বিপদ। নিজের বেলায় প্রমিত আর অন্যের বেলায় ভাষা দূষণ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বশর্ত আর পথ করে দিয়েছিল ভাষা আন্দোলন। বাংলা ভাষা প্রাণ পেয়েছিল পদ্মাপাড়ে। সেই অমিত সম্ভাবনার জায়গাটি নষ্ট করার অধিকার নাই কারো। আমি কোন আঞ্চলিক ভাষার বিরুদ্ধে না। কিন্তু বহুকষ্ট আর পরিশ্রমে আমাদের মেধাবী অগ্রজেরা বাংলা ভাষার যে লেখ্য ও কথ্যরূপ তৈরি করেছেন তাকে নষ্ট করার চক্রান্ত চলছে। আজ এমন হাল দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠী মূলত শুদ্ধ বাংলায় বলতে বা লিখতেই জানে না। এর জন্য প্রতিবেশী বাংলার গুণীরাও দায়ী। তাঁরা নিজেরা নিজেদের বেলায় ঠিক কাজ করলেও কথা আর কাজে হিন্দী আশ্রয়ী। সাউথের সাথে তাদের তফাৎ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির জীবন আজ হিন্দীময়। ভাষার এমন অব্যবহার আর কথায় কথায় এত হিন্দী উত্তর ভারতেও দেখা যায়না। আমি গিয়েছিলাম জোড়াসাঁকো দর্শনে। ঠাকুরবাড়ির চারপাশ ঘিরে এখন মাড়োয়ারীদের রাজত্ব। আপনি বাংলায় রবীন্দ্রনাথ বললে অনেকে এমনভাবে তাকায় যেন আপনি হিব্রু ভাষায় কথা বলছেন।

সেটা তাদের সমস্যা। আমাদের দেশে ইতোমধ্যে এক বিশাল সাহিত্য শিল্পের জগত গড়ে উঠেছে। আমাদের ভাষা আমাদের অহংকার। আর কোন জাতি এভাবে জান দিয়া ভাষার মর্যাদা বাঁচায়নি। সে ইতিহাস ও অধিকার পড়েছে তোপের মুখে। ভাষা মুখে বা লেখায় আসতে সময় নিয়েছিল । ইতিহাস বলে অনেক পথ পেরিয়ে আমরা এই ভাষার সৌকর্য আর শিল্পরুপ পেয়েছি। রবীন্দ্রনাথ নজরুল থেকে আজকের লেখকেরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছেন সেখান থেকে পিছু হটাতে চাইছে তিনটে বিষয়। প্রথমত সাম্প্রদায়িকতা বা ভাষা বিদ্বেষ। তারপর একধরনের উগ্রতা আর সবশেষে খামখেয়ালিপনা। সাম্প্রদায়িকতা বলতে আমি বোঝাচ্ছি ভাষাসাম্প্রদায়িকতা। রাজনৈতিক বৈরীতা বা নানা ইস্যুতে বৈরীতা থাকায় ওপার বাংলার ভাষার প্রতিও একধরণের আক্রোশ আছে। এই আক্রোশ যেখানে থাকলে বা যেখানে বিরোধিতা করলে আমরা কিছু পেতাম বা জয়ী হতাম সেখানে নাই। আছে কথা ও লেখায়। মনে রাখতে হবে জার্মানীর ইহুদী আর আদি ইহুদী একভাষায় কথা বলে। এ নিয়ে তাদের বিরোধ নাই। যেমন নাই আরবিভাষী মানুষের। তারা মধ্যপ্রাচ্য আফ্রিকা বা দুনিয়ার যেদেশে বসবাস করুকনা কেন ভাষা ভিত্তিক সাহিত্য আর শিল্পে এক সুতোয় বাঁধা। আমাদের তাই দুধ ও পানির তফাৎ বুঝতে হবে। ধর্মের নামে ভাষা চললে আমরা বাংলা ভাষায় ধর্মগ্রন্থ পড়তাম না। আমাদের ঈশ্বরকে আরাধনা করার জন্য আমরা যে ভাষায় দোয়া বা মন্ত্র পাঠ করিনা কেন পরে ঠিক ই নিজের ভাষায় মন খুলে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করে বলি, আমায় করুণা করো। বা এটা দাও ওটা দূর করো। এই যে শেষ অবধি নিজের ভাষার কাছে ফিরে যাওয়া এর নাম আত্মসমর্পণ। এ জন্যেই ভাষা আমাদের মা।

জাতিগতভাবে আমাদের অর্জন যেমন অনেক তেমনি ধরে রাখার ব্যাপারেও আমরা উদাসীন। এতটা ই যে একেক সময় মনে হয় আমরা আমাদের সেই মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত দেশে আছি না থাকি? সমাজে বাংলা নামের ব্যবহার কমে আসছে। সম্ভাষণে আগমনে বিদায়ে বাংলার ব্যবহার প্রায় নাই। একদা একটি বাংলা শব্দ একজন বাঙালির প্রাণ এই কথা বিশ্বাস করা বাংলাদেশীদের জীবনে বাংলা শুধুমাত্র তার আপন শক্তি আর মানুষ নিরুপায় বলে টিকে আছে। এ কারণে আমাদের দেশের ভাষার এখন মূল দুশমন একাধিক। প্রতিবেশীদেশের হিন্দী মাসী মরুর দেশের খালা আর ইংরেজি আন্টি আমার জননীকে চেপে ধরেছে। বাচ্চারা এখন আংকেল আন্টি ছাড়া কাউকে চেনেনা। হামদর্দি হবার বাইরে সমব্যথী হয়না। বাইরের দুনিয়া খুলছে খুলুক। কিন্তু আপনার নিজের দরজা জানালা যদি খোলা রেখে ডাকাত ঢুকতে দেনতো ঘরের বদনাটাও একদিন আর পাবেন না।

শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে একারণে মাথা উঁচু মানুষের সংখ্যাও কমছে। জন্মসূত্রে প্রাপ্ত বিষয়গুলোকে আদর করতে হয়। মানতে হয়। যারা এদেশের নেতা নেত্রী তারা কেউ পাঁচ মিনিটের বেশী শুদ্ধ বাংলা লিখতে বা বলতে পারেননা। যারা অভিনেতা তারাও পারেননা। বিচারকের বানানে হাজার ভুল হলে আসামীতো ভুল লিখবেই। এভাবে ধীরে ধীরে এক গভীর খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাভাষা। এর উত্তরণ বা সমাধান মানুষের কাছে। তবে প্রক্রিয়া তাদের জানা নাই। যাদের জানা আছে তারা এখন মোসাহেবী স্তাবকতা কিংবা বিরোধিতায় নিমজ্জিত। টিভি রেডিও খবরের কাগজ বা মিডিয়া কাঁপাতে গিয়ে আমরা কখন যে আমাদের শান্ত স্নিগ্ধ বাংলা ভাষাকে শত্রুর হাতে ছেড়ে দিয়েছি নিজেরাই জানিনা।

তারপরও এদেশে আসেনা ফাগুণ আসে একুশে ফেব্রুয়ারি। যে মাস ভাষার জন্য আত্মদান আর রক্তের গৌরবে জাগ্রত এক কৃষ্ণচূড়া পলাশের মাস। আশা বড় জটিল বিষয়। সে কিছুতেই পথ ছাড়েনা। শুধু আরো আরো বরকত জব্বার সালাম নয় সে পথ চেয়ে থাকে বিজ্ঞানী সাহিত্যিক নাট্যকার শিল্পীসহ সেইসব নিরীহ শিক্ষকদের যারা সাধারণ পোশাক ও জীবনের অসাধারণ মহীরুহ তারা ছাড়া বাংলাভাষার এই দুর্দশা ঘুচবে না। আমরা কি ভাষা বাঁচাতে আদৌ সচেতন হবো?

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামলেখক

(সংগৃহীত)

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত